[মানুষের বিবর্তন নিয়ে লিখতে শুরু করার পর মনে হয়েছিল এভো ডেভোর মত এতো কাটিং এজ গবেষণাগুলো নিয়ে না লিখলে মানব বিবর্তনের অনেক কিছুই, বিশেষ করে বংশগতিয় ব্যাপারগুলোর অনেক কিছুই, ঠিক পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তবে লিখতে বসার পর ক্রমশ বুঝতে শুরু করলাম যে বিষয়টা যত সহজ মনে করেছিলাম আসলে কিন্তু তা নয়, সহজবোধ্য বাংলায় এ ধরণের জটিল বিষয় নিয়ে লেখা আসলে বেশ কঠিন। তাই আগের পর্বগুলোতে গবেষণাগুলোকে খুব সহজভাব উপস্থাপন করতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু তার ফলে যা হওয়ার তাই হল, বেশ কিছু কঠিন বিষয় এই শেষের পর্বে এসে এক সাথে লিখতে হল এবং লেখাটা আকারেও হাতীর মত সাইজ ধারণ করলো। যারা এতদিন কষ্ট করে এমন একটা খটমটে লেখা পড়েছেন, প্রশ্ন করেছেন এবং সাথে থেকেছেন তাদের সবাইকে ধন্যবাদ। ও হ্যা, প্রায় ভুলে যাচ্ছিলাম…… বিবর্তন নিয়ে লেখালিখির প্রতি শর্তহীনভাবে প্রগাঢ় ভালোবাসা দেখানোর জন্য লেখাটা শাফায়েতকে উৎসর্গ করা হল 🙂 ]

:line:

প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব

এইতো কয়েক দশক আগের কথা, গরিলা নয় বরং শিম্পাঞ্জির সাথে আমাদের বেশী মিল বা শিম্পাঞ্জির ক্রোমোজোম আর আমাদের ক্রোমোজমের মধ্যে এত সাদৃশ্য দেখে রীতিমত হইচই পড়ে গিয়েছিল। অথচ কি আশ্চর্য, একুশ শতকে পা রাখার আগেই আমাদের আলোচনার টপিকই উলটে যেতে শুরু করেছে। আমরা যেন আজ এক্কেবারে ভিন্ন মেরুতে দাঁড়িয়ে আছি! শিম্পাঞ্জির জিনোমের সাথে আমাদের জিনোমের ৯৮-৯৯% মিল আর কোন খবর নয়। যারা জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণায় নিয়োজিত আছেন তারা তো বটেই, এমনকি যারা এ বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন তাদের কাছেও আজ এই প্রশ্নগুলো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। জীববিজ্ঞানে আজ প্রাণের বিবর্তন নিয়ে আর কোন সন্দেহ নেই, প্রশ্ন নেই আমাদের এবং শিম্পাঞ্জির সাধারণ পূর্বপুরুষের অস্তিত্ব নিয়ে; আজ আমাদের গবেষণা এবং সংশয়গুলোর ধরণধারণই বদলে গেছে। এখন আমরা প্রশ্ন করছি, বংশগতীয়ভাবে এতই যদি মিল থাকবে তাহলে শিম্পাঞ্জির সাথে এত বাহ্যিক, শারীরিক, আচরণগত, বুদ্ধিবৃত্তিক পার্থক্য আসছে কোথা থেকে? প্রশ্নগুলো একদিকে যেমন প্রমাণ করে যে গুণগতভাবে বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের উত্তরণ ঘটে গেছে, আবার অন্যদিকে বোঝা যায় যে, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার জন্য বিজ্ঞানের এবং প্রযুক্তির যে অগ্রগতির দরকার ছিল তা হয়তো মোটে আমাদের হাতের মুঠোয় আসতে শুরু করেছে।

এই প্রশ্নগুলোই আগে যে কেউ করেননি তা বললে অবশ্য ভুল হয়ে যাবে। যারা করেছেন এবং যেভাবে করেছেন তার সাথে আজকের প্রশ্নগুলোর গুণগত এক বিশাল পার্থক্য রয়েছে। আগে যারা বিবর্তনে অস্বীকার করতেন, মানুষকে জীবজগতের অন্যান্য প্রাণীর সাথে এক করে দেখতে নারাজ ছিলেন তারাই এ ধরণের কথাবার্তা বলতেন। বলতেন মানুষ আর শিম্পাঞ্জী বা অন্যান্য নরবানরদের মধ্যে পার্থক্য ‘এতটাই বেশী’ যে, এদের পূর্বপুরুষ কোনভাবেই এক হতে পারেনা। প্রকৃতির অন্যান্য প্রাণীদের সাথে মানুষের বুদ্ধিমত্তা কোনভাবেই তুলনীয় নয়, ‘সৃষ্টির সেরা’ মানুষকে কোনভাবেই প্রকৃতির সাধারণ নিয়মের মধ্যে এক করে দেখা সম্ভব নয়, । হাক্সলী এবং ডারউইন যখন প্রথম মানুষকেও অন্যান্য প্রাণীর মতই প্রকৃতি এবং বিবর্তনের অংশ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন তখনও রীতিমত হইচই পড়ে গিয়েছিল।

11_human_chimp_sitting_sciam 

ছবিঃ সাইন্টিফিক আমেরিকানের সৌজন্যে (১৬)

কিন্তু বিবর্তন তত্ত্ব এবং তারই অংশ হিসেবে মানব বিবর্তনের প্রক্রিয়া আজকে এতটাই সুপ্রতিষ্ঠিত যে জীববিজ্ঞানীরা আজকে আর এ ধরণের প্রশ্নগুলো নিয়ে মাথা ঘামান না। আমাদের বিবর্তনের পথের অনেক অলিগলির সন্ধান হয়তো আমরা এখনও পাইনি কিন্তু মানুষ যে অন্যান্য প্রাণীর মতই বিবর্তিত হয়ে এখানে এসে পৌঁছেছে এটা নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশই নেই। দেড়শ বছর আগেই ডারউইন বলেছিলেন, আমাদের সাথে অন্যান্য প্রাণিদের বুদ্ধিমত্তার পার্থক্যটি আসলে মাত্রাগত, প্রকারগত নয় -তার দেওয়া এই অনুকল্পটি আজ বৈজ্ঞানিকভাবেই সুপ্রতিষ্ঠিত। এক দশকেরও বেশি আগে, সেই ১৯৯৮ সালে আমেরিকার ন্যশানাল আ্যকাডেমি অফ সায়েন্সেস একটি রিপোর্টের বক্তব্যে এই বিষয়টি সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়, ‘’ বৈজ্ঞানিকভাবে এখন আর মনে করা সম্ভব নয় যে, কোন জীব তার আগের কোন এক জীব থেকে বিবর্তিত হয়ে আসেনি, বা, অন্যান্য সব জীবের ক্ষেত্রে বিবর্তনের যে প্রক্রিয়াটা প্রযোজ্য সেই একই প্রক্রিয়ায় মানুষের উদ্ভব ঘটেনি’ [১৪]।

শুধু ফসিল রেকর্ডই নয়, জেনেটিক্স এবং অণুজীববিদ্যার গবেষণা থেকেই এটা সন্দেহাতীভাবেই প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, মানুষ এবং শিম্পাঞ্জি একই পূর্বপুরুষ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল প্রায় ৬০-৭০ লক্ষ বছর আগে। ২০০৫ সালে শিম্পাঞ্জি এবং মানুষের জিনোমের তুলনামূলক সংশ্লেষণের ভিত্তিতে পাওয়া গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, মানুষ বা শিমাঞ্জির জিনোমে প্রায় ৩০০ কোটি বা ৩ বিলিয়ন ডিএনএ বেস পেয়ার রয়েছে এবং দু’টি প্রজাতির মধ্যে যৌথভাবে হিসেব করলে প্রায় সাড়ে তিন কোটি বেস পেয়ারের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে (১৫)। অর্থাৎ, সার্বিকভাবে আমাদের জিনোমে বেস পেয়ারগুলোর মধ্যে অমিলের শতকরা পরিমাণ মাত্র দেড় ভাগের মত। প্রায় ৯৮.৫% এর এই সাদৃশ্যগুলো যেমন আমাদের সাথে শিম্পাঞ্জির সাধারণ পূর্বপুরুষের বিবর্তনের ধারাটিকে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে ঠিক তেমনি আবার আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে বাকি দেড় ভাগের মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে রয়েছে মানুষ এবং শিম্পঞ্জির মধ্যে পার্থক্যগুলোর চাবিকাঠি।

শিম্পাঞ্জির সাথে আমাদের জিনোমে এত মিল থাকা সত্ত্বেও বাহ্যিক এবং বুদ্ধিগতভাবে এতটা পার্থক্য কিভাবে হল, এই প্রশ্নটার উত্তর দেওয়ার মত ক্ষমতা বিজ্ঞানের ছিল না এইতো কিছুদিন আগে পর্যন্তও। ডারউইন তো জানতেনই না, বিংশ শতাব্দী জুড়ে বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতির পরেও কিন্তু পুঙ্খানুপু্ঙ্খভাবে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মত জ্ঞান এবং তথ্য আমাদের হাতে ছিল না। বিজ্ঞানের সাথে সাথে কম্পিউটার প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির কারণেই একবিংশ শতাব্দীতে এসে প্রথমবারের মত আমরা এ নিয়ে গবেষণা শুরু করার মত অবস্থায় এসে পৌঁছাতে শুরু করেছি। কিন্তু মানুষ নিয়ে সরাসরি যে কোন গবেষণাই যে অত্যন্ত ধীর গতিতে এগুবে সেটা মেনে নিয়েই আমাদের এগুতে হবে। কারণ, মানুষ নিয়ে গবেষণার বৈধতা নিয়েও আবার বেশ কিছু জটিলতা আছে, ইচ্ছা বা ক্ষমতা থাকলেও অনেক গবেষণাতেই চট করে হাত দেওয়া সম্ভব নয়। ফলের মাছি, মুরগী, ইদুঁর বা মাছের মত বিভিন্ন প্রাণীর ভ্রূণের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন জিনের এক্সপ্রেশন ঘটিয়ে জেনেটিক্স বা এভো ডেভোর যে সমস্ত গবেষণা করা হচ্ছে, সেটা তো আর মানুষের ভ্রূণতে করা সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরেও আমরা এগুচ্ছি, আধুনিক প্রযুক্তি এ ধরণের অনেক সীমাবদ্ধতাকেই আজ কাটিয়ে উঠতে সহযোগিতা করছে।

৬০ লক্ষ বছর আগে সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর মানুষ এবং শিম্পাঞ্জি যার যার মত বিবর্তিত হয়ে চলেছে। এই সময়ে আমাদের জিনোমের যে পরিবর্তনগুলো ঘটেছে সেগুলো মানুষের ‘বিশেষ’ বৈশিষ্ট্যগুলো বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। নিজেদের উৎপত্তির ইতিহাসটুকু জানার নিছক কৌতুহল থেকেই নয়, বিভিন্ন রোগের ওষুধ তৈরি এবং চিকিৎসার জন্যও বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞান আজ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। তাই আমরা দেখি, শুধু জীববিজ্ঞানীরাই নন, মেডিকেল ডাক্তার থেকে শুরু করে কম্পিউটার বিজ্ঞানী, পরিসংখ্যানবিদ পর্যন্ত বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার গবেষকেরাই মানুষের বিবর্তন নিয়ে বিভিন্ন গবেষণায় নিয়োজিত হচ্ছেন।

এমনি একজন বিজ্ঞানী ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার জৈব-পরিসংখ্যানবিদ ডঃ ক্যাথারিন পোলার্ড, ২০০৩ সাল থেকে শিম্পাঞ্জি জিনোম সংশ্লেষণ এবং বিশ্লেষণের কন্সোর্টিয়ামের অন্যতম গবেষক হিসেবে কাজ করে আসছেন। তিনি তার লেখা অত্যাধুনিক কম্পিউটার প্রোগ্রামগুলোর মাধ্যমে গত ৬০-৭০ লক্ষ বছরে আমাদের জিনোমের কোথায় কোথায় সর্বোচ্চ পরিমাণে পরিবর্তন ঘটেছে তা খুঁজে বের করার কাজে নিয়োজিত আছেন। ২০০৯ সালে সাইন্টিফিক আমেরিকানে তিনি এ নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেন (১৬)। তার সেই লেখাটি, ডঃ শন ক্যারলের লেখা বিভিন্ন বই এবং প্রবন্ধ এবং এভো ডেভো নিয়ে নোভায় প্রচারিত ভিডিওটিতে উল্লেখিত অত্যাধুনিক গবেষণাগুলোকে তুলে ধরবো এখানে। চলুন দেখা যাক এবং সেগুলো কিভাবে মানব বিবর্তনের বিভিন্ন ধাপ বুঝতে সহায়তা করছে ।

সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পর থেকে এই সময়টাতে আমাদের অর্থাৎ শুধুমাত্র Homo sapiens দের জিনোমে প্রায় দেড় কোটি বেস পেয়ারের পরিবর্তন ঘটেছে [১৬]। শতকরা হিসেবে এর পরিমাণ এক ভাগের অনেক কম হলেও ১৫ মিলিয়ন বা দেড় কোটি বেস পেয়ারের বিশ্লেষণ করা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। আর এর মধ্যে কোন কোন মিউটেশন বা পরিবর্তনগুলো আমাদের ‘মানুষ হয়ে ওঠা’র পিছনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে তা খুঁজে বের করা তো বলতে গেলে খড়ের গাদা থেকে সুই খুঁজে বের করার মতই দুঃসাধ্য একটি ব্যাপার। এখানে আরেকটা ব্যাপারও মনে রাখা দরকার। বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় বেশীরভাগ বিক্ষিপ্ত মিউটেশনই কিন্তু ক্ষতিকর নয়, তেমনি সেগুলো আবার তেমন কোন উপকারেও আসে না। নিরপেক্ষ এই মিউটেশনগুলো একরকম স্থির এবং নিয়ত গতিতে বাড়তে থাকে যা দিয়ে বিজ্ঞানীরা সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে আসা দু’টি প্রজাতির মধ্যে ভাগ হয়ে যাওয়ার সময় নিরূপণ করতে পারেন। কিন্তু কোন একটা বিশেষ জায়গায় যদি এই সাধারণ হিসেবের চেয়ে অনেক বেশী হারে মিউটেশন ঘটতে দেখা যায় তখন বোঝা যায় যে সেই বংশগতীয় বৈশিষ্ট্যগুলো ধণাত্মক নির্বাচনের(Positive Selection) মধ্যে দিয়ে গেছে বা যাচ্ছে। অর্থাৎ এই পরিবর্তনগুলো কোন না কোনভাবে প্রজাতিটির টিকে থাকায় বিশেষ সুবিধা দিয়েছে যার ফলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় এই পরিবর্তনগুলো শুধু যে টিকে গেছে তাইই নয় ত্বরান্বিতও হয়েছে। ডঃ পোলার্ড এই অসাধ্য কাজটি করতেই মনোনিবেশ করেছেন তার লেখা বিশাল কম্পিউটার প্রোগ্রামগুলো দিয়ে। এই দেড় কোটি ডিএনএর মধ্যে তিনি কিছু নির্দিষ্ট অনুক্রমের খোঁজ করে চলেছেন। তিনি ডিএনএর এমন অনুক্রমগুলো খুঁজছেন যেগুলো একদিকে শিম্পাঞ্জির চেয়ে আলাদা, অর্থাৎ সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার পরে মানুষের জিনোমে যাদের সর্বোচ্চ মিউটেশন ঘটেছে কিন্তু অন্যদিকে আবার বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় শিম্পাঞ্জি এবং অন্যান্য মেরুদন্ডী প্রাণীর জিনোমে তাদের মধ্যে তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি।

২০০৩ সালের নভেম্বর মাসে এল সেই প্রথম ইউরেকা মুহূর্তটি। মানুষের জিনোমের এই ১৫ কোটি বেস পেয়ারের মধ্যে সর্বোচ্চ-পরিবর্তনশীল সেই ডিএনএ অনুক্রমগুলোর লিষ্ট বের করার জন্য চূড়ান্ত প্রোগ্রামটা রান করা হল। যে কোন ডেস্কটপ কম্পিউটারে শিম্পাঞ্জি এবং মানুষের জিনোমের এই তুলনামূলক প্রোগ্রামটা চালাতে সময় লাগবে ৩৫ বছর, তার সুপার কম্পিউটারে তা রান করে ফেললো এক দুপুরেই এবং তার ফলাফল হল বিস্ময়কর। লিস্টের শীর্ষে অবস্থান করছে মানুষের ডিএনএর মধ্যকার ১১৮টি বেসের একটি অনুক্রম। বিভিন্ন প্রাণীর জিনোমের ডাটাবেসগুলো ঘেটে দেখা গেল যে, শুধু মানুষের জিনোমেই নয়, মুরগী, ইঁদুর এবং শিম্পাঞ্জিসহ অনেকের মধ্যেই ডিএনএর এই অনুক্রমটির অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে। অতীতের বিভিন্ন গবেষণায় মানুষের মস্তিষ্কের কোষে এই অনুক্রমটির কার্যক্রম দেখা গেছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। অনুক্রমটির নাম দেওয়া হয় হার১ (HAR1, Human Accelerated Region 1)। সেই দুপরটির কথা স্মরণ করে ডঃ পোলার্ড বলেন, ‘আমরা যেন লটারি জিতে গেলাম। সবাই জানেন যে, মানুষের মস্তিষ্ক শিম্পাঞ্জির মস্তিষ্কের চেয়ে আকারে, গঠনে এবং জটিলতায় সব দিক দিয়েই খুবই অন্যরকম। কিন্তু মানুষের মস্তিষ্ককে আলাদা করার পিছনে যে পার্থক্যমূলক বৈশিষ্ট্যগুলো কাজ করে তার বিবর্তনীয় প্রক্রিয়া এবং বিকাশ সম্পর্কে আমরা খুবই কম জানি। মানুষের এই সবচেয়ে রহস্যময় দিকটির উপর আলোকপাত করার জন্য হার১ কে বেশ সম্ভবনাময় মনে হচ্ছিল‘‘[১৬] ।

আসলেই হয়তো তাই, পরবর্তী গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফলগুলো যেন সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। মানুষ এবং শিম্পাজি বিবর্তনের পথে আলাদা হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কোটি কোটি বছর ধরে এই হার১ অনুক্রমটি যেন অলসভাবে ঘুমিয়ে ছিল। তারপর হঠাৎ করেই সে প্রবল বিক্রমে জেগে উঠেছে মানুষের জিনোমে। মুরগীর সাথে শিম্পাঞ্জির ( বা মানুষের) সাধারণ পূর্বপুরুষের বিভাজন ঘটেছিল প্রায় ৩০ কোটি বছর আগে। কিন্তু এদের জিনোমে হার১ অনুক্রমটির তুলনা করলে দেখা যায় যে এত কোটি বছরে পরিবর্তন ঘটেছে মাত্র ২টি অক্ষরের। বেশীরভাগ মেরুদন্ডী প্রাণীর জিনোমের ক্ষেত্রেও মোটামুটিভাবে একই কথা প্রযোজ্য। অথচ তুলনামূলকভাবে মানুষ আর শিম্পাঞ্জির জিনোমের মধ্যে এই দুটি অনুক্রমের মিউটেশনের পরিমাণ দেখলে অবাক না হয়ে উপায় থাকে না। অপেক্ষাকৃত অনেক কম সময়ের ব্যবধানে, মাত্র ৬০-৭০ লক্ষ বছরে পরিবর্তনের ঘটেছে শতকরা ১০%। অর্থাৎ, আমাদের জিনোমে হার১ অনুক্রমের ১১৮ টি বেসের মধ্যে ১৮ টি বেস বদলে গেছে, বিবর্তনীয় সময়ের স্কেলে বিচার করলে একে বেশ বড়সড় সাইজের মিউটেশন বলেই ধরে নিতে হয়। এ থেকে দু’টো অনুকল্প দাঁড় করানো যায় খুব সহজেই।

12_har1sequence_sciam_human_chick_chimp

ছবিঃ মানুষ, শিম্পাঞ্জি এবং মুরগীর জিনোমে হার১ অনুক্রমের তুলনামূলক চিত্র, সাইন্টিফিক আমেরিকানের সৌজন্যে (১৬)

প্রথমতঃ এই হার১ অনুক্রমটি আমাদের জিনোমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কোন ভূমিকা পালন করে। না হলে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় একে এত কোটি বছর ধরে প্রায় অপরিবর্তিতভাবে সংরক্ষণ করা হতো না। আর দ্বিতীয়তঃ গত কয়েক লক্ষ বছরে মানুষের জিনোমে এর যে দ্রুতগতিতে পরিবর্তন ঘটেছে তা থেকে এও বোঝা যায় যে, এই পরিবর্তনগুলো খুব সম্ভবতঃ ধণাত্মক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে বা যাচ্ছে এবং মানুষের বিবর্তনে এর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

পরবর্তী গবেষণাগুলো থেকে আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বের হয়ে আসতে শুরু করেছে। আমাদের মস্তিষ্কের বাইরের দিকের ভাঁজ হয়ে থাকা অংশটির নাম হচ্ছে সেরেব্রাল কর্টেক্স, আমাদের মস্তিষ্ক এবং বুদ্ধিমত্তার বিবর্তনে এই অংশটির একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ভাষা, সুর সৃষ্টি বা গণিত চর্চার মত ‘মানবিক’ ক্ষমতাগুলোর বিকাশের সাথে মস্তিষ্কের এই অংশটি ঘনিষ্টভাবে জড়িত বলে ধারণা করা হয়। শিম্পাজির সাথে আমাদের সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে ভাগ হয়ে যাওয়ার পরে আকার এবং জটিলতায় সর্বোচ্চ পরিমাণ পরিবর্তন ঘটেছে আমাদের মস্তিষ্কের, আর সেই মস্তিষ্কের মধ্যে সেরেব্রাল কর্টেক্সের পরিবর্তন ঘটেছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। আমাদের সেরেব্রাল কর্টেক্সকে যদি টেনে ফ্ল্যাট করে বিছিয়ে দেওয়া যায় তা হলে দেখা যাবে যে, তা চার পৃষ্ঠা জুড়ে জায়গা করে নিচ্ছে। আমাদের সবচেয়ে কাছের আত্মীয় শিম্পাঞ্জিদের সেরেব্রাল কর্টেক্স নেবে মাত্র এক পাতার সমান জায়গা, সাধারণ বানরেরটা নেবে একটি পোষ্টকার্ডের সমান আর ইদুঁরের ক্ষেত্রে তা নেবে মাত্র একটা স্ট্যাম্পের সমান জায়গা (১৭)। আর ২০০৫ সালের এক গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের এই হার১ অনুক্রমটি সেরেব্রাল কর্টেক্সের বিন্যাস এবং ছক তৈরিতে নিয়োজিত এক ধরণের নিউরনের উপর অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ভ্রূণাবস্থায় এই নিউরনগুলোতে একটু এদিক সেদিক হয়ে গেলে ‘স্মুথ ব্রেইন’ নামক একধরণের মারাত্মক জন্মগত ব্যাধি দেখা দিতে পারে। এমনকি বড় বয়সে সিজোফ্রেনিয়ার মত রোগ সৃষ্টিতেও এই নিউরনগুলোর ভূমিকা থাকতে বলে মনে করা হয়।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই হার১ অনুক্রমটি কিন্তু প্রোটিন তৈরিকারি জিন হিসেবে কাজ করে না, তারা শুধু আরএনএ কোড করে। ডঃ পোলার্ড যে ২০১ টি সর্বোচ্চ-পরিবর্তনশীল ডিএনএর অনুক্রম বা ‘হার’গুলোর এর লিষ্ট বের করেছিলেন, তার মধ্যে বেশীরভাগগুলোই কিন্তু প্রোটিন তৈরি করা জিন নয় বরং জিনের উপর নিয়ন্ত্রকের ভূমিকাপালনকারী বিভিন্ন ধরণের ডিএনএর অনুক্রম বা সুইচ। আমাদের মানুষ হয়ে ওঠার পিছনে যে সব ডিএনএর অনুক্রম বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করা হচ্ছে তাদের অনেকেই আসলে প্রোটিন তৈরি করা জিন নয়। এভো ডেভোর নিয়ে লেখা আগের পর্বগুলোতে যে সুইচগুলোর কথা আলোচনা করেছিলাম এদের অনেকেই সেরকম সুইচ বা আরএনএ কোড করা ডিএনএর বিভিন্ন অংশ। অর্থাৎ, আমাদের মানুষ হয়ে ওঠার পিছনের পরিবর্তনগুলো খুঁজে বের করতে হলে শুধুমাত্র প্রোটিন তৈরিকারি জিনগুলোর খোঁজ করলেই আর হচ্ছে না। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী জিনোমের অন্যান্য অংশগুলোর কার্যকারিতাও বুঝতে হবে। এতদিন আমরা প্রোটিন তৈরি করা শতকরা দেড় ভাগ জিন ছাড়া ডিএনএর বাকি অংশগুলোকে অনেকটা ‘জাঙ্ক’ বা অপ্রয়োজনীয় ডিএনএ বলে মনে করে এসেছি। গত দুই দশকে আনবিক জীববিজ্ঞানের সাথে সাথে কম্পিউটার প্রযুক্তির এহেন উন্নতি না ঘটলে আমাদের জিনোমের এই অংশগুলির ভূমিকা বুঝে ওঠা একরকম অসম্ভবই হয়ে দাঁড়াতো।

ডঃ পোলার্ডের বের করা সর্বোচ্চ পরিবর্তনশীল অনুক্রমগুলোর আশে পাশে যে জিনগুলো রয়েছে তার মধ্যে অর্ধেকের বেশী জিনই আমাদের মস্তিষ্কের বিকাশ, গঠন এবং কাজের সাথে জড়িত। তা তে অবশ্য অবাক হওয়ারও কিছু নেই, শিম্পাঞ্জির সাথে আমাদের সাধারণ পূর্বপুরুষের আলাদা হয়ে যাওয়ার পর আমাদের মস্তিষ্কের আকার বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩ গুণেরও বেশী, অন্যান্য প্রাইমেটদের তুলনায় মানুষের বুদ্ধিমত্তার বিবর্তনও ঘটেছে অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতিতে। তাই সর্বোচ্চ-পরিবর্তনশীল ডিএনএর অনুক্রমগুলোর লিষ্টে মস্তিষ্কের বিবর্তনের সাথে জড়িত জিন বা সুইচগুলো অন্তর্ভুক্ত থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক।

ডঃ পোলার্ডের লিষ্টের মধ্যে এমনি একটি উল্লেখযোগ্য জিন হচ্ছে ফক্সপি২(FOXP2) এবং এই জিনে মিউটেশন ঘটলে মানুষের ভাষা এবং কথা বলার ক্ষমতা বিঘ্নিত হয়। তিন প্রজন্ম ধরে এ ধরণের রোগে আক্রান্ত একটি পরিবারের জিনের উপর গবেষণার ফলে অনেক নতুন নতুন তথ্য জানা গেছে। শুধু ভাষাই নয় বরং ভ্রূণাবস্থায় মস্তিষ্কের আরও অনেক জায়গাতেই এই জিনটির সক্রিয়তা দেখা যায়। আগের লেখাগুলোতে উল্লেখিত জিনগুলোর মতই এটিও একটি টুল কিট বা নিয়ন্ত্রক জিন, এবং হ্যা, হক্স জিন বা প্যাক্স জিনের মতই মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাইমেট, ইঁদুর এমনকি পাখির মধ্যেও এই জিনটির অস্তিত্ব রয়েছে। অর্থাৎ, এই জিনটিও আমাদের জিনোমে নতুন করে উদ্ভাবিত হয়নি। ২০০৭ সালের এক তুলনামূলক গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, শুধু আমাদের মধ্যেই নয় নিয়ান্ডারথাল প্রজাতির জিনোমেও হুবুহু একই ভার্সান উপস্থিত ছিল। অর্থাৎ, নিয়ান্ডারথালদের সাথে আমাদের সাধারণ পূর্বপুরুষের ভাগ হয়ে যাওয়ার সময় হিসেব করে বলা যায় যে, প্রায় ৫ লাখ বছর আগেই এই জিনটির অস্তিত্ব ছিল আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে (১৬)। এদের জিনোমের সাথে তুলনামূলক গবেষণা থেকেও দেখা যাচ্ছে যে এর মধ্যে মিউটেশনের পরিমাণও আসলে খুবই নগন্য। শিম্পাঞ্জির জিনটির সাথে বেশ কয়েক জায়গায় পার্থক্য দেখা গেলেও আমাদের প্রোটিন প্রোডাক্টের মধ্যে মাত্র দু’টি মিউটেশন ঘটেছে। আর অন্যদিকে ওরাং ওটাং এর সাথে পার্থক্য দেখা যাচ্ছে ৩ টি এবং ইঁদুরের সাথে ৪টি পজিশনে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে যে, এই জিনটির আশে পাশে অবস্থিত ডিএনএর মধ্যে প্রোটিন কোডিং করে না এমন ধরণের বেশ কিছু সুইচ এবং ডিএনএর অনুক্রম রয়েছে যাদের মধ্যে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য মিউটেশন দেখা যাচ্ছে।

আমরা আগেই দেখেছি যে, হক্স, প্যাক্স৬ বা ফক্সপি২ এর মত মাষ্টার টুলকিট জিন বা নিয়ন্ত্রক জিনগুলোর প্রত্যকে যেহেতু একই সাথে জীবদেহের বিভিন্ন অংশের বিকাশে ভূমিকা রাখে তাই এত সহজে এদের মিউটেশন ঘটতে পারে না। শুধু তো তাই নয়, এরা আবার অন্যান্য অনেক জিনের কাজের উপর নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবও বিস্তার করে থাকে। তাই, এদের যে কোন একটাতে মিউটেশন ঘটলে দেহের বহু জায়গা এবং শারীরবৃত্তীয় কাজের উপর বড়সড় প্রভাব পরতে পারে এবং তার ফলাফল হতে পারে ভয়াবহ। প্রজাতির টিকে থাকায় খুব বড় ধরণের বাড়তি সুবিধা না পেলে বিবর্তনের ধারায় এধরণের প্রভাবশালী এবং অভিজাত জিনগুলোকে আসলে অপরিবর্তিতভাবেই সংরক্ষণ করা হয়, অর্থাৎ এদের মধ্যে খুব বেশী মিউটেসশন ঘটতে পারেনা। তাই ডঃ পোলার্ড বা ডঃ শন ক্যরলের মত বিজ্ঞানীরা এখন মনে করেন যে, এই জিনগুলোতে মিউটেশন ঘটার চেয়ে এদের উপর নিয়ন্ত্রণকারী সুইচগুলোতে মিউটেশন ঘটা এবং তাদেরকে প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় অর্থপূর্ণভাবে টিকিয়ে রাখা অনেক বেশী সহজ। কোন প্রজাতিতে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটার মধ্যে এদের ভূমিকাকে আর ছোট করে দেখার উপায় নেই। শুধু জিনগুলোর মধ্যকার মিউটেশনগুলোই নয় বরং তাদের আশে পাশে প্রোটিন কোডিং করে না এমন ধরণের ডিএনএ অনুক্রমগুলোর মধ্যেও আমাদের বিবর্তনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে (১৮)।

এতক্ষণ মস্তিষ্কের বিবর্তনের সাথে সম্পর্কযুক্ত কয়েকটি ডিএনএ অনুক্রমের উদাহরণ দেখলাম। ডঃ পোলার্ডের লিষ্টে কিন্তু এছাড়াও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুক্রম রয়েছে। সর্বোচ্চ-পরিবর্তনশীল ডিএনএর অনুক্রম বা ‘হার’গুলোর এর লিষ্টে দ্বিতীয় অনুক্রম বা হার২(একে HACNS1 ও বলা হয়) এর কথাই ধরা যাক। আমাদের হাত এবং বিশেষ করে বুড়ো আঙ্গুলের গঠন কিন্তু অন্যান্য সব প্রাইমেটদের থেকেই আলাদা। আর তার ফলেই আমরা এমন কিছু সুক্ষ্ম কাজ করতে পারি যা আমাদের খুব কাছের আত্মীয় নরবানরদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। আমরা দক্ষতার সাথে অস্ত্র বা হাতিয়ায় ব্যাবহার করতে পারি, কলম ধরতে পারি, তুলি দিয়ে ছবি আঁকতে পারি, কম্পিউটারের কি-বোর্ড টিপে ব্লগের পর ব্লগ লিখতে পারি। ভ্রূণাবস্থায় মানুষের জিনোমের এই হার২ এর এক্সপ্রেশান থেকে যাচ্ছে যে তারা বুড়ো আঙ্গুল এবং কব্জির গঠনে অংশগ্রহণকারি জিনগুলোর কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু শিম্পাঞ্জির জিনোমে যে হার২ এর অনুক্রমটি রয়েছে তা কিন্তু বুড়ো আঙ্গুল এবং কব্জির গঠনে তেমন কোন ভূমিকাই পালন করে না। এ ধরণের ডিএনএ অনুক্রমগুলোর কার্যক্রমের মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে রয়েছে আমাদের এই বিশেষ অপোসেবল বুড়ো আঙ্গুলের বিবর্তনের ইতিহাস।

এধরণের আরেকটি দ্রুত হারে পরিবর্তিত হওয়া জিন হচ্ছে AMY1 , আমাদের শারীরিক বিবর্তনই শুধু নয়, ব্যাবহারিক এবং সাংস্কৃতিক বিবর্তনেও প্রত্যক্ষ্যভাবে এর অবদান রয়েছে। আগুনের ব্যবহারের মতই কৃষিও আমাদের প্রজাতির বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কৃষির উদ্ভাবনের ফলে আমাদের সামনে ক্যালরি সমৃদ্ধ স্টার্চ জাতীয় খাদ্যের ভান্ডার উন্মুক্ত হয়ে গেছে। এই ধরণের খাদ্যগুলোর ব্যাপক ফলন এবং মজুদ গড়ে তুলতে না পারলে আমাদের আধুনিক সভ্যতাগুলোই হয়তো গড়ে উঠতে পারতো না। কিন্তু শুধুমাত্র সাংষ্কৃতিক পরিবর্তনের মাধ্যমেই তো খাদ্যভ্যাসের এই পরিবর্তন সম্ভব হয়নি, এর জন্য শারীরবৃত্তিয় কিছু পরিবর্তনেরও প্রয়োজন পড়েছে। আর সেখানেই বিশেষ ভূমিকা রেখেছে এই AMY1 জিনটি।

13_har1_foxp2_amy1-and-others_sciam

ছবিঃ সাইন্টিফিক ছবিঃ মানুষের দেহে সর্বোচ্চ পরিবর্তনশীল ডিএনএ অনুক্রমগুলোর উদাহরণ, সাইন্টিফিক আমেরিকানের সৌজন্যে (১৬)

মানুষের বিবর্তনের ধারায় এই জিনটির বেশ কিছু মিউটেশন যে ঘটেছে তাইই শুধু নয়, প্রাইমেটদের সাথে তুলনা করলে দেখা যায় যে, আমাদের জিনোমে এই জিনের অনেক বেশি সংখ্যক কপিও রয়েছে। অত্যাধুনিক কিছু গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, যে প্রজাতির মধ্যে যত বেশী এই AMY1 এর কপি রয়েছে তারা তাদের মুখে তত বেশী এমাইলেজ নামক এনজাইমটি নিঃসরণ করতে সক্ষম এবং তারই ফলশ্রুতিতে তারা তুলনামূলকভাবে বেশী স্টার্চ হজম করতে সক্ষম।এরকম আরেকটি জিনের উদাহরণ হচ্ছে LCT। মাত্র ৯০০০ বছর আগে এই জিনটির মধ্যে পরিবর্তনের কারণেই আমরা আজকে প্রাপ্তবয়ষ্ক অবস্থায়ও গৃহপালিত পশুদের দুধ খেয়ে হজম করতে পারি। বেশীরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণিতেই শুধুমাত্র শিশুরা দুধের মধ্যকার কার্বোহাইড্রেট ল্যাকটোজ হজম করতে সক্ষম। এই মিউটেশনটা না ঘটলে আমাদের পক্ষেও এই ল্যাকটোজ হজম করা সক্ষম হত না।

শুধু তো আমাদের নিজেদের উৎপত্তির গল্পটি জানার জন্যই নয় বরং নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যও আজ বিবর্তনের ইতিহাসটা জানা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। মানুষ, শিম্পাঞ্জি এবং অন্যান্য প্রাইমেটদের তুলনামূলক গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের জিনোমে এমন কিছু মিউটেশন ঘটেছে যেগুলো হয়তো আমাদের প্রজাতিতে আলজাইমারস বা ক্যান্সারের মত অসুখগুলোর জন্য দায়ী। এই ধরণের বেশ কিছু অসুখ শুধু আমাদেরই হয় বা আমাদের মধ্যে বেশী পরিমাণে হয়। অন্যান্য প্রাইমেটদের জিনোমের অপরিবর্তিত জিনগুলো কম কিংবা বেশী হলেও এই রোগগুলো প্রতিরোধ করতে সক্ষম। এইচাইভির মত রেট্রোভাইরাসের আক্রমণ প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। এ ধরণের অসুখগুলোর চিকিৎসা বের করতে হলে মানুষসহ বিভিন্ন প্রাইমেটদের মধ্যকার বিবর্তনীয় সম্পর্ক এবং জিনোমের পার্থক্যগুলো এবং মিউটেশনগুলো বোঝা এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। তবে এ বিষয়টা আপাতত তোলা থাক, পরবর্তীতে জেনেটিক্স নিয়ে আলোচনার সময় এ প্রসংগটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে ।

আমরা মানুষ হলাম কি করে, কি দিয়ে, কোথা থেকে এসেছি আমরা? সেই অনাদিকাল থেকে এই প্রশ্নগুলো করে এসেছি আমরা। হ্যা, এটা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই যে আমরা এই ছোট্ট পৃথিবীতে সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। জীবজগতে আমরা এমন অনেক কিছুই করতে সক্ষম যা আর কোন প্রাণীই করে না। আমরা কি না পারি? আমরা আত্মসচেতন, আয়নায় নিজেকে দেখে চিনতে পারি, কথা বলতে পারি, গান গাইতে পারি, ‘সভ্যতা’ গড়ে তুলতে পারি, আমরা পড়তে লিখতে পারি, আর্ট, সাহিত্য, বিজ্ঞানের চর্চা করতে পারি, এমনকি একটা বোতাম টিপে সভ্যতার ইতিও ঘটাতে পারি। কিন্তু আবার অন্যান্য জীবের মতই বিবর্তনের ধারায় যে আমরা আজ এখানে এসে পৌঁছেছি সেটা নিয়েও সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। প্রাকৃতিক নিয়মেই আমাদের বুদ্ধিমত্তার বিবর্তন ঘটেছে, আর তারই হাত ধরে আমরা আজ এমন একটা অবস্থায় এসে পোঁছেছি যেখানে বসে আমরা আমাদের উৎপত্তি, বিকাশ এবং বিবর্তন নিয়ে প্রশ্ন করতে পারছি। স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পরবর্তীতে প্রাইমেটদের ছকের মধ্যে আমাদের বিবর্তন ঘটেছে, তাই আমাদের সাথে শিম্পাঞ্জী, বনোবো বা ইঁদুরের জিনোমের অভাবনীয় সাদৃশ্যও বাস্তবতা বই আর কিছু নয়।

কতগুলো প্রশ্ন দিয়ে এভো ডেভোর লেখাটা শুরু করেছিলাম। যেমন ধরুন, মাত্র ২০-২৫ হাজার জিন নিয়ে (যা কিনা মুরগী বা ভুট্টার জিনের চেয়েও সং খ্যায় কম) আমরা কি করে এত বুদ্ধিমান প্রাণীতে পরিণত হলাম? বা সবচেয়ে নিকট আত্মীয় শিম্পাঞ্জির সাথে আমাদের জিনোমে এত মিল থাকা সত্ত্বেও, বা ঘুরিয়ে বললে এত অল্প অমিল থাকার পরও, মানুষের আকার, গঠন এবং বুদ্ধিবৃত্তিতে এতটা পার্থক্য ঘটলো কিভাবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরও লুকিয়ে আছে আজকের এই আধুনিক গবেষণাগুলোর মধ্যেই। উপরের আলোচনাগুলো থেকে আমরা পরিষ্কারভাবেই দেখতে পাচ্ছি যে, এক প্রজাতি থেকে আরেক প্রজাতিতে বিবর্তিত হতে হরেক রকমের নতুন নতুন জিনের উদ্ভব ঘটার প্রয়োজন পরে না। শুধুমাত্র প্রোটিন তৈরি করা জিনগুলোর উদ্ভাবনের মধ্যেই নয়, বরং কোথায়, কিভাবে কোন অবস্থায় জিনগুলোর এক্সপ্রেশান ঘটছে, তার আশে পাশের সুইচ এবং অন্যান্য ডিএনএ অনুক্রমগুলো তার উপর কিরকম প্রভাব ফেলছে, এসব অনেক কিছুর উপর ভিত্তি করেই জীবদেহে বেশ বড় বড় পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে। অর্থাৎ, শুধুমাত্র জিনের সংখ্যা বা নতুন করে অভিনব সব জিনের মধ্যেই নয়, বরং এই সুইচ বা ডিএনএর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশের পরিবর্তনের মধ্যেও হয়তো আমাদের ‘মানুষ হয়ে ওঠা’র রহস্যের অনেকখানি লুকিয়ে রয়েছে। আমাদের বুদ্ধিমত্তা, ভাষা বা দ্বিপদী হয়ে ওঠার মত ‘মানবিক’ বৈশিষ্ট্যগুলোর পিছনে অভিনব কিংবা আলাদা ধরণের জিন খোঁজার দিন হয়তো ফুরিয়েছে। মানুষ এবং শিম্পাঞ্জির জিনোম সিকোয়েন্সিং এর আগে পর্যন্তও ভাবা হত যে আমাদের জিনোমে নতুন নতুন জিনগুলো থেকেই হয়তো তথাকথিত ‘মানবিক’ বৈশিষ্ট্যগুলোর ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে, তা মোটেও ঠিক নয়। দ্বিপদী হয়ে ওঠা, ভাষার বিকাশ, বা বুদ্ধিমত্তার বিবর্তনের পিছনে হয়তো নতুন নতুন জিনের প্রয়োজন পড়েনি। পুরোনো জিনগুলোই নতুন সাজে নতুন আঙ্গিকে ব্যবহৃত হয়েছে বারবার বিভিন্ন ধরণের প্রাণীর বিবর্তনে।

এভো ডেভো নিয়ে এই দীর্ঘ আলোচনাটার ইতি টানার সময় হয়েছে। মানব বিবর্তনের মত জটিল একটা বিষয় বুঝতে হলে মনে হয় এভো ডেভোর দুয়ারে টোকা দেওয়া ছাড়া আর গতি নেই। আর আনবিক জীববিজ্ঞান, জেনেটিক্স, জিনোমিক্স, বা এভো ডেভোই তো শুধু নয়, আজকে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির আরও অনেক শাখাও বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মত আমরা কোন জিনগুলোর প্রভাবে এক কোষী ভ্রূণ থেকে আমাদের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যংগগুলো তৈরি হচ্ছে তা প্রত্যক্ষ করছি। শুধু তো তাই নয়, অবাক বিস্ময়ে দেখছি, হাতের সাথে পায়ের পার্থক্য কোথায়, কত অল্প পরিবর্তনেই হাতের বদলে বাদুড়ের পাখার বিবর্তন ঘটে যেতে পারে। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মত বিবর্তনও আজ এক্সপেরিমেন্টাল বা ব্যবহারিক বিজ্ঞানে রূপ নিতে চলেছে। জীবের আকারে, গঠনে বিবর্তন ঘটছে -এটা দেখানোতেই আর সীমাবদ্ধ নেই বিবর্তনবাদ, কিভাবে এই জটিল গঠনগুলো তৈরি হচ্ছে সেই রহস্যের গভীরেও আমাদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। জীবের বিবর্তনকে শুধু কোটি কোটি বছরের ফসিলের আলোয় বা ডিএনএ এর ভিতরে ঘটা পরিবর্তনের ভিত্তিতে বা ব্যাক্টেরিয়ার জনপুঞ্জে ঘটা পরিবর্তনের মাধ্যমেই আমরা জানবো না, চোখের সামনে গবেষণাগারেই হয়তো প্রমাণ করতে পারবো আমাদের প্রজাতির বিবর্তনের ধাপগুলো।

তথ্যসূত্রঃ

(১ থেকে ১৩ পর্যন্ত রেফারেন্সগুলোর জন্য আগের পর্ব দেখুন)

১8)National Academy of Science, Teaching about Evolution and the Nature of Science (Washington, DC: National Academy Press, 1998), p.16.

১৫) Nature 437, 69-87 (1 September 2005); Initial Sequence of the Chimpanzee genome and comparison with the human Genome.

১৬) Pollard Katherine, May 2009. ‘What makes Us Human’. Scientific American, INC.

১৭) বন্যা আহমেদ, ২০০৬, বিবর্তনের পথ ধরে, পৃঃ ১২৮, অবসর প্রকাশনা সংস্থা।

১৮) Carroll S, 2005, Endless Forms most Beautiful. W.W. Norton & Company, p. 270-280.

১৯) http://www.cirs-tm.org/researchers/researchers.php?id=563

২০) Science 22 June 2007, VOL 316.no. 5832, pp. 1756-1758. Restriction of an Extinct Retrovirus by the Human TRIM5 Antiviral Protein.

২১) http://www.naturalhistorymag.com/features/061488/the-origins-of-form?page=5