মহাজাগতিক সংস্কৃতির পথে- মহাবৃত্ত। দ্বিতীয় বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, এপ্রিল-জুন ২০১০। সম্পাদক- আসিফ। প্রকাশক- ডিসকাশন প্রজেক্ট। পৃষ্ঠা সংখ্যা- ১২০। মূল্য- ১৫০ টাকা।

আসিফের ডিসকাশন প্রজেক্টের ‘মহাবৃত্ত’ হাতে পেয়েছি দু’মাস হয়ে গেলো। হাতে পেয়েই দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়েছি ১২০ পৃষ্ঠার সংকলনটিতে। কিন্তু মহাবৃত্তে প্রকাশিত গম্ভীর লেখাগুলো পড়ার ক্ষেত্রে ‘স্পিড রিডিং’ কার্যকরী নয়। বিজ্ঞান-পাঠে সময় লাগে এবং ‘পাঠকৃত নির্যাস মস্তিষ্কে ধারণ’ করতে করতে কেটে যায় আরো অনেকটা সময়। মহাবৃত্তের মূল প্রসঙ্গে আসার আগে ব্যক্তিগত ধন্যবাদ জানাচ্ছি মুক্তমনা ও আসিফকে। মুক্তমনাকে ধন্যবাদ এই কারণে যে মহাবৃত্তের পরিচিতি মুক্তমনায় তুলে ধরা না হলে এবং গ্রাহক হবার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ না করলে ‘মহাবৃত্ত’র সাথে হয়তো আমার পরিচয় ঘটতো না। আর আসিফকে ধন্যবাদ দিচ্ছি একাধিক কারণে। ডিসকাশন প্রজেক্টের মতো একটা অ-বাণিজ্যিক কার্যকরী বৈজ্ঞানিক সংগঠন আসিফ প্রায়-একাকী দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন। ১৯৯২ সালের ১৯শে মে যাত্রা শুরু করে ডিসকাশন প্রজেক্ট এখন আঠারো বছরের তরুণ। বাংলাদেশে সম্মানীর বিনিময়ে বিজ্ঞান বক্তৃতার সূচনা হয়েছে আসিফের হাতে। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার কাজে আসিফের অবদান বাংলাদেশের আপেক্ষিকতায় বিশাল। এসবের জন্য আসিফ বাংলাদেশের সব বিজ্ঞান-প্রেমীর কাছ থেকে ধন্যবাদ পাবেন। আমার ব্যক্তিগত ধন্যবাদটাও যোগ হচ্ছে সেখানে।

আসিফ সম্পাদিত মহাবৃত্তের দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা (এপ্রিল – জুন ২০১০) বেরিয়েছে বিশেষ ‘আইনস্টাইন সংখ্যা’ হিসেবে। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের যুগান্তকারী গবেষণা-পত্র প্রকাশিত হয়েছিল- যার ফলে প্রচলিত বিজ্ঞানের ধারাই বদলে গেছে। আপেক্ষিকতা তত্ত্বের একশ’ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০৫ সালকে পদার্থবিজ্ঞানের বছর বা World Year of Physics ঘোষণা করা হয়েছে এবং সে উপলক্ষ্যে বছরব্যাপী বিজ্ঞানের নানা রকম আয়োজন চলেছে। মহাবৃত্তের এ সংখ্যাটি ২০০৫ সালের বদলে ২০১০ সালে প্রকাশিত হলেও উপলক্ষ্য যে ২০০৫ সালের পদার্থবিজ্ঞান বছর ও আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের শতবর্ষ উদ্‌যাপন তা সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রকাশের বিলম্বের কারণে ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান বছর উদ্‌যাপনের খবরও সংক্ষিপ্ত আকারে উল্লেখিত হয়েছে।

মহাবৃত্তের আলোচ্য সংকলনটি একাধিক কারণে সমৃদ্ধ। এ সংখ্যায় আইনস্টাইন সম্পর্কে যাঁরা লিখেছেন তাদের মধ্যে আছেন স্বনামধন্য নৈসর্গিক দ্বিজেন শর্মা, বাংলাদেশের খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানীরা- প্রফেসর এ এম হারুন অর রশীদ, প্রফেসর অজয় রায় এবং প্রফেসর আলী আসগর, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের সাধারণ সম্পাদক ও বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির অন্যতম পুরোধা মুনির হাসান, মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও দুর্ধর্ষ বিজ্ঞান-লেখক ডঃ অভিজিৎ রায়, ‘কার্টুন’ সম্পাদক আহসান হাবীব, লেখক-প্রকাশক-সংগঠক মফিদুল হক, এবং আরো এক ঝাঁক শক্তিশালী তরুণ বিজ্ঞান-কর্মী। আইনস্টাইন সম্পর্কে এতসব শক্তিশালী লেখকের লেখা একটি সংখ্যায় প্রকাশ করতে পারা সত্যিই বড় শ্রমসাধ্য কাজ। আসিফ এই শক্ত কাজটি দক্ষতার সাথে করতে পেরেছেন। আইনস্টাইনের জীবনের বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন দিকের অনেকগুলো ছবি সন্নিবেশিত হয়েছে এ সংখ্যায়। ফলে সংকলনটির মান ও সার্বজনীনতা বেড়েছে অনেক গুণ।

বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকার সামগ্রিক চিত্র যে সুবিধাজনক নয় তা আমরা কম-বেশি সবাই জানি। “আমাদের সংস্কৃতিতে বিজ্ঞানের দুর্বল অবস্থান”- এর কারণে আমাদের বিজ্ঞান-পত্রিকাগুলোর বেশির ভাগই খুব একটা আয়ুষ্মান হয় না। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি কী রকম তা দ্বিজেন শর্মা তাঁর শুভেচ্ছা সম্পাদকীয়তে খুব কম কথায় সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমাদের বিজ্ঞান আছে পাঠ্যবইয়ে, গবেষণাগারের চৌহদ্দিতে, নেই নিত্যদিনের ভাবনাচিন্তায়, জীবনচর্চায়”। কারো কারো একক বা সমন্বিত প্রচেষ্টায় বিজ্ঞানের পথে কিছুদূর অগ্রসর হবার পরেও দেখা যায় আমাদের যাত্রাভঙ্গ হয়। দ্বিজেন শর্মা এর কারণ হিসেবে বলেছেন, “অবাঞ্ছিত বিশৃঙ্খলা বার বার আমাদের পথচ্যুত করছে, এগোতে দিচ্ছে না”। অবাঞ্ছিত বিশৃঙ্খলার স্বরূপ আমরা জানি, অনেক ক্ষেত্রে কারণও জানি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো সে কারণগুলো দূর করার ক্ষমতা যাদের হাতে- তারা হয় বিজ্ঞান বোঝেন না, বা বুঝলেও বিজ্ঞানের পথ সুগম করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না। তাই বলা চলে বাংলাদেশে সত্যিকারের বিজ্ঞান-চর্চা যা হচ্ছে তার বেশির ভাগই হচ্ছে ব্যক্তিগত চেষ্টায়, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই। উদাহরণ- আসিফের ডিসকাশন প্রজেক্ট ও মহাবৃত্ত।

মহাবৃত্তের শুরুতেই স্থান পেয়েছে “আপেক্ষিক তত্ত্বের শতবর্ষ” শিরোনামে প্রফেসর এ এম হারুন অর রশিদের সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মাহমুদ হোসেন ও আসিফ। বাংলাদেশের প্রথম সারির তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর হারুন অর রশিদ। আশি-নব্বই এর দশকে দৈনিক সংবাদ-এর বিজ্ঞানের পাতায় হারুন অর রশিদ স্যারের লেখা পড়ে জেনেছি কত বিজ্ঞানীর নাম আর তাঁদের গবেষণার কথা। আমার জানা মতে বাংলাদেশে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এ পর্যন্ত মাত্র দুটো টেক্সট বই প্রকাশিত হয়েছে- যার একটির লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এ এম হারুন অর রশিদ, অন্যটির লেখক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর হুজ্জোত আলী প্রামাণিক। হারুন অর রশিদ স্যারের বই পড়ে কোয়ান্টাম মেকানিক্স শিখেছে আমার মত বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালাম, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম পথিকৃৎ পল ডিরাক ও ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের সংস্পর্শে এসেছিলেন প্রফেসর হারুন অর রশিদ। তাঁর সাথে আলাপ-চারিতায় তাই আইনস্টাইনের পাশাপাশি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নানারকম তথ্যও আলোচিত হয়েছে। আলোচিত হয়েছে পল ডিরাক, হাইজেনবার্গ ও রিচার্ড ফাইনম্যানের কথাও।

বিজ্ঞান ও ধর্ম প্রসঙ্গে খুবই দরকারী ও সাহসী কথা বলেছেন প্রফেসর হারুন অর রশিদ। “বাইবেল হলো বিশ্বাসের ব্যাপার, আইনস্টাইনের বিশ্বসৃষ্টি হলো যুক্তির ব্যাপার, পরীক্ষণের ব্যাপার। এ দুয়ের মেলানোর কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি কখনো মনে করিনি, এখনো করি না” (পৃষ্ঠা-১৩)। কিন্তু পর মুহূর্তেই তিনি বলেছেন, “এটা ঠিক যে ধর্মীয় অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে বিজ্ঞানের মূল বাণী বোঝার চেষ্টা করা যায় যেমন, বিজ্ঞানের যুক্তির মাধ্যমেও ধর্মের মূল বাণী সবার পক্ষে আত্মস্থ করা সম্ভব” (পৃষ্ঠা-১৩)। “ধর্মের মূল বাণী” ব্যক্তি, সমাজ, বা সময় বিশেষে বিভিন্ন। অন্যদিকে “বিজ্ঞানের মূল বাণী” বলতে ঠিক কী বোঝায় তা স্পষ্ট নয়। আমার মনে হয়েছে এই কথাগুলোর মাধ্যমে স্যার বলতে চেয়েছেন ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের মূলত কোন বিরোধ নেই! একটু আপোষকামী মতবাদ হয়ে গেলো মনে হচ্ছে। অবশ্য স্যার এটাও বলেছেন যে “উভয় ব্যাপারে প্রত্যেকেরই নিরাসক্ত, নির্মোহ এবং সচেতনভাবে শুধু বিশুদ্ধ জ্ঞানের প্রতিই নিবেদিতপ্রাণ হতে হবে, প্রত্যাদিষ্ট জ্ঞান নয়, তা না হলে সব বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হতে বাধ্য” (পৃষ্ঠা-১৩)। প্রত্যাদিষ্ট জ্ঞান সম্পর্কে যতই সতর্ক-বাণী দেয়া হোক না কেন- প্রত্যাদিষ্ট জ্ঞান-ই সব ধর্মের মূলধন। তাই বিজ্ঞানের মাধ্যমে ধর্মের মূল বাণী খুঁজে পাওয়া এবং ধর্মের মাধ্যমে বিজ্ঞানের মূল বাণী খুঁজে পাওয়ার মিথষ্ক্রিয়া কার্যকর বলে মেনে নেয়া যায় না।

বাংলাদেশে পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার বর্তমান চিত্র সম্পর্কে খুবই সময়োপযোগী প্রশ্ন করা হয়েছিল। কিন্তু সচেতনভাবেই প্রশ্নটার উত্তর এড়িয়ে গেছেন প্রফেসর হারুন অর রশিদ। বলেছেন “এখন পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার জন্য প্রয়োজন হয় নানা ধরণের বড় মাপের গবেষণা সুবিধা। আর্থিক কারণেই কেবল বাংলাদেশে নয় অনেক দেশেই এগুলো পাওয়া সম্ভব নয়”। মোদ্দা কথা হলো- আমাদের টাকা নেই- তাই আমরা গবেষণা করতে পারি না। কথাটা কি পুরোপুরি সত্য? কত টাকা দরকার হয় তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায়? তৃতীয় বিশ্বের পদার্থবিজ্ঞানীদের জন্য এখন আন্তর্জাতিক পদার্থবিজ্ঞান সমিতিগুলো যত সুযোগ-সুবিধা দেয়- তার কতটুকু কাজে লাগায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো? শুধু তাই নয়, যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে বসে সত্যেন বসু আইনস্টাইনের সাথে গবেষণা-পত্র লিখেছেন, যেখানে সৃষ্টি হয়েছে বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান নীতি- আজ সেখানে সত্যেন বসুর কোন চিহ্নও নেই। “কেবল পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যানের ঘরে একটা ছবি আছে, আর একটি ছবি আমি উদ্যোগ নিয়ে তৈরি করে বিজ্ঞান গ্রন্থাগারে রাখার ব্যবস্থা করেছিলাম” (পৃষ্ঠা-১২)। এটা থেকেই বোঝা যায় বিজ্ঞানের গবেষণা ও গবেষকদের প্রতি আমাদের আচরণ।

একটা ব্যাপার এখানে উল্লেখ করা দরকার। সাক্ষাৎকারের কয়েক জায়গায় উল্লেখ করা হয়েছে ১৯০৫ সালে আইনস্টাইনের তিনটি পেপার প্রকাশিত হয়েছে। আসলে ১৯০৫ সালে আইনস্টাইনের চারটি পেপার প্রকাশিত হয়েছেঃ
1. On a heuristic point of view concerning the production and transformation of light, Annalen der Physik, No. 17 (1905), pp 132-148, (বিখ্যাত E=h পেপার। এটার জন্যই নোবেল পুরষ্কার দেয়া হয় আইনস্টাইনকে)।
2. On the motion of small particles suspended in liquids at rest required by the molecular-kinetic theory of heat, Annalen der Physik, No. 17 (1905), pp 549-560. (ব্রাউনিয়ান গতি সম্পর্কিত পেপার)
3. On the electrodynamics of moving bodies, Annalen der Physik, No. 17 (1905), pp 801-921 (১২১ পৃষ্ঠার এই গবেষণাপত্রে আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়)।
4. Does the inertia of a body depend on its energy content? Annalen der Physik, No 18 (1905), pp 639-641. (এটাই বিখ্যাত E=mc2 পেপার, মাত্র আড়াই পৃষ্ঠা। )।

বাংলায় বিজ্ঞানের কথা বলার আমাদের প্রতিষ্ঠিত অধ্যাপকরা যেভাবে কথা বলেন বা লেখেন তা প্রায় সময়েই মনে হয় ইংরেজি’র আক্ষরিক অনুবাদ। ফলে ভাষাটা বাংলা হলেও খুব একটা সহজবোধ্য হয় না। যেমনঃ “অবশ্যই আমার দেহের অণু-পরমাণু জন হুইলারের কথামতো ‘স্পাঘেটিকৃত’ হয়ে যাবে এবং এমনকি সবশেষে মহাকাশও স্পাঘেটিকৃত হয়ে যাবে” (পৃষ্ঠাঃ ১০)। ‘স্পাঘেটি’ কী জিনিস আমরা ক’জন জানি? জন হুইলারের দেশে স্পাঘেটি খুবই সর্বজনগ্রাহ্য একটা খাবার। কিন্তু এখানে তুলনাটা তো খাবারের জন্য দেয়া হয়নি, দেয়া হয়েছে এর সরু লম্বা আকৃতির জন্য। এক্ষেত্রে ‘স্পাঘেটিকৃত’ বললে ব্যাপারটা কি বাংলা হয়ে গেলো? একই ব্যাপার ঘটে যখন আমরা Newton’s law-কে বাংলায় ‘নিউটনের আইন’ বলি। যেমনঃ “দেশ-কালের বিকৃতি এবং কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞানের মিলনের ফলে উদ্ভুত আইনগুলোই হলো ‘কোয়ান্টাম অভিকর্ষ আইন’” (পৃষ্ঠা-১০)। বাংলা শব্দই যদি বোধগম্যতার প্রতিবন্ধক হয়ে ওঠে- তাহলে বাংলায় বিজ্ঞান-চর্চার মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে বাধ্য। কেন জানি না আমাদের দেশের বড় বড় অধ্যাপকদের বাংলা একটু খটমটে।

আইনস্টাইনের প্রথম স্ত্রী মিলেইভার সাথে আইনস্টাইনের সম্পর্কের উত্থানপতন নিয়ে লেখা মফিদুল হকের প্রবন্ধ “আইনস্টাইন ও মিলেভাঃ এক জটিল সমীকরণ”। প্রবন্ধের শুরুতেই লেখকের স্বীকারোক্তি “বিজ্ঞানের সাথে আমার বিশেষ যোগ নেই, আগ্রহ যতোটা আছে উপলব্ধি সেই তুলনায় একেবারেই নগণ্য” – পাঠকের উৎসাহে পানি ঢেলে দেয়। এরপর পাঠক লেখকের বৈজ্ঞানিক যুক্তিবোধ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতেই পারেন। লেখাটি শুরু হয়েছে লেখকের ২০০৫ সালে সুইজারল্যান্ড ভ্রমণকে কেন্দ্র করে। লেখকের পরিচিত সুইজারল্যান্ডের সমাজকর্মী মায়া ভিকির কাছেই লেখক প্রথম শোনেন আইনস্টাইনের প্রথম স্ত্রী মিলেইভা সম্পর্কে। তারপর ওয়াল্টার আইজাকসনের লেখা আইনস্টাইনের জীবনী পড়ে জেনেছেন আইনস্টাইনের জীবনে মিলেইভার ভূমিকার কথা। পুরো প্রবন্ধে মফিদুল হক বোঝাতে চেয়েছেন যে আইনস্টাইন নানাভাবে বঞ্চিত করেছেন মিলেইভাকে। তাঁদের বিয়ের আগে জন্মানো কন্যা লিজেরেল সম্পর্কে কোন খবর না নেয়া, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব- আসলে আইনস্টাইন-মিলেইভা তত্ত্ব, ইত্যাদি অনেক অ-প্রমাণিত অভিযোগ রয়েছে আইনস্টাইনের বিরুদ্ধে। ইউরোপে অনেক মানুষ আছেন যাঁদের চোখে আইনস্টাইন একজন ‘আইডিয়া-চোর’। আমার ধারণা মায়া ভিকি তাঁদেরই একজন। মিলেইভার বৈজ্ঞানিক প্রতিভা নানা কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তার জন্য শুধুমাত্র আইনস্টাইনকে দায়ী করাটা হবে বড় বেশি একপেশে। বেশ কিছু তথ্যবিচ্যুতি আছে মফিদুল হকের লেখায়। আলবার্ট আইনস্টাইনের সাথে মিলেইভার বিবাহ বিচ্ছেদ প্রসঙ্গে ২১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে “১৯১২ সালে মিলেভা-আইনস্টাইনের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে”, আবার ২৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে “১৯১৮ সালে মিলেভা-আইনস্টাইনের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে”। একই প্রবন্ধে দু’রকম তথ্য- কিন্তু দুটো তথ্যই ভুল। সঠিক তথ্য হলো – মিলেইভা ও আলবার্টের মধ্যে বিবাহ-বিচ্ছেদ চুক্তি হয় ১৯১৪ সালের ২৪ জুলাই। চূড়ান্ত আইনী বিচ্ছেদ ঘটে ১৯১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। লেখক প্রশ্ন করেছেন, “তবে অন্যভাবে অর্থ না যুগিয়ে পুরষ্কারের অর্ধেক কেন মিলেভাকে দিতে চাইলেন আইনস্টাইন সেটাও একটা রহস্য বটে। তাহলে কি মিলেভার কিছুটা হলেও অংশভাগ ছিল?” (পৃষ্ঠা-২৩)। এ প্রশ্নটার ভিত্তিও তথ্য-প্রমাদ প্রসূত। মিলেইভা পুরষ্কারের পুরো অর্থ পাবার শর্তেই আইনস্টাইনকে ডিভোর্স করেছিলেন। বিচ্ছেদের শর্ত অনুযায়ী আইনস্টাইন তাঁর নোবেল পুরষ্কারের পুরো অর্থই পাঠিয়ে দেন মিলেইভার হাতে ১৯২২ সালে। লেখক বলছেন, “স্বামী পরিত্যক্ত দুঃখময় জীবন নিয়ে নানা বিরূপতার সঙ্গে লড়তে লড়তে অবশেষে করুণ মৃত্যু ঘটে মিলেভার” (পৃষ্ঠা- ২৩)। মিলেভার মৃত্যু দুঃখজনক- তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু লেখক এজন্য পরোক্ষ ভাবে আইনস্টাইনকে দায়ী করেছেন। কিন্তু যে তথ্যগুলো উল্লেখ করেন নি মফিদুল হক তা হলো- আইনস্টাইন বিয়ে-বিচ্ছেদের পরও মিলেইভার নিয়মিত খবর নিয়েছেন। নোবেল পুরষ্কারের অর্থ দিয়ে মিলেইভা তিনটি বাড়ি কিনেছিলেন। দুটো বাড়ি ভাড়া দিয়েছিলেন, একটাতে নিজে থাকতেন। নিজে যেটাতে থাকতেন তা তিনি কিনেছিলেন আইনস্টাইনের নামে। যদিও আইনস্টাইন কেনার সময় তা জানতেন না। পরে জানার পরে তিনি বাড়িটা বিক্রি করে সব অর্থ মিলেইভার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আর যাদের কাছে বাড়িটি বিক্রি করেছিলেন- তাদের সাথে চুক্তি ছিল- মিলেইভা যতদিন বেঁচে থাকবেন সেই বাড়িতে থাকবেন বিনা ভাড়ায়। নতুন মালিক বাড়িটির অধিকার পাবেন মিলেইভার মৃত্যুর পর। ১৯৪৮ সালে মিলেইভার মৃত্যুর পর তাঁর বিছানার নিচে পাওয়া গিয়েছিল পঁচাশি হাজার সুইস ফ্রাঙ্ক।

“মানস পরীক্ষণের এক অসাধারণ কাহিনী”- সত্যিই অভিজিৎ রায়ের এক অসাধারণ লেখা। বিজ্ঞানের ভাষা যে কত প্রাঞ্জল আর আকর্ষণীয় হতে পারে তা অভিজিৎ রায়ের লেখার সাথে যারা পরিচিত তারা সবাই জানেন। এ লেখায় আইনস্টাইনের শৈশব থেকে শুরু করে আপেক্ষিকতার পৃথিবীবিখ্যাত আইনস্টাইন হয়ে ওঠার নানা ধাপ ফুটে উঠেছে ছন্দোময় গতিতে। আইনস্টাইনের মানস পরীক্ষণের বর্ণনা পড়তে পড়তে দেখা যাবে মুগ্ধ পাঠক নিজের অজান্তে নিজেই শুরু করে দিয়েছেন আইনস্টাইনের মানস পরীক্ষণের পুনরাবৃত্তি। ভাষার সাবলিল গতির কারণে আইনস্টাইনের তত্ত্বের জটিল গ্রন্থি খুলে গেছে সহজেই। ছোট্ট একটা ব্যাপার এখানে উল্লেখ করছি তা হলো আইনস্টাইনের বোনের নাম ‘মাজা’ নয়- মায়া (Maja)। ইউরোপের অনেক ভাষায় ‘j’ উচ্চারণ ‘য়’।

“আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব- নতুন শতাব্দীর আলোকে” প্রবন্ধে প্রফেসর আলী আসগর আলোচনা করেছেন আইনস্টাইনের General theory of relativity’র গোড়ার কথা। জেনারেল থিওরিকে বাংলায় ‘সাধারণ তত্ত্ব’ না বলে ‘সার্বিক তত্ত্ব’ বললে অনেক বেশি অর্থবহ হয়- যেমন বলেছেন অভিজিৎ রায় ও শামসুদ্দিন আহমেদ এই সংকলনে প্রকাশিত তাঁদের প্রবন্ধে। আলী আসগরের প্রবন্ধ সুলিখিত। ভাষার গাম্ভীর্যকে স্বীকার করে নিয়ে বলা যায়- আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্বের প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে তার পরীক্ষামূলক প্রমাণ সহ আইনস্টাইনের শেষ জীবন পর্যন্ত মৌলিক বল গুলোর সমন্বয়ের ব্যাপারে তাঁর গবেষণার কথা ধারাবাহিক ভাবে বর্ণিত হয়েছে। তবে লেখা ও চিত্রের সমন্বয়ের ব্যাপারে কিছুটা অসামঞ্জস্য রয়ে গেছে। ব্যবহৃত চিত্রে (পৃষ্ঠা-৪৫) নম্বর দেয়ার দরকার ছিল, তাহলে চিত্রের অবস্থান নিয়ে সমস্যা এড়ানো যেতো।

‘কালের প্রতিভা আলবার্ট আইনস্টাইন’ লিখেছেন বিজ্ঞান কর্মী নাসরিন সুলতানা মিতু। বলা হচ্ছে এটা অনুবাদ। কিন্তু কীসের অনুবাদ তা উল্লেখ করা হয়নি কোথাও। কোন কিছু অনুবাদের প্রথম শর্ত হলো মূল লেখার উৎস উল্লেখ করতে হবে। যাই হোক- লেখার গতি সাবলীল। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইনের জীবনের মোড় ঘুরে যাওয়া থেকে শুরু করে আণবিক বোমা প্রকল্পে আইনস্টাইনের তত্ত্বের প্রয়োগ পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে। অসাবধানতাবশত কয়েকটা জায়গায় কিছু ভুল রয়ে গেছে। যেমন বলা হয়েছে “দ্বিতীয় প্রবন্ধে তিনি প্রমাণ করেছিলেন পরমাণুর অস্তিত্ব” (পৃষ্ঠা-৪৮)। পরমাণুর অস্তিত্ব কিন্তু আইনস্টাইনের অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত। আইনস্টাইনের উল্লেখিত দ্বিতীয় প্রবন্ধটি ছিল ব্রাউনিয়ান গতি সম্পর্কিত। ৪৯ পৃষ্ঠায় আলোর গতি সম্পর্কে বলা হয়েছে “আলো সেকেন্ডে ২,৯৯,৭৯২,৪৫৮ কিলোমিটার বেগে চলে”। এখানে কিলোমিটারের জায়গায় মিটার হবে। সাধারণত সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার গ্রহণযোগ্য। ৫০ পৃষ্ঠায় আইনস্টাইনের নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তির সাল উল্লেখ করা হয়েছে ১৯১৪। আইনস্টাইন ১৯২১ সালের নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন ১৯২২ সালে।

“আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্বের ভিত্তিভূমি” আলোচিত হয়েছে শামসুদ্দিন আহমেদের ছোট্ট প্রবন্ধে। লেখক অল্প কথায় সোর্সবডি ও টেস্টবডির মধ্যকার ভর ও গতির আপেক্ষিকতা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। ‘জেনারেল থিওরি’র প্রতিশব্দ হিসেবে ‘সার্বিক তত্ত্বে’র ব্যবহার যথাযথ হয়েছে।

সংকলনের একেবারে ভিন্ন রকম লেখা হলো আহসান হাবীবের “আইনস্টাইন এবং অতপর”। আইনস্টাইনের চরিত্রের মজার মজার দিক উঠে এসেছে এই লেখায়। আইনস্টাইন খুব ভুলোমনা ছিলেন- এটার প্রমাণ খুব বেশি পাওয়া যায় না। লেখায় উল্লেখিত আইনস্টাইনের নিজের বাড়ি মনে করে ভুল করে অন্যের বাড়িতে ঢুকে যাওয়া, সে বাড়ির ভদ্রমহিলাকে নিজের বাড়ির পরিচারিকা মনে করা ইত্যাদি প্রচলিত গল্প জেনেও পড়তে ভালোই লাগে।

মুনির হাসান “আইনস্টাইন আমার আইনস্টাইন” প্রবন্ধে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্বের পরীক্ষামূলক প্রমাণের পর রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাবার কাহিনী বর্ণনার পাশাপাশি ১৯০৫ সালে প্রকাশিত আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের ব্যাখ্যাও করা হয়েছে সহজ ভাষায়। মুনির হাসানের লেখা সুখপাঠ্য এবং সহজে বোধগম্য।

খালেদা ইয়াসমিন ইতি “আলবার্ট আইনস্টাইনের জীবনপঞ্জি” সংক্ষেপে সংকলন করেছেন তাঁর প্রবন্ধে। ১৮৭৯ সালে জন্ম থেকে ১৯৫৫ সালে মৃত্যু পর্যন্ত বিভিন্ন বছরে আইনস্টাইনের উল্লেখযোগ্য অর্জন ও ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। ছোট্ট একটা তথ্য-বিচ্যুতি আছে। মিলেইভার সাথে আইনস্টাইনের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছিল ১৯১৪ সালে (পৃষ্ঠা-৬১) নয়, ১৯১৯ সালে।

ফাতেমা বেগম জুম্মি’র “স্বহস্তে লিখিত আইনস্টাইনের পান্ডুলিপি” ও তারেক অণুর লেখা “আইনস্টাইনের বাড়িতে” ছোট লেখা হলেও বেশ সাবলীল সুন্দর। তারেক অণু সুইজারল্যান্ডের বার্নে গিয়ে আইনস্টাইনের বাড়ির সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করে এসেছেন- সত্যিই প্রশংসার দাবীদার। আইনস্টাইনের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে লেখকের ছবিটা পাঠকের উপরিপাওনা।

পুরো সংকলনের সবচেয়ে বড় প্রবন্ধ (১৮ পৃষ্ঠা) প্রফেসর অজয় রায়ের “ভৌত বাস্তবতা- আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ”। এই প্রবন্ধে লেখক রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের সাক্ষাৎকারের পূর্ণ-বিবরণ, তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনার অন্তর্নিহিত ভাব, সাক্ষাৎকারের বাংলা অনুবাদ সহ ব্যাখ্যা করেছেন ভৌত বাস্তবতার প্রকৃতি, আইনস্টাইনের মৌলিক নীতি, স্থূল জগত ও আণুবীক্ষণিক জগতের দ্বন্দ্ব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে আলবার্ট আইনস্টাইনের কথোপকথনের বিষয়বস্তু সত্যিই চমৎকার। বিজ্ঞানীর দর্শন ও কবির বৈজ্ঞানিক সত্ত্বা
দুটো কীভাবে যেন এক সূতোয় গেঁথে গেছে। যদিও কিছু কিছু ব্যাপারে আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ একমত হতে পারেন নি, তাতেও দেখা গেছে চিন্তার নতুন দিক খুলে গেছে। বিষয়বস্তুর জটিলতার কারণে মাঝে মাঝে ভাষাও একটু জটিল হয়ে গেছে। যেমন- “পথে একটি বিশাল উষ্ট্র-পৃষ্ঠাকৃতির দ্রুতি নিরোধের সম্মুখীন হলো” (পৃষ্ঠা-৭৩)। প্রবন্ধটির বর্ণ-বিন্যাসে কিছু সমস্যা হয়েছে যা সম্পাদকের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। আইনস্টাইনের অনেক উদ্ধৃতি- কোন রকম উদ্ধৃতি চিহ্ন না থাকায় মূল লেখার সাথে মিশে গিয়ে মাঝে মাঝে সমস্যা তৈরি করেছে (পৃষ্ঠা-৭৪)। ৮০-৮১ পৃষ্ঠায় পাদটীকা মিশে গেছে মূল লেখার সাথে। ফলে মূল প্রসঙ্গের আগেই চলে এসেছে পাদটীকার ভাষ্য। বেশ কয়েক জায়গায় দু’রকম রেফারেন্সিং এর কারণে রেফারেন্স নম্বর আর পাদটীকা মিশে গেছে। ম্যাক্স বর্ন (Born) এর নামের বাংলা বানানের ভিন্নতার কারণে মূল অর্থ বদলে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যেমন- “যা আমি অনুধাবন করতে চাই, বলতে পারেন, অনেকটা বর্ণের মতো কল্পজাগতিক পদ্ধতিতে” (পৃষ্ঠা-৭৪)।

সৈয়দ তোশারফ আলী তাঁর “মানবতন্ময় বিজ্ঞানী আইনস্টাইন” প্রবন্ধে আইনস্টাইনের মানব কেন্দ্রিকতা ব্যাখ্যা করেছেন। এ প্রবন্ধে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সাথে সাথে তাঁর মানবিক দিকটাও ফুটে উঠেছে। লেখক প্রবন্ধটি শেষ করেছেন এভাবে- “তার প্রতি হৃদয়ের প্রগাঢ়তম শ্রদ্ধা জানাতে পারাটা সৌভাগ্যের ব্যাপার নিঃসন্দেহে” (পৃষ্ঠা-৮৭)। এখানে ভাগ্যের ব্যাপারটা কী কারণে এলো জানি না। কাউকে শ্রদ্ধা জানানোর সাথে ভাগ্যের সম্পর্ক কী? ‘সৌভাগ্য’ ‘দুর্ভাগ্য’ জাতীয় কিছু অবৈজ্ঞানিক শব্দ আমরা অসতর্কতার সাথে ব্যবহার করি- মাঝে মাঝে যেগুলোর কোন অর্থ হয় না।

আসিফের দুটো প্রবন্ধ আছে এই সংকলনে। প্রথমটা “কার্ল সাগানের দৃষ্টিতে সুবিধাজনক প্রসঙ্গ কাঠামো বলে কিছু নেই”-এ কিছুটা আইনস্টাইন সংশ্লিষ্টতা আছে। কার্ল সাগানের দৃষ্টিতে সুবিধাজনক কাঠামো বলে যে কিছু নেই- তা কিছুটা জটিল মনে হয়েছে আমার কাছে। তাছাড়া প্রসঙ্গটি কি সরাসরি কার্ল সাগানের নাকি আসিফের তাও ঠিকমত বুঝতে পারতে পারলাম না। কারণ লেখার কোন্‌ অংশটা কার্ল সাগানের রেফারেন্স থেকে এসেছে তা পরিষ্কার নয়। তবে এটা বোঝা যায় যে লেখাটার মূল উপাদান কার্ল সাগান থেকে নেয়া। প্রবন্ধে ব্যবহৃত চিত্রগুলোর নম্বর দিয়ে মূল লেখায় সে চিত্র-নম্বর উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করলে পাঠকের কিছুটা সুবিধা হতো। প্রবন্ধটার শেষ হয়েছে এভাবে- “বিশ্বের প্রত্যেকটি স্থান অন্যস্থানের মতোই শ্রেয় এবং সমকক্ষ। কোথা থেকে বর্ণনা করছে এটা কোনো ব্যাপার নয় প্রকৃতির প্রত্যেকটি নিয়মই অভিন্ন। যদি এটা সত্য হয় এবং মহাবিশ্বে আমাদের অতাৎপর্যপূর্ণ স্থানের ব্যাপারে বিশেষ কিছু থাকে তা হবে হতবুদ্ধিকর- তখন এটা অনুসরণ করে বা বলে যে কোন কিছুই আলোর চেয়ে দ্রুত গতিতে ভ্রমণ করতে পারে না” (পৃষ্ঠা-৯২)- ঠিক পরিষ্কার বোঝা গেল না।

মোস্তফা আমিনুর রশীদের “পদার্থবিজ্ঞানে ষষ্ঠ বিপ্লব” ঠিক আইনস্টাইন সংক্রান্ত নয়। জুলিয়ান বারবারের “The End of Time” অবলম্বনে সময়ের স্বরূপ নিয়ে কিছুটা তাত্ত্বিক আলোচনা করা হয়েছে। স্টিফেন হকিং তাঁর Brief History of Time- এর পুরো একটা অধ্যায় লিখেছেন Arrow of Time বা সময়ের একমুখী তীর প্রসঙ্গে। জুলিয়ান বারবারের “ষষ্ঠ বিপ্লব” দেখার জন্য আমাদের কতদিন অপেক্ষা করতে হবে আমরা এখনো জানি না।

রজনীশ রতন সিংহ লিখেছেন “পদার্থবিজ্ঞানের অর্জন দিয়ে কয়েক শতক প্রযুক্তি উন্নয়ন সম্ভব”। লেখক প্রবন্ধের শুরুতেই বলেছেন “জীববিজ্ঞানকে আগামী শতাব্দীর বিজ্ঞান হিসেবে গণ্য করা হলে পদার্থবিজ্ঞানে মানুষের এতদিনের বৃহৎ অর্জনকে খাটো করা হয়” (পৃষ্ঠা-৯৯)। ঠিক একমত হতে পারছি না, কারণ জীববিজ্ঞানের সাথে পদার্থবিজ্ঞানের কোন বিরোধ নেই। বরং এতদিন জীববিজ্ঞানে পদার্থবিজ্ঞানের ব্যবহার কম থাকলেও বর্তমানে জীব-পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্র প্রসারিত হচ্ছে দিনের পর দিন। প্রবন্ধে কোন রকম পরিচিতি ছাড়াই রিচার্ড ডকিন্স-এর একটা ছবি ও লার্জ হ্যান্ড্রন কোলাইডারের একটা ছবি ছাপানো হয়েছে (পৃষ্ঠা-১০০)। শেষোক্ত ছবিটি ১০৮ পৃষ্ঠায় আবার ছাপানো হয়েছে।

খালেদা ইয়াসমিন ইতি’র “২৪ কোটি আলোক বর্ষ দূরে দানবীয় এক বিস্ফোরণ” সংবাদ-পত্রের প্রতিবেদন আকারে লেখা। Big Bang-এর বাংলা বানান হওয়া উচিত বিগ ব্যাং- ‘ব্যাঙ’ নয়। কারণ ‘ব্যাঙ’-এর অন্যরকম একটা অর্থ আমাদের আছে। আসিফের দ্বিতীয় প্রবন্ধ “বিগব্যাঙ তত্ত্বের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু”-র ‘ব্যাঙ’ এর বেলাতেও এ’কথা প্রযোজ্য। আসিফের এই প্রবন্ধটির প্রথম অংশ লেখা হয়েছিল ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে। দ্বিতীয় অংশ লেখা হয়েছে আরো পরে। লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের বিস্তারিত বিবরণ আছে এ লেখায়। পরীক্ষণ প্রক্রিয়া এখনো চলছে। ফলাফল বিশ্লেষণ প্রকাশিত হতে আরো সময় লাগবে। হিগ্‌স বোসন বা গডস পার্টিক্যাল পাওয়া যাবে কি না প্রশ্নের উত্তর এখন সময়ের ব্যাপার।

সংকলনের শেষের দিকে ২০০৮ সালে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্ত বিজ্ঞানীদের জীবন ও অবদান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

এটা ঠিক যে- কোন সাময়িকীর একটা বিশেষ সংখ্যা দু’বার প্রকাশিত হয় না। এ সংখ্যার ভুলগুলো শুধরানোর কোন উপায় নেই, কিন্তু এ সংখ্যার ভুল থেকে সামনের সংখ্যার সতর্কতা সংকেত পাওয়া যাবে ভেবে কিছু জিনিস উল্লেখ করছি। বিশেষ সংখ্যায় লেখাগুলো নির্বাচনে কিছুটা পূর্ব-পরিকল্পনা থাকলে লেখার বিষয়-বৈচিত্র্য বাড়ে, একই তথ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটে না। যেমন বর্তমান আইনস্টাইন সংখ্যায় প্রধান সবগুলো লেখাতেই আইনস্টাইনের কিছু কিছু দিক বার বার আলোচিত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে একেক লেখককে একেক দিক নিয়ে লিখতে বললে এই পুনরাবৃত্তি এড়ানো যেতো।

এ সংখ্যার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো বানান বিভ্রাট। খুব কম পৃষ্ঠাই আছে যেখানে কোন বানান ভুল নেই। আসিফের নিজের প্রবন্ধের একটা পৃষ্ঠাতেই (পৃষ্ঠা-৮৮) ছয়টা ভুল বানান চোখে পড়ছে।

সবশেষে একটা সংশয়ের কথা না বললেই নয়। একটা বিজ্ঞান পত্রিকা যখন বের হয় তখন তার একটা টার্গেট গ্রুপ থাকে। মহাবৃত্তের টার্গেট গ্রুপ মানে পাঠক কারা? কাদেরকে বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে মহাবৃত্তের প্রকাশনা? সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে- “দেশের সর্বস্তরের বিজ্ঞান লেখক, গবেষক, চিন্তাবিদ, সকল বিজ্ঞান সংগঠন তথাপি বিজ্ঞানমনস্ক প্রতিটি ব্যক্তি ও সংগঠনের অংশগ্রহণে যে সংকলনটি দ্বারা নির্ধারণের চেষ্টা করা হবে দেশের বিজ্ঞান চর্চার মানদন্ড”। এরকম চিন্তা খুবই উচ্চাভিলাসী চিন্তা, কিন্তু খুব একটা বাস্তব চিন্তা নয়। কারণ একটা মাত্র সংকলনের পক্ষে সবার উপযোগী করে বিজ্ঞানের লেখা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সুতরাং অপ্রিয় হলেও সত্য যে আগে থেকে বিজ্ঞান-প্রেমিক না হলে মহাবৃত্তের বর্তমান সংখ্যাটি পড়ে নতুন করে কারো মনে বৈজ্ঞানিক-প্রেম জাগবে না। তাই মহাবৃত্তকে একটা টার্গেট-গ্রুপ নির্ধারণ করতে হবে। স্কুল-পড়ুয়া কিশোর-কিশোরীদের উপযোগী একটা লেখাও বর্তমান সংখ্যায় নেই। বিজ্ঞান-পত্রিকার লেখা প্রকাশিত হবার আগে প্রত্যেকটি লেখার রিভিউ হওয়া দরকার। তাতে লেখায় তথ্য ও তত্ত্বগত ভুল থাকার সম্ভাবনা কমে যায়।

সবশেষে শত প্রতিবন্ধক পেরিয়ে কোন রকম বিজ্ঞাপন ছাড়া মহাবৃত্তের মত একটা উঁচু মানের বিজ্ঞান সংকলন প্রকাশ করার জন্য আসিফকে আবারো অভিনন্দন, অভিনন্দন তাঁর ডিসকাশন প্রজেক্টের প্রত্যেক সদস্যকে।