মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা- (৩য় পর্ব)
-মোকছেদ আলী*
১ম পর্ব। ২য় পর্ব। ৩য় পর্ব।
রেলগাড়ি স্টেশন ত্যাগ করার সংকেত দিল। শুয়া পোকার মত আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে চলল। বাংলাদেশে কতকগুলি শহর আছে, যাদের বুকের উপর দিয়ে রেল লাইন গেছে। যেমন, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, কুমিল্লা, খুলনা, সিরাজগঞ্জ। কুষ্টিয়াও ঠিক তেমনি। কুষ্টিয়া শহরের বুকের উপর দিয়ে বীরের ন্যায় গর্বিতভাবে দুপাশের জনপদকে কাঁপিয়ে ছুটে চলল রাজবাড়ি অভিমুখে।
আজ থেকে কুড়ি বৎসর আগে ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্থ শহরগুলির অন্যতম এই কুষ্টিয়া। হানাদার পাক বাহিনী ও তাদের দোষর যারা এই দেশেরই মানুষ, কুষ্টিয়াকে পোড়ায়ে ছাড়খার করে দিয়েছিল। ট্রেনে বসেই আমার তখন দেখে মনে হচ্ছিল- আসলে এইটাই পোড়াদহ।
গাড়ী দ্রুত গতিতে চলতে লাগলো। জানালা দিয়ে দৃষ্টি চলে গেছে বাইরে। পাকা দালান বাড়ি, দোকান পাট দ্রুত চলে যাচ্ছে পিছনে- কিন্তু সেদিকে আমার খেয়াল নাই। খেয়াল চলে গেল ২০ বৎসর পিছনে। ১৯৭১ সনের মুক্তি যুদ্ধে কত লোক যে নিহত হয়েছে তার কোন হিসাব নিকাশ নেই। কেহ বলেন ৩০ লক্ষ। আবার কেহ বলেন ১৫ লাখ। কেহ বলেন ৫ লাখ। এ যেন নবী রসুলের মতো। নবী রসুলের সংখ্যা কত? কেহ বলেন, ১ লাখ ২৪ হাজার, কেহ বলেন ২ লাখ ২৪ হাজার। প্রায় ১ লাখের গড়মিল। কার কথা সত্যি? কিন্তু যুদ্ধের সময় যে গণহত্যা হয়েছিল, আমরা বাঙালীরা ৩০ লাখ বলেই ধরে নিয়েছি এবং বিশ্বাস করি।
৩০ লাখ হোক আর ৩০ হাজারই হোক, আসলে তো মারা গেছে এই দেশেরই নিরীহ মানুষ। বাঙালী নিরীহ মানুষ যেমন মরেছে, মরেছে কিছু নিরীহ বিহারী মানুষ। বাঙালীদের মধ্যে যেমন ছিল স্বাধীনতা বিরোধী। তদ্রুপ বিহারীদের মধ্যে কিছু ছিল স্বাধীনতার পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। তেমন বিহারীরা কি মানুষ না? আমার চোখের সামনে ধরে নিয়ে গেল আওয়ামী লীগের কিছু পান্ডারা, বিহারী বলে পরিচিত কোদালিয়া পাড়ার মন্নাফ বিহারীকে। বিহারী আর বাঙ্গালী কাকে বলে তাতো আমি বুঝি না। আমি বুঝি মানুষ। সেই মন্নাফ বিহারী ছিলেন মানুষ। আমি তাকে কোনদিন উর্দ্দূ বা হিন্দীতেও কথা বলতে শুনি নাই। একনিষ্ঠ নামাজী। বিহারী পাড়ায় নিজ উদ্যোগে নিজ খরচে মানুষের জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন এবাদতখানা, মসজিদ। আজও কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কোদালিয়া পাড়ায়। এই মানুষটি পোড়াদহের হাটে কাপড়ের ব্যবসা করতেন। সদাহাস্য মুখ মন্নাফ মিয়া ছিলেন দরিদ্রের পরম বন্ধু। মাড়োয়ারী শিবচাঁদের বিরাট আড়ৎ দখল করে রক্ষা করেছিলেন সব সম্পদ। কত লোভী লোক গেছে শিবচাঁদ মাড়োয়ারীর সম্পদ লুণ্ঠন করতে, দেন নি মন্নাফ। বলেছেন- এটা আমি আমানত রেখেছি। একদিন শিবচাঁদ বাবুরা ফিরে আসবে। সেদিন ফিরে পাবে তাদের সহায় সম্পদ। আমি মুসলমান, মুসলমান কখনও পরের সম্পদ গ্রাস করে না। তিনি তার কথা রেখেছিলেন। শিবচাঁদ ফিরে এসে অক্ষত অবস্থায় সব কিছু ফিরে পায়। আড়তে যে সমস্ত পাট, ছোলা, ধান চাল ছিল তার এককোণাও নষ্ট হয়নি।
একদিনের কথা। আমার শ্বশুড় রোজার মধ্যে জামা কাপড় তৈরি করছেন। ঈদের মাত্র ৪/৫ দিন বাঁকী। প্রতিদিন পাঞ্জাবী মিলিটারী আসে ছেঁড়া কাপড় সেলাই করতে। তিনি সেসব সেলাই করে দেন। কেউ এক টাকা ফেলে দেয়। আবার কেউ গায়ের জোরে না দিয়ে চলে যায়। একদিন দুইজন মিলিটারী সেপাই এলো। তাদের অনেক ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে দিলেন। কিন্তু তারা সেলাইয়ের মজুরী দিল না। খলিফা হাবিবর রহমান আমার শ্বশুড়ের দোকানে কাজ করতো। সে বলল- “সেলাইকা আজুর দেয়া নেই কিউ?” বাস্, তখন তারা দুজন ক্ষিপ্ত হয়ে আমার শ্বশুড় আর হাবিবরকে বলল, “এই ছালে লোক, দেখতা নেহি হাম লোক মিলিটারী হ্যায়। চল্ ব্রীজমে, তুমকো গোলি করকে খতম কর দেগা।” তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। আমার শ্বশুড় ও হাবিবর ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। ভাগ্য ভালো, ঐ পথে মন্নাফ মিয়া যাচ্ছিলেন। মিলিটারী দেখে ঘরে প্রবেশ করলেন। আমার শ্বশুড় সব কথা বাংলায় খুলে বললেন। শুনে মন্নাফ ক্রোধে আগুন হয়ে গেলেন। তিনি তখন উর্দ্দূতে যা বললেন তার মোটামুটি অর্থ- তোমার মিলিটারী মেজর আমার বন্ধু লোক। সেকি তোমাদের হুকুম দিয়েছে পাবলিকের কাছে কাজ করিয়ে তার মজুরী না দিতে, তারপর তাদের গুলি করে মারার হুমকি দিতে? বলেই তিনি পকেট থেকে ছয়ঘড়া অটোমেটিক রিভলভার আর মিলিটারী মেজরের দেয়া আইডেন্টি কার্ড দেখাতেই, সৈনিক দুজন মুষড়ে গেল। তখন তারা আমার শ্বশুড়ের হাত ধরে বলল, ব্রাদার মাফ কি জিয়ে। তারপর ২০ টাকা মজুরী দিয়ে চলে যায়। মন্নাফ বিহারী এইভাবে ভেড়ামারার কতজনের জীবন যে রক্ষা করেছেন তার ইয়ত্তা নেই।
সেই মন্নাফ বিহারীকে আমার চোখের সামনে দিয়ে ধরে নিয়ে গেল আওয়ামী লীগের যুবক ছেলেরা। হাইস্কুলে নিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে। আরো কত যে বিহারীকে হত্যা করেছে। একজনকে হত্যা করে আনন্দে পৈশাচিক নৃত্য করে ধ্বনি দেয় জয়বাংলা। সেদিন তারা শুধু মন্নাফ বিহারীকেই হত্যা করেনি। হত্যা করেছে একজন খাঁটি মানুষেকে। কিন্তু আমি যতদূর জানি- তার হত্যাকারীরা কেউই আজ বেঁচে নাই।
————-
*মোকছেদ আলী (১৯২২-২০০৯)। স্বশিক্ষিত। সিরাজগঞ্জের বেলতা গ্রামে জন্ম। গ্রামটি বর্তমানে নদীগর্ভে বিলীন।
নৃপেন্দ্র সরকার@ dada ami ki apnar e-mail address ta pete pari?
[email protected] a akta mail pathaben plz
এতো ভালো লেখা এতো কম পাঠক।দুঃখজনক। @ মাহফুজ লিখে যাবেন আরো পড়ার অপেক্ষায়।
আপনার লেখাগুলো পড়ে অনেক বিষয় আরো পরিষ্কার হচ্ছে। চালিয়ে যাবেন নিশ্চয়।
লেখাটি ভাল লাগল। :rose:
ভাল লাগল। মন্নাফ বিহারীর ঘটনাটা মনে করিয়ে দেয় আমাদের ইউনিয়ন চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিনের কথা। তিনি মুসলিম লীগ সমর্থক ছিলেন। অথচ দেখ তাঁর ভূমিকাটা কী মহান ছিল।
স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি সময়ে স্থানীয় কিছু মুসলমান হিন্দুদের বাড়ীর উপরদিয়ে অযথা যাতায়াত শুরু করে দেয়। যেকোন সময় লুটপাট শুরু হবে। একবার শুরু হলে আর থামবে না। এই সংবাদ পেয়ে চেয়ারম্যান সাহেব তাঁর মেম্বারদের ডেকে বললেন – আমি বেঁচে থাকতে যদি কোন হিন্দুর গায়ে আঁচড় লাগে আমি কাউকে ছাড়ব না। উনার এককথায় কাজ হয়েছিল।
নভেম্বর মাসের দিকে মুক্তিবাহিনীর লোকেরা তাঁকে এবং গৌরপদ নামে তাঁর হিন্দু মেম্বারকে ধরে নিয়ে দুরে লাইন করে গুলি করে। গৌরপদ মারা যান ঘটনা স্থলে। জসিম উদ্দিন সাহেব বেঁচে আসেন। তিনি এখনও জীবিত। ভাবছি উনাকে নিয়ে লিখব।
এক কানাই মাষ্টার জনপ্রিয় ছিলেন। মুক্তিবাহিনীরা তাঁকে মেরে ফেলল। আমি আমার সহপাঠী বছিরকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম – তোরা উনাকে কেন মারলি? বলল – কানাই মাষ্টার রাজাকার ছিল।
কানাই মাষ্টার নাকি রাজাকার ছিলেন? আসলে সেটি সত্য নয়। আর এক মুক্তিযোদ্ধার শ্বশুরের ঈর্ষার পাত্র ছিলেন কানাই বাবু। শ্বশুরকে খুশী করার জন্যই কানাই বাবু ফোঁস।
হয়তো মন্নাফ মাষ্টার মাড়োয়ারীর সম্পদ আগলে রেখেছিলেন। লুট করতে পারেনি। তাই ফোঁস।
মানুষ কী বিচিত্র! মুহুর্তের উন্মাদনায় মানুষ রূপান্তরিত হয় পশুতে। মন্নাফ বিহারী সেই পশুত্বেরই শিকার।
@নৃপেন্দ্র সরকার,
দাদা,
বেশ কিছুদিন আগে টিভিতে এক বিহারীর প্রতিবেদন দেখেছিলাম- যিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।
আমার এক সময় ধারণা ছিল- বিহারী মানেই রাজাকার। কিন্তু মোকছেদ আলীর লেখা পড়ে আমার সেই ধারণা পাল্টে গিয়েছিল।
তবে এটা ঠিক যে অধিকাংশ বিহারীই স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল।
বাংলাদেশে এখনও লক্ষ লক্ষ বিহারী রয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে তারা রয়েছে। দেশ স্বাধীনের পর অনেক বিহারী পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু পাকিস্তান তাদের গ্রহণ করেনি। অনেক বিহারী বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে ভোটাধিকার লাভ করেছে।
ধর্মীয় দিক দিয়ে এরা শিয়া মতাবলম্বী।
আচ্ছা দাদা, চেয়ারম্যান জসিম উদ্দীন কি বিহারী?
@মাহফুজ,
বাঙ্গালী।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের দুবছরের সিনিয়র ছিলেন নাজিম আক্তার কাসেম। এত প্রানবন্ত ছেলে কম দেখা যায়। বিহারী পরিচয় জানলাম তাকে মেরে ফেলার পরে। যুদ্ধ শেষের দিকে বিহারী মারার ঢেউ উঠে। কাসেম নিশ্চিন্তে আড্ডা দিয়ে যাচ্ছে। ঢেউএর লোকেরা কী ভাবে জানল কাসেম একজন বিহারী। ধরে এনে মেরে ফেলল। বাস্!