শান্তি কমিটির পরিচয় এভাবেই তুলে ধরা হয়েছে ১৯৭১ সালে তৈরি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) এক রিপোর্টে। ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে এ রিপোর্ট দেয় সিআইএ। এতে বলা হয়, সামরিক বাহিনী (পাকিস্তানি) ও তার সহযোগীরা দিনের বেলায় অনেক শহর ও গ্রাম নিয়ন্ত্রণ করলেও পূর্ব পাকিস্তানের বেশির ভাগ এলাকায় ‘বিদ্রোহী’ অর্থাৎ মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা দমন করতে পারছে না।
এর আগে ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের এক গোপন দলিলে শান্তি কমিটিকে ‘সামরিক শাসনের প্রতীক’ আখ্যা দিয়ে এ কমিটি বিলুপ্ত করার সুপারিশ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের (এনএসসি) সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের (এসআরজি) জন্য রিপোর্টটি তৈরি করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নিকট-প্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ব্যুরোর সদস্য অ্যান্টনি কুয়াইনটন। পরদিন অর্থাৎ ৩০ জুলাই এসআরজির বৈঠকে রিপোর্টটি নিয়ে আলোচনা হয়। ওই গ্রুপের চেয়ারম্যান ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী) হেনরি কিসিঞ্জার। পররাষ্ট্র, অর্থ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তা এবং সশস্ত্রবাহিনী ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানরা এ গ্রুপের সদস্য।
পূর্ব পাকিস্তানে দুর্ভিক্ষ এবং পাকিস্তান-ভারত সম্ভাব্য যুদ্ধ ঠেকানোর লক্ষ্যেই মূলত রিপোর্টটি তৈরি করা হয়। এ ছাড়াও কয়েকটি লক্ষ্যের কথা উল্লেখ আছে ‘সিনারিও ফর অ্যাকশন ইন ইন্দো-পাকিস্তান ক্রাইসিস’ শিরোনামের ওই রিপোর্টে। লক্ষ্যগুলো হলো রাজনৈতিক মীমাংসার দিকে অগ্রসর হওয়ার বিষয়টিকে উৎসাহিত করা, পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) থেকে বাঙালিদের দেশত্যাগ করে শরণার্থী হওয়া থামানো এবং ভারত থেকে সীমান্তের এপার-ওপার তৎপরতার অবসান ঘটানো। এসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয় রিপোর্টে। সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল (ক) পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা, (খ) শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের মাধ্যমে যেন পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো না হয় তা নিশ্চিত করা, (গ) জেনারেল টিক্কা খানকে সরিয়ে জনগণের আস্থাভাজন কোনো বেসামরিক ও বিশিষ্ট বাঙালি নাগরিককে গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া এবং (ঘ) সামরিক শাসনের প্রতীক হয়ে ওঠা শান্তি কমিটি বিলুপ্ত করা।
রিপোর্টে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে বাঙালিদের দেশত্যাগ বন্ধ করার পাশাপাশি শরণার্থী প্রত্যাবর্তনও নিশ্চিত করতে হবে। আর শরণার্থীরা তখনই দেশে ফিরে আসতে আগ্রহী হবে, যখন তাদের জবরদখল ও লুট হওয়া সহায়-সম্পদ ফেরত পাওয়ার এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাবে। রিপোর্টে জোর দিয়ে বলা হয়, এমন ঘোষণা দিতে হবে যে, হিন্দুদের আর কোনো সহায়-সম্পত্তি মুসলমানদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হবে না এবং এরই মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া সম্পত্তি পূর্বতন মালিকদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে। বাঙালি, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট, জমিজমা ও অন্যান্য সহায়-সম্পদ কারা লুট করেছিল, সে বিষয়ে স্পষ্ট বিবরণ রিপোর্টটিতে না থাকলেও এটা যে শান্তি কমিটিরই কাজ তা এই রিপোর্ট পড়ে বুঝতে অসুবিধা হয় না।
সাম্প্রদায়িক ডানপন্থী কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি যে বিহারিদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সিআইএর রিপোর্টে, বাঙালিদের ওপর সেই বিহারিদের নৃশংসতার বর্ণনা আছে অন্য মার্কিন দলিলেও। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার কনসাল জেনারেল আর্চার কে ব্লাড ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দপ্তরে যে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন, তা নিয়ে আগেই পত্রপত্রিকায় প্রতিবেদন বেরিয়েছে। তবু প্রাসঙ্গিক হওয়ায় একটি অংশ এখানে উল্লেখ করা হলো। ‘সিলেকটিভ জেনোসাইড’ অর্থাৎ বেছে বেছে গণহত্যা শিরোনামের ওই টেলিগ্রাম বার্তায় বলা হয়, ‘পাকিস্তানি সৈন্যদের মদদে অবাঙালি মুসলমানরা পরিকল্পিতভাবে দরিদ্র জনগণের বাসাবাড়িতে হামলা চালাচ্ছে। হত্যা করছে বাঙালি ও হিন্দুদের।’
সেনাবাহিনীর হিসাবে ভুল : যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন সমঝোতার যে চেষ্টা একাত্তরে চালিয়েছিল, সেটা বাঙালিদের প্রতি কোনো মানবিক কারণে নয় বরং নিজেদের স্বার্থে। ওই সময়ের মার্কিন দলিলপত্রে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই পাকিস্তানি বাহিনীর সম্ভাব্য সাফল্য নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠতে থাকে মার্কিনিরা। ফলে এ অঞ্চলে তাদের স্বার্থ রক্ষা কিভাবে হবে, সে হিসাব শুরু করে তারা।
১২ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখের সিআইএ রিপোর্টে বলা হয়, ২৫ মার্চ সামরিক অভিযান শুরু করার সময় পশ্চিম পাকিস্তানি সমরনায়করা সম্ভবত মনে করেছিলেন, আওয়ামী লীগকে গুঁড়িয়ে দিয়ে পূর্ব বাংলার কার্যকর নিয়ন্ত্রণ পেতে তাদের কয়েক ঘণ্টা কিংবা বড় জোর কয়েক দিন লাগবে। তাদের সেই হিসাব সম্ভবতই ভুল ছিল।
এই পর্বটিও তথ্য সমৃদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা দিকের উন্মোচন এতে আছে। একই সঙ্গে পাক সেনা ও রাজাকার বাহিনীর বর্বরতাও স্পষ্ট।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা তথা ইতিহাসকে আরো সমৃদ্ধ করার জন্য চন্দন দা’কে অনেক ধন্যবাদ। :yes: