সমকামিতা নামে একটা বই লিখেছিলাম এবছরের বইমেলায় (২০১০)। প্রকাশক শুদ্ধস্বর। মোটেও মেইনস্ট্রিম বই নয়। আমি ভাবিনি বইটা কারো চোখে পড়বে। খুব যে পড়েছে তা নয়। পথিকের মতে তো বইটা নাকি ইচ্ছে করেই ‘ব্ল্যাক আউট’ করা হয়েছে! কারণ, বইটা এমন একটা স্পর্শকাতর বিষয়ে যে কোন মেইনস্ট্রিম পত্রিকাই এটি নিয়ে লেখালিখি করতে সাহস করবে না । তবে, আমার অবশ্য কখনোই মনে হয় নাই যে সে কারণে কোন লেখা আটকে দেয়া হয়েছে। যদিও পথিকের সন্দেহ করার পেছনে যুক্তিসঙ্গত কিছু কারণ আছে। সমকালের বিজ্ঞান বিভাগ কালস্রোতের দায়িত্বে নিয়োজিত আসিফ সাহেব একবার আমার একটা লেখা নিয়ে সমস্যায় পড়েছিলেন শুনেছিলাম। লেখাটার শিরোনাম ছিলো – ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব কি সমকামিতাকে ব্যাখ্যা করতে পারে? তো ‘সমকামিতা’ নামটি দেখেই নাকি পত্রিকার প্রকাশক তা ছাপতে চাননি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য শিরোনাম পালটে লেখাটা ছাপা হয়েছিলো (দেখুন এখানে)। এমনকি বইটি প্রকাশের সময় সেটার খবরও ছেপেছিলো ভিন্ন একটি নামে (দেখুন এখানে)। তারপরেও আমার কখনো মনে হয়নি পত্রিকার সম্পাদকেরা সবাই এ ধরণের লেখা আটকানোর জন্য হন্যে হয়ে বসে আছে। আটকানো যদি হয়েই থাকে তবে সেটা বিষয়ের কারণে নয়, বরং লেখকের ছাই পাশ লেখার কারণে। আসলে আমার বই আর কে পড়বে, বলুন! আর পড়লেও সেটা নিয়ে আবার শক্তি আর সময়ের অপব্যবহার করে রিভিউ লিখবেই বা কে! আর লিখলেও সেটা যে ছাপা হবেই তারই বা কি গ্যারান্টি? আর আমি নিজেও খুব আইলস্যা প্রজাতির জীব। বই একবার বাজারে চলে আসার পরে আমি খুব একটা খোঁজ খবর আর রাখি না, কোথায় কি ছাপা নাপা হয়েছে, কে জানে? এবারো রাখতাম না যদি না আমার বইয়ের প্রকাশক শুদ্ধস্বরের আহমেদুর রশীদ (টুটুল ভাই) আমাকে ইমেইল করে খবরটা না জানাতেন। তার ইমেইল থেকেই জানলাম, প্রথম আলো পত্রিকায় নাকি বইটা নিয়ে কিছু একটা ছাপা হয়েছে। এটা অবশ্য আমার জন্য অবাক করা খবর। কারণ পত্রিকা জগতে প্রথম আলো একটু কুলীন বলে পরিচিত। তাদের নাক উঁচা। তারা নাকি যে সে বইয়ের রিভিউ প্রকাশ করে না। আমি প্রথম আলো একেবারে পড়িই না বলা যায়। আমার ধারণা তারা খুব ব্যবসায়ী গোছের পত্রিকা। শুনেছি তারা কাউকে চটিয়ে কোন ‘বিতর্কিত’ ধরনের জিনিস প্রকাশ করতে চায় না। কিন্তু আমার ভুল ভাঙ্গল। আজকে ইন্টারনেট সার্চ করে দেখলাম সত্যি প্রথম আলো গত শুক্রবার দিন (০৬-০৮-২০১০) আমার সমকামিতা বইয়ের রিভিউ করেছে,টুটুল ভাই খবরটা না জানালে লেখাটা আমার অজ্ঞাতই থেকে যেত বহুদিন-

অবগুণ্ঠন সরে গেল
আলতাফ শাহনেওয়াজ | তারিখ: ০৬-০৮-২০১০

samokammita_very_sm

আলফ্রেড কিন্সে নামের আমেরিকার ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক অধ্যাপক একদিন ক্লাসে লেকচার দিচ্ছিলেন। সেদিন ধান ভানতে শিবের গীতের মতো ওই ক্লাস-লেকচারার আলোচনায় চলে গিয়েছিলেন বোলতার যৌনপ্রবৃত্তির দিকে। এবার শিক্ষার্থীদের আর উত্সাহের শেষ নেই। সেই সময়ের তরুণ শিক্ষকের দিকে তাঁরা ছুড়ে দিতে থাকলেন একটির পর একটি প্রশ্নবাণ। ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে দিনের এই ঘটনা পরবর্তী সময়ে আলফ্রেড কিন্সেকে অনুপ্রাণিত করেছিল মানুষের যৌনবৃত্তি ও সমকামিতার কার্যকারণ উদ্ঘাটনের গবেষণায়। যেখানে বিজ্ঞানের আলোয় মানুষের শরীর বৃত্তির অনুভূতি, যৌনতা এবং সমকামিতার মনস্তাত্ত্বিকভাবে ব্যাখ্যা করলেন তিনি। শুরু হলো এ বিষয়ে সূত্রাবদ্ধ আলোচনা। জানার জন্য এই তথ্যগুলো কারও কাছে হয়তো দরকারি হতে পারে। আবার না জানা থাকলেও তেমন ক্ষতি হবে না অনেকেরই। তবে কথা হলো, যে বিষয়ে মাথা খোঁজার জন্য এত কান টানাটানি, এত ভণিতা এবং যে পুস্তকের মাধ্যমে আলফ্রেড কিন্সের ইতিবৃত্ত জানা গেল, তার নাম ‘সমকামিতা’, লেখক অভিজিত্ রায়। বইয়ের মলাটে লাল কালিতে লেখা ‘সমকামিতা’ শব্দের পাশে উত্কীর্ণ হয়েছে ‘একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান’—এই শব্দাবলি। ফলে বইয়ের শিরোনাম থেকে স্পষ্ট হয়, সমকামিতাকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে বোঝাপড়া করাই পুস্তকটির অভিপ্রায়। ভূমিকা অংশে লেখক আগে ভাগে জানিয়েও দিয়েছেন সেই কথা। মোট ১০টি অধ্যায়ে শেষ হয়েছে লেখকের অনুসন্ধান—‘প্রকৃতি ও সমকামিতা’, ‘রূপান্তরকামিতা আর সমকামিতার জগত্ ‘উভলিঙ্গত্ব’, ‘গবেষণার রুদ্ধ দুয়ার খুললেন যাঁরা’, ‘সমকামিতা কি কোনো জেনেটিক রোগ’-এর এ রকম নানা শিরোনামের অধ্যায়ে সমকামিতা নামের প্রপঞ্চটিকে ওপর-নিচ থেকে ভেঙেচুরে দেখার চেষ্টা আছে বইটিতে।

এ ক্ষেত্রে বলা ভালো, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সমকামিতা প্রপঞ্চটি গুণবাচক কিছু নয়। কিন্তু মানুষের যৌনবৃত্তি এবং আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে এর যোগসাজসের তল খোঁজার চেষ্টাও নিশ্চয় দুষ্কর্ম নয়। আলোচ্য বইয়ের ছত্রে ছত্রে তারই নজির বিদ্যমান। যেমন সমকামিতার পূর্বাপর তালাশের সঙ্গে সঙ্গে এখানে অভিজিত্ রায় দেখিয়েছেন ছেলে ও মেয়ের মস্তিষ্কের মধ্যে গঠনগত ভিন্নতা রয়েছে। ফলে তাদের প্রবণতাও বিভিন্ন হতে বাধ্য। এর পরষ্পরায় ছেলেমেয়ের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন তিনি গোটা বিশ্বের এন্তার সমীক্ষা হাজির করার মাধ্যমে।

আবার মানুষের পাশাপাশি প্রাণিজগতের সমকামিতা বিষয়ে ব্যাখ্যান আছে এ গ্রন্থে। অন্যদিকে এই প্রপঞ্চ সম্পর্কে বিভিন্ন ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গি কিরূপ, তার খোঁজও মেলে। সেক্সের সঙ্গে জেন্ডারের সম্পর্ক এবং পার্থক্য, সমাজের সঙ্গে এর রিস্তা-বহু বিচিত্রভাবে সমকামিতার স্বরূপ বিশ্লেষিত হয়েছে বইটিতে। তত্সঙ্গে সেক্সচুয়ালিটি বা যৌনতার খোলনলচেকে যথাসম্ভব পরিচ্ছন্ন করে ব্যবচ্ছেদ করার দিকেও অভিজিত্-এর অভিমুখ। তাঁর ভাষ্য যেমন সেক্স বিষয়টি পুরোপুরি শরীরের ওপর নির্ভরশীল তেমনি জেন্ডার কিন্তু নির্ভর করে সমাজের ওপর। … ‘মেয়েলি’ বা ‘পুরুষালি’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে জেন্ডার প্রপঞ্চকে যুক্ত করা হয় যেখানে নারী বা পুরুষের লিঙ্গীয় বৈশিষ্ট্যকে ছাপিয়ে স্বভাব-আচরণ ইত্যাদি বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ও প্রকাশ পায়।

উৎসঃ প্রথম আলো, সাহিত্য সাময়িকী, তারিখ: ০৬-০৮-২০১০

আলতাফ শাহনেওয়াজের সাথে আমার কোন ব্যক্তিগত যোগাযোগ নেই। কিন্তু তিনি যে আমার বইটি পড়ে একটি চমৎকার শিরোনাম দিয়ে ছোট কিন্তু সুন্দর একটি রিভিউ করেছেন, তার জন্য আমি সত্যই কৃতজ্ঞ।সেই সাথে প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ দিতে হয় – কারণ, তারা এই রিভিউটি প্রকাশ করেছেন তাদের পত্রিকায়।

শুনতে পাই, বইটি নাকি ‘সুধীজনের একটু আধটু দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে’। সামনে নাকি আরো কিছু রিভিউ বড় আকারে পত্রিকায় ছাপা হবে। যদি হয়, তবে এখানে এমনিভাবে পাঠকদের জানিয়ে যাব ভাবছি। অবশ্য আমি যদি সৌভাগ্যক্রমে সেটা জানতে পারি কখনো!