ক.
‘নারী সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত প্রাণী’ (ভার্জিনিয়া উলফ)। ভোল্গা থেকে গঙ্গা বই থেকে জানা যায়-সভ্যতম সভ্যতার সৃষ্টি হয়েছে নারীর দাসত্বের মধ্য দিয়ে। রাশিয়ার ভলগা নদীর তীরে যে সভ্যতার সূচনা ঘটেছিল তখন পর্যন্ত মানব সভ্যতা ছিল নারী কেন্দ্রিক;- প্রতিটি গোত্র এক একজন গোত্রপ্রধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত এবং এই গোত্র প্রধান হতেন নারী। নারীরা শিকারসহ যাবতীয় সাংসারিক কাজে নেতৃত্ব দিত। তখন পর্যন্ত কোন ধর্ম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেনি। করলে, বলাই বাহুল্য, পৃথিবীর অনেক ধর্মের ইতিহাস বদলে যেত। সৃষ্টিকর্তার প্রেরিত শ্রেষ্ট মহামানবের কাতারে উচ্চারিত হত অনেক মহামানবীর নাম। তবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ না করলেও সেই সময়কার মানুষদের ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি ছিল নারী। ভাস্কর শিল্পী মারলিন স্টোন তার বই When God was a Woman বইতে বলেছেন, খ্রীষ্টপূর্ব ২৫ হাজার বছর আগের নারী মূর্তিগুলো তারই নিদর্শন। এছাড়াও, ঐ বই থেকে যানা যায়, প্রথম পিতৃতান্ত্রিক নবী ইব্রাহিমের জন্মের বহু হাজার বছর আগে নারী ঈশ্বরের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ফলত, স্পষ্টত প্রতিয়মান হয়, ঈশ্বরের লিঙ্গ পরিবর্তন হয়েছে ক্ষমতা পরিবর্তনের সাথে সাথে। এবং এই ক্ষমতা পরিবর্তনের সাথে সাথে উদ্ভব হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের, বৃহর্দাথে নতুন একটি সভ্যতার। পুরুষ কেন্দ্রিক এই সভ্যতা অনেকাংশে হয়ে উঠল যুদ্ধ ও ধর্ম কেন্দ্রিক সভ্যতা। ভোগের সভ্যতা বললেও ভুল হবে না। নারী উঠে গেল ভোগ্য পণ্যের তালিকার শীর্সস্থানে। সভ্যতার যাতে আর পালাবদল না ঘটে সে ব্যবস্থা নিশ্চিৎ করতে তৎপর হয়ে উঠল পুরুষশাসিত সমাজ। এক্ষেত্রে ধর্ম বিশ্বাসটাকে আগে নিজেদের মধ্যে ভালো করে রপ্ত করে তারপর ঘুমের ঔষধের মত করে নারীদের খাইয়ে দেয়া হল। বিষয়টিকে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন শরৎচন্দ্র- ‘পুরুষেরা যাহা ইচ্ছা করে, যাহা ধর্ম বলিয়া প্রচার করে, নারী তাহাই বিশ্বাস করে এবং পুরুষের ইচ্ছাকে নিজেদের ইচ্ছা বলিয়া ভুল করে এবং ভুল করিয়া সুখী হয়।’ একে একে পৃথিবীতে মহামানব, দার্শনিক ও যুদ্ধবাজদের আগমনের ফলে সভ্যতা (পুরুষরা) এগিয়ে চলল তর তর করে। নারী পুরুষের ব্যবধান বেড়ে যেতে থাকলো ক্রমান্নয়ে। নারীরা পড়ে রইল (ফেলে রাখা হল কৌশলে) সেই আদিম জায়গায়। সক্রেটিস জ্ঞান বিস্তাতের জন্য শুধুমাত্র তরুণ যুবকদের বেছে নিয়েছিলেন। প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্টব্যবস্থায় নারীদের শুধুমাত্র সন্তান পালনের জন্য রেখে দিয়েছেন। আমি হলপ করে বলতে পারি, পুরুষের ভোগে ও বংশবিস্তারে যদি নারীদের প্রয়োজন না হত তাহলে কবেই নারীর নাম থাকত পৃথিবীর বিলুপ্তসব প্রাণীদের তালিকায়। সত্য হল, নারীদের প্রয়োজনের দিকটাই তাদেরকে বাঁচিয়ে রেখেছে; এবং যতদিন না এই প্রয়োজনের বিকল্প আবিষ্কার হচ্ছে ততদিনই বেঁচে থাকবেন নারীরা। তাদের এই প্রয়োজনের দিকটাই তাদের ভোগান্তির জন্য দায়ী, এবং, আবার ক্ষেত্রবিশেষ, এটা তাদের সুখের অন্যতম কারণও বটে।

এক সভ্যতা থেকে আরেক সভ্যতার উন্নতি বলতে আমরা যা বুঝি সেটা পুরুষের উন্নতি- বৈশ্বিক, ক্ষমতা, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, চিকিৎসা, জীবন যাত্রার মান, সম্পর্ক, ভোগ–আরো অনেক কিছূতেই। পৃথিবীর প্রতিটা প্রাণীর মধ্যে নারী-পুরুষ এই দুইটা লিঙ্গ বিদ্যবান। মানুষ বাদে অন্যান্য প্রাণীদের মাঝে নারী পুরুষের যে ব্যবধান সেটা প্রকৃতিগত,- আদি থেকে আজ অব্দি একই সমান্তরাল রেখায় প্রবাহমান। একমাত্র মানুষের মাঝেই এই ব্যবধান (নারী-পুরুষের সামাজিক অবস্থান, মর্যাদা ও ক্ষমতাগত) সভ্যতা থেকে সভ্যতা, সমাজ থেকে সমাজ, সংস্কৃতি থেকে সংস্কৃতি, পরিবার থেকে পরিবার, ব্যাক্তি থেকে ব্যাক্তি ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। আদিমযুগে নারী পুরুষের ব্যবধানটা ছিল অন্যান্য প্রাণীর মতই প্রকৃতিগত। ধরেই নেয়া যেতে পারে, তখনও নারীর উপর অত্যাচার শুরু হয়নি, যে দিন থেকে মানুষ তথাকথিত মানুষে (সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে নিজেদেরকে ভাবতে শুরু করলো) পরিণত হল সে দিনই প্রথম নির্যাতিত হয়েছে নারী। তারপর সভ্যতার যত প্রসার ঘটেছে নারীরা তত কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। খুব কৌশলে পৃথিবীর প্রতিটা পুরুষকে করে তোলা হয়েছে শাসক : পুরুষ (স্বামী) যত অক্ষম-অকর্মা হোক না কেন, নারী (স্ত্রী) তার অধীন হতে বাধ্য সে যতই কর্মঠ, পরিশ্রমী হোক।

খ.
সভ্যতার সূচনা হয় পরিবার প্রথার হাত ধরে, পরিবার হচ্ছে মানব সভ্যতার আদি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের বিকাশের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে পুরুষতন্ত্র; আর, ‘মাতৃ-অধিকারের উচ্ছেদ হচ্ছে স্ত্রীজাতির এক বিশ্ব ঐতিহাসিক পরাজয়।’ আজ family বলতে আমরা যা বুঝি শুরুর দিকে তা ছিল না, family বলতে গোলামদের বোঝাত। famulus অর্থ হচ্ছে একজন ঘরোয়া দাস এবং familia মানে এক ব্যাক্তির অধীনে অনেকগুলো ক্রীতদাস। পরিবার প্রথার মাধ্যমে স্ত্রীদের ওপর পুরুষ বা স্বামীরা সর্বময় ক্ষমতা লাভ করে এবং তারা স্ত্রীদের সতীত্ব এবং পিতৃত্ব সম্পর্কে নিশ্চিৎ হতে পারে। আর স্ত্রীদের জন্য যে দিন থেকে এক পতী নিশ্চিৎ করা হল বা যৌন স্বাধীনতা হরণ করা হল সে দিন থেকে নারী হয়ে উঠল বেশ্যা বা বেশ্যালয় গড়ে উঠল। উদ্ভব হল পতিতাবৃত্তির। ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস এর মতে, ‘একপতিপত্নী প্রথা ও পতিতাবৃত্তি সম্পূর্ণ বিপরীত হলেও তারা পরস্পর অবিচ্ছেদ্যে বিপরীত।’ বহু নারী গমন যে পুরুষত্বের আরেক টি নাম! ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস এটাকে পুরুষের জন্য ‘সানন্দে বহন করার মত নৈতিক কলঙ্ক’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। বেশ্যার সাথে স্ত্রী এর পার্থক্য হচ্ছে : বেশ্যা শরীর বিক্রি করে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, দেহের বাইরে খদ্দের পুরুষের আর কোন অধিকার থাকে না। আর বিবাহের মাধ্যমে নারী তার সর্বস্ব সমর্পণ করে আমৃত্যু দাসত্বকে বরণ করে নেই। নারীদের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে, বিবাহপ্রথা সম্পূর্ণ ভাবে নৈতিবাচক ভূমিকা পালন করে। পতিতাবৃত্তির উচ্ছেদ প্রসঙ্গে বদরুদ্দীন উমর তাঁর ‘নারী প্রশ্ন প্রসঙ্গে’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন, ‘পুরুষের বহুগামিতার জন্য বহুগামী নারীর প্রয়োজন অপরিহার্য। যেহেতু সাধারণভাবে পরিবারের অন্তর্গত নারীর সাথে পুরুষের বিবাহ বহির্ভূত অবাধ গমন ব্যাপকভাবে সম্ভব নয়, তাই পুরুষের এই বহুগামিতা সম্ভব করার জন্য উদ্ভব হয়েছিল প্রায় খোলাখুলিভাবে রক্ষিতা রাখার ব্যবস্থা (hetaerism)। কিন্তু সেটার প্রচলন তেমন ব্যাপক হওয়ার পথে বাঁধা অনেক। কাজেই একবিবাহ প্রথায় পুরুষের বহুগামিতা সম্ভব করার জন্য উদ্ভব হয়েছিল পতিতাবৃত্তির (prostitution)। ব্যাক্তিগত সম্পত্তি ও পতিতাবৃত্তির উদ্ভব এ কারণেই পরস্পরের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। এ কারণে প্রথম প্রথাটির উচ্ছেদ ব্যতীত দ্বিতীয়টির উচ্ছেদ বাস্তবত সম্ভব নয়।’ মার্কস এর মতে, শ্রেণীবৈশম্যের সূচনাও হয়েছে এই পরিবার বা বিবাহ প্রথার মাধ্য দিয়ে- নারী-পুরুষ বিভাজনের মাধ্যমে।

গ.
পুরুষ সভ্যতার সবথেকে বড় আবিষ্ককার হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা (concept of God)। পুরুষের আদলে গড়ে তোলা হয়েছে ঈশ্বরকে। (আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে গ্রীক কবি জেনোফিনিস বলেছিলেন, ‘ষাঁড়ের যদি মানুষের মতো হাত ও ক্ষমতা থাকত তাহলে তারা দেব-দেবীর আকার, রূপ, চরিত্র ষাঁড়ের মতো করেই তৈরী করতো।’) পৃথিবীর প্রতিটা ধর্মে লক্ষ-কোটি নবী, রসূল এসেছেন যাঁদের মধ্যে কেউ-ই নারী নন। নারীদেরকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নধরণের ফতোয়া দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে, থামিয়ে রাখা হয়েছে তাদের মানুষিক উন্নয়নকে। পুঁজিবাদী সমাজে এসেছে নারীদের গুরুত্ব মানুষ হিসাবে আরো লোপ পেয়েছে। আমরা, বর্তমান সময়ে নারীদের যে অবস্থানগত যে উন্নতি দেখি, সেটি প্রকৃতপক্ষে পণ্য হিসাবে। এ বিষয়গুলো নিয়ে পরে আরো বিশদভাবে আলোচনা করা হবে।

ঘ.
মানুষের সাথে পশুর পার্থক্য হচ্ছে ভাষা। ভাষা হচ্ছে প্রকৃতির সর্বশ্রেষ্ঠ গিফ্ট। আর মানুষের সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হচ্ছে এই ভাষার ব্যবহার, অর্থ্যাৎ সাহিত্যের সৃষ্টি। পুরুষ সভ্যতার প্রধান হাতিয়ার হল ভাষার আত্মীকরণ। পুরুষ সমাজের ভাষা নির্ধারণ করে। এই ভাষা নির্ধারণের মাধ্যমে নির্ধারণ করে মানুষের আচরণ, ক্ষেত্র বিশেষ মানুষের জীবনচিত্র। প্রকৃতির এই শ্রেষ্ঠ গিফট এবং সভ্যতার এই শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারকে দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছে পুরুষ শাসিত সমাজ। আজ কেউ যদি বলে, আমি রাস্তায় একজন মানুষকে দেখলাম। আমরা বুঝি সে কোন পুরুষকে দেখেছে কেননা নারীকে দেখলে বলতো, আমি রাস্তায় একটা মহিলাকে দেখলাম- খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যপার। এক্ষেত্রে ঐ লোকটিকে অর্থাৎ ঐ ভদ্রলোককে দোষ দেওয়া যাবে না। আমরা এভাবেই ভাষাকে গড়ে তুলেছি। মানুষ পুরুষ শব্দের সমার্থক শব্দ। নারী- সে আবার মানুষ হল কবে ? ইংরেজি তে মানুষ বলতে বলা হয় human, man শব্দটি এখানে কৌশলে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। যদি কেউ মানুষকে huwoman বলে তবে ব্যাকরণ গলা টিপে ধরবে। ‘chastity’ শব্দটি নারী-পুরুষ উভয়কে নির্দেশ করলেও এটা পারিভাষিক শব্দ ‘সতীত্ব’ শুধুমাত্র নারীর ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। Newman তাঁর The Idea of a University-গ্রন্থে বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হচ্ছে gentlemen বা ভদ্রলোক তৈরী করা তিনি gentlewomen বা ভদ্রমহিলাদের কথা বেমালুম ভুলে গেলেন। এইভাবে ভাষাকে ব্যবহার করে পুরুষ শুধুমাত্র নারীর ওপর আধিপত্যই বিস্তার করে নি, তার মানুষিকতাকেও দমিয়ে দিয়েছে।

পৃথিবীর তাবৎ মহামানবেরা খুব পরিকল্পনা করে গড়ে তুলেছে এই পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতা। তার ঈশ্বর পুরুষ, প্রথম প্রেরিত মানব পুরুষ, এমনকি যাদের জীবন নেই, যারা এই বিভেদ বোঝে না তারাও বাদ পড়েনি,- বলা হয়ে থাকে, সূর্য হচ্ছে পুরুষ, চাঁদ বা অন্ধকার হচ্ছে নারী, পুরুষ উত্তাপ, নারী ছায়া, পুরুষ গতি, নারী মূর্তি, সমুদ্র পুরুষ, নদী নারী। আরও বলা হয়ে থাকে, নর থেকেই নারীর আবির্ভাব, এখানে নারীর স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। মহিলা শব্দটিরও বুৎপত্তি গত অর্থ হচ্ছে মহল, অর্থ্যা নারীর মহলে থাকার জন্যই যেন জন্ম। এই সব শব্দের মারপ্যাচ, পুরুষতন্ত্রের কারসাজি।

এবার সরাসরি আসছি পুরুষতন্ত্রের সবথেকে বড় আবিষ্কার- ‘সাহিত্যে’। সাহিত্যে নারীকে ইচ্ছে মত ব্যবহার করা হয়েছে। কোন উপন্যাসের নায়িকাকে আজ অব্দি কুৎসিত, কাল দেখা যায়নি (ক্ষেত্রবিশেষ ব্যাতিক্রম ঘটতেই পারে!)। উপন্যাসের নায়ক হোক যেমন তেমন নায়িকাকে বিশ্ব সুন্দরী হতেই হবে। বাংলা সাহিত্যে আলাওলের পদ্মাবতী কিম্বা লাইলি মজনুর লাইলি থেকে শুরু করে হালনাগাদ উপন্যাস-গল্পের নায়িকাদের যে রুপের বর্ণণা দেওয়া হয়েছে তাতে তাদের মানবী ভাবতে কষ্ট হয়। আদর্শ নারী মানেই রুপবতী। রুপ না থাকলে সে আবার নারী কেন! নজরুল তাঁর কবিতায় বলেছেন, আমি হতে চাই না একা নারী কারো; এরা দেবী, এরা লোভী…(পুজারিনী)’’। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘পুরুষ আধিপত্য ছেড়ে দিলেই মেয়ে আধিপত্য শুরু করবে। দুর্ববলের আধিপত্য অতি ভংঙ্কর (শেষের কবিতা)।’ রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় রানী এলিজাবেথের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। ইংরেজি সাহিত্যে, হেলেনের জন্য ধ্বংশ হয়ে যায় ত্রয় নগরী (সাধারণ পাঠকরা এমনটিই মনে করে!)। প্রকৃত সত্য হচ্ছে এই ধ্বংশের পেছনে কাজ করেছে আকিউলাস ও হেক্টরের ক্ষমতার লোভ। নারী এখানে উপলক্ষ মাত্র। ইলিয়ড শুরু হয় একটি দাসিকে কেন্দ্র করে আকিলিস ও আগামেমনসের মধ্যে বিবাদের সূত্র ধরে। হোমাদের কাব্যে দেখা গেছে স্ত্রীরা তাদের বীর স্বামীদের দাসীদের সাথে ভাগাভাগি করতে বাধ্য হত। অডিসিতে দেখা যায়, টেলিমেকাশ মাকে ধমক দিয়ে চুপ করে থাকতে বলে। ইউরিপিডিস্-এর রচনায় স্ত্রীকে বলা হয় oikurema বা গৃহস্থালী চালানোর একটি জিনিস। মিডিয়াতে দেখা যায় জেসন মিডিয়াকে ব্যবহার করে গোল্ডেন ফ্লিস দখলে আনে এবং পরবর্তীতে ক্ষমতার লোভে মিডিয়াকে ফেলে রাজা ক্রিয়নের মেয়েকে বিয়ে করে। পরবর্তীকালের সাহিত্যকর্মেও একই দৃশ্য ফুটে উঠেছে। একসময় চরিত্রহীন তলস্তয় আশ্রয় নিলেন ধর্মে। তাঁর স্ত্রী সোফিয়া তেরটি সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন। জমিদারি দেখাশোনাসহ তলস্তয়কে পান্ডুলিপি প্রস্তুত ও প্রকাশনায় সহায়তা করেন। তবুও নারী জাতি সম্পর্কে তলস্তয়ের স্বীকারক্তি হচ্ছে, ‘মেয়েদের সান্নিধ্য সমাজ জীবনের একটি প্রয়োজনীয় অপ্রীতিকর ব্যাপার, যতটুকু সম্ভব এদেরকে এড়িয়ে চল।’ জাঁ জ্যাক রুশো (১৭১২-১৭৭৮) তাঁর এমিলি উপন্যাসের নায়িকাকে বলেছেন, ‘যখন এমিল তোমার (সোফিয়া) স্বামী হবে, তখন সে তোমার প্রভু। প্রকৃতির অভিলাষ হচ্ছে যে তুমি তার অনুগত থাকবে।’ রুশো আরও বলেছেন, ‘প্রকৃতির বিধান হচ্ছে নারী অনুগত থাকবে পুরুষের।’ রুশো ব্যাক্তি জীবনে অনেক নারীর সহচর্যে এসেছেন, জন্ম দিয়েছেন অবৈধ সন্তান আবার নিজেই বলেছেন, ‘যে স্বামীদের নিশ্চিৎ হতে হবে তাদের স্ত্রীদের সতীত্বে যাতে তাদের সন্তানেরা আসলেই হয় তাদের নিজেদের সন্তান।’

ঙ.
আধুনিক বা পুঁজিবাদী বা ভোগবাদী বা পুরুষ সভ্যতা হচ্ছে বাজার কেদ্রিক সভ্যতা। এই সভ্যতাই নারী পণ্য হিসাবে গন্য। বিজ্ঞাপনে নারীকে ব্যবহার করে সর্বচ্ছ মুনাফা আদায়ের চেষ্টা করছে পুঁজিকেদ্রিক সমাজ। সাবান/শাস্পু/সুগন্ধি/পোশাক/কসমেটিকস/এমনকি গরু মার্কা ঢেউ টিন, সবখানেই বাছাই করা সুন্দরীদের স্বল্প কাপড়ে টিভি পর্দায় পরিবেশন করা হচ্ছে, যেন এসব বিজ্ঞাপনের দর্শক কেবল মাত্র পুরুষরাই। পুরুষকেদ্রিক সভ্যতা করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মত নারীকে সর্বত্তম ব্যবহার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এবং সফল হচ্ছে তো বটেই। এক্ষেত্রে নারীদের অকৃত্রিম সহযোগিতার কথা স্মরণ করার মত। আগে শুধু নারীদের দেহকে ভোগ করা হত, আর কায়িক শ্রম বলতে সন্তান পালন ও রান্না-বান্নাকেই বোঝানো হত। আর পুঁজিকেন্দ্রিক বর্তমান সমাজ সবকিছু থেকে সর্বস্ব মুনাফা আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, ফলত, সংসার সামলানোর পাশাপাশি দক্ষতা অনুযায়ী কাজ করতে হচ্ছে নারীদেরকে। সুন্দরী মহিলাদের দেহকে পুঁজি করে বিশ্ববাজারে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। বউ বা প্রেমিকাকে কোলের মধ্যে রেখে আমরা সেই সব সুন্দরীদের রূপ উপভোগ করছি। আধুনিক শ্রমবাজারের যে নারীরাই প্রবেশ করছে তাদেরকে একধরণের পতিতাবৃত্তির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হচ্ছে। ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙ্গে-যেন, তদরূপ, মহিলাদের কাজই হচ্ছে যৌনসুখ প্রদান করা।

অসমাপ্ত

বি দ্র : আমি জানি মুক্তমনায় এ বিষয়ে অনেক ভালো ভালো লেখা ছাপা হয়ে গেছে। আমার এ লেখাটির কোনো প্রয়োজনই হয়ত ছিল না। তারপরও মুক্তমনায় পোস্ট করলাম, উদ্দেশ্য, আমার শ্রদ্ধেয় পাঠকদের কাছ থেকে কিছু শেখা…

কৃতজ্ঞতায় :
নারীহুমায়ুন আজাদ
ঈশ্বর, সৃষ্টি ও ধর্মসা’দ উল্লাহ
নারীসস্পাদনায় তাহা ইয়াসিন
নারী প্রশ্ন প্রসঙ্গেসম্পাদনায় বদরুদ্দীন উমর
দ্বিতীয় লিঙ্গসিমোন দ্য বোভেরার
নারীর মূল্যশরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
ভোলগা থেকে গঙ্গারাহুল সাংকৃত্যায়ন
যুক্তিবাদের চোখে নারী-মুক্তিপ্রবীর ঘোষ
ধর্মের উৎস সন্ধানেভবানীপ্রসাদ সাহু
নারী ধর্ম ইত্যাদিগোলাম মুরশিদ
নারী পুরুষ ও সমাজআনু মুহাম্মদ
যে সত্য বলা হয়নিআকাশ মালিক
মুক্তমনা ও অন্যান্য ব্লগ ও
ইন্টারনেট

বি: দ্র: শাশ্বতিকীর লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংখ্যা প্রকাশের অপেক্ষায়…