শারীরিক ও মানসিক সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে

 

ক্যাথেরীনা রোজারিও কেয়া

 

আমার শৈশব কেটেছে ঢাকার ধানমনডীর আঠার নম্বরে  ছোট  বেলা থেকে দেখে এসেছি এক জনকে  নিয়োগ  দেয়া আছে জলের পাম্প বা মেসিন ছাড়বার  জন্যেনদীমাত্রিক এই দেশে জলের নিয়ন্ত্রন এক বিশাল বিষয় এ নিয়ে ঝগড়া বিবাদ , মনোমালিন্য এমনকি কোর্ট কাছারি পর্যন্ত হয়পানিকে নিয়ন্ত্র করার ব্যাপারটি সেই কারবালা থেকে শুরু করে ফারাক্কা পেরিয়ে বাংলাদেশে বাড়ীওয়ালা পর্যন্ত পৌঁছোয়  পানির মালিকানা কিভাবে কৃষক সমবায় সমিতির হাত গড়িয়ে বিআইডিএস এর  হাত পেরিয়ে নন প্রফিটের এর হাতে এসে পৌছেছে, সে আরেক রাজনৈতিক আলোচনা আমার আলোচনার বিষয় আজ অন্য

 

সেই যে ভদ্রলোকের নিয়োগ ছিলো পানির পাম্প ছাড়ার জন্যে তাকে ছোট বড় সবাই তার নাম বয়রাবলে ডাকত,আমি দিদিমা কে রাত্তিরে ত্রিফলা ভিজিয়ে সকালে সেই জল পান করতে দেখেছিজেনেছি ত্রিফলার একটি ফল আমলকি, অন্যটি  হরিতকি এবং বয়রাভাবতাম ভদ্রলোকের  নাম বোধ করি সেই ফলের নামে  খানিকটা বড় হয়ে বুঝলাম ভদ্রলোকের নামসামাদতিনি কানে কম শুনতেন বলে তাকে বয়রা বলে ডাকা হতোতার প্রতিবন্ধীতা তার নামে, তার পরিচয়ে রুপান্তরিত হয়েছিল


আমাদের মধ্যে কিছু বিষয় আছে যা মেনে নিতে কষ্ট হয়যেমন বাচ্চা দেখলেই অহেতুক ধমকে উঠি,  বয়ষ্ক দেখলেই এড়িয়ে চলি আর প্রতিবন্ধী  দেখলেতো কথাই নেই তার নামই পালটে দেই  পা খোঁড়া মানুষ দেখলে আসে পাশে সবাই তাকে ডাকে ঐ ল্যাংড়া বলে আর সে বিয়ে করলে তার স্ত্রী  রাতারাতি  হয়ে যান ল্যাংড়ার বউ 

 

যে প্রতিবন্ধীতা চোখে দেখা যায়  তার বিষয়ে কথা বলে আমরা বড়ই আনন্দ পাইআর যে গুলো মানসি রোগ, যাকে বোঝার ক্ষমতা কম তাকে দেখি আরো কঠোরভাবেঅল্পবয়সী মানসিক রোগী দেখলে বলি বিয়ে দিয়ে দাও, ভাল হয়ে যাবেমেয়েদের মাইগ্রেনের ব্যথা হলে বলি বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে

 


গতবার দেশে গিয়ে জেনেছিলাম সিলেটের স্বশিক্ষিত কবি দিলয়ারের ছেলে কবি কিশয়ার মারা গেছেনকবি দিলয়ার খুব সহজ ভাবে একদিন স্বল্প পরিচয়ে আমায় বলেছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতি উঠোনে পড়ে থাকা মেয়েদের লম্বা চুলের ওপর মোরগের হেঁটে যাবার মত, যতো মোরগটি পায়ে জড়ানো চুলের জট  খুলতে যায় ততোই জড়িয়ে যায়।। সরল ব্যাখ্যা শুনে বিস্মিত হয়েছিলামসেই কবি দিলয়ারের ছেলে কবি কিশয়ার বাবার মতই সরল ভাষার আর মনের


জানলাম মানসি  রোগের  সঙ্গে যুদ্ধ করতেন, যখন ফিরে আসতেন স্বাভাবিক অবস্থায় তখন লিখতেন কবিতা যাতে থাকতো মৃত্যুর অনুভুতি তার মৃত্যু স্বেচ্ছায় কিনা রহস্যেই ঢাকা রইল  জানলাম বাংলাদেশে মেয়েদের আবাসিক হলে একাধিক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে  সেখানে মানসিক রোগের চিকিসা, সাইকোথেরাপী, কাউন্সেলিং এর প্রচলন নেই, সুযোগ নেই  শুনে হতাশ হলাম

 

আমার মেবোন ছোট বেলায় কোন এক সেমিনারে পাবনায় গিয়েছিল, ফিরে এসে বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলো বাবা কেন মানুষ হেমায়েত পুরে চিড়িয়াখানার মত পাগল দেখতে যায়?”  ওদের সেমিনারের এক দিনের এজেন্ডাছিলো পাগলা গারদ ডেশব্দটা  ভেবে দেখুন পাগলা গারদর্থাৎ পাগলদের জেলখানা, চিকিসালয় নয়বাংলায় একটা প্রচলিত কথা আছে মানসিক অসুখের ওষুধ হচ্ছে লাঠ্যাষধি কি নির্মম চিন্তা তাই না?


আমার এক বিজ্ঞানমনষ্ক, বিজ্ঞান প্রেমী বন্ধু গাটঁছড়া বাঁধার পর জেনেছে জীবন সঙ্গী স্কিটসোফ্রেনিকতার বিজ্ঞান ভাবনায় মানসি রোগের অভিজ্ঞতা ছিল না, মহা বিস্ময়ে আমার কাছে বর্ণনা করেছে যা এই রোগের স্বাভাবিক  অবস্থাবলেছে তার কাছের মানুষটি কি ভাবে সন্দেহের চোখে তাকায়, কি ভাবে বারোতলার ওপর থেকে লাফিয়ে পড়তে চায়আমার বন্ধুটির না জানা শুন্যস্থানগুলো আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা দিয়ে ভরাবার চেষ্টা করি বলি তুমি সঙ্গে আছ কিন্তু যখন রোগের র্যায়গুলো চলে তখন কিন্তু তুমি তার কেউ নও স্বাভাবিক পরিতিতে  তোমার একদিন এন্টিডিপ্রেশেনের ওষুধ খেতে হতে পারে যদি না দৃঢ়চেতা হও


আমি নেদারল্যান্ডে যেদিন পা রাখি ওদিন ভারতের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয়।। মধ্যবয়সী এই প্রাণোচ্ছল মানুষটি চমকার সুর তুলতেন বাঁশীতে, তামাম বিশ্বেজ্ঞানকে অবলীলায় সহজ করে বলার অদ্ভুত ক্ষমতা রাখতেনআমার আগের বছর এমএ করতে এসেছে, এক ব্যাচের না হয়ায় দেখা হতো কদাচিত  বড় দিনের কাছাকাছি কোন এক দিনে ভোর সকালে আমার এক সহপাঠীর ফোনে ঘুম ভাঙলো মেয়েটি  জিগ্যেস করলো, তোমার জানালা দিয়ে দুই হস্টেলের মাঝের চত্ত্বরটা কি দেখা যায়, আমি বললাম যায় বৈকি, কেন? বলল তাহলে দেখজানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দেখি মাইক পুরনাম শান বাঁধান চত্ত্বরে উপুর হয়ে পড়ে আছেঅসাড় দেহে গত রাতের পার্টি কাপড় বেলা গড়াতে জেনেছি মাইক স্কিটসফ্রেনিক ছিলেন,  রোগের আশু উপস্থিতি জেনে চলে গিয়েছিলেন বেলজিয়ামে, কথা বলেছিলেন পাদ্রির সাথে, শেষে বান্ধবীর বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, দরকার ছিল ডাক্তারী পরামর্শের, নেন নি  বান্ধবীও জানত না কি করা উচিত মাইক ভেবেছিলেন এড়িয়ে যেতে পারবেন, কিন্ততু রোগটা তার আয়ত্তের মধ্যে ছিল নামাইক ভেবেছিলেন লাফিয়ে পড়তে পারবেন পাঁচতলা থেকে, ভেবেছিলেন তার মৃত্যূ নেই, মহামানব তিনি  রোগের এই অবস্থায় এটা মনে করাই স্বাভাবিক  মাইকের উপুর হওয়া দেহটা দেখেছি আর ভেবেছি ঠিক মন করে আমার দেহটাও পড়ে থাকতে পারতআমাদের অনেকের তো অনেক মানসিক সমস্যা আছেযার কিছু প্রকাশিত, কিছু নয়

 

ভাবুন তো যারা এই রোগে আক্রান্ত কি ভীষ টানাপোড়েন চলে তাদের মনের ভেতর, কি ভয়ংকর একলা তারা, তবু কি সহজে চালিয়ে যান জীবন


আমার সিলেট বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজন সহকর্মী ছিলেন যারা ঋতুকালীন মানসিক রোগে ভুগতেন  সবার সেকি হাসাহাসি তাদের নিয়ে অথচ এটা কেউ ভাবতো না যে কি বিশাল ক্ষমতায় এনারা রোগকে আয়ত্তে রেখে ১১ মাস চাকরী করতেন আর সময়টা আসবার আগেই সরে আসতেন রুটিন জীবন থেকে  বাস্ত আর সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসতেন কর্মস্তলেমানসিক রোগ নিয়ন্ত্র করা যায় ওষুধেপাশের মানুষ কে জানতে হয় কখন দ্বারস্ত হতে হবে প্রফেশনাল সাহায্যের  জন্যে

 

আমরা প্রতিবন্ধীদে পুনর্বাসনের কথা বলি কিন্তু তার আগে স্বীকৃতি দিতে হবে সেটা ভুলে যাইশারীরিক প্রতিবন্ধীতা আমাদের দেশে দেখা হয় পাপের ফল, সৃষ্টির্তার আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ অথবা শাস্তি হিসেবে তাই আমাদের আচরও হয়ে থাকে নির্দ যেন শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তকে  আরো শাস্তি দেবার ক্ষমতা আর অধিকার দুটোই আমাদের আছে

 

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সাধার জীবন যাপনের জন্য বিভিন্ন পুনর্বাসন টেকনোলজি আবিষ্কৃত হচ্ছেআমার একজন সহকারী চোখে  দেখেন  না, তিনি ব্যবহার করেন JAWS  software যাতে তার কম্পিউটাটি কথা বলে, আমার সহকর্মী পেশী  শিথিলতার জন্য কীবোর্ডে হাত রাখতে পারেন না তিনি ব্যবহার করেন  Dragon software  যাতে মুখে বলা কথা টাইপ হয়ে যায় কম্পিউটারে

 

এমন আর কত কি নয়া উদ্ভব ঘটছেজানি এগুলোর সাথে বৈভব জড়িত তাই বিত্তবলে দুর্বল আমার দেশে এগুলোর প্রচলন এখনো নেইএকখানা হুইলচেয়ার যোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হয় আর তা চালানোর  মত রাস্তাও পাওয়া যায় না

 

কিন্তু যা বলতে চাইছি তা হলো,  প্রতিবন্ধী বিষয়টি যতদিন  আহা রে অথবা আল্লায় শাস্তি দিছেএই জায়গাটা থেকে বেরুতে পারবে না ততদিন মনে হয় এই জনগোষ্ঠীকে সমাজের সমান অংশীদার ভাবতে আমাদের কষ্ট হবে

 

বাংলা টেলিভিশনে দেখলাম একজন হাতহীন ছাত্র পা দিয়ে লিখে পরিক্ষা দিচ্ছেন  প্রতিবেদনটি শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে পেছনে ভেসে এলো গিটারের করুণ সুর বাংলাদেশ ক্রাচে বা আশাবারি  (শব্দটা সম্প্রতি বাবার কাছে শেখা) হাতে হেঁটে যাওয়া মানুষ দেখলেই আমরা হয় এড়িয়ে চলি নতুবা আহারে বলে ফেলিঅথচ ভাবি না তার ভেতরে একজন যোদ্ধার বাস

 

মুক্তমনার পাঠক বৈষম্যের বিরুদ্ধে যদি ধ্বজ্বা ধরবেনই ভাবছেন এই লেখাটা পড়ে ভাবুনতো আপনি কি ভাবে দেখেন শারীরিক অথবা মানসিক প্রতিবন্ধীতাকে?