জীবনানন্দের ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থের একটি অন্যতম কবিতা ‘নিরঙ্কুশ’
জাফর উল্লাহ্
জীবনানন্দ দাশ (জীঃ দাঃ) বেঁচে থাকাকালীন তাঁর ছয়টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন। প্রথমটি ছিল ‘ঝরা পালক’ যেটি প্রকাশ হয়েছিল ১৯২৭ সনে। আর সর্বশেষটি, ‘শ্রেষ্ট কবিতা’, বের হয়েছিল ১৯৫৪ সনে। তাঁর পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘সাতটি তারার তিমির’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৮ সনে। এই গ্রন্থের কবিতাগুলো – সর্বমোট ৪৯টি – লিখা হয়েছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন অর্থাৎ ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সন এই সময়ের মধ্যে।
যদিও ভারতবর্ষকে এই মহাযুদ্ধ সরাসরিভাবে জড়ায়নি, তবুও যুদ্ধের প্রভাব কমবেশী পড়েছিল সর্বত্রই। এই মহাযুদ্ধের শেষের দিকে জাপানীরা যখন বার্মা আক্রমণ করে তখন বৃটিশরা তাদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে ভারত থেকে অজস্র সৈন্য নিয়ে তাদের উপর পালটা আক্রমণ করে। এই বার্মা ফ্রন্টে যুদ্ধ চলাকালীন কোলকাতা, শিলং, ঢাকা, আরো নিকটবর্তী আন্যান্য শহর থেকে সাপ্লাই যেতে থাকে মণিপুর, নাগাল্যাণ্ড, ও বার্মা সীমান্তে। এই কারণে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রভাব পূর্ব ভারতে যতটুকু পড়েছিল ততটুকু ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে পড়েনি। এই মহাযুদ্ধ নিশ্চয় জীঃ দাঃ কে প্রভাবিত করেছিল।
‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যগ্রন্থের আনেক ক’টি কবিতায় ফার-ইস্টের বিভিন্ন বন্দরের কথা উল্লেখ আছে। তাঁর ‘সৃষ্টির তীরে’ কবিতায় হিটলারের নামও উল্লেখ আছে। এই মহাযুদ্ধের রণদামামা বেজে উঠায় পৃথিবীটার সর্বত্রই ছেয়ে গিয়েছিল অন্ধকারে। তাই এই কাব্যগ্রন্থের কোথাও বাংলার নৈসর্গিক দৃশ্যের বর্ণনা নেই। এসবের পরিবর্তে দেখলাম আছে ‘জুহু’ কবিতায় এরোড্রামের কলরবের কথা। এই কাব্যের অধিকাংশ কবিতার বিষয়বস্তু জড়িয়ে আছে বিষন্নতায়।
এই ডিপ্রেসিং কবিতাগ্রন্থের নাম ‘সাতটি তারার তিমির’ কেন রাখা হয়েছিল সেটি নিয়ে একদিন অপরাহ্নে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে চিন্তা করছিলাম আমি। হঠাৎ মনে হলো সাতটি তারা কী আমাদের পৃথিবীর ৭টি মহাদেশ? সারা ধরায় এই মহাযুদ্ধের কারণে ঘন অন্ধকার নেমে এসেছিল। তাই কবির কাছে বোধহয় মনে হয়েছিল সারা পৃথিবীটা তিমির আচ্ছন্ন।
জীঃ দাঃ এর ‘নিরঙ্কুশ’ কবিতাটি এই কাব্যগ্রন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত। বছর কয়েক আগে আমি এই কবিতারটির ইংরেজী অনুবাদ করেছিলাম। এই লেখায় আমি জীঃ দাঃ এর এই কবিতাটি তুলে ধরছি আর সেই সাথে আমার আনুবাদটির পুনর-প্রকাশ করছি।
—————–
নিরঙ্কুশ
জীবনানন্দ দাশ
মালয় সমুদ্র পারে সে এক বন্দর আছে শ্বেতাঙ্গিনীদের।
যদিও সমুদ্র আমি পৃথিবীতে দেখে গেছি ঢের :
নীলাভ জলের রোদে কুয়ালালুম্পুর, জাভা, সুমাত্রা ও ইন্দোচীন, বালি
অনেক ঘুরেছি আমি – তারপর এখানে বাদামি মলয়ালী
সমুদ্রের নীল মরুভূমি দেখে কাঁদে সারাদিন ।
শাদা-শাদা ছোটো ঘর নারকেলখেতের ভিতরে
দিনের বেলায় আরো গাঢ় শাদা জোনাকির মতো ঝরঝরে ।
শ্বেতাঙ্গদম্পতি সব সেইখানে সামুদ্রিক কাঁকড়ার মতো
সময় পোহায়ে যায়; মলয়ালী ভয় পায় ভ্রান্তিবশত,
সমুদ্রের নীল মরুভূমি দেখে কাঁদে সারাদিন ।
বাণিজ্যবায়ুর গল্পে একদিন শতাব্দীর শেষে
অভ্যুত্থান শুরু হ’লো এইখানে নীল সমুদ্রের কটিদেশে;
বাণিজ্যবায়ুর হর্ষে কোনো একদিন,
চারিদিকে পামগাছ – ঘোলামদ – বেশ্যালয় – সেকোঁ – কেরোসিন
সমুদ্রের নীল মরুভূমি দেখে রোখে সারাদিন ।
সারাদিন দূর থেকে ধোঁয়া রৌদ্রে রিরংসায় সে উনপঞ্চাশ
বাতাস তবুও বয় – উদীচীর বিকীর্ণ বাতাস;
নারকেলকুঞ্জবনে শাদা-শাদা ঘরগুলো ঠান্ডা ক’রে রাখে;
লাল কাঁকরের পথ – রক্তিম গির্জার মুন্ডু দ্যাখা যায় সবুজের ফাঁকে ;
সমুদ্রের নীল মরুভূমি দেখে নীলিমায় লীন ।
———
Inevitable
Jibanananda Das
(Translated by A.H. Jaffor Ullah)
There happens to be a port for light-skinned gals on the shore of Malay Sea.
Seen many a sea all across the globe; been through Kuala Lumpur, Java,
Sumatra, Indochina, and Bali where the blue mist-laden sun’s ray had touched me.
Now it pains me to see a tan Malayan woman crying all day long.
She watches a blue hued desolate place on the shore of the sea.
There happens to be white colored cottages scattered inside a palm grove.
Those look whiter in the daylight just as fireflies would shine in the dark.
Light skinned couples mill around there just as crabs would hug a seashore,
They spend times, the Malaya woman frets and flusters by mistake,
She cries watching this blue hued desolate place on the shore of the sea.
At the turn of the century, many ocean voyagers were heading this way,
towards this constricted harbor; thanks a million to the trade wind.
Because of good fortune bestowed by trade wind, one day the wasteland
became filled with palm trees, opaque liquors, brothel, culverts, kerosene. Now she
zealously guards this blue hued desolate place on the shore of the sea all daylong.
She watched cloud-filled sunrays from a distance all day long with lustful eyes;
she turned forty-nine. The wind from a dispersed zephyr still blows;
They keep those white cottages cool all daylong now.
Red dirt filled road perks up the red spire of a church which is visible amidst greenery.
The blue hued desolate place now ceases to exist.
———————-
The original Bangla poem appeared in “The darkness of seven stars”
Dr. A.H. Jaffor Ullah, a researcher and columnist, writes from New Orleans, USA.
(F) (G) (L)
দীপেন ভট্টাচার্য এবং বকলমের মন্তব্যদুটো চমৎকার!
@দীপেন ভট্টাচার্য
অনেক অনেক ধন্যবাদ মন্তব্য রাখার জন্য। সপ্তর্ষী মন্ডলের কথা আমারো মনে হয়েছিল কিন্তু! বাংলা অভিধানে ‘মলয়’ শব্দটির দুটো মানে আছে। একটি হচ্ছে – দক্ষিণ ভারতের পশ্চিম ঘাট পর্বতমালা আর অপরটি হচ্ছে – মালয়। ‘নিরঙ্কুশ’ কবিতাটি পড়ে আমার প্রথম থেকেই মনে হয়েছে কবি মালয় এর কথা লিখেছেন কেননা আর যে ক’টি জায়গার কথা প্রথমেই বলেছেন সেগুলো হচ্ছে মালয়ের আশপাশের শহরের ও দ্বীপের কথা। জী: দা: কবিতা অনুবাদ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সেটি জেনেও সাহস নিয়ে লেগে পড়ি অনুবাদ করতে। আপনি মাঝে মধ্যে আপনার মন্তব্য রাখবেন। ব্লগে মতবিনিময় এর ব্যাপারে আমি অতি আগ্রহী। লিখায় যদি ভূল তথ্য বা বিশ্লেষণ থাকে তা তখনি শোধরে নেয়া যায়। ভাল থাকবেন।
@বকলম
আপনাকেও ধন্যবাদ মন্তব্য রাখার জন্য। জী: দা: কে ভারতের অন্যতম post-modern কবি বলে আখ্যায়িত করা যায়। কবি যে রবীন্দ্র বলয় থেকে বাইরে থাকতে পেরেছিলেন তার জন্য দায়ী কিন্তু তাঁর academic background। ইংরেজী সাহিত্যের সাথে তাঁর সম্যক পরিচয় ঘটে কলেজ জীবনে। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে যে, জী: দা: মার্কিন কবি Walt Whitman এর কবিতেগুচ্ছ ‘Leaves of Grass’ টি পড়ে ছিলেন আর সেটির দ্বারা প্রভাবিতও হয়েছিলেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘রূপসী বাংলা’র কবিতাগুলো পড়ে সতত মনে হচ্ছিল যেন Whitmanই বাঙালী হয়ে গ্রাম বাংলার রূপের ধারা বিবরণী দিচ্ছেন। ১৯৩০ দশকের অর্থ বিভ্রাট এর ব্যাপারটা পশ্চিম বিশ্বে ঘটেছিল। সেটির প্রভাব জী: দা: এর উপর কতটুকু রেখাপাত করেছিল তা কে বলতে পারবে? আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ constructive dialogue এর জন্য।
@ফরিদ আহমেদ
আপনার সহৃদয় মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা জানবেন।
দীপেন ভট্টাচার্য
পুনঃ শেষবার জীবনানন্দের কাব্যসমগ্র কিনতে গিয়ে মনে হল আমার টাকার কোন অংশই কি কবির উত্তরাধিকারীরা পাবেন? বোধহয় না। বাংলার অর্থনীতিতেও এই সলজ্জ দ্বিধান্বিত মানুষটির অবদান অনেক।
জাফর ভাই,
বিষণ্নতার একটি কারন যুদ্ধ তো অবশ্যই। আধুনিক কবিদের সূচনাকারীরাও (এজরা পাউন্ড এবং টি এস এলিয়ট) নৈরাশ্যবাদী ও যুদ্ধ প্রভাবিত। তবে এই নৈরাশ্যের আরো কারন আছে।
৩০ এর দশকের পূর্বে যে রাবীন্দ্রিক ঐশ্বরিক নিশ্চয়তা ছিল তা ভেংগে যায় বিভিন্ন কারনে। কার্ল মার্ক্স, ডারুইন এবং পরবর্তীতে আইনস্টাইন রাবীন্দ্রিক ঐশ্বরিক নিশ্চয়তা ভেংগে দেন। ফলে মানুষের ভরসার জায়গা হিসাবে ইশ্বর এর গুরুত্ব কমে যায়। আধুনিক কবিরা রবীন্দ্রনাথের মত নিশ্চিতভাবে আর বলতে পারেন না “তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভাল?”।
অন্যদিকে এই যুদ্ধ এবং তার পরিনতির জন্য এমন কোন জায়গাও নেই যেখানে প্রতিকার চাওয়া যেতে পারে।
পশ্চিমের আধুনিক কবিদের বিষণ্ণতার আরেকটি কারন হল ৩০ এর অর্থনৈতিক মহামন্দা। উপমহাদেশের কবিদের এই মহামন্দা খুব একটা আক্রান্ত না করলেও পশ্চিমের কবিদের করেছিল।
কবিরা আস্তে আস্তে আরো সাবজেক্টিভ হয়ে যাচ্ছিলেন। সেকারনেই মনে হয় অনেক শব্দ একেবারেই কবিদের নিজস্ব অনুভূতির। অনেক বেশি আত্মিক। অনেক দুর্বোধ্য শব্দও তারা ব্যবহার করতেন। এবং প্রায় সবাই তখন স্যুর-রিয়ালিস্টিক হয়ে যান।
@অভিজিৎ রায়
আপনারা এতদিন ধরে কষ্টে ও সাধনায় এই প্রতিষ্ঠান ধরে রেখে আমাদের লেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। তার জন্যে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ। মুক্তমনা সত্যিই অনন্য, বাঙ্গালীর অন্য কোন অঙ্গনেই এই ধরনের মুক্ত ও সাহসী চর্চার অবকাশ নেই। আশা করি -খাঁচার বাইরে যে উন্মুক্ত অরণ্যের পথ – সেটা দেখিয়ে দিতে মুক্তমনা সবসময় সফল হবে।
ভাল থাকবেন।
দীপেন ভট্টাচার্য
জাফর ভাই,
কবিতা ও সেটির অনুবাদের জন্য ধন্যবাদ। আপনার জীবনানন্দের অনুবাদ বেশ কয়েক জায়গায় দেখেছি, খুব ভাল লেগেছে।
১। আপনার মহাযুদ্ধোত্তর পৃথিবী তিমিরাচ্ছন্ন কথাটির সাথে আমি একমত, কিন্তু সাতটি তারার তিমির কথাটি হয়ত সাতটি মহাদেশ থেকে আসে নি। সাতটি মহাদেশের ধারণাটি বেশ আধুনিক, জীবনানন্দের সময় অলিম্পিকের পাঁচটি চক্র খচিত পাঁচ মহাদেশের ধারণাই ছিল প্রধান।
যার প্রতি দ্বিতীয় কবিতায় “নক্ষত্রের আকাশ” উল্লিখিত সেখানে তারা বলতে আকাশের তারাই বোঝান হয়েছে এটা মনে করা যেতে পারে। নক্ষত্রের কথা বার বার বললেও জীবনানন্দ কোন নির্দিষ্ট নক্ষত্রের (এখানে নক্ষত্র বলতে তারাই বোঝাচ্ছি, তারাগুচ্ছ নয়) নাম লেখেন নি, আমার জানা মতে শুধু সপ্তর্ষি ও স্বাতীর উল্লেখ করেছেন (পাঠকদের অন্য কিছু জানা থাকলে আমাকে জানাবেন)। সেই ক্ষেত্রে সাতটি তারা বলতে সপ্তর্ষিকে মনে করা যেতে পারে।
সাধারণতঃ নক্ষত্রের আগুণে যে আকাশ জাজ্বল্যমান থাকে, সেখানে মাত্র সাতটি তারার আলোয় সে তিমিরাচ্ছন্ন।
২। মলয়ালী কথাটা নিয়ে আপনি হয়ত আগেও শুনেছেন। মালয় সাগর পারে মলয়ালী থাকতে পারে, কিন্তু বাংলায় মলয়ালী বলতে কি কেরালাবাসীদের বোঝান হয় না? জীবনানন্দ নিজে এটাকে জটিল করেছেন মালাবার (কেরালা) উপকূলের কথা বলে। তবে আপনি এই কবিতায় Malayan woman কথাটা ঠিকই ব্যবহার করেছেন। কবিতার অর্থে এই নারী দূরপ্রাচ্যের যে কোন সমুদ্রতীরের অধিবাসী (পলিনেশিয়া চোখে ভাসে)। (প্রাচ্যে বাণিজ্যবায়ু ধরে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকদের আগমন কবিতায় প্রচ্ছন্ন।)
৩। সারাদিন দূর থেকে ধোঁয়া রৌদ্রে রিরংসায় সে উনপঞ্চাশ
আপনি অনুবাদ করেছেনঃ
She watched cloud-filled sunrays from a distance all day long with lustful eyes;
she turned forty-nine.
আপনি যে সাহস করে she turned forty-nine লিখেছেন তার জন্য ধন্যবাদ দিই, আমি তো বুঝতেই পারছিলাম না সে উনপঞ্চাশ এর মানে কি! তবে জাফর ভাই, এই ক্ষেত্রে আর একটা অর্থ হতে পারেঃ কবি নিজেকেও বোঝাতে পারেন (রিরংসায় কবিরই আচ্ছন্ন হবার সম্ভাবনা)। সাতটি তারার তিমির ১৯৪৮-এ প্রকাশিত হয়, কবির বয়স সেই বছর ছিল ৪৯। যদিও সেই কাব্যগ্রন্থের সব কবিতাই ৪৮-এর আগে লেখা, তবু এই সমাপতনকে না উল্লেখ করে পারলাম না।
ভাল থাকবেন। আরো লিখুন।
দীপেন ভট্টাচার্য
@দীপেন ভট্টাচার্য,
:yes: দুর্দান্ত। এ ধরণের আলোচনার জন্যই বোধ হয় মুক্তমনা অনন্য।
আপনিও আরো লিখুন। আরো বেশি করে আলোচনায় অংশ নিন…
@দীপেন ভট্টাচার্য,
দুর্দান্ত!! এধরনের মন্তব্য মূল লেখাকে আরো উচ্চতর অবস্থানে নিয়ে যায়।