আমার স্মৃতিতে ড. ওয়াজেদ মিয়া  


অজয় রায়

 

যা মনে হচ্ছিল অবশ্যাম্ভাবী তা-ই ঘটল। দেশের খ্যাতনামা পদার্থবিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া আর আমাদের মাঝে নেই। ৯ মে বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। ড. ওয়াজেদ মিয়া শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী বা জয় ও পুতুলের পিতাই নন, নিজ গুণেই ছিলেন গুণান্বিত ও নিজ পরিচয়ে বৈশিষ্টমন্ডিত। তিনি ছিলেন দেশের একজন বড়মাপের তাত্ত্বিক নিউক্লীয় পদার্থবিদ, তবে পরমাণু বিজ্ঞানী নামেই তিনি দেশবাসীর কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।


অতন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত ওয়াজেদ মিয়া ছিলেন ষাটের দশকের গোড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যায় আমার শিক্ষকতা জীবনের প্রথমদিকের ছাত্র। অনার্স ও এমএসসি দুটিতেই তিনি প্রথম শ্রেণী পেয়েছিলেন। তাদের ব্যাচটি ছিল খুবই তুখোড় ও বুদ্ধিদীপ্ত, বিশেষ করে তাদের মধ্যে চারজনের কথা আজও আমার দিব্যি মনে আছে। কাজেই মেধাতালিকায় কার কী অবস্থান ছিল, আজ আর মনে নেই। পাস করার পরপরই ১৯৬৩ সালে ঢাকায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত আণবিক শক্তি কেন্দ্রে জুনিয়র বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেন তিনি। সম্ভবত পরের বছরই কমিশনের বৃত্তি নিয়ে লন্ডনে চলে যান উচ্চ শিক্ষার্থে। ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে ডিআইসি করে লন্ডনের কোনো একটি কলেজ থেকে তাত্ত্বিক নিউক্লীয় পদার্থবিদ্যায় পিএইচডি করে ১৯৬৭ সালের শেষদিকে দেশে ফিরে ঢাকায় আণবিক শক্তি কেন্দ্রে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।


এ সময় ১৯৬৮-৬৯-এর গণআন্দোলন শুরু হয়ে গেছে, স্বাধীকার ও সায়ত্ত্বশাসন, ছয় দফা বাস্তবায়নের দাবি এবং সর্বোপরি শেখ মুজিবকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করার আন্দোলন। কেমন করে জানি এ গণআন্দোলনে আমিও নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে গেলাম। একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে সবদিক বজায় রেখেই ওয়াজেদ মিয়া গোপনে এ আন্দোলনের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করতে থাকেন। কমিশনের বিজ্ঞানীদের নিয়ে সংগঠন গড়ে তোলেন তিনি।
ছাত্রাবস্থা থেকেই ওয়াজেদ ছিলেন রাজনীতি সচেতন ও ভালো সংগঠক। ১৯৬১ সালে তিনি ফজলুল হক হলের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ছাত্রলীগের একজন নিষ্ঠাবান কর্মী হিসেবে সম্ভবত ওই সময় থেকে শেখ মুজিবের সংষ্পর্শে এসেছিলেন তিনি। ১৯৬৭ সালে শেখ সাহেবের জ্যেষ্ঠ কন্যা হাসিনার সঙ্গে ড. ওয়াজেদ, অনেকটা হঠাৎ করেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। শেখ সাহেব তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাগারে বন্দি। বিয়ের কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই একদিন বিভাগে এসে এ নিয়ে আমার মত জানতে চাইলেন। আমি কিছুক্ষণ ভেবে বলেছিলাম, ‘তোমার পরিবারের যদি মত থাকে তাহলে আর অসম্মতি করো না।’  আমি শেখ হাসিনাকে তো দূরের কথা, শেখ সাহেবকেও চিনতাম না, যদিও তার মুক্তির জন্য আমরা আন্দোলনে নেমেছি।


১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ক্র্যাক ডাউনের পর মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস শেখ পরিবারের সঙ্গে ওয়াজেদকেও অবরুদ্ধ ঢাকায় বন্দি জীবনযাপন করতে হয়েছিল।


সফল গবেষকের পাশাপাশি ড. ওয়াজেদ ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ পদার্থবিদ্যা সমিতি ও পেশাজীবী বিজ্ঞানীদের সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিল। এছাড়া অনেক জনকল্যাণমহৃলক সংগঠনের সঙ্গে তিনি যুক্ত থেকেছেন।


নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে দেশ-বিদেশে তার যথেষ্ঠ পরিচিতি ছিল। যতদূর জানি, নিউক্লিয়াসের গড়ন ও নিউক্লীয় বর্ণালি বিষয় ছিল তার গবেষণার বিষয়। কর্মজীবনে গবেষণার পাশাপাশি তিনি প্রথমে ঢাকা আণবিক শক্তি কেন্দ্রের পরিচালক এবং পরে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। এ পদে থেকেই তিনি ১৯৯৯ সালে অবসর গ্রহণ করেন ৫৭ বছর বয়সে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবল্পব্দুর নারকীয় হত্যাকান্ডের সময় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে নিয়ে ড. ওয়াজেদ মিয়া জার্মানিতে একটি গবেষণা ফেলোশিপে অবস্থান করছিল। ফলে অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে তারা বেঁচে যান। পরে ওয়াজেদ শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারতের দিল্লিতে ১৯৮১ সাল পরন্ত অবস্থান করতে বাধ্য হয়েছিলেন। দেশে তখন বৈরী পরিবেশ শেখ পরিবারের জন্য। ভারত সরকারের এই বদান্যতার কথা ওয়াজেদ একাধিকবার কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আমার কাছে উল্লেখ করেছেন।


আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক সব সময় উষ্ণ ছিল, ছিল স্নেহাসিক্ত, তিনি আমাকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন, তার কথোপকথনেই তা প্রকাশ পেত। ড. ওয়াজেদের সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় বছর দুয়েক আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। বঙ্গবন্ধু কন্যাকে সেনা সমর্থিত ড. ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার যেদিন বন্দি করে তার ৩-৪ দিন পর ড. ওয়াজেদ গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে আমি সেখানে তার সঙ্গে দেখা করি। মুমুর্ষু অবস্থায় সে প্রায় অচৈতন্য ছিল, দু’একটি কথা হয়েছিল মাত্র। দুর্বল শরীরে মাথায় হাত দিতেই চোখ মেলে তাকিয়ে আমাকে ওয়াজেদ বলেছিলো, ‘স্যার, আপনি এসেছেন? আমার জন্য দোয়া করবেন।’ এই ছিল তার সঙ্গে আমার শেষ কথা। এবারো স্কয়ার হাসপাতালে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম, কিন্তু বোধ্য কারণেই দেখা সম্ভব ছিল না। অনেকবার ভেবেছিলাম দীর্ঘদিন ধরে জটিল রোগে আক্রান্ত প্রিয় ছাত্রটিকে দেখতে যাব, কিন্তু সুধা সদনের বেড়া ডিঙিয়ে সেখানে পৌঁছানো আমার মতো নিরীহ মানুষের পক্ষে অসম্ভব। তাই বিরত থেকেছি। আমার কেমন যেন সব সময় মনে হতো সুধা সদনের রাজনৈতিক ডামাডোলে এবং অসংখ্য রাজনৈতিক নেতাকর্মীর সমারোহে এ নিভৃতচারী মানুষটি বড্ড একা, অসহায় না হলেও, বড্ড নিঃসঙ্গ ছিলেন।


২৫ মার্চের পাক আর্মির ক্র্যাকডাউন-পরবর্তী একটি ঘটনার উল্লেখ করে আমার এ ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায় দাড়ি টানব। যতদূর মনে পড়ে দিনটি ছিল মার্চের ৩০ বা ৩১। পাক আর্মির ভয়ে আত্মগোপন করে ইস্কাটনে আমার এক ছাত্রের বাসায় আশ্রয় নিয়েছি। রাত সাড়ে ৮টার দিকে সাল্পব্দ্য আইন আবার জারি হবে তাই সিগারেট কিনতে এক গলির দোকানে উপস্থিত হয়েছিলাম। সেখানেই অপ্রত্যাশিতভাবে ওয়াজেদের সঙ্গে দেখা – দু’জন দু’জনকে দেখে ভূত দেখার মতো অবস্থা। ‘স্যার, আপনি এখানে?’ আমার হতভম্ব প্রতিত্রিক্রয়া,’ওয়াজেদ, তুমি?’ সেও সিগারেট কিনতে বেরিয়েছিল। কাছেই শেখ হাসিনাকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, সঙ্গে নবজাতক জয়। দু’জনই দু’জনকে সাবধান করে বললাম, ‘এভাবে বের হওয়াটা ঠিক হয়নি।’ জোর করে বাসায় নিয়ে গেল, বঙ্গবল্পব্দু কন্যা হাসিনাকে দেখে যাবেন না?  সপ্রতিভ কিশোরী হাসিনা ও জয়কে দেখে দ্রুত ডেরায় ফিরে এলাম, কারণ কারফিউ সমাগত। সে দিনই শেখ হাসিনাকে প্রথম দেখলাম। সেদিন কী ভেবেছিলাম এ সপ্রতিভ মেয়েটিই হবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী?


শিক্ষক হয়ে প্রিয় ছাত্রের শোকগাথা লিখতে হবে তা কোনোদিন ভাবিনি। ক্ষমতার খুব কাছাকাছি থেকেও ক্ষমতা তাকে স্পর্শ করেনি- ক্ষমতা থেকে দূরে থাকা এই সুন্দর মানুষটির কথা হয়তো কোনোদিনই ভুলব না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি রইল আমার গভীর সমবেদনা।

(লেখাটি দৈনিক সমকালে ১১ ই মে ২০০৯ প্রকাশিত)


অজয় রায়, বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ। শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের সভাপতি এবং মুক্তমনার উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য।