রোকেয়াঃ অন্য আলোয় দেখা

 

মুক্তমনায় স্বাক্ষর শতাব্দের বেগম রোকেয়াঃ পুনপাঠ আবশ্যক নামে চমৎকার একটি চিন্তা-জাগানিয়া প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ওই প্রবন্ধে গত রাতে একটি মন্তব্য করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার মাত্রা এবং পরিমিত জ্ঞানের অভাবে সেই মন্তব্য এমনই বিশাল আকার ধারণ করলো যে ওখানে আর দেওয়াটা সঠিক হবে কি না বুঝতে পারলাম না। প্রবন্ধের চেয়ে মন্তব্য যদি তিনগুণ বড় হয় তাইলে ক্যামনে হয়? সে কারণেই এটাকে আলাদা লেখা হিসাবে পোস্ট করলাম। রোকেয়ার সঠিক মূল্যায়ন হোক এ বিষয়ে যেহেতু স্বাক্ষর আর আমার মধ্যে কোনো মতের অমিল নেই, সেহেতু আশা করছি যে স্বাক্ষর এতে কিছু মনে করবেন না। ।

 

বেগম রোকেয়ার সম্পূর্ণ রচনাবলী, তাঁর ধ্যান-ধারণা  ইত্যাদি সম্পর্কে না জেনেই আমরা তাঁকে অনেক বিশেষণে ভূষিত করে রেখেছি। তাঁর একটা ভাবমূর্তি তৈরি হয়ে গিয়েছে আমাদের মনে। কিন্তু আসলে তিনি কী ছিলেন সে সম্পর্কে আমাদের আসলে যথাযথ কোনো ধারণাই নেই। তিনি কি ছিলেন নারীবাদী? নাকি পুরুষতন্ত্রের নিগড়েই বাঁধা ছিলেন? ছিলেন কি নারী শিক্ষার অগ্রদূত? নাকি পুরুষদের জন্য শিক্ষিত স্ত্রী তৈরিতে নিয়োজিত ছিলেন তিনি? ছিলেন কি ধর্মের কঠোর সমালোচক? নাকি ছিলেন ধর্মবাদী? ছিলেন কি বিপ্লবী? নাকি ছিলেন একজন আপোষকামী সমাজকর্মী? পুরুষতন্ত্রের বাঁধানো ছকের মধ্যেই ছুটোছুটি করেছেন তিনি? এর বাইরে যাবার সাহস তাঁর হয় নি?

 

বেগম রোকেয়ার মূল্যায়ন সবচেয়ে ভালভাবে করেছেন দুজন ব্যক্তি। এর মধ্যে একজন হচ্ছেন হুমায়ুন আজাদ। তিনি তাঁর নারী গ্রন্থের পুরুষতন্ত্র ও রোকেয়ার নারীবাদ অধ্যায়ে বেগম রোকেয়াকে নারীবাদী হিসাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলেছেন। প্রশংসার এমন কোনো বিশেষণ নেই যা প্রয়োগ করেন নি। পুরুষতন্ত্রের সাথে বাধ্য হয়ে সামান্য কিছু সন্ধির বিষয়কে উপেক্ষা করে তাঁর চোখে বেগম রোকেয়া ছিলেন পৃথিবীর এক শ্রেষ্ঠ নারীবাদী। পিতৃ ও পুরুষতন্ত্রকে ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ করে রোকেয়া একে বিপর্যস্ত করে রেখে গেছেন বলেই তিনি মনে করেছেন। তিনি রোকেয়াকে মুল্যায়ন করেছেন এভাবেঃ

 

রোকেয়া পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে চালিয়েছিলেন সার্বিক আক্রমণ। তিনি ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেছেন পুরুষতন্ত্রের তৈরি নারী ও পুরুষের ভাবমূর্তি, বর্জন করেছেন নারীপুরুষের প্রথাগত ভূমিকা; তুলনাহীনভাবে আক্রমণ করেছেন পুরুষতন্ত্রের বলপ্রয়োগসংস্থা ধর্মকে। রোকেয়া পরে ধর্মের সাথে কিছুটা সন্ধি করেছেন আত্মরক্ষার জন্যে; নইলে তাঁকে ও তাঁর আদর্শকে অত্যন্ত বিপন্ন করে তুলতো মুসলমান পিতৃতন্ত্র। তিনি এমন এক পিতৃতন্ত্রের সদস্য ছিলেন, যেখানে পুত্র মাকে শেখায় সতীত্ব।

 

অন্যজন হচ্ছেন হুমায়ুন আজাদেরই সুযোগ্য ছাত্রী আকিমুন রহমান। তিনি তাঁর বিবি থেকে বেগম গ্রন্থের স্বামীর ছাঁচে বিকশিত প্রতিভারা অধ্যায়ে বেগম রোকেয়া, নূরন্নেছা খাতুন, সুফিয়া কামালদের মত নারীবাদীদের তুলোধুনো করে ছেড়েছেন। তাঁর কাছে রোকেয়া স্ববিরোধিতায় পরিপূর্ণ এক নারী, পুরুষতন্ত্রের জুতোয় পা ঢোকানো নারী ছাড়া আর কিছু নয়। নিজস্ব ভাবনায় স্বাধীনভাবে রোকেয়ার চিন্তাভাবনা পাখা মেলে নি, বরং স্বামীর ছাঁচেই নিজেকে নিরন্তর গড়ে তুলেছেন তিনি। আকিমুন রহমানের ভাষ্যতেইঃ

 

সীমাহীন স্ববিরোধ ও পুরুষতন্ত্রের প্রথা মান্য করার অন্য নামই হচ্ছে রোকেয়া। নারীর জীবন গড়ে তোলার কাজে নিবেদিত এক ব্রতী বলে মান্য হন রোকেয়া, তবে তাঁর নিজের জীবনকে নিজের ইচ্ছেমতো কাঠামো দেবার শক্তি ও ইচ্ছেই তাঁর মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না। তাঁর নিজের জীবনই তাঁর নিজের তৈরি নয়। রোকেয়া নারীপ্রতিভা হিশেবে নন্দিত; রোকেয়া প্রতিভা ঠিকই, তবে স্বামীর ছাঁচে বিকশিত প্রতিভা। তিনি অভিজাত পুরুষতন্ত্রের কুপ্রথা ও অবরোধ পীড়নের বিরুদ্ধে মুখর, আর নিজের জীবনে অতিনিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন পতিপ্রভুর পরিয়ে দেওয়া শৃঙ্খল; আমৃত্যু নিয়ন্ত্রিত হন একটি শবদেহ দ্বারা। তাঁর বিবাহিত জীবন স্বল্পকালের, বৈধব্যের  কাল দীর্ঘ; স্বল্প বিবাহিত জীবন কাটে তাঁর মহাপাথরের বন্দনায় আর দীর্ঘ বৈধব্যের কাল কাটে মৃতি পতির তৈরি করে রেখে যাওয়া ছক অনুসারে। রোকেয়া বাঙালি মুসলমান নারীর জাগরণের জন্যে লিখে যান জ্বলাময়ী প্রবন্ধ আর নিজের জীবনে অনড় করে রাখেন অন্ধকার ও প্রথার মহিমা। রোকেয়া আদ্যপান্ত স্ববিরোধিতাগ্রস্ত। রচনায় তাঁর ক্ষোভ ও বক্তব্য বেজে ওঠে; ব্যক্তিজীবনে তিনি যাপন করেন প্রথাগ্রস্ত, বিনীত, মান্য করে ধন্য হয়ে যাওয়া জীবন। তাই তাঁর রচনাবলী থেকে চোখ ফিরিয়ে তাকানো দরকার তাঁর জীবনের দিকে; তবেই স্পষ্ট হয় উঠবে তাঁর সত্য পরিচয় ও ভূমিকা। রোকেয়া আমূল নারীবাদী শুধু কোনো কোনো বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশে, নতুবা জীবনাচরণে ও বিশ্বাসে রোকেয়া অতি প্রথা মান্যকারী স্ববিরোধিতাগ্রস্ত পতিপ্রভুর চিরবাধ্য ও অনুগত এক বিবি ছাড়া আর কিছু নয়।

 

মুক্তমনার ব্যানারে রোকেয়ার ধর্মগ্রন্থগুলো যে সব পুরুষরচিত এরকম একটি অসাধারণ উক্তি রয়েছে।

 

যখনই কোন ভগ্নী মস্তক উত্তোলনের চেষ্টা করিয়াছেন, অমনি ধর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচনরূপ অস্ত্রাঘাতে তাঁহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছেআমরা প্রথমতঃ যাহা মানি নাই, তাহা পরে ধর্মের আদেশ ভাবিয়া শিরোধার্য করিয়াছি আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগন ……ঐ ধর্মগ্রন্থগুলিকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রচার করিয়াছেনএই ধর্মগ্রন্থগুলি পুরুষরচিত বিধি-ব্যবস্থা ভিন্ন আর কিছুই নহে

 

এই লাইনগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে পড়লে রোকেয়াকে অগ্রসর চিন্তাভাবনার একজন যুক্তিবাদী মানুষ হিসাবে না ভাবাটাই অনুচিত। অথচ সেই একই রোকেয়া যখন বলেন যে প্রাথমিক শিক্ষা বলে যা কিছু শিক্ষা দেওয়া হয় তা কোরানেই আছে তখন বড়সড় ধাক্কাই খেতে হয়। মুসলমান বালিকাদের কোরান শিক্ষা দেওয়া সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মনে করতেন। বঙ্গীয় নারী-শিক্ষা সমিতির অভিভাষণ এ রোকেয়া বলেনঃ

 

মুসলমান বালিকাদের প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে কোরান শিক্ষাদান করা সর্বাপেক্ষা অধিক প্রয়োজন। . আপনারা কেহ মনে করিবেন না যে, প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে কোরান শিক্ষা দিতে বলিয়া আমি গোঁড়ামীর পরিচয় দিলাম। তাহা নহে, আমি গোঁড়ামী হইতে বহু দূরে। প্রকৃত কথা এই যে, প্রাথমিক শিক্ষা বলিতে যাহা কিছু শিক্ষা দেওয়া হয়, সে সমস্ত ব্যবস্থাই কোরানে পাওয়া যায়।

 

রোকেয়া যতই বলুক না কেন যে তিনি গোঁড়ামী হইতে বহু দূরে, আমরা কিন্তু ঠিকই তাঁর মধ্যে একজন গোঁড়া মুসলমানকে দেখে ফেলি। কোরান পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, মোল্লাদের এই ধারণার সাথে রোকেয়ার অসম্ভব মিল খুঁজে পেয়েও বিস্মিত হই আমরা।

 

পুরুষ লোক যে আই এ, বি এ পাশ বউ চায় এ ধরনের বিকৃত রুচির পিছনেও তিনি বর্তমান ধর্মহীন শিক্ষাকে দায়ী করেছেন। ধ্বংসের পথে বঙ্গীয় মুসলিম অভিভাষণে তিনি বলেনঃ

 

কোন ভদ্রলোক বায়না ধরেছেন যে আই এ পাশ পাত্রী চাই। কেউ চান অন্তত ম্যাট্রিক পাশ, তা না হলে তারা খ্রীস্টান বা ব্রাক্ষ্ম হয়ে যাবেন। এসব বিকৃত রুচির প্রধান কারণ বর্তমান ধর্মহীন শিক্ষা।

 

তবে এই সব ধর্মহীন বিকৃত লোকেরা যাতে হাতছাড়া না হয়ে বিদুষী ভার্যার হাতে পড়ে পাক্কা মুসুল্লী হয়ে ওঠেন সেই ব্যবস্থা করার জন্য তিনি নারীদের উপদেশ দেন।

 

উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত ভদ্রলোকের ঘরে এখন এম এ পাশ বউ না হলে আলো হয় না। কিন্তু এজন্যে সে বেচারাদের গালাগালি না দিয়ে বরং যাতে তাঁরা আমাদের হাতছাড়া না হন, তারই ব্যবস্থা করতে হবে। আমার আরো জানা আছে যে, অনেক বিকৃত-মস্তিষ্ক ধর্মহীন লোক উপযুক্তা বিদুষী ভার্যার হাতে পড়ে শুধরে গিয়ে চমৎকার পাকা মুসুল্লী হয়েছেন।

 

এই রকম পশ্চাদপদ চিন্তাভাবনা মনে হয় আজকালকার অশিক্ষিত মহিলারাও করে থাকেন। এই হচ্ছে আমাদের পৃথিবীর অন্যতম সেরা নারীবাদীর ভাবনা। কাজেই তার উদ্দেশ্য আর যাই হোক ভারতীয় মুসলমানের জন্য শিক্ষিতা বউ তৈরী করা ছিল না স্বাক্ষরের এই কথার সাথে রোকেয়ার ভাবনার একেবারেই মিল পাওয়া যায় না।

 

পুরুষদের শুধু পাক্কা মুসুল্লী বানিয়েই থেমে থাকেন নি রোকেয়া। আদর্শ মুসলিম বিদ্যালয় গড়ে নারীদেরকেও আদর্শ মুসলিম নারীতে গঠন করার ইচ্ছা পোষণ করেছেন তিনি। আর তাঁদের মিলনে জন্ম দিতে চেয়েছেন সেইসব সন্তান-সন্ততিদের যারা হবে  হযরত ওমর ফারুক আর হযরত ফাতেমা জোহরার মতোই পুন্যবান, ধার্মিক।

 

ফলকথা উপরোক্ত দুরবস্থার একমাত্র ঔষধ- একটি আদর্শ মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়.. আদর্শ মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়ে আদর্শ মুসলিম নারী গঠিত হবে যাদের সন্তান-সন্ততি হবে হযরত ওমর ফারুক, হযরত ফাতেমা জোহরার মতো।

 

এই যদি হয় সুলতানার স্বপ্ন, আর এই স্বপ্ন সত্যি হলে বঙ্গদেশ যে একটি তালেনবানি রাষ্ট্রে পরিণত হতো সে বিষয়ে নিশ্চয়ই কারো সন্দেহের অবকাশ থাকার কথা নয়।

 

রোকেয় শুধু নারীদেরকে শিক্ষিত পুরুষদের জন্য শিক্ষিত বউই হতে বলেন নি, তাদেরকে সুগৃহিনী হবারও উপায় বাতলে দিয়েছেন। পুরুষতন্ত্র নারীদের যে কয়েকটি ভূমিকা পালনে বাধ্য করে তার মধ্যে এটি অন্যতম। অথচ রোকেয়ার ধারণা ছিল যে নারীরা সুগৃহিনী হবার জন্য প্রবলভাবে ইচ্ছুক। কিন্তু কেউ-ই এখন পর্যন্ত সুগৃহিনী হতে পারে নি কারণ এর জন্য যে বিশেষ গুণের প্রয়োজন তা তারা অর্জন করতে পারে নি। নারীদের সুশিক্ষা অর্জন যে শুধুমাত্র সুগৃহিনী হবার নিমিত্তেই সে কথা বলতে তিনি ভোলেন নি।

 

বেশ কথাআশা করি আপনারা সকলেই সুগৃহিণী হইতে ইচ্ছা করেন, এবং সুগৃহিণী হইতে হইলে যে যে গুণের আবশ্যক, তাহা শিক্ষা করিতে যথাসাধ্য চেষ্টাও করিয়া থাকেনকিন্তু আজ পর্য্যন্ত আপনাদের অনেকেই প্রকৃত সুগৃহিণী হইতে পারেন নাইকারণ আমাদের বিশেষ জ্ঞানের আবশ্যক, তাহা আমরা লাভ করিতে পারি নাসমাজ আমাদের উচ্চশিক্ষা লাভ করা অনাবশ্যক মনে করেনপুরুষ বিদ্যালাভ করেন অন্ন উপার্জ্জনের আশায়, আমরা বিদ্যালাভ করিব কিসের আশায়? অনেকের মত আমাদের বুদ্ধি বিবেচনার প্রয়োজন নাইযেহেতু আমাদিগকে অন্নচিন্তা করিতে হয় না, সম্পত্তি রক্ষার্থে মোকদ্দমা করিতে হয় না, চাকরীলাভের জন্য সার্টিফিকেট ভিক্ষা করিতে হয় না, নবাব রাজা উপাধিলাভের জন্য স্বেতাঙ্গ প্রভুদের খোসামোদ করিতে হয় না, কিংবা কোন সময়ে দেশরক্ষার্থে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইতে হইবে নাতবে আমরা উচ্চশিক্ষা লাভ (অথবা Mental culture) করিব কিসের জন্য? আমি বলি, সুগৃহিণী হওয়ার নিমিত্তই সুশিক্ষা (Mental culture) আবশ্যক

 

 

সুগৃহিনীদের ঘরকন্নার কাজগুলোর তালিকা এবং সেই সাথে সাথে এগুলোকে সফল করার উপায়ও বাতলে দিয়েছেন তিনি। আসুন দেখি রোকেয়া বর্ণিত সুগৃহিনীদের ঘরকন্নার তালিকাগুলো কী কী।

 

ঘরকন্নার কাজগুলি প্রধানতঃ এই-
(
ক) গৃহ এবং গৃহসামগ্রী পরিস্কার ও সুন্দররূপে সাজাইয়া রাখা
(
খ) পরিমিত ব্যয়ে সুচারুরূপে গৃহস্থালী সম্পন্ন করা
(
গ) রন্ধন ও পরিবেশন
(
ঘ) সূচিকর্ম্ম
(
ঙ) পরিজনদিগকে যত্ন করা
(
চ) সন্তানপালন করা

 

পুরুষবাদী পুরুষেরাও মনে হয় না এরকম নির্লজ্জভাবে মেয়েদের ঘরকন্নার তালিকা তৈরি করে হাতে ধরিয়ে দেবে। সুশিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে সুগৃহিনী হওয়ার জন্য মেয়েদের উদ্দেশ্যে সবশেষে তিনি বলেছেনঃ

 

যদি সুগৃহিণী হওয়া আপনাদের জীবনের উদ্দেশ্য হয়, তবে স্ত্রীলোকের জন্য সুশিক্ষার আয়োজন করিবেন

 

রোকেয়ার মধ্যযুগীয় চিন্তাভাবনার সবচেয়ে প্রকট রূপ দেখা যায় তাঁর বোরকা প্রবন্ধে। হুমায়ুন আজাদ রোকেয়াকে তাঁর এই অসুস্থ চিন্তার জন্য বেশি কিছু বলেন নি। এটাকে পিতৃতন্ত্রের সাথে কিছুটা মিটমাটের উদাহরণ হিসাবে বলে চালিয়ে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু আকিমুন রহমান এই মধ্যযুগীয় ভাবনাকে দেখেছেন রোকেয়ার পুরুষতন্ত্রের নানা মাপের প্রভুর ধ্যান-ধারণা বিশ্বাস দ্বারা অনুপ্রাণিত হিসাবে। বোরকা যে মধ্যযুগীয় পিতৃতন্ত্র নারীর উপর চাপিয়ে দিয়েছে সেটাকে রোকেয়া অস্বীকার করেছেন অথবা বুঝতে পারেন নি। যে রোকেয়া অবরোধবাসিনীদের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখেছেন তিনিই পর্দার স্বপক্ষে সাফাই গেয়েছেন। বোরকাকে উন্নতির পথে বাধা হিসাবে দেখেন নি। বোরকা পরা নিয়ে তাঁর সমালোচনা করায় উষ্মা প্রকাশ করে তিনি বলেনঃ

 

তাঁহারা প্রায়ই আমাকে বোরকা ছাড়িতে বলেন। বলি, উন্নতি জিনিসটা কি? তাহা কি কেবল বোরকার বাহিরেই থাকে? যদি তাই হয় তবে বুঝিবে যে জেলেনী, চামারনী, কি ডুমুনী প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা আমাদের অপেক্ষা উন্নতি লাভ করিয়াছে।

 

রোকেয়া তাঁর মধ্যযুগীয় মানসিকতায় বুঝতে অক্ষম হয়েছে যে তাঁর মত শিক্ষিত মহিলার চেয়েও মানসিকভাবে ওই সমস্ত জেলেনী, চামারনী আর ডুমুনীরা এগিয়ে ছিলেন সমাজে। তাঁরা অন্তত বোরকার আড়ালে লুকোতে চায় নি শিক্ষিত নারীদের মত উন্নতির কথা বলে। সমমর্যাদা আদায় করে নিয়েই পুরুষের সাথে সমানতালে কাজ করে গিয়েছেন তাঁরা।

 

পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি যে মহিলাদের দায় এই পুরষবাদী মানসিকতা থেকেও উত্তরণ ঘটে নি রোকেয়ার। ফলে, বোরকার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখে এর থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে হবে এটাই ছিল তাঁর প্রস্তাবনা। এর জন্য সারা শরীর মুখ ঢাকা বোরকা পরে কুৎসিত জীব হতেও তাঁর আপত্তি ছিল না।

 

রেলওয়ে প্লাটফর্মে দাঁড়াইয়া কোন সম্ভ্রান্ত মহিলাই ইচ্ছা করেন না যে, তাঁহার প্রতি দর্শকবৃন্দ আকৃষ্ট হয়। সুতরাং ঐরূপ কুৎসিত জীব সাজিয়া দর্শকের ঘৃণা উদ্রেক করিলে কোন ক্ষতি নাই। রেলওয়ে ভ্রমণকালে সাধারণের দৃষ্টি (public gaze) হইতে রক্ষা পাইবার জন্য ঘোমটা কিম্বা বোরকার দরকার হয়।

 

এই রকম বক্তব্য যদি কোনো মহিলা বা পুরুষ বর্তমান যুগে এসে গীতা দি বা তসলিমা নাসরীনের সামনে করতো তাহলে কি দশা হতো সেটাই ভাবছি আমি। কোনো নারীবাদী বা নারী মুক্তির অগ্রদূতের কণ্ঠ নয়, যেন শুনছি ছাত্রী শিবিরের কোনো সক্রিয় সদস্যার কথা।

 

পর্দা করার ক্ষেত্রে অন্যায় পর্দা আর আবশ্যকীয় পর্দার এক হাস্যকর পার্থক্যও করেছেন রোকেয়া। পুরুষের চাপানো পর্দাতে আপত্তি তাঁর, সেটা অন্যায় বলে। আবার নিজের ইচ্ছাতে তিনি পর্দা করতে চান, বোরকার আড়ালে নিজেকে ঢেকে রাখতে চান সেটাকে আবশ্যিক বলে। বোরকা পরে চলাফেরায় কোনো অসুবিধা হয় না বলেই তিনি মনে করেন। বোরকাকে তিনি কিছুতেই ছাড়বেন না বলে রীতিমত ঘোষণাই দিয়েছেন তিনি।

 

আমরা অন্যায় পর্দা ছাড়িয়া আবশ্যকীয় পর্দা রাখিব। প্রয়োজন হইলে অবগুণ্ঠন (ওরফে বোরকা) সহ মাঠে বেড়াইতে আমাদের আপত্তি নাই। স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যে শৈলবিহারে বাহির হইলেও বোরকা সঙ্গে থাকিতে পারে। বোরকা পরিয়া চলাফেরায় কোন অসুবিধা হয় না।

 

এই রকম শৃঙ্খল আকাঙ্খী পর্দানশীন নারীবাদী থাকলে পুরুষবাদীদের আর কোনো চিন্তা আছে কি?

 

বোরকা ছাড়াতো বহু দূরের কথা। এর প্রেমে এমনই মশগুল তিনি যে একে আরো কীভাবে সৌন্দর্যমণ্ডিত এবং কারুকার্যময় করা যায় সে বিষয়েও তাঁর চিন্তার কমতি নেই।

 

সচরাচর বোরকার আকৃতি অত্যন্ত মোটা (Coarse) হইয়া থাকে। ইহাকে কিছু সুদর্শন (Fine) করিতে হইবে। জুতা কাপড় প্রভৃতি যেমন ক্রমশ উন্নতিপ্রাপ্ত হইয়াছে, সেইরূপ বোরকারও উন্নতি প্রার্থনীয়।

 

রোকেয়ার প্রার্থনা যে কাজে লেগেছে সেটা এখন ঢাকায় রঙ-বেরঙের কারুকার্যময় বোরকা পরিহিত মহিলাদেরকে দেখলেই বোঝা যায়।

 

পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে, পুরুষতন্ত্রের শেকল ভাঙার চেয়ে এটাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে পায়ে নুপুর হিসাবে পড়তে রোকেয়ার কোনো আপত্তিই ছিল না। রোকেয়ার এই শৃঙ্খল আকাঙ্খাকে তীক্ষ্ণভাবে বিদ্রুপ করেছেন আকিমুন রহমান।

 

রোকেয়া শৃঙ্খল মোচনের যোদ্ধা নন; নানারকম শৃঙ্খল নানাভাবে জড়িয়ে নেয়ার পরামর্শদাতা তিনি। বশীভূত আপোষকামী অ চিরমান্যকারী বলেই শেকলসহ কতো স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করা যায় তা তিনি জানান ও অন্যদের স্বচ্ছন্দে চলাফেরা শেখার জন্যে অনুশীলন করতে বলেন। শেকল নিয়ে তাঁর কোনো ক্ষোভ নেই, তবে শেকলের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যে তাঁর বেশ মাথাব্যথা আছে। তিনি চান শেকল থাকুক, কিন্তু ওই শেকল হয়ে উঠুক আরো সুদর্শন।

 

স্বাক্ষর রোকেয়াকে বিপ্লবী বলেছেন। কিন্তু আমার কাছে রোকেয়াকে বিপ্লবীতো অনেক দূরের কথা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোতে নিজের ভূমিকা সম্পর্কেই সচেতন ছিলেন না কি না সে বিষয়েই সন্দেহ জাগে। যে সমাজকে ভাঙতে চাচ্ছেন নারীর জন্য অশুভ সমাজ বলে, সেই সমাজেরই অশুভ নীতিমালাকে গলায় মালা করে গলাবাজি করছেন তিনি। অবরোধবাসিনীদের নিয়ে লিখেছেন, আবার নিজেই বোরকার আড়ালের অবরোধকে প্রমোট করার চেষ্টা করেছেন। এত বেশি স্ববিরোধী আচরণ করেছেন তাঁর কথা এবং কাজের যে, সত্যি সত্যি তিনি কি চেয়েছিলেন সে বিষয় নিয়ে যথেষ্টই সন্দেহ রয়েছে। তাঁর রচনা যে বিভ্রান্তি তৈরি করে সেই বিভ্রান্তি দূর না করেই আমরা তাঁকে নারী মুক্তির অগ্রসেনানী হিসাবে ঘোষণা দিয়ে ফেলেছি। অন্য নারীদের মুক্তিতো অনেক দূরের কথা, নিজেই নিজের সঠিক মুক্তি খুঁজতে তিনি পেরেছিলেন কি না সেটা নিয়েইতো সংশয় রয়েছে। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারী মুক্তিতে বরং ক্ষতিকর ভূমিকাই রেখেছেন তিনি। পুরষতন্ত্রের শেখানো বুলিকেই নারীবাদের ছদ্মমোড়কে নারীর সামনে পরিবেশন করেছেন তিনি।

 

স্বাক্ষরের সাথে একমত যে রোকেয়ার পুনঃপাঠ একান্ত আবশ্যক। রোকেয়া যেহেতু প্রচুর স্ববিরোধিতা করেছেন তাঁর রচনাবলীতে এবং এই স্ববিরোধিতা তাঁর জীবনাচরণেও স্পষ্ট, সে কারণে নারী মুক্তি এবং নারীবাদের ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থানকে সুস্পষ্ট করার জন্য পুনঃপাঠ ছাড়া বিকল্প আর কিছু নেই। পুনঃপাঠের মাধ্যমেই হয়তো পুনর্মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে রোকেয়াকে। তাঁকে ঘিরে যে সব মিথ গড়ে উঠেছে সেগুলোকে সরিয়ে দিয়েই তার আড়াল থেকে আবিষ্কার করা যাবে আসল রোকেয়াকে।

 

তথ্যসূত্রঃ

 

১। নারী হুমায়ুন আজাদ

২। বিবি থেকে বেগম আকিমুন রহমান

৩। রোকেয়া রচনাবলী