প্রকৃতিবাদ বনাম ভাববাদ
এম.এ কাদের
বিশ্ব জগতের মূল উৎস ও উপাদান কী? এই প্রশ্নে দার্শনিকগণ পরস্পর বিরোধী দু’টি তত্ত্বে উপনিত হয়েছেন। একটি প্রকৃতিবাদ ও অপরটি ভাববাদ। প্রকৃতিবাদ অনুসারে বস্তু জগতের মূল উৎস ও উপাদান হলো বস্তু অর্থাৎ একমাত্র বস্তুই স্বনির্ভর, এবং বস্তু ছাড়া যা কিছু সবই বস্তু নির্ভর। বস্তুই সব কিছুর মূল (Primary) এবং অন্য সবকিছু বস্তু থেকে উৎসারিত (Secondary)। বস্তু জগতের স্বক্রিয় ও স্বনিয়ন্ত্রিত গতিধারা সংক্রান্ত তত্ত্বই প্রকৃতিবাদ। প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে বস্তু ও শক্তি অভিন্ন হওয়ায় বস্তু জগতের সর্বপ্রকার ক্রিয়াশীলতা ও পরিববর্তনশীলতার জন্য প্রকৃতি দায়ী; এ জন্য প্রকৃতির বাইরের কোন শক্তি বা সঞ্চালক অপ্রয়োজনীয়। অন্যদিকে ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে বিশ্ব জগতের মূল উৎস ও উপাদান হলো পরম চেতনা। (পরমাত্মা, পরম মন)। পরম চেতনাই সত্তা। ভাববাদী তত্ত্বানুসারে একমাত্র পরম চেতনাই স্বনির্ভর অস্তিত্ব এবং অন্য সবকিছুর অস্তিত্ব পরম চেতনার অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল। পরম চেতনাই সবকিছুর মূল (Primary) এবং অন্য সবকিছু চেতনা উৎসারিত(Secondary) ।
বিজ্ঞান প্রকৃতিবাদের শ্রেষ্ঠ সন্তান, কারণ বিজ্ঞান প্রকৃতির (বাস্তব ঘটনাবলী ও অস্তিত্বের) প্রকৃতিবাদী ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ । অন্যদিকে বিশ্বাসতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ সন্তান ভাববাদ। কারণ ভাববাদ বিশ্বাসতন্ত্রের সার সংকলন।
প্রশ্ন আসে যে, বস্তু কী? মাটি, পানি, বায়ু, লোহা, পাথর এই যৌগিক ও মৌলিক পদার্থগুলো কী বস্তু? এগুলো বস্তু নয়; বস্তুর বিভিন্ন রূপ বা পদার্থ। পদার্থ ও প্রাকৃতিক ঘটনাধারার অন্তর্নিহিত স্বনির্ভর (সৃষ্টি ও ধ্বংস নিরপেক্ষ) অস্তিত্বই বস্তু। এখানে স্বনির্ভরতার অর্থ যার সৃষ্টি নেই; ধ্বংস নেই; বহিস্থ কারণ নেই কিন্তু অস্তিত্বশীল। উল্লেখ্য বস্তুর যেহেতু কোন নিজস্ব রূপ নেই, তাই বস্তু যখন যে রূপে বা পদার্থ রূপে থাকে তখন সেটাই তার রূপ।
প্রশ্ন আসে যে, বস্তু ও প্রকৃতির মধ্যে সম্পর্ক কী? বস্তুর স্বয়ংক্রিয়, স্বনিয়ন্ত্রিত ও স্বনির্ভর গতিধারাই প্রকৃতি। তাই বস্তু ও প্রকৃতির মধ্যে মূলতঃ কোন পার্থক্য নেই। একই অস্তিত্বের দুটি দিক ছাড়া কিছু নয়। একদিক থেকে দেখলে মনে হয় প্রকৃতি এবং অপর দিক থেকে দেখলে মনে হয় বস্তু। পদার্থ ও শক্তি এবং পানি ও বরফের মধ্যে যেমন মূলত: কোন পার্থক্য নেই, যতটুকু পার্থক্য তা নিতান্তই অবস্থাগত। বস্তু ও প্রকৃতির ক্ষেত্রেও ঠিক একই কথা প্রযোজ্য। এখন আমরা প্রকৃতিবাদ এবং ভাববাদের স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্যগুলো উপস্থাপন করছি:
প্রকৃতিবাদী তত্ত্বানুসারে জাগতিক সকল অস্তিত্বের উৎস ও মূল উপাদান হল বস্তু এবং ভাববাদী তত্ত্বানুসারে জাগতিক সকল অস্তিত্বের উৎস ও মূল উপাদান হল পরম চেতনা, পরম মন বা পরমাত্মা।
প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে একমাত্র বস্তুই স্বনির্ভর অস্তিত্ব। অপরদিকে ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে পরমাত্মাই একমাত্র স্বনির্ভর অস্তিত্ব। এজন্য ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে পরমাত্মাই পরম সত্তা এবং প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে বস্তু স্বনির্ভর হওয়ায় একমাত্র বস্তুই পরম স্বত্তা। বস্তু ছাড়া যা-কিছু, যেমন- স্থান-কাল, শক্তি, চেতনা, জীবন-মন, পরিবর্তন ইত্যাদির অস্তিত্ব বস্তুর অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে একমাত্র পরমাত্মাই স্বনির্ভর হওয়ায় পরমাত্মা ছাড়া যা কিছু, যেমন- বস্তু, স্থান-কাল, শক্তি, জীবন, মন, পরিবর্তন ইত্যাদি সবকিছুই পরমাত্মার অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল।
ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে বস্তু জগতের সবকিছু পরমাত্মা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়, অর্থাৎ বস্তুজগতের সৃষ্টি ও ধ্বংস সহ সকল রকমের পরিবর্তন পরমাত্মা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অন্যদিকে প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে বস্তু ও পদার্থ সহ যা কিছু আছে সবই বস্তু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও চালিত হয়, কারণ বস্তু ও শক্তি অভিন্ন।
প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে মানুষের চিন্তা-চেতনা, আবেগ-অনুভূতি ইত্যাদি বস্তু ও বস্তুগত পরিস্থিতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অন্যদিকে ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে চিন্তা-চেতনা দ্বারাই বস্তু ও বস্তুগত পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রিত হয়। অর্থাৎ প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে বস্তু ও বস্তুগত পরিবেশ পরিস্থিতি দ্বারা মানুষের চিন্তা-চেতনা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে চিন্তা-চেতনা দ্বারাই বস্তু ও বস্তুগত পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রিত হয়।
ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে বস্তু ও শক্তি দুটো ভিন্ন জিনিস। বস্তু জড় বিশেষ, কিন্তু শক্তি একটি অবস্তুগত জিনিস। শক্তি যখন বস্তুর উপর ক্রিয়া করে তখনি বস্তু সক্রিয় হয়ে ওঠে। অন্যদিকে প্রকৃতিবাদ অনুসারে বস্তু ও শক্তি ভিন্ন কিছু নয়। শক্তি ও বস্তুর মধ্যে মূলত: কোন পার্থক্য নেই। যেমন- পানি, বরফ ও বাষ্প। এদের মধ্যে মূলত: কোন পার্থক্য নেই। যতটুকু পার্থক্য তা নিতান্তই অবস্থাগত এবং বাহ্যিক। এ জন্য এরা পরস্পর রূপান্তরযোগ্য। বস্তু এবং শক্তিও তাই।
ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে শক্তি ও বস্তু ভিন্ন হওয়ায় বস্তু জড় বিশেষ। এজন্য জড়ের উপর শক্তি সক্রিয় হলেই জড় ও জড় জগতে পরিবর্তন আসে। এজন্য ভাববাদীরা জড়বাদী ও মৌলবাদী। অন্যদিকে প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসার শক্তি ও বস্তু অভিন্ন হওয়ায় বস্তু কোন জড় নয়, স্বয়ংক্রিয় সক্রিয় অস্তিত্ব বিশেষ। এজন্য প্রকৃতিবাদীরা জড়বাদী নয়; প্রগতিবাদী। ভাববাদীরা বস্তুজগতের স্বনির্ভর অস্তিত্বকে স্বীকার করে না। এ জন্য ভাববাদীরা নাস্তিক। অন্যদিকে প্রকৃতিবাদীরা বস্তু জগতের বাস্তব অস্তিত্বকে স্বীকার করে, এজন্য প্রকৃতিবাদীরা আস্তিক। অপর আর একটি যুক্তি অনুসারে ভাববাদীরা নাস্তিক। আর তা হল ভাববাদীরা যার অস্তিত্বই নেই তাকে পরম অস্তিত্ব বা সত্তা হিসেবে মনে করে, এ অর্থেও ভাববাদীরা নাস্তিক। অপরদিকে প্রকৃতিবাদীরা যার অস্তিত্বই নেই তার অস্তিত্বকে স্বীকার করে না, এ অর্থেও প্রকৃতিবাদীরা আস্তিক।
প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে বস্তু স্বয়ংক্রিয় ও সক্রিয় হওয়ায় বস্তুজগৎ গুণ ও পরিমাণগতভাবে পরিবর্তনশীল। এজন্য প্রকৃতিবাদীরা অভিব্যক্তিবাদী, কিন্তু ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে বস্তু জড় অস্তিত্ববিশিষ্ট হওয়ায় বস্তু জগৎ পরিমাণগতভাবে পরিবর্তনশীল হলেও গুণগতভাবে অপরিবর্তনীয়। এজন্য ভাববাদীরা অভিব্যক্তিবাদী নয়, জড়বাদী। উল্লেখ্য, অভিব্যক্তিবাদী তত্ত্ব অনুসারে জগৎ ও জগতের অন্ত:স্থ সবকিছুই, যেমন- বিভিন্ন প্রকৃতির জীব, যৌগিক পদার্থ, মৌলিক পদার্থ, গ্রহ নক্ষত্র, এমনকি এই মহাবিশ্বের সবকিছুই অভিব্যক্তির মাধ্যমে অস্তিত্ব লাভ করেছে। অন্যদিকে ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে বস্তু জগতের বহিস্থ এক পরমাত্মা দ্বারা জগৎ ও জগতের অন্ত:স্থ সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে, এজন্য ভাববাদীরা সৃষ্টিবাদী; অভিব্যক্তিবাদী নয়।
ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে বস্তু ও গুণ সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির জিনিস। এজন্য বস্তু ও গুণের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিদ্যমান। অন্যদিকে প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে গুণ ও বস্তু ভিন্ন কিছু নয়। বস্তু ছাড়া গুণ এবং গুণ ছাড়া বস্তুর পৃথক কোন অস্তিত্ব নেই। ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে গুণ ও বৈশিষ্ট্য অবস্তুগত ও ভাবগত একটি বিষয়, কিন্তু প্রকৃতবাদী তত্ত্ব অনুসারে গুণ কোন অবস্তুগত বিষয় নয়; গুণ নিজেই একটি বস্তুগত বিষয়। এজন্য প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে গুণ ও পরিমাণ পরস্পর রূপান্তরধর্মী।
ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে জীবন জীব কোষের কোন গুণ বা ধর্ম নয়। পরমাত্মা থেকে আসা একটি অলৌকিক ও অবস্তুগত শক্তি, কিন্তু প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে চেতনা বা মন পরমাত্মা থেকে আসা কোন অলৌকিক ও অবস্তুগত শক্তি নয়; বরং মস্তিস্ক কোষ থেকে আসা বস্তুগত একটি গুণ বা ধর্ম বিশেষ। তাই মস্তিষ্ক বিলীন হবার সাথে সাথেই মন বা চেতনার চির অবসান ঘটে। অন্যদিকে ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে মস্তিষ্ক কোষের অবসান হবার সাথে সাথে মন বা চেতনার চির অবসান ঘটে না, স্থানান্তরিত হয় মাত্র।
ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে মানুষের দেহের মধ্যে আত্মা নামক অবস্তুগত একটি অবিনাশী অস্তিত্ব আছে। মানুষের দেহের অবসানের পরেও আত্মার অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে। অন্যদিকে প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে মানুষের দেহের অবসানের সাথে সাথে জীবন, মন, চেতনা, ইত্যাদির চির অবসান ঘটে। আত্মা বলে অবিনাশী ও চিরন্তন কিছু নেই। কাজেই আত্মার অমরত্বের কোন প্রশ্নই ওঠে না।
ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে আত্মা অমর হওয়ায় দেহত্যাগের পরবর্তী ফলভোগের উদ্দেশ্যে আত্মা স্বর্গ অথবা নরকে অবস্থান করে। কিন্তু প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে আত্মা অমর নয়; তাই মৃত্যু পরবর্তী ফলভোগের কোন প্রশ্নই আসে না। প্রকৃতিবাদী দার্শনিকগণ বলেন, সমাজ দাস ও প্রভু শ্রেণীতে বিভক্ত হওয়ার পর দাসেরা যাতে প্রভু শ্রেণীর শাসন ও শোষণ মেনে নেয় সেই উদ্দেশ্যে ভাববাদী পণ্ডিতেরা অমরাত্মার ধারণার অবতারণা করেন। প্রকৃতিবাদী দার্শনিকরা আরো বলেন, মৃত্যু পরবর্তী ভাল থাকা খাওয়ার লোভ কিংবা ভীতি প্রদানের উপায় ও কৌশল হিসেবে অমরাত্মার ধারণার প্রবর্তন করা হয়।
ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে মানুষের বাস্তব জীবন নিশির স্বপন। পারলৌকিক জীবনই আসল জীবন এবং স্বর্গসুখ ভোগ করাই জীবনের পরমার্থ বা লক্ষ্য। তাই বাস্তব জীবনের দুঃখ-দুর্দশাকে উপেক্ষা করে পারলৌকিক জীবনের সুখ ভোগের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা প্রয়োজন। অন্যদিকে প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে পারলৌকিক জীবন স্বপ্নমাত্র, বাস্তব জীবনই আসল জীবন। তাই পারলৌকিক জীবনের ভরসায় না থেকে বাস্তব জীবনকে সমস্যামুক্ত ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ করে গড়ে তোলাই জীবনের লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন।
ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে ভাববাদীরা ভোগবাদী। কারণ ভোগ করা বিশেষত: স্বর্গসুখ ভোগ করাই জীবনের পরম পুরুষার্থ। এখানে বলা প্রয়োজন যে, ভাল মন্দ বিচার না করে নির্বিচারে সুখানুভব করার মানসিকতাই ভোগবাদ। উল্লেখ্য প্রকৃতিবাদীরা বলেন, ভাববাদীরা নিজেদের জীবনের ব্যাপারে ভোগবাদী হলেও সমাজে বঞ্চিত লোকদের জন্য ত্যাগবাদী তত্ত্ব প্রচার করে। এ জন্য ভাববাদীরা নিজেদের জন্য ভোগবাদী, কিন্তু বঞ্চিত জনের জন্য ত্যাগবাদী। অন্যদিকে প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে মানুষের জীবনের লক্ষ্য ভোগও নয়; আবার ত্যাগও নয়। বরং প্রয়োজন পূরণ ও ক্রমাগত সমস্যার সমাধানের মধ্য দিয়ে একটি স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ ও উপভোগ্য জীবন-যাপন করা। উল্লেখ্য যুগপৎ ভোগবাদ ও ত্যাগবাদের বিরোধিতার অর্থ এ নয় যে, সর্বত্রই সুখানুভবের বিপরীতে অবস্থান করতে হবে, কারণ ভোগবাদ ও সুখানুভব এক জিনিস নয়।
ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে প্রকৃতির জগৎ প্রাকৃতিক কার্যকারণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও মানুষের মনোজগৎ ও সামাজিক ক্রিয়াকর্ম কার্যকারণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, কিন্তু প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে মানুষের মানসিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডও কার্যকারণের অধীন।
প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে মানসিক ও সামাজিক ক্রিয়াগুলো বাস্তব কার্যকারণের আওতাধীন হওয়ায়, কারণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মানসিক ও সামাজিক সমস্যাগুলো দূর করা সম্ভব, কিন্তু ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে মানসিক ও সামাজিক সমস্যাগুলোকে কার্যকারণ তথা বিজ্ঞানের মাধ্যমে সমাধান অসম্ভব। সংগত কারণে এ জন্য প্রয়োজন কোন আদর্শ অনুসরণ ও অনুকরণের মাধ্যমে জীবনকে আদর্শের দিকে নিয়ে যাওয়া।
লক্ষ্য সাধনের উপায় হিসেবে প্রকৃতিবাদীরা কার্যকারণ তথা বিজ্ঞানের আশ্রয় গ্রহণ করে, কিন্তু ভাববাদীরা লক্ষ্য সাধনের উপায় হিসেবে নানারূপ আদর্শের কথা বলে এবং যে আদর্শকে রূপায়িত করার জন্য বিবিধ প্রকৃতির প্রথা-পদ্ধতি, আচার-অনুষ্ঠান, তন্ত্র-মন্ত্র, বল প্রয়োগ এবং খুব বেশি হলে প্রযুক্তির কথা বলে, কিন্তু বিজ্ঞানকে এড়িয়ে বলে।
আদর্শ রূপায়িত করার অন্যতম উপায়গুলো হল- বল প্রয়োগ (যেমন- আইন, নৈতিকতা, যুদ্ধ-বিগ্রহ)। এজন্য উদ্দেশ্য সাধনের উপায় হিসেবে ভাববাদীরা আইন, নৈতিকতা ও যুদ্ধ-বিগ্রহকে কাজে লাগায়। এভাবে এরা শক্তি, শাস্তি ও বল প্রয়োগের পথে অগ্রসর হয়, কিন্তু প্রকৃতিবাদীরা আদর্শ প্রতিষ্ঠার বিপরীতে প্রয়োজন পূরণ ও সমস্যার সমাধানের কথা বলে এবং সমস্যা সমাধানের উপায় হিসেবে সমস্যার কারণ নির্ণয় ও তা দূর করার পথে অগ্রসর হয়। উল্লেখ্য ভাববাদীরা ক্ষেত্র বিশেষে আংশিক কার্যকারণের প্রয়োগ ঘটায়, কিন্তু সামগ্রিক কার্যকারণের পথে অগ্রসর হয় না। কারণ বিজ্ঞানের পথ হল ঘটনার প্রকৃতি, প্রক্রিয়া ও সামগ্রিক কার্যকারণের পথ, কিন্তু প্রযুক্তি প্রায়শ: আংশিক কার্যকারণের উপর প্রতিষ্ঠিত।
সামাজিক ক্ষেত্রে ভাববাদীরা সব সময় নৈতিকতার পথে অগ্রসর হয়। যেমন- ভাববাদীরা কোন মানুষকে কথিত কোন অনৈতিক কাজের জন্য দায়ী ও দোষারোপ করে শাস্তিদানের প্রক্রিয়া অবলম্বন করে। কিন্তু প্রকৃতিবাদীরা সব ঘটনাকে কার্যকারণের দৃষ্টিতে দেখায় ব্যক্তি কোন খারাপ কাজ করলে ঐ কাজের কারণ খুঁজে বের করে তা দূর করার পথে অগ্রসর হয়। উল্লেখ্য, প্রথম পথটি হলো নৈতিকতার পথ এবং দ্বিতীয় পথটি হলো বিজ্ঞানের পথ।
ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে মানুষের জীবনের সব সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এজন্য এরা মানুষের জীবনের দুঃখ-দুর্দশা, দারিদ্র্য, কর্মহীনতা, অশিক্ষা, রোগ-শোক, বৈষম্য ইত্যাদিকে জীবনের স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে এবং এগুলোকে মেনে নেয়ার আহবান জানায়। কিন্তু প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে বিজ্ঞানের পথে মানুষের জীবনের সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব। এজন্য প্রকৃতিবাদীরা জীবনের সমস্যাগুলোকে মেনে না নিয়ে ক্রমাগত সমাধানের পথে অগ্রসর হবার আহবান জানায়। ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে পরম ভাবের সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রণ হিসেবে ভাগ্যের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এজন্য ভাববাদী দার্শনিকেরা বলেন, পৃথিবীতে মানুষের করার কিছুই নেই; আছে শুধু ভাগ্যকে মেনে নেয়া। কিন্তু প্রকৃতিবাদী দার্শনিকেরা বলেন, মানুষ শুধু বস্তুই নয়; শক্তি এবং চেতনাও বটে। তাই মানুষ তার শক্তি ও চেতনাকে প্রয়োগ করে তথাকথিত ভাগ্যের পরিবর্তন সাধন করতে পারে। উল্লেখ্য, ভাববাদীরা ভাগ্যকে মেনে নিয়ে সকল দুর্দশাকে মাথা পেতে নিয়ে স্বর্গসুখ লাভের জন্য প্রস্তুত থাকার আহবান জানায়। এর বিপরীতে প্রকৃতিবাদীগণ তথাকথিত ভাগ্যকে মেনে না নিয়ে বাস্তব জীবনকে সমস্যামুক্ত করার আহবান জানায়।
ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে মানুষের নীতি-ধর্ম, সমাজ ইত্যাদি অতি মৌলিক বিষয় হওয়ায় এগুলো চির অপরিবর্তনীয়। এজন্য ভাববাদীরা মৌলবাদী তথা জড়বাদী। কিন্তু প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে জগৎ ও জগতের সবকিছু পরিবর্তনশীল হওয়ায় নীতি-ধর্ম-আদর্শ, সমাজ ইত্যাদিও চির পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তন সার্বিক বিচারে প্রগতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এজন্য প্রকৃতিবাদীগণ প্রগতিবাদী; জড়বাদী অর্থাৎ মৌলবাদী নয়।
ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে বস্তু জগতের স্বনির্ভর, স্বতন্ত্র এবং নিজস্ব কোন অস্তিত্ব নেই। তাই বস্তু জগৎ সম্পর্কে নিশ্চিত জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়, কিন্তু প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে বস্তু জগতের নিজস্ব ও স্বনির্ভর অস্তিত্ব আছে। তাই বস্তু জগৎ সম্পর্কে নিশ্চিত জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে মানুষের পক্ষে নিশ্চিত জ্ঞান সম্ভব নয় এবং যা কিছু জানা যায় তাও নিশ্চিত নয়। এজন্য এরা তথাকথিত জ্ঞান অর্জনের জন্য গুরু, দেবতা, মহাদেবতা এবং কখনও ব্যক্তিগত অনুভূতি, দিব্যদৃষ্টি ও বিশ্বাসের কথা বলে। পক্ষান্তরে প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে পরীক্ষণ, নিরীক্ষণ, যুক্তি, অভিজ্ঞতা, প্রয়োগ ও এদের সমন্বিত পদ্ধতির মাধ্যমে নিশ্চিত জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব।
ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে যেহেতু মানুষের পক্ষে নিশ্চিত জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়, এজন্য আদর্শ এবং আদর্শ অনুকরণ ও অনুসরণ আবশ্যক। কিন্তু প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে নিশ্চিত জ্ঞান সম্ভব হওয়ায় আদর্শ, আদর্শ অনুসরণ, অনুকরণ অপ্রয়াজনীয়। সঙ্গত কারণে প্রকৃতিবাদীরা সকল প্রকার আদর্শ ও গুরুবাদিতার বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে।
কিন্তু প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে কোন বাস্তব বিষয় সম্পর্কে প্রমাণসিদ্ধ সত্য চিন্তা চেতনাই জ্ঞান, কিন্তু ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে দৈববাণী, শাস্ত্রীয় বচন, গুরু বচন, দিব্যদর্শন, ব্যক্তিগত অনুভূতি, বিশ্বাস, আত্মবিশ্বাস ইত্যাদি সবই জ্ঞান।
প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে মানুষের জীবনের লক্ষ্য প্রকৃতি, জীবন ও সমাজের সকল প্রতিকূলতাকে জয় ও প্রয়োজন পূরণের মাধ্যমে জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ করে তোলা, এজন্য প্রকৃতিবাদ একটি জীবনমুখী তত্ত্ব। কিন্তু ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে বাস্তব জীবন তেমন কিছুই নয়। তাই বাস্তব জীবনের মধ্যে নিজেদেরকে নিবদ্ধ না রেখে পারলৌকিকতার মধ্যে নিজেদেরকে নিবদ্ধ করা প্রয়োজন। এজন্য ভাববাদ একটি জীবনবিমুখী তত্ত্ব।
উল্লেখ্য, ভাববাদ ও প্রকৃতিবাদের দ্বন্দ্বের মীমাংসার জন্য সমন্বয়মূলক একটি তৃতীয় ধারার অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। এর মধ্যে একটি হলো নিরপেক্ষ অদ্বৈতবাদ। এই তত্ত্ব অনুসারে পরম সত্তা বস্তুও নয়; চেতনাও নয়। উল্লেখ্য এ ক্ষেত্রে পরম সত্তা চেতনা না হওয়ায় তা আবার বস্তুতে পরিণত হয়, কারণ প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে পরম সত্তার রূপ যাই হোক না কেন চেতনা নিরপেক্ষ হলেই বস্তু। এখানে প্রশ্ন আসতে পারে বিগব্যাং তত্ত্ব অনুসারে মহাবিস্ফোরণের পূর্বে স্থান-কালের ঊর্ধ্বে যে অস্তিত্ব থেকে মহাবিশ্বের উৎপত্তি তাকে কী বস্তু বলে আখ্যায়িত করা যায়? এ প্রশ্নের উত্তরে একজন প্রকৃতিবাদী বলবেন, অবশ্যই। কারণ পরম সত্তা যে রূপ বা প্রকারেরই হোক না কেন চেতনা নিরপেক্ষ ও স্বনির্ভর হলেই তা বস্তু।
অপর আর একটি সমন্বয়মূলক তত্ত্বানুসারে পরম সত্তা একই সাথে বস্তু ও চেতনা দুই-ই, আর এটা যদি সত্য হয় তবে আবারও তা ভাববাদে পরিণত হয়, কারণ এ ক্ষেত্রে পরম সত্তা পরম চেতনায় পরিণত হয় এবং এটা আর বস্তু থাকে না। ফলে সমন্বয়মূলক তত্ত্বেরও কোন অস্তিত্ব থাকে না।
এখন প্রশ্ন হলো ভাববাদ ও প্রকৃতিবাদের মধ্যে কোন্ তত্ত্ব সঠিক? এ বিষয়ে প্রকৃতিবাদীদের অভিমত এই যে, বস্তু একটি বাস্তব বিষয়। পদার্থের জগতের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বস্তুর প্রকাশ ঘটে। তাই বস্তুর অস্তিত্ব প্রমাণ সাপেক্ষ। কিন্তু পরমাত্মা বা পরম চেতনা বা পরম মন বাস্তব বিষয় নয় এবং বাস্তব জগতের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে এর বহি:প্রকাশ ঘটে না এবং তা প্রমাণ সাপেক্ষ নয়। তাই ভাববাদ কোন গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব হতে পারে না।
উল্লেখ্য প্রকৃতিবাদ ও ভাববাদের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে বিজ্ঞানের অবস্থান কী এ প্রশ্নের প্রথম উত্তর হলো যে, বিজ্ঞান যে কোন বাস্তব ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা প্রকৃতিগতভাবেই করে থাকে। এখানে অতিপ্রাকৃত ভাববাদের কোন স্থান নেই। কাজেই বিজ্ঞান সব সময় প্রকৃতিবাদী; অবশ্যই ভাববাদী নয়। বিজ্ঞান কখনই ভাববাদী হয় না; হতেও পারে না।
দ্বিতীয়ত: বিজ্ঞানের বুনিয়াদী তত্ত্বসমূহ যেমন- আপেক্ষিক তত্ত্ব, কোয়ান্টাম তত্ত্ব, অভিব্যক্তিবাদ, মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব, তাপগতিবিদ্যার সূত্র, বংশগতি তত্ত্ব ইত্যাদি সকল বৈজ্ঞানিক তত্ত্বই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রকৃতিবাদী অবস্থানকেই প্রমাণ করে; অলৌকিক, অতিপ্রাকৃত ভাববাদকে নয়।
যেমন- আপেক্ষিক তত্ত্বে স্থান-কাল-পদার্থ শক্তি সহ বস্তু জগতের সবকিছুকে আপেক্ষিক বলে প্রমাণ করা হয়েছে। এখানে পরম (absolute)) বা ধ্রুব বলে কিছু নেই। অর্থাৎ আপেক্ষিক সম্পর্কের জগতে অতিপ্রাকৃত ভাববাদী ব্যাখ্যার কোন স্থান নেই।
কোয়ান্টাম তত্ত্বে শক্তির প্রকৃতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, শক্তি যুগপৎ কণিকা ও তরঙ্গধর্মী। শক্তি কণিকা ঝাঁকে ঝাঁকে কণিকা-তরঙ্গ আকারে বিচ্ছুরিত হয়। শক্তিকে এখানে প্রকৃতিগতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অতিপ্রাকৃতিক ভাববাদের কোন স্থান এখানে নেই।
অভিব্যক্তিবাদে বলা হয়েছে যে, পৃথিবীতে জীব প্রজাতিসমূহের উদ্ভব ক্রমবিকাশের মাধ্যমে। অলৌকিকভাবে কোন পরমাত্মা জীবের প্রজাতিসমূহ সৃষ্টি করে বসেনি। এটা প্রজাতিসমূহের উদ্ভবের প্রকৃতিগত ব্যাখ্যা। তাই এখানে অতিপ্রাকৃত, অলৌকিক ভাববাদের কোন স্থান নেই। মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বে বলা হয়েছে যে, প্রায় ১৫০০ কোটি বছর পূর্বে অসীম ভর সম্পন্ন একটি বিন্দু থেকে মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি। শূন্য থেকে অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃতভাবে সৃষ্টি হয়নি। তাই এখানে অতিপ্রাকৃত ভাববাদের কোন স্থান নেই।
তাপগতিবিদ্যার সূত্রে বলা হয়েছে যে, বস্তু-শক্তির সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই, কিন্তু রূপান্তর হয় মাত্র। বস্তু-শক্তির কোন সৃষ্টি না থাকায় এর কোন সৃষ্টিকর্তাও নেই। এখানে বস্তু-শক্তিকে প্রকৃতিগতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখানে অলৌকিক কোন ভাববাদের কোন স্থান নেই।
বংশগতিবিদ্যার সূত্রানুসারে ক্রোমোজম ও প্রাকৃতিক পরিবেশ দ্বারা বংশগতি নিয়ন্ত্রিত হয়। অতিপ্রাকৃত পরমাত্মার কোন ভূমিকা এখানে নেই।
সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, বিজ্ঞানের সমস্ত বুনিয়াদী তত্ত্বই ঘটনাবলীর ব্যাখ্যাকে প্রকৃতিগতভাবেই করে। এখানে অলৌকিক, অতিপ্রাকৃত ভাববাদের কোন স্থান নেই।
প্রশ্ন আসে যে, তাত্ত্বিক যুক্তির বিপরীতে ব্যবহারিক জীবনের যৌক্তিকতায়- ভাববাদ ও প্রকৃতিবাদের মধ্যে কোনটি গ্রহণযোগ্য? অর্থাৎ কোন তত্ত্বটি জীবনমুখী এবং জীবনের বাস্তব সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে তার যথার্থতা যাচাই করে দেখা যেতে পারে। ভাববাদ ভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের ছত্রছায়ায় জীবনের নানাবিধ সমস্যার ও মানুষে মানুষে পর্বতপ্রমাণ বৈষম্যের স্বীকৃতি প্রদান করে; দুঃখ-দুর্দশা, বঞ্চনা ইত্যাদিকে মেনে নেয়ার অনুপ্রেরণা যোগায়। নিঃসন্দেহে এই বিষয়গুলো জীবনবিরোধী। ভাববাদ, মৌলবাদ তথা জড়বাদের স্বীকৃতি প্রদান করে এবং এই স্বীকৃতি জীবনের অগ্রগতি ও প্রগতিকে ব্যবহৃত করে; এটিও জীবনবিরোধী।
ভাববাদ কখনও ভোগবাদ এবং কখনও কৃচ্ছতাবাদের অনুগামী। ভাল-মন্দ বিচার না করে ভোগে জীবন ভাসিয়ে দেয়াই ভোগবাদ। বিচার-বিবেচনা না করে যে কোন ভোগকে ত্যাগ করাই কৃচ্ছতাবাদ বা ত্যাগবাদ। ভোগবাদ বা ত্যাগবাদ কোনটাই জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না। জীবনের লক্ষ্য জীবন সমস্যার সমাধান ও প্রয়োজন পূরণ করে জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় ও উপভোগ্য করে তোলা। ত্যাগবাদ ও ভোগবাদ উভয়েই এর বিরোধী। এ বিচারেও ভাববাদ জীবন বিরোধী। ভাববাদ বলে এ জীবন কিছুই না; একটি স্বপ্ন ও ছলনামাত্র। এ ধরণের কথা বলে ভাববাদীরা মানুষের বাস্তব জীবনকে গুরুত্বহীন ও অর্থহীন করে তোলে- এটিও জীবনবিরোধী। তদুপরি ভাববাদ জীবন সমস্যার সমাধানের জন্য বিজ্ঞান তথা কার্যকারণের পথে অগ্রসর না হওয়ায় সমস্যার কারণ ও তা প্রতিকার করতে পারে না। এদিক থেকেও ভাববাদ একটি জীবনবিমুখী তত্ত্ব।
অন্যদিকে প্রকৃতিবাদ মানুষের বাস্তব জীবনের সমস্যার কারণ নির্ধারণ ও তা দূর করার পথে অগ্রসর হয়। এতে মানুষের জীবন সমস্যামুক্ত, উপভোগ্য ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই ব্যবহারিক জীবনের যৌক্তিকতায় ভাববাদের তুলনায় প্রকৃতিবাদ যথার্থ অর্থেই গ্রহণযোগ্য- এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
পৃথিবীতে যত বাদ মতবাদ আছে তা দুই প্রকার-
1. প্রভূত্ববাদ
2. প্রবৃত্তিবাদ
প্রভূত্ববাদের যত ভুল ব্যবহার তা প্রবৃত্তিবাদেরই ফসল। ইহুদী, খ্রিস্টান, হিন্দু ইত্যদি ধর্মে শিরক প্রবৃত্তিবাদের কারণেই। আর যত ইজম চালু হয়েছে সবই প্রবৃত্তিবাদেরর শাখা-প্রশাখা।
প্রভূত্ববাদ নিন্দনীয় নয়; যতক্ষণ তা প্রবৃত্তিবাদ দ্বারা আক্রান্ত না হয়। কিন্তু প্রবৃত্তিবাদ আগা-গোড়াই নিন্দনীয়।
“ভাববাদী তত্ত্ব অনুসারে বস্তু জগতের সবকিছু পরমাত্মা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়, অর্থাৎ বস্তুজগতের সৃষ্টি ও ধ্বংস সহ সকল রকমের পরিবর্তন পরমাত্মা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। অন্যদিকে প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে বস্তু ও পদার্থ সহ যা কিছু আছে সবই বস্তু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও চালিত হয়, কারণ বস্তু ও শক্তি অভিন্ন।”
=================
তাহলে শক্তি কী জিনিস?
ইসলাম আমাকে বস্তু থেকে ও বস্তুর শক্তি থেকে উপকৃত হতে শিখিয়েছে। আর বস্তুর শক্তিদাতার প্রতি কৃতজ্ঞ ও সমর্পিত হতে।
=================
“প্রকৃতিবাদী তত্ত্ব অনুসারে একমাত্র বস্তুই স্বনির্ভর অস্তিত্ব।”
==================
কোনো বিজ্ঞানী আজ পর্যন্ত প্রমাণ করতে পারেনি- বস্তু স্বনির্ভর। আর এখানেই সবকিছুর সমাধান।
আর এ সমাধানের কোনো পথ ‘অক্ষম’ বিজ্ঞানের কাছে নেই। আছে শুধু ঈমানের কাছে। যে ঈমান বিশ্বস্ত পথে অর্জিত হয়।
যে ঈমানের পথ বিশ্বস্ত নয় সে ঈমান মুসলিমের নয়। এখানেই মুসলিম বিজ্ঞানের ব্যবহার করে- পথের বিশ্বস্ততা অর্জন করতে। এরপর সমর্পিত হয়। যেমন সমর্পিত হয় মানুষ বিজ্ঞানের কাছে, বিজ্ঞানের উপর শুধুই আস্থা ও বিশ্বাসের কারণে; একেবারে যাচাই-বাছাই ছাড়া।
================
“ভোগবাদ বা ত্যাগবাদ কোনটাই জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না। জীবনের লক্ষ্য জীবন সমস্যার সমাধান ও প্রয়োজন পূরণ করে জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় ও উপভোগ্য করে তোলা। ত্যাগবাদ ও ভোগবাদ উভয়েই এর বিরোধী। এ বিচারেও ভাববাদ জীবন বিরোধী। ভাববাদ বলে এ জীবন কিছুই না; একটি স্বপ্ন ও ছলনামাত্র। এ ধরণের কথা বলে ভাববাদীরা মানুষের বাস্তব জীবনকে গুরুত্বহীন ও অর্থহীন করে তোলে- এটিও জীবনবিরোধী। তদুপরি ভাববাদ জীবন সমস্যার সমাধানের জন্য বিজ্ঞান তথা কার্যকারণের পথে অগ্রসর না হওয়ায় সমস্যার কারণ ও তা প্রতিকার করতে পারে না। এদিক থেকেও ভাববাদ একটি জীবনবিমুখী তত্ত্ব।
অন্যদিকে প্রকৃতিবাদ মানুষের বাস্তব জীবনের সমস্যার কারণ নির্ধারণ ও তা দূর করার পথে অগ্রসর হয়। এতে মানুষের জীবন সমস্যামুক্ত, উপভোগ্য ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই ব্যবহারিক জীবনের যৌক্তিকতায় ভাববাদের তুলনায় প্রকৃতিবাদ যথার্থ অর্থেই গ্রহণযোগ্য- এ বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।”
================
এখানে প্রকৃতিবাদ বলতে যা দেখানো হচ্ছে তা মূলত ভোগবাদেরই ছলনা-শব্দ। এজন্যই তা মানুষের জীবনকে বিপথে ঠেলে দেয়।
“ জীবনের লক্ষ্য জীবন সমস্যার সমাধান ও প্রয়োজন পূরণ করে জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় ও উপভোগ্য করে তোলা”
জীবনের এ লক্ষ্যই বলে দিচ্ছে- প্রকৃতিবাদ আসলে ভোগবাদের খোলস।
আর “ভাববাদ বলে এ জীবন কিছুই না; একটি স্বপ্ন ও ছলনামাত্র। এ ধরণের কথা বলে ভাববাদীরা মানুষের বাস্তব জীবনকে গুরুত্বহীন ও অর্থহীন করে তোলে- এটিও জীবনবিরোধী।”
এখানে ভাববাদ বলে যদি ইসলামকে বোঝানো সঠিক হয় তাহলে বলব- আপনি ইসলাম সম্বন্ধে প্রায় অজ্ঞ। কারণ, জীবনকে অর্থপূর্ণ
করে তোলার ক্ষেত্রে ইসলামের চেয়ে আর কার অবদান বেশি বলে আমি মানতে পারি?
মুসলিম বিবাহ করে যিনা করে না; প্রকৃতিবাদী যিনা করে জীবনের কী অর্থ পেয়েছে? মুসলিম খায়, হারাম খায় না ( যে মুসলিম ইসলাম মেনে চলে) ; প্রকৃতিবাদীর প্রবৃত্তি হালাল-হারাম নির্ধারণ করে নিজ প্রবৃত্তির চাহিদা অনুযায়ী, তাই তো মদ, যিনা, সমকামিতা তার কাছে হালাল। যাইহোক একজন মুসলিমকে জীবনের কোন উপভোগ থেকে বঞ্চিত হতে হয়? একটিও নয়। যে উপভোগ যে পথে জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলে সে উপভোগই মুসলিম গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে যে উপভোগ যে পথে জীবনকে অর্থহীন করে তোলে সে উপভোগ ও পথকে মুসলিম এড়িয়ে চলে। এর অর্থই কি ‘জীবনকে গুরুত্বহীন ও অর্থহীন করে তোলা’? তাহলে কেন নয় ইসলামের পথে জীবনকে অর্থপূর্ণ করা? কেন মিছে লেকচার?
মুসলিমের জীবনের চেয়ে আর কার জীবন ‘স্বাচ্ছন্দ্যময় ও উপভোগ্য’?
ইসলাম কি বলে- “এ জীবন কিছুই না; একটি স্বপ্ন ও ছলনামাত্র ” ?! ইসলাম সম্বন্ধে ‘হাতি দেখতে কুলোর মত’ জাতীয় জ্ঞান থেকে এমন বাক্য ইসলাম সম্বন্ধে বলা যায়। (যদি এখানে ভাববাদ বলে ইসলামকে বুঝিয়ে থাকেন।)
যে সকল বিষয় জীবনকে অর্থহীন করে সেগুলোকেই কেবল ইসলাম ‘মরিচিকা ও ছলনা’ বলে জীবনকে অর্থপূর্ণ করার পথ সুগম করে। যে জীবন অনন্ত সফল জীবন লাভের মাধ্যম সে জীবনকে কীভাবে গুরুত্বহীন বলতে পারে ইসলাম?! খাবারের মাধ্যমে শক্তি অর্জন পরম লক্ষ্য হওয়ার অর্থ কখনোই খাবারের স্বাদ কোয়ালিটিকে গুরুত্বহীন করে না ইসলাম। বরং সে বলে একটির জন্য অপরটি প্রয়োজন। হাঁ, ইসলাম সে খাবার থেকে সতর্ক করে, যা শক্তি অর্জনের পথে বাধা।
কথাগুলো আরো বিস্তারিত লিখতে পারলে ভালো হত।
লিখলাম, যদি কারো উপকার হয়, কারো জীবন অর্থপূর্ণ হয়, কেউ জীবনের মানে খুঁজে পায়।
অন্যদিকে প্রকৃতিবাদ মানুষের বাস্তব জীবনের সমস্যার কারণ নির্ধারণ ও তা দূর করার পথে অগ্রসর হয়। এতে মানুষের জীবন সমস্যামুক্ত, উপভোগ্য ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।—কিন্তু কয়দিন? বেশিদিন তো না….মরার সময় প্রকৃতিবাদীরা চরম কষ্ট নিয়ে মারা যায়….কেউ আস্ত পাগল হয়ে (Friedrich Nietzsche), কেউ দিশেহারা হয়ে,কেউ না পাওয়ার চরম অতৃপ্তি নিয়ে (শামসুর রাহমান)…মানুষের জীবনটা যে খুবই ছোট্ট….তাই শুধুই প্রকৃতি নিয়ে পড়ে থাকলে নিশ্চিত অশান্তি আর অসীম অতৃপ্তি….আসলে দুটোই থাকতে হবে,একেবারে ব্রহ্মাচার্যও পালন করার দরকার নেই,আবার একেবারে প্রকৃতিবাদী হবার যুক্তি নাই….বিজ্ঞান দিয়েই এখন প্রমান করা যায় যে যেকোনো মুহুর্তেই মহাবিশ্ব বিধ্বংশ বিলীন হয়ে যেতে পারে…তাই শুধু প্রকৃতিবাদ মানুষের প্রশান্তি নিশ্চিত করতে চিরকালীন অক্ষম ! আপনি যে এই মুহুর্তেই মারা যাবেননা তা নিশ্চিত করতে এখনো পারেনি বিজ্ঞান বা প্রকৃতিবাদ কোনটাই…তাই প্রকৃতিবাদের ওপর ভরসা করে বেশিদিন জীবন উপভোগ করা যায় না…বয়স চল্লিশ পেরুলেই তো ডায়াবেটিস, স্পনডিলাইটিস , চালশে আরো একশ একটা অসুখ, অসুধেও একসময় আর কাজ হয়না….শুধু ভাববাদই পারে সেসময় একটু প্রশান্তি দিতে !
বিজ্ঞানকে বস্তুবাদী বলাটা আমার কাছে খণ্ডিত সংজ্ঞা মনে হয়। কারণ তখন “বস্তু” কি এ বিষয়ক জটিলতা চলে আসে। সহজতর সংজ্ঞা, বিজ্ঞান “পর্যবেক্ষণবাদী”, অর্থাৎ বিজ্ঞানের মতে পর্যবেক্ষণই সত্যের দিকে এগোবার একমাত্র উপায়। আগামী কাল উত্তর আকাশে যদি কিছু পরিমান “ভাব” সত্যিই ভেসে থাকতে দেখা যায়, তাহলে বিজ্ঞানীরা সবাই ভাববাদী হতে দ্বিধা করবেন না।
আরও কিছু বিচ্ছিন্ন মন্তব্য:
সব ভাববাদী পরমাত্মাকে জগতের বাইরের কিছু মনে করেন, এমন নয়। অনেকের মতে জগৎ পরমাত্মার অভিব্যক্তি।
ধর্মের উৎপত্তি এতই সরল হলে তো কথা ছিল না।
বুঝলাম না। কোথায় স্বর্গসুখ লাভ করা? পৃথিবীতেই? সব ভাববাদীই কি তাই মনে করেন? পরে অবশ্য কৃচ্ছতাবাদের কথা বলেছেন। কিন্তু পুরোটা পরিষ্কার হচ্ছেনা।
প্রকৃতিবাদের কথা জানিনা, কিন্তু বিজ্ঞানের সব জ্ঞানই সাময়িক, পর্যবেক্ষণের সাথে মিলে যায় তাই টিকে যায়। শতভাগ নিশ্চয়তার গ্যারান্টি বিজ্ঞানে নেই।
@রৌরব, ঠিকই বলেছেন, বিজ্ঞানের কাজ হলো পর্যবেক্ষণ করা । কিন্তু দর্শনের সংজ্ঞা হলো The investigation of causes and laws underlying reality. দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞান ও দর্শন পরস্পর সম্পূরক । কিন্তু বাস্তবে দৃশ্যমান হলো বস্তু । সাধারন ভাবে বস্তুর সংজ্ঞা হলো A substance of which all physical objects are made. বিজ্ঞান ও দর্শনের তত্ত্ব অনুযায়ী বস্তু প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হচ্ছে । দার্শনিক ভাষায় একে বলা হয় “বস্তু চলমান” । দর্শন শাস্ত্রেই প্রথম উল্লেখ হয় ধ্রুব সত্য বলে কিছু নেই । সব কিছুই স্থান, কাল ও পাত্রের উপর নির্ভরশীল, যা বিজ্ঞান কর্তৃক প্রমানিত হয় ।
দর্শন ও বিজ্ঞান অনুপস্থিত । নিজ অভিজ্ঞতা মানুষের একমাত্র সম্বল । আগুন কি সে জানেনা । তবে দেখেছে আগুনকে সব প্রানী ভয় পায় । সে ভয়কে দূর করে আগুনের কাছে গিয়ে দেখেছে, আগুন তাকে আক্রমন করেনা । তাই আগুনকে নিয়ন্ত্রনে আনার মধ্য দিয়েই অদৃশ্য শক্তির কল্পনা মানুষের মনে উদয় ।
লেখাটা ভালো লেগেছে।
ভাব বাদের কাজই তো শুধু গালে হাতের ঠেস দিয়ে ঈশ্বর ভাবনায় বিলীন হওয়া আর প্রকৃতি বাদের কাজ প্রকৃতির সাথে একাত্মতা বোধ করা। 😀