( আনাসের লেখা ‘বিশ্ব নবীর ডাক্তারী’ পড়ার পর মোকছেদ আলীর লেখাটির কথা মনে পড়ায় পোষ্ট করতে আগ্রহী হলাম)

তুচ্ছ, কিন্তু ধন্বন্তরী
-মোকছেদ আলী*

একটি কথা প্রায়ই শোনা যায়, আর সেটা হইতেছে – “সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তায়ালা বিশ্ব ব্রহ্মান্ড অর্থাৎ আসমান ও জমিন এবং এতদউভয়ের মধ্যে যাহা আছে তাহা অকারণ ক্রিড়াচ্ছলে সৃষ্টি করেন নাই।” আল্লাহ তায়ালা তাঁহার পাক কালাম আল কোরানের সুরা দোখানের ৩৮-৩৯ আয়াতে স্পষ্ট ভাষায় বলিয়াছেন- “আমি নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু ক্রীড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। আমি এগুলো যথাযথ উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছি; কিন্তু তাদের অধিকাংশই বোঝে না।”
এই আয়াতটি হাফেজ মুনির সাহেব অনুবাদ করিয়াছেন-
“আমি আসমানসমূহ, যমীন এবং এদের উভয়ের মাঝখানে যা কিছু আছে তার কোনোটাই খেল তামাশার ছলে পয়দা করিনি। এগুলো আমি যথাযথ উদ্দেশ্য ছাড়াও সৃষ্টি করিনি, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ (সৃষ্টির এ উদ্দেশ্য সম্পর্কে) কিছুই জানে না।”
এই আয়াতের মর্ম অনুসারে প্রকৃতির রাজ্যের কোন বস্তুই তুচ্ছ বা ফেলনার নহে। কিন্তু আমরা অজ্ঞতার কারণে ইহার মূল্য বুঝি না।
ভাগ্যিস, আয়াতটি কোরানে দেওয়া হইয়াছে, তাহা না হইলে আমরা কোন বস্তু দ্বারাই উপকার পাইতাম না, সেগুলো শুধু খেল তামাশার বস্তু হইয়াই থাকিত। আমার প্রশ্ন- উক্ত আয়াতটি কোরানের মধ্যে না থাকিলে প্রকৃতির গাছ-গাছড়াগুলো কিম্বা বিভিন্ন দ্রব্যাদি কি গুণ বিবর্জিত হইয়া থাকিত?
যখনই কোন বিজ্ঞানী কোন কিছুর উপর পর্যবেক্ষণ পরীক্ষা নিরীক্ষা দ্বারা কোনকিছু আব্ষ্কিার করিয়াছেন তখনই ইসলামী ধার্মিক পণ্ডিত ব্যক্তিরা ওয়াজ করিতে শুরু করেন-‘এই কথা তো বহু আগেই কোরানে উল্লেখ করা হইয়াছে।’
এই সমস্ত ইসলামী ধার্মিক পণ্ডিতেরা কোরানকে মেডিকেল সাইন্স বলিতেও দ্বিধাবোধ করে না। এমন দাবীদার ব্যক্তিরা কিন্তু কোরান গবেষণা করিয়া কোন কিছু আবিষ্কার করিতে পারে না। পারে তাহারাই যাহারা কোরান গবেষণা না করিয়া বস্তু লইয়া গবেষণা করিয়াছে।
যাহারা কোরানকে মেডিকেল সাইন্স বলিয়া লাফালাফি করে তাহাদের কথা শুনিয়া মনে হয়- মানুষের রচিত মেডিকেলের বই বাদ দিয়া মেডিকেল কলেজগুলিতে কোরানকে প্রধান পাঠ্য পুস্তক হিসাবে স্থান দিতে হইবে। তাহাতে ডাক্তাররা আরো হয়তো অনেক কিছুই আবিষ্কার করিতে পারিবেন।
কোরানে একটি কথা ঠিক বলিয়াছে, ‍”কিন্তু অধিকাংশ মানুষ (সৃষ্টির এ উদ্দেশ্য সম্পর্কে) কিছুই জানে না।” এই আয়াতটি একটি না বোধক। অর্থের বিকৃতি না ঘটাইয়া হা সূচক বাক্যে পরিণত করিলে হইবে- ‍”কিন্তু অল্প মানুষ (সৃষ্টির এ উদ্দেশ্য সম্পর্কে) জানে।”
দুনিয়ার দিকে তাকাইলে দেখা যায় এই অল্প মানুষ কিন্তু মুসলমান নয়, বরং বিধর্মী কিম্বা কোন ধর্মের ধার ধারে না, কিম্বা যাহারা ধর্মের লেবাস লইয়া মাতামাতি করে না। তাহারা আপন মনে গবেষণা করিয়া মানুষের উপকার করিয়া চলে। আবিস্কৃত জিনিসটি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবারই কাজে লাগে বা তাহারা ব্যবহার করে। ধার্মিকরা বিজ্ঞানের জিনিস খায়, মজা লুটে আর গুণগান গায় আল্লাহর। আর বলে- আল্লাহই তো বিজ্ঞানীদের মাথায় জ্ঞান দিয়াছেন, অতএব গুণগাণ তো আল্লাহরই গাইতে হইবে। আবার বিজ্ঞানীরা যখন আল্লাহর অস্তিত্ব লইয়া টানাটানি করে তখন ধার্মিকরা বিজ্ঞানীদের মাথা কাটিতে উদ্যত হয়। আর কয়, আল্লাহর জ্ঞান লইয়া জিনিস বানাইয়া এখন আল্লাহর বিরুদ্ধে কথা বল, এখন আর তোমাকে বাঁচিয়া থাকিতে দেওয়া যায় না।
নসিহত করিতে গিয়া মৌলবীরা কয় আল্লাহর পাক কালামে আছে- “এই দুনিয়াটা কিছুই নয়, শুধু খেলা আর মন ভুলানোর ব্যাপার মাত্র, আসল জীবনের ঘর তো পরকাল।” (এই মুহূর্তে আয়াতটি কোন সুরায় আছে মনে পড়িতেছে না।)
এখন কথা হইল, একবার বলা হইতেছে- ‘কোন কিছুই ক্রিড়াচ্ছলে সৃষ্টি করিনি’, আবার বলা হইতেছে- ‘খেল তামাশার ব্যাপার মাত্র।’ এমন বৈপরিত্য কথাবার্তা কেন?? (আমি মুখ্য মানুষ, তাই বুঝি না; জ্ঞানীদের দারস্ত হইতে হইবে)।
যাহা হউক, আমার ব্যক্তিগত জীবনের কতকগুলি ঘটনা উল্লেখ করিব- প্রকৃতির তুচ্ছ জিনিস যে কাজে লাগে, তাহা কোরান গবেষণা ছাড়াই ঘটিয়াছে।

এক:
বাল্যকালে মাঠের ঘাস কাটিতে কাটিতে কাচিতে হঠাৎ বাম হাতের কনুই আঙ্গুলটি নখ সমেত কাটিয়া যায়। প্রচুর রক্ত পড়িতে থাকে। যন্ত্রনাও হইল। আমি কাচি ফেলিয়া ডান হাতে চাপ দিয়া আঙ্গুল ধরিয়া কান্দিতে লাগিলাম। বছির বুড়া নামক একজন বৃদ্ধ আমার দুর্দশা দেখিয়া শান্তনা দিয়া কহিল, “কান্দিস না, এখনই সারিয়া যাইবে।” বলিয়া তিনি কালো কচুর ডাঁটা (ডাগুর) ছিড়িয়া আনিলেন। পাতার দিক হইতে আঙ্গুলের চাপে চিপিয়া, ছ্যাপ বা সাবানের ফেনার ন্যায় কস বাহির করিয়া আমার কাটা আঙ্গুলের উপর কষ লাগাইয়া দিলেন। আর সাবধান করিয়া দিলেন, পানি লাগাবি না আর তেঁতুল খাবি না। তারপর উপদেশ দিলেন বাড়ি গিয়া কালো কচুর ডাইগ্যার কষ বেশি করিয়া লাগাইয়া ছাফ তেনা (পরিষ্কার কাপড়) দিয়া আঙ্গুলে জড়াইয়া বান্ধিয়া রাখিবি।
তাহার সাবধান বাণী ও উপদেশ মান্য করিয়া দুই দিনে আমার কাটা স্থান শুকাইয়া উঠিল। কয়েকদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ সারিয়া গেল বটে কিন্তু চিরদিনের জন্য আঙ্গুলের চাড়ার উপর দাগ শিরার ন্যায় রহিয়া গেল। এই বৃদ্ধ বয়সেও সেই দাগটি খুব স্পষ্ট হইয়া আছে। কাটাস্থানে কালো কচুর কষ যে মহা উপকারী তাহা অনেকেই অবগত নহে।
এখন প্রশ্ন হইল- বসির বুড়া কি কোরানের আয়াত গবেষণা করিয়া কাল কচুর কষ যে উপকারী তাহা বাহির করিয়াছে? কালো কচুর কষের উপকারীতার বিষয়ে কি কোরানে উল্লেখ আছে?
বিজ্ঞানের আবিষ্কারের ফলে এখন তো বাজারে বিভিন্ন ধরনের এন্টিসেপটিক পাওয়া যায়। স্যাভলন, ডেটল জাতীয় অনেক ধরনের তরল, পাউডার, কিম্বা ক্রিম জাতীয় ঔষধ বাহির হইয়াছে। কেন ১৪০০ বছর আগে মোহাম্মদ কোরান গবেষণা করিয়া এগুলি আবিষ্কার করিতে পারিলেন না?

দুই:
শীত চলিয়া গিয়াছে। চৈত্রের গরম হাওয়া মাঠ ঘাটকে উত্তপ্ত করিয়া তুলিয়াছে। মজম আলীদের মাইঠ্যালের পানি প্রায় শুকাইবার উপক্রম হইয়াছে। আমার পাড়ার ছেলেরা ঐ মাইঠ্যালে নামিয়া হাতাইয়া হাতাইয়া মাছ ধরিতেছে। আমি বেশ কতগুলি টাকি, ভেদা ও বাইল্যা মাছ ধরিয়াছি। হাতাইতে হাতাইতে একটি শিং মাছ ধরিয়াছি, পানির কিনারে দাঁড়ানো আমার ভাতিজা বাচ্চুর হাতের বদনায় মাছ রাখিতেছি। জিয়াল মাছটি মাথা ঘুরাইয়া আমার হাতে কাঁটা বসাইয়া দিল। আমি আর পানিতে নামিলাম না। তীব্র একটা বেদনায় হাত জ্বলিতে লাগিল।
আমার এই দুরবস্থা দেখিয়া মজম আলীর মাতা মাইঠ্যালের পাড়িতে গজানো ‘বিষ কাটালী’ গাছের পাতা ছিড়িয়া হাতের তালুতে বুড়া আঙ্গুল দিয়া পিষিয়া রস বাহির করিয়া আমার ক্ষতস্থানে মাখাইয়া দিলেন। তারপর আমাকে তাহার বাড়িতে লইয়া গিয়া, লোহার হাতা, আখার আগুনে গরম করিয়া ক্ষতস্থানে চাপ দিয়া সেঁক দিলেন। আমার বেদনা অনেক কমিয়া গেল। আমার মুখে হাসি ফুটিল। তাহা দেখিয়া মজম আলীর মাতা মন্তব্য করিলেন, “জিয়াল মাছের কাঁটা খাইয়া তখন তো খুব ভ্যাবাইলা, আর এখনতো খুব হাসতিছাও।”
বিষ কাঁটালীর বিষ নাশের কথা কয়জনে জানে? (১ নং এর মত এখানেও একই প্রশ্ন রাখিলাম)

তিন:
ঈশ্বরদী আমবাগানে ব্যবসায়ী মুসলিম মিঞা। বৃদ্ধ মা, ৪ টি ছেলে মেয়ে নিয়ে ছোট্ট সংসার। ব্যবসায়ে যা আয় হয় তাহাতেই স্বচ্ছন্দে চলিয়া যায় সংসার। কাহারো সাতে পাচে থাকে না। অমায়িক নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ। নিজে নির্ঝঞ্ঝাট হইলে কি হইবে, আসলে দুনিয়াটা তো নির্ঝঞ্ঝাট নহে। এই ঝঞ্ঝাটটা বাধাইল আমাশয় রোগ।
মুসলিম মিঞা দারুন আমাশয়ে ভুগিতে লাগিলেন। শহরের নাম করা ডাক্তারের ব্যবস্থা মত ফ্লাজিল ট্যাবলেট, অবশেষে সুমাইসিন ক্যাপসুল গিলিয়া গিলিয়া হয়রান, কিন্তু আমাশয় রোগটা আর হয়রান হয় না।
ইস্ বন্ধুর ভাইয়ের বিবাহের দাওয়াতটা পর্যন্ত বাতিল করিতে হইল। বরযাত্রীরা ফিরিয়া আসিয়া খানা পিনার যে ফিরিস্তি দিল, তাহাতে মুসলিম মিয়ার জিব্বায় পানি না আসিলেও চোখের কোণায় পানি জমা হইল। বরযাত্রী বন্ধু কহিল, “তোমার অবস্থাটা বুঝতে পারছি, আমাশয়ে তল পেটে দারুন বেদনা হচ্ছে তো?”
“হ্যাঁ ভাই, তুমি ঠিক কেচটা ঠিকই ধরিয়াছ। কত অসুদ খাইলাম, কিন্তু আমাশয় রোগটা সারিল না।” বন্ধুটি কহিল, “আমার কথা যদি বিশ্বাস কর, তবে বিনা পয়সায় তোমার আমাশয় সেরে যাবে।”
মুসলিম মিয়া কহিল, “পয়সা খরচ কর্ত্তে তো কিরপনতা করছি নারে ভাই। যদি কেউ আমার এই কষ্টকর রোগটা সারাতে পারে, এক্ষুনি তাকে ৫০০ টাকা দিব।”
বন্ধুটি হাসিয়া কহিল, “টাকা আপাতত: পকেটেই রাখ, যা বলি তাই কর।”
করুন নয়নে মুসলিম মিয়া বন্ধুটির মুখের প্রতি তাকাইল। বন্ধুটি গলার স্বরটাকে গম্ভীর করিয়া এক রকম আদেশের সুরেই কহিল, “সাদা কাঁটাক্ষুঁড়ে গাছের শিকড় এক মুঠ লইয়া পরিষ্কার পানি দিয়া ধুইয়া পাটায় ছেঁচিয়া রস একটা গেলাসে লইয়া, তার মধ্যে কুশুরের গুড় দিয়া সরবৎ করিয়া দৈনিক ৩ বার খাও। দুই দিন খাইলেই আমাশয় ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়িয়া পালাইবে।”
বন্ধুর পরামর্শে মুসলিম মিঞা কাঁটাখুড়ের শিকড়ের সরবৎ পান করিল।
একি যাদু না ম্যাজিক? দুই দিনেই দীর্ঘদিনের আমাশয় একেবারে সারিয়া গেল।
মুসলিম মিয়া ভাবিতে লাগিল, হাতের কাছে ভাল অসুদ থাকিতে আমরা ডাক্তারের কাছে এত দৌড়াই কেন?
কাঁটাক্ষুড়া যে আমাশয়ের শ্রেষ্ঠ ধন্বন্তরী ঔষধ, মুসলিম মিয়া এই কথাটা বন্ধু মহলে প্রচার করিতে লাগিল।

চার
মুসলিম মিয়ার কন্যা ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী। পাড়া প্রতিবেশী লোকেরা বলে, ‘মেয়ে তো নয়, যেন হলদে পাখির ছাও। বিয়ে দিতে পয়সা লাগবে না। পয়সা দিয়েই নিয়ে যাবে।’ এহেন মন্তব্যে পিতা মনে মনে আত্মপ্রসাদ লাভ করে, আর আল্লাহর হাজার শোকর করে।
মেয়ের পায়ের পাতায় একটি ফুস্কুড়ি হয়। ক্রমে সেই ফুস্কুড়িটি গলে গিয়ে সারা পাতায় ঘা হয়। পিতা সুচিকিৎসার সুব্যবস্থা করে। শহরের গণ্যমান্য সব চিকিৎসকের পরামর্শ মতই অসুদ পানি খাওয়ায়। দিন যায়, কিন্তু ঘা সারে না। পয়সা খরচ হয় বেশী, ঘায়ের আয়তনও হয় বেশী।
মেয়ের কষ্টে পিতা চিন্তিত হয়। বন্ধুদের পরামর্শে মেয়েকে রাজশাহী শহরের বড় হাসপাতালে লইয়া যায়। অগাধ অর্থ ব্যয় হয়। দিন যায়, হপ্তা যায়, মাসও চলিয়া যায়, কিন্তু পায়ের ঘা আর যায় না।
পিতামাতা বড়ই চিন্তিত হয়। বাড়ির ভাড়াটিয়ার পরামর্শে এক কবিরাজের সঙ্গে দেখা করে। পায়ের ঘা দেখিয়া কবিরাজ অসুদের ফরমূলা বাতলাইয়া দেয়।
গান্ধাফুলের পাতা পাটায় বাটিয়া আফিমের সহিত মিশাইয়া মলমরূপে পায়ে লাগাইতে বলে। কবিরাজের ফরমূলা মত গাঁদা ফুলের পাতা পাটায় বাটিয়া, তাহার মধ্যে আফিম মিশাইয়া পায়ের ঘায়ে প্রলেপ দেয়।
কিন্তু মুসলিম মিয়ার বিশ্বাস হয় না। এত টাকা খরচ করিয়া সারিল না। আর এই সামান্য জিনিষে সারিবে!
কি আশ্চর্য দুই দিন ব্যবহার করিবার পর ঘা শুকানো শুরু হইয়া গেল। মাত্র এক সপ্তাহ ব্যবহারে সম্পূর্ণ সারিয়া গেল।
বাইদারা যে বলে- চিনলে জরি, না চিনলে জঙ্গলের খড়ি। আসলে কথাটা সত্যি।

পাঁচ
মাঘ মাস। প্রচন্ড শীত। আমার স্ত্রী প্রথম পুত্র সন্তান প্রসব করিল। নবজাতকের কামানের পর আমার স্ত্রীর হাতের তালু ফাটিয়া যায়। শীতের শেষে সাধারণত পায়ের গোড়ালী ও ওষ্ঠদ্বয় ফাটে। কিন্তু হাতের তালু ফাটে, একথা শুনি নাই।
নবজাত শিশুর পরিচর্যা করা ও বাটনা বাটা ও কুটনা কোটার কাজ করিতে পারে না। বড় কষ্ট হইতে লাগিল, অন্যে ভাত মাখাইয়া দেয়, চামচ দিয়া মাখা ভাত গলধঃকরণ করে।
পাবনার প্রবীণ ডাক্তারবাবু, পরিতোষ সাহাকে কল দিলাম। দেখিয়া শুনিয়া ক্যালাডল ব্যবস্থা দিল। ক্যালাডল ডাক্তারের উপদেশ মত প্রায় ১ মাস ব্যবহার করা হইল। কিন্তু ফলোদয় হইল না। খবর শুনিয়া আমার শ্বশুড় আসিয়া তাহাকে লইয়া গেল।
গ্রামের মশহুর প্রবীণ ডাক্তার মোকছেদ হোসেনের চিকিৎসাধীনে রহিল। শীত ফুরাইয়া গেল। গরম পড়িল। সবাই ভাবিল এইবার নিশ্চয়ই নিরাময় হইবে। জৈষ্ঠের প্রচণ্ড গরমেও ঘা নিরাময় হইবার কোনই লক্ষণ দেখা গেল না।
আমার এক বন্ধু শুনিয়া কহিল- ইহা ছোঁচবাত, ইহার কোন ঔষধ নাই। প্রতিদিন সকাল বেলায় বাড়ির চারিদিকে ঘুরিতে হইবে এবং হাতের কাছে যে গাছ পাওয়া যাইবে, তাহার পাতা ছিড়িয়া দুই হাতের তালুতে ঘষিতে হইবে। ঐ সব গাছের মধ্যে হয়ত এমন একটি পাতা থাকিতে পারে যাহার গুণে ঐ ফাটা ঘা নিরাময় হইবে। পরামর্শমত প্রায় ৮/১০ দিন পাতা ঘষিল। কিন্তু, যথাপূর্ব্বং তথা পরং।
আমিরুল নামে আমার কারখানার এক শ্রমিক আমার স্ত্রীকে কহিল, “চাচী, আমার বড় মামীর আপনার ন্যাক্যাল ঘা হইছিল, কত অশুধপাতি খাইল। কিন্তু সারিল না। হ্যাশে ফিনাইল মাখিয়া সারিয়া গেল। আপনে ফিনাইল মাখেন সাইরা যাইব।”
অবোধ বালকের কথা শুনিয়া আমার স্ত্রীর বিশ্বাস জন্মিল, হয়ত সারিয়া যাইবে।
সে দুই আনা পয়সা দিয়া ফিনাইল আনাইলো। দুই দিন মাখিলে ফাটা ঘা শুকাইয়া গেল। এক সপ্তাহ পর হাতের তালু মসৃণ হইল।
এখন আমার ছেলের বয়স একত্রিশ, এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে আমার স্ত্রীর হাত মসৃণই আছে। আমার স্ত্রী বলে, “কত টাকা পয়সা খরচ হইল, ক্যালাডল, আরো কত কি অসুদ খাইলাম- ভাল হইল না, আর সামান্য দুই আনার ফিনাইলে ভাল হইল। আল্লাহ পাক কোন্ জিনিসে কোন্ গুণ দিয়া থুইছে তাকি আমরা জানি?”

ছয়:
আমার চতুর্থ পুত্র। নাম রাখা হইয়াছে ওবাইদুল হক, সবাই ডাকে ওবাইদুল্লাহ। হামাগুড়ি হইতে প্রমোশন পাইয়াছে। ওবাইদুল্লাহর দরদী আত্মীয়গণ ওবাইদুল্লাহর হাত ধরিয়া বলে, হাঁটি হাঁটি পা পা। ওবাইদুল্লাহ এক পা দুই পা করিয়া অগ্রসর হয়, আর খুশীতে হাসিতে থাকে। ল্যাটা মারিয়া বসিয়াও থাকে। শীতকাল আসিল। মাঠে আমন ধানে পাক ধরিল। বিকালের পড়ন্ত রোদে ওবাইদুল্লাহকে কোলে লইয়া নলবোনা মাঠে গেলাম। সারা মাঠে পাকাধানের সোনালী শিষের সমারোহ, চোখ জুড়াইয়া যায়। মৌ মৌ গন্ধে পেটও ভরিয়া যায়।
ওবাইদুল্লাহ প্যান্ট ভরিয়া পায়খানা করিল। নদীর পানিতে তাহাকে শৌচাইয়া দিলাম। শৌচাইতে গিয়া দেখি তাহার পাছায় ফুস্কুরি হইয়াছে।
দুইদিন পরে ঐ ফুস্কুরি গলিয়া সারা পাছায় ঘা হইল। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মলম দিতে লাগিলাম। ডাক্তার কিছু খাওয়ার বড়িও দিলেন। কিন্তু ঘা আর সাড়ে না। ছেলেকে কোলে করা যায় না। খুবই কষ্ট হয়।
একদিন কথা প্রসঙ্গে পাবনা মনোহারী দোকানের মালিক বক্কার মিঞা কহিল, “ভাই, ঢাকার লালমোহন সাহার তৈরি, শংখ ও পদ্ম মার্কা ‘ক্ন্ডু দাবানল’ মলম লাগান, দুই দিনেই ঘা সারিয়া যাইবে।” বলিয়াই সে একটি কৌটা তাহার দোকানের আলমারীর ভিতর হইতে বাহির করিয়া আমার হাতে দিল। জুতার কালির মতো কৌটা। উপরে, পদ্মফুলের উপর শংখের ছবি। লিখা আছে, লাল মোহন সাহার শংখ ও পদ্ম মার্কা কুন্ডুহ দাবানল। কৌটার তলায়, কি কি রোগ নিরাময় হয় ও ব্যবহার পদ্ধতি লিখা আছে।
দুইদিন মাত্র ব্যবহার করিলে, ঘা একেবারে সারিয়া গেল।
ঐ মলম আরো কয়েকটি ছেলের ঘায়ে ব্যবহার করিয়া আশ্চর্য ফল পাইয়াছি।
বাস্তবিকই কুন্ডুহ দাবানল এক ধন্বন্তরী ঘায়ের মলম। বাংলাদেশ হওয়ার পর আর পাওয়া যায় না।

সাত:
বয়স তিন কুড়ি পার হইয়াছে অনেক আগেই। এই বয়সে অনেকের মুখের মধ্যে দাঁতের নাম গন্ধ পর্যন্ত থাকে না। আমার কয়েকজন আত্মীয়ের বয়স তিন কুড়ির অনেক নিচেই রহিয়াছে, কিন্তু তাহাদের মুখ গহব্বরের বিশেষ অস্ত্রগুলি পরে আসিয়া সবার আগেই চলিয়া গিয়াছে। এই অস্ত্রগুলি মুখ বিবরে থাকাকালীন মর্যাদা দিলে চলিয়া যাইতে বিলম্ব করে। বিখ্যাত মনিষীগণ এই কথা কহিয়া থাকেন- ‘দাঁত থাকিতে দাঁতের মর্যাদা দেওয়া উচিত।’ দাঁত থাকিতে দাঁতের মর্ম্ম না জানিলে, পরিশেষে অনাকাংখিত বুড়া উপাধি পাইতে হয়।
অবাঞ্চিত বুড়া উপাধিতে কেহ যাহাতে মধুর সম্বোধন না করে, সেজন্য দাঁতের যেটুকু যত্ন করা কর্তব্য তাহার চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশিই করি।
মধুর সম্পর্কের যুবকেরা আমার দাঁতের ঔজ্জ্বল্য দেখিয়া বলে, “দুলাভাইয়ের দাঁত দেখছি সবগুলি ঠিক আছে,” পরক্ষণেই কৌতুহল হইয়া প্রশ্ন করে, “হ্যাঁ দুলাভাই বুট ভাজা চিবাইতে পারেন তো?”
আমি ওষ্ঠদ্বয়কে সংকুচিত করিয়া উজ্জ্বল কোদাল মার্কা দন্তরাজিকে বিকশিত করিয়া বলি, “দিয়াই দ্যাখনা এক ডালা, টেস্ট (test নয়, taste)পরীক্ষাটা হয়েই যাক। ”
আমার এহেন গৌরবের ধন, ছেদন দন্তের একটা নড়বড়ে হইয়া স্থানচ্যুত হইবার আবেদন করিল। আবেদনপত্র মঞ্জুর করিব করিব করিতেছে। এমন সময়, হাকিমুল নজরুল জটাধারী, আবেদন নাকচ করিবার পরামর্শ দিলেন। কহিলেন, “আমি যাহা বলি একটা সাদা কাগজে লিখে নেন্ত।”
লিখিলাম-:
১। নারিকেলে শিকড় এক মুট।
২। সুপারির শিকড় এক মুট।
৩। পেয়ারার পাতা এক মুট।
৪। ডালিমের পাতা এক মুট।
৫। বাবলার ছাল এক মুট।
৬। জিগার ছাল এক মুট।
৭। ফিটকিরি আধা তোলা।
৮। তূতে এক চিমটি।
৯। পানি এক কেজি।
প্রথমে শিকড়গুলি পরিস্কার জলে ধৌত করিয়া, কুচি কুচি করিয়া কাটিবে। একটি পাত্রে নয় নম্বর তালিকার পানি দিয়া, উহাতে উপরোক্ত দ্রব্যগুলি দিয়া জ্বাল দিতে থাকিলে পানি টগ্বগ্ করিয়া ফুটিতে ফুটিতে যখন অর্ধেক পরিমিত রহিবে তখন একটি কাপড়ে ছাকিয়া একটি বোতলে রাখিবে। চায়ের কাপে মুখে সহ্য হয় এরূপ গরম পানি দিয়া তাহার ভিতর চা চামচের এক চামচ কাত দিবে। উক্ত পানি মুখে দিয়া ২/৩ বার অনেক্ষণ ধরিয়া কুল্লি করিবে। সপ্তাহ খানেক পরেই বুঝিতে পারিবে, ছেদন দন্তটি স্বস্থানে বহাল তবিয়তে থাকিয়া কর্তব্য পালন করিতেছে।
হেকিম সাহেবের নির্দেশ মত ৮/৯ দিন, দিনে রাত্রে ৪/৫ বার করে কুলি করিয়া যৎপরোনাস্তি উপকৃত হইয়াছি। ছেদন দন্তটি ভারত-বাংলাদেশের মাঝখানে অবস্থিত। ডিমার্কেশন পোষ্টের মতই দৃঢ়ভাবে দাঁড়াইয়া আছে।
আমাদের দেশের সর্বত্র, আনাচে কানাচে, রোগ নিরাময়ের দাওয়াই, কত গাছ গাছড়া রহিয়াছে, তাহার প্রয়োগ জানার অভাবেই অবহেলিত থাকে। বয়োবৃদ্ধ জ্ঞানী লোকেরা এসব দ্রব্যের গুণ সম্পর্কে সচেতন। আগ্রহী ব্যক্তিকে অনেক তথ্য দিতে পারেন।

আট:
মানবদেহের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গুরুত্ব অপরিসীম। আবার এই সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মধ্যে কতকগুলি আছে যাহা ইন্দ্রিয় নামে পরিচিত। মানুষ জ্ঞান অর্জনের নিমিত্ত প্রকৃতিদত্ত এই সব ইন্দ্রিয় প্রাপ্ত হয়েছে। চক্ষুর মাধ্যমে দর্শন জ্ঞান অর্জিত হয়। সুগন্ধ, দুর্গন্ধ সম্বন্ধীয় জ্ঞান ঘ্রানেন্দ্রিয় নাসিকার মাধ্যমে অর্জিত হয়। শব্দ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জিত হয় শ্রবনেন্দ্রীয় কর্ণের মাধ্যমে। টক মিষ্টি ঝাল কটু তিক্ত পানসে প্রভৃতি স্বাদ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জিত হয়, আস্বাদন ইন্দ্রিয় জিহ্বার মাধ্যমে। উষ্ণ, ঠান্ডা নাতিশীতোষ্ণ প্রভৃতির জ্ঞান অর্জিত হয়, মানবদেহের সর্ব বৃহৎ অঙ্গ, চর্মের মাধ্যমে। স্পর্শ সুখ আমরা অনুভব করি এই চর্মের মাধ্যমে।
এই সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গের গুরুত্ব কোনটার চেয়ে কোনটাই কম নহে। মাতৃগর্ভ হইতে যদি কেহ কোন একটি ইন্দ্রিয় ব্যতিরেকে জন্মগ্রহণ করিয়া থাকে তবে সেই ব্যক্তি সেই ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য বা ইন্দ্রিয় লব্ধ জ্ঞান হইতে বঞ্চিত হয়। তথাপি, মনুষ্যগণ চক্ষুকেই বেশী মূল্যবান মনে করে। বস্তুতঃপক্ষে চক্ষু যে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই। আমার শ্র্রদ্ধেয়া দাদী আম্মা (ঠান দিদি) প্রায়শঃ বলিতেন, “চক্ষু রতনের দাম পনর আনা, আর বাদ বাকী দেহটার দাম এক আনা। (বর্তমানে আনা নাই, সব পয়সা। দাদী আম্মা বাঁচিয়া থাকিলে হয়ত বলিতেন, চক্ষুর দাম পঁচানব্বই পয়সা, আর দেহটার দাম পাঁচ পয়সা।) এমন মূল্যবান চক্ষু রত্নটিকে যত্ন করিতে কার্পন্য করি না। একখানা চিকিৎসা বিদ্যার চক্ষু অধ্যায়ে পড়িয়াছিলাম চক্ষুর ব্যায়াম চক্ষুর দৃষ্টি শক্তিকে বৃদ্ধি করে।
চক্ষুর ব্যায়ামের পদ্ধতি-
সূর্য উদয়ের পূর্বে সবুজ বৃক্ষাদির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া রাখিবে। দশ মিনিটকাল স্থির দৃষ্টে চাহিয়া থাকিবে, পলক ফেলিবে না। চক্ষু দিয়া পানি পড়িবে, তারপর সহসা চক্ষুর দৃষ্টি নিজ বক্ষস্থলে ফিরাইবে। মাথা না ঘুরাইয়া চক্ষুর দৃষ্টি একবার ডাইনে, আবার বামে, আবার উপরে নিচে বার বার ঘুরাইবে। তারপর কিছুক্ষণ চক্ষুর পাতা বন্ধ করিয়া রাখিবে এরূপ কার্য প্রতিদিন অভ্যাস করিবে। ইহাতে চক্ষুর যাবতীয় পীড়া দূরীভূত হইয়া চক্ষুর জ্যোতি বৃদ্ধি পাইবে। বহু দূরের জিনিস সহজে দৃষ্টি গোচর হইবে।
খনার বচনের কেতাবে পড়িয়াছিলাম- “আহারান্তে চোখে জল, হয় তার দৃষ্টি প্রবল।” অর্থাৎ আহার শেষে থালে হাত ধুইয়া ডান হাতের মধ্যমা অঙ্গুলী ভিজাইয়া দুই চোখে দুই ফোটা পানি দিবে, ইহাতে চক্ষুর দৃষ্টি শক্তি বৃদ্ধি পাইবে।
অমূল্য রতন চোখের দৃষ্টিশক্তিকে অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য যথা সম্ভব সব কিছুই করি। মাঝে মাঝে চক্ষুর ব্যায়াম করি। আহারান্তে চোখে এঁটোজলের ফোঁটাও লই। চোখের জ্যোতি আমার ভালই। দূরের ব্যক্তিকেও চিনিতে ভুল হয় না, সুচের ধাগায় সুতা পরাইয়া দেই।
বিপদসঙ্কুল এই পৃথিবী। এখানে বিপদ কখন কোন দিক হইতে আসিবে সঠিক করিয়া কেহই বলিতে পারে না। চেষ্টা ও য্ত্ন করিলেও যে চির জীবন সুস্থ সবল থাকা যায় না, তাহা অতীতের লিখিত ইতিহাসে ভুরি ভুরি প্রমাণ রহিয়াছে।
চক্ষুর কার্যকারীতা অক্ষুন্ন রাখার জন্য চেষ্টা ও যত্নের ত্রুটি করি নাই। কিন্তু আকস্মিক বিপদ হইতে রক্ষা পাইবার কোনই উপায় নাই।
সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলিয়া পড়িয়াছে। মাঠের কাজ সমাপ্ত করিয়া গৃহে প্রত্যাবর্তন করিতেছি। চেচাইনা দোয়ার সাকোর উপর উঠিয়াছি। হঠাৎ দক্ষিণ দিক হইতে আকাশের ছোট বোনরি (ঘূর্ণিবায়ু) আসিয়া আমার চোখ মুখে ঝাপটা দিয়া গেল। তৎক্ষনাৎ বাম চোখটা কুট কুট করিতে লাগিল। আমি পথ চলিতে চলিতে বাম হাতের তালু দিয়া চোখ কচলাইলাম। পানি বাহির হইল।
রাত্রে যতক্ষণ জাগ্রত রহিলাম ততক্ষণই চোখের ভিতর কাঁটা কাঁটা ফুটিতে লাগিল। অসহ্য ঠেকিতে লাগিল। সকালে গিন্নি চোখ দেখিয়া কহিল, “চোখের মনির উপর ফুলি পড়িয়াছে। ফুলির ভাল চিকিৎসা করেন, ভেড়ামারার পৌরসভার চেয়ারম্যান সাহেব।”
কালবিলম্ব না করিয়া চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি গেলাম। চক্ষু দেখিয়া বলিলেন, “ফুলি পড়িয়াছে, ভয়ের কোন কারণ নাই, খোদার রহমতে, আমার ঝাড়ায় সারিয়া যাইবে।” তাহার আশ্বাস বাণীতে মনে শান্তনা পাইলাম। তিনি আলাপাতা, একটি কলকিতে জ্বালাইয়া, আরেকটি কলকি দিয়া ঢাকিয়া, কলকীর তলায় ফুঁদিয়া ধোঁয়া আমার চোখে দিলেন।
মাত্র পাঁচদিনের চিকিৎসায় ফুলি কাটিয়া চোখ পরিস্কার হইল। চক্ষুর এই চিকিৎসা বাবদ তিনি কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করিলেন না। উপরন্তু তিনি প্রতিদিন সকালে আমাকে চা নাস্তা খাওয়াইতেন।
তিনি এই বিদ্যাটা শিক্ষা করিয়াছিলেন, তাহার পিতার নিকট। তাহার পিতাকে লোকেরা সাত গেরামের পরামানিক বলিয়া শ্রদ্ধা ও সম্মান করিত। তিনি চক্ষু চিকিৎসায় অত্যন্ত পারদর্শী ব্যক্তি ছিলেন, তাহার সুচিকিৎসায় অত্র এলাকার লোকের চক্ষুর পীড়া নিরাময় হইয়াছে, কতজনে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়া পাইয়াছে।
কিন্তু তিনি চিকিৎসা বাবদ কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করেন নাই। তাঁহার চিকিৎসা ছিল সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। তিনি দেশীয় গাছ-গাছড়া দ্বারা চিকিৎসা করিতেন। গাছ গাছড়ার গুণাগুণ সম্বন্ধে তাঁহার জ্ঞান ছিলো অগাধ।

নয়:
শিশুরা স্বভাবতই চঞ্চল হয়। বিশেষ করিয়া ৬/৭ বৎসর বয়সের শিশুগণ একটু বেশি চঞ্চল হয়। আমার এক ভাইজতা, চঞ্চলতায় বাড়ির আর সব ছোটদের সে গুরু। ডাক দোহাই মানে না।
বাড়ির পিছনে খেসারীর ভুই। সেই খেশারীর ভুইয়ের ভিতর পলান টুক টুক খেলিতেছে। বোতল ভাঙ্গা কাঁচ কে যেন খেশারীর ভুইয়ে ফেলিয়াছে, আমন ধানের নাড়ায় জড়াইয়া খেশারী স্থানে স্থানে প্রায় ২ হাত উচু হইয়াছে। সেই উচু খেশারীর আড়ালে লুকাইতে গিয়া ভাঙ্গা বোতলের কাঁচে পা কাটিয়া গেল। দর দর করিয়া রক্ত পড়িতে লাগিল। কান্দিতে কান্দিতে বাড়ি আসিল।
রক্ত এবং কাটা স্থানের হা দেখিয়া আমি অস্থির হইলাম। কলিকাতা হইতে আনা বালীগঞ্জ কেমিক্যাল, হাতকাটা বা মহাশংকর তেল ঘরে ছিল। পরিষ্কার নেকড়া দিয়া রক্ত মুছিয়া ছাপ করিয়া ঐ তেল লাগাইয়া দিয়া একটি সাদা পরিষ্কার নেকড়া দিয়া ব্যান্ডেজ করিয়া দিলাম। ৪/৫ দিন পর দেখি কাটা স্থান জোড়া লাগিয়া গিয়াছে। ব্যাথা বেদনা কিছু নাই। সম্পূর্ণ সারিয়া গিয়াছে।
মহাশংকর তেলের গুণ আছে।
[পুনশ্চ: উপরোক্ত টোটকা চিকিৎসাগুলো চিকিৎসকেরা কি কোরান গবেষণা করিয়া পাইয়াছে?]
-০০০-
অনুলেখক-মাহফুজ।

*মোকছেদ আলী (১৯২২-২০০৯)। স্বশিক্ষিত।

১. ডাক্তার মোকছেদ হোসেন। এম বি বি এস, এফ আর সি এস। এই ডাক্তারের মৃত্যু হয় ১৯৭৫ সালে মোকছেদ আলীর বাড়ীতে। সে সম্পর্কে লেখকের ‘মৃত্যুকথা’ নামে একটি পান্ডুলিপি রয়েছে।