নালিশ
হাসান মাহমুদ
আজ এই ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করছি নালিশ।
পীড়ন-মুক্ত জীবন শোষণ-মুক্ত সমাজের স্বপ্নে লক্ষ বছর কত চেষ্টা করেছি। বানিয়েছি সরকার, আদালত, পুলিশ আর জাতিসংঘ। বার বার ছুটে গেছি রাজার কাছে, প্রথার কাছে, সংস্কৃতির কাছে, সরকারের আর আইনের কাছে এবং শেষ আশ্রয় হিসেবে তোমার কাছে। কিন্তু আমাদের ভাঙ্গা বুক জোড়া লাগল না।
সংখ্যাহীন আমাদের আর্তনাদ হাহাকারে, দগ্ধ শিশু, ধর্ষিতা রমণী, উজাড় বসতি আর বিকৃত মৃতদেহে ভরে আছে হতভাগ্য মানুষের ইতিহাস। তুমি টলনি। কেন? তোমার ইচ্ছে ছাড়া যদি কিছুই হয়না তবে তোমারই ইচ্ছের করাল দ্রংষ্টায় পৃথিবী পরিণত হবে শকুনের ভাগাড়ে এবং তুমি থাকবে নিরাসক্ত উদাসীন ? তোমারই ইচ্ছেতে তিনশ’ হাজী একসাথে আগুনে পুড়ে মরবে ওই তোমারই কাছে ‘‘লাব্বায়েক‘’ বলে হজ্ব করতে গিয়ে ? তোমারই ইচ্ছেতে উদ্বাহু নৃত্য করবে হিংস্র শ্বাপদেরা গণহত্যার সাফল্যে, তোমারই ইচ্ছেতে অগণিত দয়িতা-কন্যা-স্ত্রী-ভগ্নীরা শকুনের হাতে লাঞ্ছিতা হবে ? তুমি কি ওদের চেয়ে লক্ষগুণ বেশী অপরাধী নও? তোমার অঙ্গুলি হেলনে পলকে রক্ষা পেত, – কিন্তু রক্ষা পায়নি কোটি কোটি অসহায় নিরপরাধ দলিত মথিত অত্যাচারিত নিহত মানুষ, শিশু, কোটি কোটি বেআব্রু রমণীর সÞম। তোমার সৃষ্টির চেয়ে তুমি কি লক্ষগুণে অপরাধী নও?
এর পরেও তুমি আশা করো আমি তোমার আরাধনা করব? তোমার নিষ্ঠুর উদাসীনতায় আমাকে বেঁচে থাকতে হবে দলিত গলিত শবের মত লক্ষ শোক-ক্ষোভ বুকে নিয়ে,তার পরেও তুমি আশা করো আমি আমি তোমাকে করুণাময় বলি, দয়াময় বলি? তুমি আশা কর আমি তোমার দিকে প্রশ্নের, অভিযোগের, সন্দেহের আর অবিশ্বাসের চোখে তাকাব না?
কি দিই নি তোমাকে? না দেখে বিশ্বাস করেছি তোমাতে। নিজেকে বঞ্চিত করে, প্রিয়মুখদের বঞ্চিত করে অর্থ, সময়, স্বাস্থ্য, ঘুম, খাদ্য, আবেগ, স্বস্তি, জীবনের কোন্ মহার্ঘ সম্পদ উৎসর্গ করিনি তোমাকে? তার পরেও পরীক্ষা নিচ্ছ? কিসের পরীক্ষা? শিশুকে পুড়িয়ে মেরে, মা-বোনকে ধর্ষিতা করে মানুষ হত্যা করে কিসের পরীক্ষা? জীবনের সব পরীক্ষায় ব্যর্থ হলেও প্রতিটি মানুষকে বাঁচানোর জন্য জ্বলন্ত আগুনে ঝাঁপ দিতে চিরতৈরী তার পিতা-মাতা। পশু-পাখীরাও সে চেষ্টাটুকু অন্ততঃ করে। আর তুমি? তুমি না বিশ্বপিতা? তোমার ব্যর্থতার দায় কে নেয়? মানুষকে ‘‘আশরাফুল মাখলুকাত’’ – সৃষ্টির সেরা সৃষ্টি নাম দিয়ে পোকামাকড়ের মত পিষেছ তুমি, – তোমার এই নিষ্ঠুর তামাশা’র দায় কে নেয়? আমার পরীক্ষা তুমি নেবে, তোমার পরীক্ষা কে নেয়?
তোমার রহমান, মেহেরবান নামগুলো আমরা তো দেইনি ! তুমি নিজেই নিয়েছ এবং লক্ষ বছরে লক্ষবার ও নামের সম্মান ও দায়িত্ব ভঙ্গ করেছ নির্ল্লজ্জ বেহায়াপনায়। শক্তিমানের দায়িত্ব থাকে অনুসারীদের রক্ষা করার। কোরাণে তুমি সগর্বে ঘোষণাও করেছ বিশ্বাসীদের বাঁচিয়ে নেয়া তোমার দায়িত্ব। অথচ তোমার কোটি কোটি অনুসারীকে তো দুরের কথা তোমার পাঠানো নবী ইয়াহিয়া (সাঃ) ও জাকারিয়াকে (সাঃ) পর্য্যন্ত তুমি বাঁচাতে পারনি ঘাতকের অস্ত্র থেকে। সর্বশক্তিমান নামের অপমান করেছ তুমি, বারবার বন্দী হয়েছ অত্যাচারী হত্যাকারী ধর্ষকের হাতে। সবার রিজিকের দায়িত্বে তুমি ‘‘রাজ্জাক’’ নাম নিয়েছ অথচ অথচ তোমারই সামনে কোটি মানুষ মরে গেছে দুর্ভিক্ষে না খেয়ে। মানুষের না খেয়ে মরে যাবার কষ্ট বোঝ তুমি? ধর্ষিতার কষ্ট বোঝ ? বোঝ কি নিরপরাধ অত্যাচারিতের হাহাকার? মানুষের কষ্ট মানুষের বুকে বাজে তোমার বুকে বাজে না। কেন বাজে না ? মানুষের পরীক্ষা তুমি নেবে, তোমার পরীক্ষা কে নেয়?
আজ এই ক্রান্তিলগ্নে উচ্চারণ করছি নিয়তির অমোঘ বাণী। হুঁশিয়ার হবার মুহূর্ত এগিয়ে আসছে তোমার। যদি নিহত-লা®িত-ধর্ষিতা হতভাগ্য মানুষ তোমার আশ্রয় না পায় তবে সে একদিন বিশ্বাস হারাবে তোমার ওপর। একদিন সেই বিদ্রোহী ভৃগু মহাকালকে সাক্ষী রেখে প্রভুত স্পর্ধায় তোমার দয়াহীন বুকে পদচিহ¡ এঁকে দেবে অগ্নিস্বাক্ষরে। আগামী প্রজন্মেরা আসছে শক্তিশালী প্রযুক্তি, মেধা আর মানবাধিকারের উপলব্ধি নিয়ে। ধর্মের নামে রূপকথা গিলবে না তারা। মানবে না তারা অত্যাচারকে ধর্মের নামে বৈধ করাও। বিচারের বাণীকে আর মুখ বুঁজে নীরবে নিভৃতে কাঁদতে দেবেনা তারা, তোমার ভয়াবহ পরীক্ষা নিয়ে ছাড়বে। সেদিন চোখের পলকে অদৃশ্য হবে তোমার অগণিত চাটুকারের দল। অবশেষে বুকভাঙ্গা অশ্রুসিক্ত সৃষ্টির পরিত্যক্ত স্রষ্টা হবে তুমি।
মানবাধিকারের ওপর শকুনের উৎসব ঠেকাতে পারোনি তুমি, ঠেকাতে পারবে না সেটাও। ক্ষণিকের এই মহার্ঘ মানবজীবনে মানুষের রকতের, অশ্রুর আর সÞমের হিসেব না মিললে মহাকালের ক্রোধ থেকে কেউ পরিত্রাণ পাবে না।
তুমিও না।
*********************************************************************
মহাকবি ইকবাল লিখিত ‘‘শিকওয়া’’ (অর্থাৎ নালিশ)-এর ভাবাবলম্বনে ভিন্ন আঙ্গিকে লিখিত। এটা এবং স্রষ্টার তরফ থেকে ‘‘জওয়াব-এ শিকওয়া’’ (অর্থাৎ এই ‘‘নালিশ-এর জবাব’’) তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দু’টো লেখা, সর্বশ্রেষ্ঠও বলেন অনেকে।
*********************************************************************
হাসান মাহমুদ – ০৯ মে, ৩৯ মুক্তিসন (২০০৯)
হুমম … নালিশ করার যথাযথ কারণ আছে। এ তো নিঃসন্দেহে বোঝা যায় যে, প্লেগ, মহামারী, খড়া, বন্যা, সুনামীর মত প্রাকৃতিক দুর্যোগে লক্ষ কোটি নিরপরাধ নর-নারী এবং শিশুর মৃত্যুর ব্যাপারে মানুষকে কোনভাবেই দায়ী করা চলে না। যদি ঈশ্বর বলে কিছু থেকে থাকেন, তাহলে বলতেই হয় – এ সমস্ত অরাজগতার অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে ঈশ্বর একটি অপকারী সত্ত্বা। কারণ ‘সর্বজ্ঞ’ ঈশ্বর আগে থেকেই জানতেন যে, সুনামীর ঢেঊ আছড়ে পরে তার নিজের সন্তানদের হত্যা করবে, তাদের স্বজন হারা করবে, গৃহচ্যুত করবে, ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, ঘর বাড়ি ধ্বংস করে এক অশুভ তান্ডব সৃষ্টি করবে। অথচ আগে থেকে জানা থাকা সত্ত্বেও সেসব প্রতিরোধে কোন ব্যবস্থাই তিনি নিতে পারেন নি। এ থেকে প্রমাণিত হয় ঈশ্বর এক অক্ষম, নপুংশক সত্ত্বা বই কিছু নয়। তাহলে এই অক্ষমের কাছে নালিশ করে আক্ষরিক অর্থেই কি কোন লাভ আছে?
গ্রীক দার্শনিক এপিকিউরাস (৩৪১-২৭০ বিসি) সর্বপ্রথম ‘আর্গুমেন্ট অব এভিল’ (Argument of Evil)-এর সাহায্যে ‘ঈশ্বরের অস্তিত্বের’ অসারতা তুলে ধরেছিলেন এভাবে :
ঈশ্বর কি অন্যায়-অবিচার-অরাজগতা নিরোধে ইচ্ছুক, কিন্তু অক্ষম?
তাহলে তিনি সর্বশক্তিমান নন।
তিনি কি সক্ষম, কিন্তু অনিচ্ছুক?
তাহলে তিনি পরম দয়াময় নন, বরং অপকারী সত্ত্বা।
তিনি কি সক্ষম এবং ইচ্ছুক -দুটোই?
তাহলে অন্যায়-অবিচার-অরাজগতা পৃথিবীতে বিরাজ করে কিভাবে?
তিনি কি সক্ষমও নন, ইচ্ছুকও নন?
তাহলে কেন তাঁকে অযথা ‘ঈশ্বর’ নামে ডাকা?
বস্তুত ‘The Oxford Companion to Philosophy’ স্বীকার করেছে যে, সনাতন আস্তিকতার বিরুদ্ধে আর্গুমেন্ট অব এভিল বা ‘মন্দের যুক্তি’ সবচেয়ে শক্তিশালী মরণাস্ত্র, যা কেউই এখন পর্যন্ত ঠিকমত খন্ডন করতে পারেনি। ‘ঈশর আমাদের নিয়ে পরীক্ষা করছেন’, ‘ঈশ্বরের লীলা আমরা সাধারণেরা কি আর বুঝব?’ এগুলোই মূলতঃ নালিশের জবাবে উত্তর হিসেবে উঠে আসে।
মহাকবি ইকবাল এর “শিকওয়া” র মধ্যকার চিরন্তন বিষয়গুলো একটি বয়সে আমাকে ভাবাতো। তখন জানতাম না উত্তর। তখন এই ভাবানুবাদটি পড়া অনেক বেশী জরুরী ছিলো। ভিন্ন আংগিকে লেখা হলে ও কবিতার সৌন্দর্য্য উপভোগ করায় কোথাও বাঁধা পড়েনি।
অনেক ধন্যবাদ।
জনাব হাসান মাহমুদ,
অপস্, দারুন লিখেছেন! হাসান মাহমুদ, দ্রোহের কবির মতোই লেগেছে। এক নিঃশ্বাসে পড়েই যেনো মনে হলো উদ্ভাসিত আলোর রেখা অদূরের আকাশ রাঙ্গিয়ে তুলেছে। সেই কবে মহাকবি ইকবাল লিখেছেন, আর আজও আমরা সেই অর্থহীন শৃংখল থেকে বের হতে পারছি না! এই একই দুঃখবোধ নিয়ে আমি, আমরা আর কতোকাল কাটাবো বলতে পারেন? জ্ঞ্যন এবং অভীক্ষা দিয়ে এই দ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দিন। পুড়ে পুড়ে হৃদয় গুলো খাঁটি হয়ে উঠুক।
অসংখ্য ধন্যবাদ, ভালো থাকুন।
-Keshab K. Adhikary