লেখকঃ মনওয়ার হোসেন

আপাতদৃষ্টিতে আমাদের বোঝার তেমন কোন উপায় নাই জীবন সিমুলেশন কিনা। ইনসেপশনে জীবনের সিমুলেশন নিয়ে কাহিনী দেখলাম, যদিও স্বপ্নজগৎ নিয়ে। এদিকে আয়ান ব্যাংকসের ‘সারফেস ডিটেইল’ সিমুলেশনের ভিতরে সিমুলেশনের ভিতরে সিমুলেশন নিয়েও কথা আসছে।

জীবন যদি সিমুলেশন হয়ই, আপনি কি করবেন? আজকে একজনকে এ কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি বললেন, উনি চেষ্টা করবেন সচেতন হয়েই ‘রবোটগুলিকে’ মারতে।

আমি কি করবো? প্রথমে হয়তো একটু শ্রাগমতন করবো। তারপর বোঝার চেষ্টা করবো কোন আংকেল কেন আমাদের এমনভাবে খেলাচ্ছেন। তারপর বলবো ভুলায় দিতে। 😉 আর কি?

এখনকার ধারণার কথা যদি বলি, একেবারে মৌলিক পর্যায়ে জীবন আমার কাছে অর্থবহ মনে হয় না।

কেউ কেউ বলেন, জীবনে একটা লুকানো অর্থ আছে। অথবা, অর্থটা অনেক বেশি জ্ঞানের ব্যাপার। আমাদের সে জ্ঞান নাই। হয়তো একসময় আমরা বিবর্তনের একটা পর্যায়ে গিয়ে সেই জিনিসটা বুঝবো।

হতে পারে। ফেলে দিচ্ছি না। কিন্তু সমস্যা একটাই: সিমুলেশনই হোক, বা অধিক জ্ঞানই হোক, এটা তো এখনকার জীবনে কোন পরিবর্তন আনছে না।

আমি যে জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানি না, সেটা তো একটা ফ্যাক্ট। আমার জ্ঞানবুদ্ধি এবং এ পর্যন্ত অর্জিত সীমিত পর্যবেক্ষণ এবং দুনিয়াদারী বলে যে আমরা এমন কোন গূঢ় কারণে বেঁচে থাকি তা না। মৃত্যু এক নাম্বারে বেশ কষ্টকর, তাছাড়া অনেক অনিশ্চয়তার ব্যাপার। তারচে’ আসছি যখন, বাইচ্যা লই ধরণের মানসিকতাই বেঁচে থাকার জন্য অনেকের কারণ। একটু বেশি শিক্ষিত লোকেরা জিনিসটাকে নানাভাবে এবং সুন্দরভাবে প্রকাশ করে। ‘লাইফ ইজ হোয়াট হ্যাপেনস হোয়েন ইউ আর টু বিজি মেকিং প্ল্যানস’ ইত্যাদি। লাইফ ইজ এ সেট অফ বায়োকেমিক্যাল রিঅ্যাকশনস – এটা মোটামুটি মনে হয়। সিট অফ দ্য সোল নিয়ে জুকাভ থেকে কুহন নানাধরণের allusion দিয়ে গেছেন; এক বড়ভাইকে বেশ শ্রদ্ধা করি, ওনার নিজেরও এই ব্যাপারে কিছু হাইপোথিসিস আছে, কিন্তু, যা বললাম, ‘বর্তমান জ্ঞানের ভিত্তিতে’ জীবন অনেককোষের নানা জাতের অন্তঃক্রিয়া ছাড়া আমরা আর কি?! 🙂

আমার চারপাশের বেশিরভাগ লোকের যে জীবনরে বেশ ভাল লাগে, এইটা নিয়ে আসলে তেমন হিংসা করে লাভ নাই। বিবর্তনের উদ্দেশ্যই সেটা (যদিও বিবর্তনকে মাঝে-মধ্যে আমরা আবার একটু বেশি পাত্তা দিয়ে ফেলি, তাও, ‘সাধারণ মানুষ’-এর জন্য বেশিরভাগ বিবর্তনভিত্তিক ইমপালস দমন করাটা কঠিন, এবং মানুষ পারলে কঠিন কাজ করে না আর কি। 🙂 )

সমস্যা একটাই, যারা জীবনকে, বা বেঁচে থাকাকে খুব প্রচন্ডভাবে ভালবাসে, তাদের মধ্যে আবার নিরপেক্ষভাবে এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে পর্যবেক্ষণের প্রবনতা তেমন দেখি না। পুলকিত হই সেরকম মানুষ পেলে, যারা এইরকম প্যাসিভ পর্যবেক্ষণটাও করতে পারে, আবার জীবনকে সেভাবে উপভোগও করতে পারে। যদিও গায়ের জোরে জীবনকে উপভোগ করাটা আমার কাছে আপত্তিকর মনে হয়; আবার, একটু চেখে না দেখলেও তো মুশকিল।

একটু বেশি চিন্তাশীল লোকদের সমস্যা মনে হয় অন্য। চরম নায়ালিজমের (এইটা আমি মনে মনে উচ্চারণ করি নিহিলিজম; কিন্তু উচ্চারণ বলে নায়ালিজম?!) ধাক্কায় জীবনকে উপভোগ তারা সেকেন্ডহ্যান্ডে করে। অনেকক্ষেত্রেই। আসলে এই দুই দলের মাঝের ওভারল্যাপ এলাকাটাই বেশি ইন্টারেস্টিং। তবে সবাইকে সেখানে পড়তে হবে এমন কোন কথাও নেই।

আমার নিজের মোটামুটি কড়া ডোসেজে নায়ালিজম আছে। এটা ইন্টারের পরে হইসে; এর আগ পর্যন্ত এসব বুঝার জ্ঞানবুদ্ধি/রসদ ছিল না। কি হইসে না করলে? শুনলাম না এই কথাটা। পড়লাম না এই জিনিসটা। দেখিই না কি হয়। স্বভাবগত আমি বেশ অলস (বা যাকে বলে লেথার্জিক) এবং ফাঁকিবাজও বটে। এখানেও একটা সেল্ফ-ফুলফিলিং প্রফেসির প্রবনতা কি দেখা যায়? 🙂 বই পড়তে বেশি হাত-পা নাড়াতে হয় না, গেম খেলতেও, বা মুভি দেখতেও। এখানে সমস্যা হল আমি হাঁটতে বা সাইক্লিং করতে বা হাইকিং করতেও (সুযোগ পেলে আরকি) বেশ পছন্দ করি। তো আমার এই স্বভাব-আলস্য কোত্থেকে আসলো? ‘কি হবে করে’ এই প্রশ্ন থেকে?

এইখানে নিজের সাসপেনশন অফ ডিসবিলিফ-এর প্রশ্নটাও চলে আসে। একটা বয়সে গিয়ে আমার সমাজের প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস আমার কাছে ঠিক অর্থবহ মনে হয়নি। হলে খারাপ তো হতোই না, প্রতিটা ব্যক্তির কাছে জিনিসটা আলাদাভাবে অর্থবহ হয়, সুতরাং ওভাবে কাউকে টিটকারি মারতেও চাই না। এগনস্টিক হিসেবে আমি মোটামুটি একটা সাসপেন্ডেড ধরণের অবস্থাতে জীবনাতিবাহন করি, ‘পাস্ট কেয়ারিং’ ধরনের। আমি জীবনে এখনো পর্যন্ত তেমন বিপ্লবী কিছু করিও নাই; ‘ভাল কিছু একটা করতে হবে যাতে মরলে আমার নাম টিকে থাকে’ ধরণের জিনিস আমার মত পাবলিককে দিয়ে কি হবে? ‘স্বপ্ন’ সম্পর্কে আমার ইল্যুশন বেশ আগেই চলে গেছে, তাছাড়া, ছোটবেলার স্বপ্ন আঁকড়ে ধরে থাকা সম্পর্কে কিছু বাস্তবসম্মত শিক্ষা ইতোমধ্যেও পেয়েছি, তাছাড়া ওটা আঁকড়ে ধরে থাকাও যে এক ধরণের ইনসিকিউরিটি না তাও তো না। আবার ওটা বাস্তবায়নের কিকটাও আছে।

থোরু, বা ভাল উদাহরণ ম্যাকক্যান্ডলেসের মত সব ছেড়ে চলে যাওয়ার মধ্যে তেমন কোন সমাধান দেখি না। সেখানেও আবার জীবনরসে অনেক আসক্ত হওয়া লাগে। এদিকে নিজে জীবনরসে আসক্ত একেবারে না তাও বলতে পারি না। 🙂

এইটাই পয়েন্ট। ম্যাক্রোভাবনা যদি বাদ দেই, ক্ষুদ্রায়তনে দেখা যাবে গড়ে আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু জৈবিক অনুঘটক ধরনের আছে। ওগুলিতে সুড়সুড়ি দিলে বেশ অকুপায়েড ভাবে জীবনটা কাটিয়ে দেয়া যায়। এ কারণেই ‘আরে পোলারে বিয়া দাও’ ধরনের কাজকারবার উপকারি – পাশে বাচ্চা কানতেসে, আপনি এই আর্টিকেল লিখবেন? হেহ হেহ! এটাও আবার এক ধরনের সিস্টেমিক, যান্ত্রিক সমাধানবিশেষ। কিন্তু খুবই কার্যকর। এভাবে কঠিন কোন কাজ করা, লেখাপড়া করা, ঘুরে বেড়ানো, সবই কার্যকর। টাইম পাস। তারপর মৃত্যু। জীবন হল বেশিরভাগ সময় নিজেকে এভাবে ঠকায় অকুপায়েড রাখা আরকি।

নাইলে আর কেমনে কি? আমরা সবাই জানি আমরা মারা যাচ্ছি, তাই না? আমরা না মরলেও পৃথিবী মরবে। মহাবিশ্বই মরবে। আগে হোক, পরে হোক। এটা তো আমরা জানি। নিজেদের এই মৃত্যুর কাহিনী জেনেও আমরা বেশ আনন্দের সাথে জীবন কাটিয়ে যাই, সেটা প্রাকৃতিক সৃষ্টি হিসেবে আমার বিবর্তনগত জন্মাধিকার। আবার আমাদের সীমাবদ্ধতার কারণও বটে। কিন্তু প্রকৃতির এই ফাঁদে খুশিমনে পা দিতেও আমাদের আপত্তি নাই; দুষিই বা কেমনে? যদিও মাঝে মধ্যে জিনিসটা বিপদজনক, বিরক্তিকর এবং কাম্য না।

সভ্যতা হিসেবে আমরা আস্তে আস্তে আদি-বিবর্তনীয় ইমপালসগুলো বেশি করে দমন করছি, নতুন বিবর্তনের ধারাও সৃষ্টি করছি। এখানে আমাদের এবং বিবর্তনীয় সময়ের পার্থক্য খুব বেশি হওয়াও যারা এ নতুন পথে চলছেন তাদের কষ্টটা বেশি। কিন্তু অপ্ট-আউটের তেমন সুযোগও তাদের নেই, সেখানে আবার প্রান্তিক কষ্ট আরো বেশি।

সুতরাং এই ঘরানার লোকজন হয়তো তাদের শক্তিশালী বিশ্লেষণ ক্ষমতা নিয়োগ করে বিবর্তনীয় কাম্য ধারাগুলোকেই অপটিমাইজডভাবে উপভোগ করতে পারেন। আর কি-ই বা করার আছে? আত্মহত্যা খুব একটা আকর্ষণীয় পছন্দ না, আবার (তাদের কাছে) মাইন্ডলেসভাবে বিবর্তনীয় ইমপালসে বেঁচে থাকাও না, যদিও সবখানেই উপযোগের হিসাব আছে। ব্যক্তির পছন্দ, জৈবিক এবং পারিপার্শ্বিক সীমাবদ্ধতার ভিত্তিতে।

সমস্যা যদিও সেখানেও সব সমাধাকৃত হয় না (অপটিমাইজেশনও বোরিং হয়ে যায়, তখন আবার গোলমাল করে হয়তো ফেরৎ আসতে হবে), তবুও, সেটা মন্দের ভাল।