ধর্মগ্রন্থের মতো রবীন্দ্রনাথের জঠর থেকে বিজ্ঞান বের না করলে চলে না?

-অনিশ্চিত

সাম্প্রতিক বিজ্ঞানের আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের সাথে ধর্মগ্রন্থগুলোর বাণী, উপদেশ বা ঘটনার সাদৃশ্য খুব কম। ধর্মগ্রন্থগুলো একটি সময়ের প্রতিনিধিত্ব করেছে, সে সময়ের মানুষের কল্পনার সীমাকে মেনে গণ্ডীবদ্ধ অলৌকিকতার কথা বলেছে কিন্তু সেগুলোর ব্যাখ্যার দিকে যায় নি- কল্পনার ব্যাখ্যা হয় না। পুরাকালের মানুষের কল্পনাশক্তি প্রখরতা অনেক মিথের জন্ম দিয়েছে। ধর্মগ্রন্থগুলো সেগুলোর প্রভাব থেকেও বের হতে পারে নি। এ সময়ে যখন সাম্প্রতিক উদ্ভাবনাগুলো ধর্মগ্রন্থের এসব অলৌকিকতা ও মিথের ব্যাখ্যা তুলে ধরছে, তখন একদল মানুষকে দেখা যাচ্ছে জোরজবরদস্তি করে ধর্মগ্রন্থগুলো বিজ্ঞানময়; বা বিজ্ঞান একমাত্র ধর্মগ্রন্থ থেকেই উৎসারিত– এ সম্পর্কে নতুন কল্পনা ফেঁদে জোর করে প্রমাণের চেষ্টা করছে। ফ্যালাসির বাতাবরণে ছালচামড়াবিহীন বাণীও উদ্ভাবিত হচ্ছে বেশ। এখন যা কিছুই উদ্ভাবিত হোক না কেন, একদল সরোষে জানাবে- তাদের ধর্মগ্রন্থে এই কথা অনেক আগেই বলা ছিলো; যদিও উদ্ভাবনের আগে এ সম্পর্কিত কোনো কথাই তারা বলতে পারে নি। এই প্রবণতা কিছুকাল আগেও বেশ কম ছিলো- সম্প্রতি বেশ বেড়েছে এবং ‘জনপ্রিয়’ বাংলা ব্লগগুলোই তার প্রমাণ। ধর্মকে জোর করে প্রমাণের কিছু নেই, বিজ্ঞানের সাথে মেলানোরও যুক্তি নেই, দুটো দুই ভুবনের বাসিন্দা- বিজ্ঞানের অগ্রসরতার সাথে সাথে একদল মানুষ এই বোধ থেকেও সরে যাচ্ছে। ধর্ম কি তাহলে সময়ের হুমকির মুখোমুখি? টিকে থাকা যখন প্রধান হয়ে দাড়ায়, উপায়ান্তর না দেখে মানুষ তখন নানা কৌশলের আশ্রয় নেয়। ধর্মকে যারা জোর করে বিজ্ঞানময় করতে চাচ্ছেন, তারা কি আর তবে উপায়ান্তর দেখছেন না? ধর্ম কি তাহলে বিশ্বাসহীনতার হুমকির মুখে পড়েছে?

ধর্মের মতোই একদল রবীন্দ্রানুরাগী রয়েছেন এদেশে-ওদেশে। প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক, তারা জোর করে রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে সবকিছু বলাবেনই। একবার একটি সভায় একদল জানালেন- রবীন্দ্রনাথ নাকি হেন কিছু নেই, যা নিয়ে কাব্য রচনা করেন নি। আমি জানালাম- ল্যাপটপের ব্যাটারির আয়ু কমে কেন- এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কোনো রচনা আমার চোখে পড়ে নি। তারা ক্ষিপ্ত হলেন। বললেন, রবীন্দ্রনাথের সময়ে কি ল্যাপটপ ছিলো? আমি বলি- ছিলো না। তাহলে আপনারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কালোত্তীর্ণ, সর্বকালের সেরা ইত্যাদি বলেন কেন?

এই পৃথিবীর কোনোকিছুই সর্বকালের সেরা হতে পারে না। সর্বকালের ধারণা আমাদের নেই, থাকতে পারে না। আমরা কেবল সুদূর অতীত এবং অদূর ভবিষ্যতের কথা কল্পনা করতে পারি। পৃথিবীর সব মানুষ, শিল্প বা সৃষ্টিকে থাকতে হবে এর মধ্যেই।
 


***
 

গতকাল ১০ মে তারিখে প্রথম আলোতে জাবেদ সুলতান এবং মুহতাশিম বিল্লাহর ‘কবি ও বিজ্ঞানী’ নামে একটি  লেখা প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের লেখা কয়েকটি ছত্রের মাধ্যমে লেখক প্রমাণ করতে চেয়েছেন- নিলস বোর, হাইজেনবার্গ, শ্রোয়েডিংজার যে সেসময় কোয়ান্টাম তত্ত্বের ধারণাকে বিকশিত করছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তার মর্মার্থ বুঝতে পেরেছিলেন। উল্লেখ্য, কোয়ান্টামের অনিশ্চয়তার তত্ত্বকে সে সময় মানতে যারা নারাজ ছিলেন, তাদের দলে ছিলেন আইনস্টাইন, পোলোনস্কি, রোজেনবার্গের মতো বিজ্ঞানীরা। দুপক্ষেই যুক্তিতর্কের রেশ ছিলো, যদিও শেষ পর্যন্ত আইনস্টাইনদের যুক্তি টেকে নি।

রবীন্দ্রনাথ এ নিয়ে কী বলেছিলেন?

ব্যক্তিগতভাবে কোয়ান্টাম তত্ত্ব বা অনিশ্চয়তার সূত্র ঠিক কিনা বা কোন অংশটি ঠিক, এ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোনো লেখা আমি পাই নি। রবীন্দ্রনাথ বিশুদ্ধ পদার্থবিদ্যার অনুরাগী ছিলেন, এ প্রমাণও মেলে না কোথাও। কিন্তু নিলস বোরদের পক্ষে প্রথম আলোর লেখক তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথের এই কথাগুলো-

আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ.
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে-
জ্বলে উঠল আলো
পুবে পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর’
সুন্দর হল সে।

তুমি বলবে এ যে তত্ত্বকথা, এ কবির বাণী নয়।
আমি বলব এ সত্য,
তাই এ কাব্য।

এখন আসুন দেখি, নিলস বোররা কী বলতে চেয়েছিলেন। তাঁরা একটি বাক্সে জীবিত বিড়াল আর পরমাণু বন্দুক ভরে বাক্সটি আটকে দিয়ে কী ঘটে সেই হাইপোথিসিস নিয়ে কোয়ান্টাম তত্ত্বের ব্যাখ্যা করছিলেন। এখানে বিড়ালটি যদি নড়াচড়া করে তাহলে বন্দুকের গুলি বের হয়ে বিড়ালটি মারা যাবে। প্রশ্ন ছিলো, বাক্স বন্ধ করার পর বিড়ালটি কি জীবিত ছিল নাকি মৃত? এটা বলা কি সম্ভব?

এ অবস্থায় বাক্স না খুলে বলা মুশকিল। সুতরাং এখানে বিড়ালকে জীবিত-মৃত দুটিই ধরা যায়, এটি নির্ভর করবে ব্যক্তির উপর; কোনটি ঠিক তা নিশ্চিত হওয়ার কোনই উপায় নেই। কিন্তু বাক্স খোলার পর ব্যক্তির বিশ্বাস বা ধারণা যাই থাকুক না কেন, বিড়ালটি হয় জীবিত পাওয়া যাবে, অথবা মৃত। ঠিক তেমনিভাবে, আলো কণা ও তরঙ্গ উভয় ধর্মই বহন করছে। নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করার পর অর্থা আলোকে দেখার শর্তানুসারে ব্যক্তির অবস্থান ঠিক করবে আলোর ধর্ম কণাধর্ম নাকি তরঙ্গধর্ম। একটি বিড়াল যেমন একই সাথে জীবিত ও মৃত হতে পারে না, ঠিক তেমনি আলোও একই সাথে কণা ও তরঙ্গ হতে পারে না। ব্যক্তি যখন যে ধর্ম দেখতে চায়, তখন সেটি দেখতে পাবে। আলোকে কণা দেখার প্রস্তুতি নিলে ব্যক্তি আলোকে কণা আকারে দেখবে, তরঙ্গাকারে দেখার চিন্তা থাকলে সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে হবে।

এখন বলুন, কোয়ান্টাম তত্ত্বের এই অংশের সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথার মিল কোন দিক দিয়ে খুঁজব? রবীন্দ্রনাথের চেতনা যখন যেটি দেখতে চেয়েছে, সেটি তখন সেই রঙের হয়েছে বলে? তাই যদি হয়, তাহলে বলা দরকার, পৃথিবীর অনেক কবিসাহিত্যিকের লেখা থেকেই হাজার হাজার বিজ্ঞান খুঁজে পাওয়া যাবে। উদাহরণ হিসেবে যদি বলি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই লিখেছিলেন-

আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী-
তুমি থাক সিন্ধুপারে, ওগো বিদেশিনী।

আমি আকাশে পাতিয়া কান, শুনেছি শুনেছি তোমারই গান…

রবীন্দ্রনাথের এই লাইনগুলো শুনে কি মনে হয় না আজ থেকে প্রায় একশ বছর আগেই রবীন্দ্রনাথ দূর গ্রহের বাসিন্দাদের ঠিকুজি বের করে ফেলেছিলেন, শুনেছিলেন-বুঝেছিলেন তাদের কথা? আজকের বিজ্ঞানীরা ভিনগ্রহের বাসিন্দাদের খুঁজে পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে সার্চ করছেন। ভবিষ্যতে কখনও তেমন পাওয়া গেলে তখন হয়তো কিছু পাঁড় রবীন্দ্রভক্ত এই লাইনগুলো ফেলে প্রমাণ করার চেষ্টা করবে- দেখো, কয়েকশ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ এই কথা বলে গিয়েছিলেন!
 


***
 

ধর্মগ্রন্থ নিয়ে কথা শুরু হয়েছিলো। ধর্মগ্রন্থগুলো একটি নির্দিষ্ট সময়ে সমাজের প্রতিনিধিত্বকারীর ভূমিকা পালন করেছিলো। সময় বদলের সাথে সাথে সেগুলোর ভূমিকাও হ্রাস পেতে থাকে। যেহেতু কোনোকিছুই সর্বকালের প্রতিনিধি হতে পারে না, সে হিসেবে ধর্মগ্রন্থও সর্বকালের প্রতিনিধি হিসেবে থাকতে পারে না। থাকলে প্রমাণস্বরূপ বিভিন্ন কাল থেকে অন্তত একটি করে উদাহরণ থাকতো, প্রতিটি কালের কোনো না কোনো প্রতিনিদিত্ব থাকতো। কোনো ধর্মগ্রন্থেই সেটি নেই। সেটি যেহেতু নেই, ধর্মগ্রন্থগুলোর এই সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখেই বিজ্ঞানের সাথে তুলনা করা বা আলোচনা করা উচিত। ধর্মকে ধর্মের জায়গায় রাখা উচিত, বিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের জায়গায়। না হলে দুটোকেই অপমান করা হয়। যারা ধর্মকে বিজ্ঞানময় প্রমাণের চেষ্টা করছেন, তাদের মনে রাখা উচিত- প্রডাক্টিভ আর রিপ্রডাক্টিভ কখনো একসাথে মেশে না, যেমনি মেশে না আনপ্রডাক্টিভ আর প্রডাক্টিভ ভ্যালু।

একই কথা রবীন্দ্র পাঁড়ভক্তদের জন্যও। বাঙালী জাতির ভাষা ও সাহিত্যের একটি অন্যতম ভিত রচনা করে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বসাহিত্যে বাংলা সাহিত্য প্রথম সগৌরবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বারাই। বাঙালির মনমানস গঠনে এখনও রবীন্দ্রনাথ অদ্বিতীয়। যুগে যুগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মানুষ আসেন একজনই, তারা তাদের নিজেদের কালসহ আশেপাশের কয়েকটি শতকও আলোকিত করে রাখেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক বিষয় নিয়েই লিখেছেন। তাঁর মতো বিষয়বৈচিত্র্যে মাতোয়ারা সাহিত্যিক খুব কমই পাওয়া যাবে- বিশ্বপরিমণ্ডলেও। তার মানে এই নয় যে, দুনিয়ার যাবতীয় বিষয় নিয়েই তিনি লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এতো এতো বিষয় নিয়ে লিখেছেন যে, চাইলে যে কেউ তাঁর লেখা থেকে উদ্ধৃতি বা লাইন নিয়ে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করতে পারবে- তথাকথিত ধার্মিকরা যে কাজটি এখন করছেন। এই পাঁড় ধার্মিকরা ক্ষীয়মাণ ধর্মের রাজত্বকে পুনরায় বাড়ানোর এক হাস্যকর চেষ্টায় রত। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তো তা করার দরকার নেই। পুরো আকাশে তিনি এখনও জ্বলজ্বলে সূর্য। বালির গরম দিয়ে তাঁকে আর উত্তপ্ত করার দরকার নেই।

 

এই কাজে রবীন্দ্রনাথের কৃতিত্ব বা অবদান খাটো হয় না; কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে সংক্ষুব্ধ, বিক্ষুব্ধ হতেন অবশ্যই। বরং এরকম উপমা যারা দেন, সবকিছুতেই রবীন্দ্রনাথকে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস যারা চালাচ্ছেন, তাদের লেখা বা চিন্তার অযোগ্যতা প্রকাশ পায়। আরেকদিক দিয়ে, সেটা জান্তে হোক বা অজান্তে, এগুলো রবীন্দ্রনাথকে হেয় করার একধরনের প্রয়াশ হিসেবেও দেখা যায়। সুতরাং দোহাই, রবীন্দ্রনাথকে থাকতে দিন তাঁর জায়গাতেই; ধর্ম নিয়ে বকধার্মিক বেড়ে গেছে সমাজে; রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তা চাই না।

 

(অনিশ্চিতের লেখাটি মুক্তমনায় পাঠিয়েছেন নুরুজ্জামান মানিক)