শারীরিক ও মানসিক সীমাবদ্ধতা প্রসঙ্গে
ক্যাথেরীনা রোজারিও কেয়া
আমার শৈশব কেটেছে ঢাকার ধানমনডীর আঠার নম্বরে। ছোট বেলা থেকে দেখে এসেছি এক জনকে নিয়োগ দেয়া আছে জলের পাম্প বা মেসিন ছাড়বার জন্যে।নদীমাত্রিক এই দেশে জলের নিয়ন্ত্রন এক বিশাল বিষয়। এ নিয়ে ঝগড়া বিবাদ , মনোমালিন্য এমনকি কোর্ট কাছারি পর্যন্ত হয়। পানিকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারটি সেই কারবালা থেকে শুরু করে ফারাক্কা পেরিয়ে বাংলাদেশে বাড়ীওয়ালা পর্যন্ত পৌঁছোয়। পানির মালিকানা কিভাবে কৃষক সমবায় সমিতির হাত গড়িয়ে বিআইডিএস এর হাত পেরিয়ে নন প্রফিটের এর হাতে এসে পৌছেছে, সে আরেক রাজনৈতিক আলোচনা। আমার আলোচনার বিষয় আজ অন্য।
সেই যে ভদ্রলোকের নিয়োগ ছিলো পানির পাম্প ছাড়ার জন্যে তাকে ছোট বড় সবাই তার নাম – “বয়রা” বলে ডাকত।,। আমি দিদিমা কে রাত্তিরে ত্রিফলা ভিজিয়ে সকালে সেই জল পান করতে দেখেছি। জেনেছি ত্রিফলার একটি ফল আমলকি, অন্যটি হরিতকি এবং বয়রা। ভাবতাম ভদ্রলোকের নাম বোধ করি সেই ফলের নামে। খানিকটা বড় হয়ে বুঝলাম ভদ্রলোকের নাম” সামাদ” তিনি কানে কম শুনতেন বলে তাকে বয়রা বলে ডাকা হতো। তার প্রতিবন্ধীতা তার নামে, তার পরিচয়ে রুপান্তরিত হয়েছিল।
আমাদের মধ্যে কিছু বিষয় আছে যা মেনে নিতে কষ্ট হয়। যেমন বাচ্চা দেখলেই অহেতুক ধমকে উঠি, বয়ষ্ক দেখলেই এড়িয়ে চলি আর প্রতিবন্ধী দেখলেতো কথাই নেই – তার নামই পালটে দেই। পা খোঁড়া মানুষ দেখলে আসে পাশে সবাই তাকে ডাকে ঐ ল্যাংড়া বলে আর সে বিয়ে করলে তার স্ত্রী রাতারাতি হয়ে যান ল্যাংড়ার বউ।
গতবার দেশে গিয়ে জেনেছিলাম সিলেটের স্বশিক্ষিত কবি দিলয়ারের ছেলে কবি কিশয়ার মারা গেছেন। কবি দিলয়ার খুব সহজ ভাবে একদিন স্বল্প পরিচয়ে আমায় বলেছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতি উঠোনে পড়ে থাকা মেয়েদের লম্বা চুলের ওপর মোরগের হেঁটে যাবার মত, যতো মোরগটি পায়ে জড়ানো চুলের জট খুলতে যায় ততোই জড়িয়ে যায়।। সরল ব্যাখ্যা শুনে বিস্মিত হয়েছিলাম। সেই কবি দিলয়ারের ছেলে কবি কিশয়ার বাবার মতই সরল ভাষার আর মনের।
জানলাম মানসিক রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করতেন, যখন ফিরে আসতেন স্বাভাবিক অবস্থায় তখন লিখতেন কবিতা যাতে থাকতো মৃত্যুর অনুভুতি। তার মৃত্যু স্বেচ্ছায় কিনা রহস্যেই ঢাকা রইল। জানলাম বাংলাদেশে মেয়েদের আবাসিক হলে একাধিক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। সেখানে মানসিক রোগের চিকিৎসা, সাইকোথেরাপী, কাউন্সেলিং এর প্রচলন নেই, সুযোগ নেই। শুনে হতাশ হলাম।
আমার মেজবোন ছোট বেলায় কোন এক সেমিনারে পাবনায় গিয়েছিল, ফিরে এসে বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলো “বাবা কেন মানুষ হেমায়েত পুরে চিড়িয়াখানার মত পাগল দেখতে যায়?” ওদের সেমিনারের এক দিনের এজেন্ডাছিলো পাগলা গারদ ডে। শব্দটা ভেবে দেখুন “ পাগলা গারদ” অর্থাৎ পাগলদের জেলখানা, চিকিৎসালয় নয়। বাংলায় একটা প্রচলিত কথা আছে মানসিক অসুখের ওষুধ হচ্ছে লাঠ্যাষধি। কি নির্মম চিন্তা তাই না?
আমার এক বিজ্ঞানমনষ্ক, বিজ্ঞান প্রেমী বন্ধু গাটঁছড়া বাঁধার পর জেনেছে জীবন সঙ্গী স্কিটসোফ্রেনিক। তার বিজ্ঞান ভাবনায় মানসিক রোগের অভিজ্ঞতা ছিল না, মহা বিস্ময়ে আমার কাছে বর্ণনা করেছে যা এই রোগের স্বাভাবিক অবস্থা। বলেছে তার কাছের মানুষটি কি ভাবে সন্দেহের চোখে তাকায়, কি ভাবে বারোতলার ওপর থেকে লাফিয়ে পড়তে চায়। আমার বন্ধুটির না জানা শুন্যস্থানগুলো আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা দিয়ে ভরাবার চেষ্টা করি । বলি তুমি সঙ্গে আছ কিন্তু যখন রোগের পর্যায়গুলো চলে তখন কিন্তু তুমি তার কেউ নও। স্বাভাবিক পরিণতিতে তোমার একদিন এন্টিডিপ্রেশেনের ওষুধ খেতে হতে পারে যদি না দৃঢ়চেতা হও।
আমি নেদারল্যান্ডে যেদিন পা রাখি ওদিন ভারতের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয়।। মধ্যবয়সী এই প্রাণোচ্ছল মানুষটি চমৎকার সুর তুলতেন বাঁশীতে, তামাম বিশ্বের জ্ঞানকে অবলীলায় সহজ করে বলার অদ্ভুত ক্ষমতা রাখতেন। আমার আগের বছর এমএ করতে এসেছে, এক ব্যাচের না হওয়ায় দেখা হতো কদাচিত। বড় দিনের কাছাকাছি কোন এক দিনে ভোর সকালে আমার এক সহপাঠীর ফোনে ঘুম ভাঙলো । মেয়েটি জিগ্যেস করলো, “তোমার জানালা দিয়ে দুই হস্টেলের মাঝের চত্ত্বরটা কি দেখা যায়, আমি বললাম যায় বৈকি, কেন? বলল “তাহলে দেখ”। জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দেখি মাইক পুরনাম শান বাঁধান চত্ত্বরে উপুর হয়ে পড়ে আছে। অসাড় দেহে গত রাতের পার্টির কাপড়। বেলা গড়াতে জেনেছি মাইক স্কিটসফ্রেনিক ছিলেন, রোগের আশু উপস্থিতি জেনে চলে গিয়েছিলেন বেলজিয়ামে, কথা বলেছিলেন পাদ্রির সাথে, শেষে বান্ধবীর বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, দরকার ছিল ডাক্তারী পরামর্শের, নেন নি। বান্ধবীও জানত না কি করা উচিত। মাইক ভেবেছিলেন এড়িয়ে যেতে পারবেন, কিন্ততু রোগটা তার আয়ত্তের মধ্যে ছিল না। মাইক ভেবেছিলেন লাফিয়ে পড়তে পারবেন পাঁচতলা থেকে, ভেবেছিলেন তার মৃত্যূ নেই, মহামানব তিনি। রোগের এই অবস্থায় এটা মনে করাই স্বাভাবিক। মাইকের উপুর হওয়া দেহটা দেখেছি আর ভেবেছি ঠিক অমন করে আমার দেহটাও পড়ে থাকতে পারত। আমাদের অনেকের তো অনেক মানসিক সমস্যা আছে। যার কিছু প্রকাশিত, কিছু নয়।
ভাবুন তো যারা এই রোগে আক্রান্ত কি ভীষণ টানাপোড়েন চলে তাদের মনের ভেতর, কি ভয়ংকর একলা তারা, তবু কি সহজে চালিয়ে যান জীবন।
আমার সিলেট বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজন সহকর্মী ছিলেন যারা ঋতুকালীন মানসিক রোগে ভুগতেন। সবার সেকি হাসাহাসি তাদের নিয়ে। অথচ এটা কেউ ভাবতো না যে কি বিশাল ক্ষমতায় এনারা রোগকে আয়ত্তে রেখে ১১ মাস চাকরী করতেন আর সময়টা আসবার আগেই সরে আসতেন রুটিন জীবন থেকে। বাস্তব আর সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসতেন কর্মস্তলে। মানসিক রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায় ওষুধে। পাশের মানুষ কে জানতে হয় কখন দ্বারস্ত হতে হবে প্রফেশনাল সাহায্যের জন্যে।
আমরা প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসনের কথা বলি কিন্তু তার আগে স্বীকৃতি দিতে হবে সেটা ভুলে যাই। শারীরিক প্রতিবন্ধীতা আমাদের দেশে দেখা হয় পাপের ফল, সৃষ্টিকর্তার আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ অথবা শাস্তি হিসেবে। তাই আমাদের আচরণও হয়ে থাকে নির্দয়। যেন শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তকে আরো শাস্তি দেবার ক্ষমতা আর অধিকার দুটোই আমাদের আছে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সাধারণ জীবন যাপনের জন্য বিভিন্ন পুনর্বাসন টেকনোলজি আবিষ্কৃত হচ্ছে। আমার একজন সহকারী চোখে দেখেন না, তিনি ব্যবহার করেন JAWS software যাতে তার কম্পিউটারটি কথা বলে, আমার সহকর্মী পেশী শিথিলতার জন্য কীবোর্ডে হাত রাখতে পারেন না। তিনি ব্যবহার করেন Dragon software যাতে মুখে বলা কথা টাইপ হয়ে যায় কম্পিউটারে।
এমন আর কত কি নয়া উদ্ভব ঘটছে। জানি এগুলোর সাথে বৈভব জড়িত তাই বিত্তবলে দুর্বল আমার দেশে এগুলোর প্রচলন এখনো নেই। একখানা হুইলচেয়ার যোগাড় করতেই হিমশিম খেতে হয় আর তা চালানোর মত রাস্তাও পাওয়া যায় না।
কিন্তু যা বলতে চাইছি তা হলো, প্রতিবন্ধী বিষয়টি যতদিন “আহা রে” অথবা “ আল্লায় শাস্তি দিছে” এই জায়গাটা থেকে বেরুতে পারবে না ততদিন মনে হয় এই জনগোষ্ঠীকে সমাজের সমান অংশীদার ভাবতে আমাদের কষ্ট হবে।
বাংলা টেলিভিশনে দেখলাম একজন হাতহীন ছাত্র পা দিয়ে লিখে পরিক্ষা দিচ্ছেন । প্রতিবেদনটি শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে পেছনে ভেসে এলো গিটারের করুণ সুর। বাংলাদেশ ক্রাচে বা আশাবারি (শব্দটা সম্প্রতি বাবার কাছে শেখা) হাতে হেঁটে যাওয়া মানুষ দেখলেই আমরা হয় এড়িয়ে চলি নতুবা “আহারে” বলে ফেলি। অথচ ভাবি না তার ভেতরে একজন যোদ্ধার বাস।
মুক্তমনার পাঠক – বৈষম্যের বিরুদ্ধে যদি ধ্বজ্বা ধরবেনই ভাবছেন – এই লেখাটা পড়ে ভাবুনতো – আপনি কি ভাবে দেখেন শারীরিক অথবা মানসিক প্রতিবন্ধীতাকে?
অসাধারণ একটা লেখা পড়লাম। অসাধারণ !!! আশা করি লেখাটি পড়ে আমরা সবাই নিজ নিজ মানসিকতা নিয়ে একবার হলেও ভেবে দেখব ।
যারা মতামত জানিয়েছেন তাদের বক্তব্যের সুত্র ধরে বলি, আমেরিকায় জনসংখ্যার ২০% অর্থাৎ ৬০ মিলিয়ন মানুষ কোন না কোন শারীরিক অথবা মানসিক প্রতিবন্ধকতায় ভুগছেন।। প্রতি ৯ সেকেন্ডে একজন মানুষ কাজে আঘাত প্রাপ্ত হচ্ছেন এবং পঙ্গুত্ব বরণ করছেন। আজকে যারা আমেরিকায় কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করছেন তাদের দশ জনের মধ্যে তিনজন অবসর গ্রহনের আগেই কোন না কোন প্রতিবন্ধকতায় ভুগবেন।
আমরা সাধারণত প্রতিবন্ধকতা বলতে মনে করি জন্মগতভাবে প্রতিবন্ধক। কিন্তু যারা সচল জীবন থেকে কোন দুর্ঘটনার কারণে প্রতিবন্ধি হয়ে যান তাদের কিন্তু পুনঃসামাজিকীকরন বা resociolization ঘটে। সব কিছু পালটে যায় তাদের কাছে, চেনা আশপাশ ভিন্ন হয়ে যায়। চার্লস কুলির তত্ত্ব অনুযায়ী লুকিং গ্লাস সেলফ ঘটে। নিজেকে সে দেখে অন্যের ধারণা দিয়ে, অন্যের চোখ দিয়ে। বদলে যায় তার নিজের সম্পর্কে ধারণা বা সেলফআইডেন্টিটি। সেই জন্যেই সমাজের দায়িত্ত্ব রয়েছে যাতে সম্প্রতি পঙ্গু হওয়া মানুষটি নিজেকে বাতিল অথবা অপ্রয়োজনীয় না ভাবে।
২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত কর্মক্ষেত্রে বেড়েছে ৩৫% প্রতিবন্ধি কর্মী। এই জনগোষ্ঠীর কাজে উপস্থিতি, দক্ষতা, কর্মস্পৃহা অন্য কর্মীদের মতই। American with Disability Act বলছে প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে শারীরিক অথবা মানসিক সীমাবদ্ধতা যা কিনা জীবনের স্বাভাবিক কিছু কর্মকে ব্যাহত করে। সেই কর্মগুলো হলোদৃষ্টি, শ্রবন, কথা বলা, হাঁটা, নিজের পরিচর্যা করাএবং স্বভাবিক ভাবে শ্বাস গ্রহণ করা।
শুরুটা ১৯০৮ Federal Employees worker’s act দিয়ে। এর পর আসে ১৯১৪ তে War Risk Act, যেখানে বলা হয় প্রতিবন্ধিদের জন্যে কারিগরি শিক্ষার কথা। ১৯১৭ সালে কারিগরি প্রশিক্ষণ বিশেষ গুরুত্ত্ব পায়।। ১৯২০ সালে কারখানায় আঘাত প্রাপ্ত পঙ্গুদের জন্যে, প্রতিবন্ধিদের জন্যে পরামর্শ, প্রশিক্ষণ এবং হারানো চাকুরির প্রতিস্থাপন আইনগত বৈধতা পায়।। ১৯৪৩ সালে মানসিক প্রতিবন্ধিরাও অন্তর্ভুক্ত হতে থাকেন।। ১৯৫৪ সালে Vocational Rehabilitation Act নিশ্চিত করে প্রতিবন্ধিদের জন্যে উচ্চতর শিক্ষা এবং গবেষণার । এরপর আসে আরো সংযুক্তি, ১৯৮৬ সালে পুনর্বাসন প্রযুক্তি গুরুত্ত্ব পায়। ১৯৯০ সালে American with Disability Act গঠনমুলক রূপ ধারন করে। এই act প্রতিবন্ধিদের কর্মক্ষেত্রে বিশেষ কোন পক্ষপাতিত্বের সুযোগ দেয় না, যোগ্যতাহীন হলে চাকুরির অধিকার বা নিশ্চয়তা কোনোটাই দেয় না বরং নিশ্চিত করে যাতে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র, প্রতিবন্ধি হওয়ার কারনে যেন বৈষম্যেরর শিকার না হয়। এই Act নিশ্চিত করে যাতে কর্মক্ষেত্র তাদের কর্ম উপযোগী হয়, পাবলিক যানবাহনে যাতে প্রতিবন্ধিদের সহজ গতিময়তা থাকে। সরকারী বেসরকারী অফিস, হাসপাতালে, বিদ্যালয়ে, ফার্মাসিতে যেন কোন ভাবেই প্রতিবন্ধকতার কারনে কাউকে সার্ভিস না পেয়ে ফিরে যেতে না হয়।
এরপর ১৯৯৭ সালে ADA -তে যুক্ত হয়ছে Early Intervention বা অগ্রীম ব্যবস্থা গ্রহণ যাতে প্রতিবন্ধি শিশুরা অনায়াসে প্রবেশ করতে পারে কর্মক্ষেত্রে।
মূল কথা যেমন আইন তৈরী করাটা জরুরী তেমনি তা মেনে চলাটাও জরুরী। কিন্তু যদি সাংস্কৃতিকভাবে অথবা, জীবনচর্চায়এই মানসিক শারীরিক প্রতিবন্ধকতা মেনে নিতে না পারি তাহলে কিন্তু আইন তৈরীর প্রয়োজনই বোধ করবো না আমরা।
@কেয়া,
রিপোর্টিং ভঙ্গীতে অতি জরুরী একটি লেখা। প্রত্যেককে আয়নার ভেতরে দেখা নিজের ছবিকে মৌলিক মানবিক প্রশ্নসমূহের মুখোমুখি করানো দরকারি বটে।
প্রতিবন্ধী মানুষ সর্ম্পকে দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তনের জন্য চাই সমাজ সচেতনতা তথা চিন্তার প্রতিবন্ধকতা দূর করা।
আপনাকে সাধুবাদ জানাই। চলুক। :yes:
একটা সমাজকে মূল্যায়ন করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে সেই সমাজ তার ভিন্নতর সদস্যদেরকে কীভাবে দেখে সেটাকে খেয়াল করা। সেই মানদণ্ডে আমাদের সমাজ যে বহু বহু যুগ পিছিয়ে আছে তা ক্যাথেরীনার বলিষ্ঠ লেখা এবং অভিজিৎ এবং ইরতিশাদ ভাইয়ের চমৎকার মন্তব্য থেকেই বোঝা যায়। তবে এটা সত্যি যে, পশ্চিমা বিশ্ব শারীরিক বা মানসিক সীমাবদ্ধ মানুষদেরকে আজ যেভাবে মর্যাদা দিচ্ছে একসময় তারাও সেটা দিত না। আমাদের মতই ‘কুরুচি এবং কুসংস্কৃতি’ তাদেরও ছিল। এখানেও তাদেরকে নির্বোধ (dunce), হাঁদারাম (imbecile) বা গর্দভ (fool) বলে ডাকা হতো আমাদের দেশের মতই। হাসাহাসি এবং পরিহাসও করা হতো তাদেরকে নিয়ে আমাদের রীতিতেই। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব অতিদ্রুত সেই নিষ্ঠুর অবস্থা থেকে নিজেদেরকে উত্তরণ করেছে সাফল্যজনকভাবে। আজ এখানে কোন ব্যক্তিকে শারীরিক বা মানসিক সীমাবদ্ধতার কারণে বিন্দুমাত্র ভিন্নভাবে দেখার অবকাশ নেই। না সামাজিকভাবে না আইনগতভাবে।
ক্যাথেরীনার লেখাটা পড়তে গিয়ে একটা বিষয় মনে পড়লো আমার। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম যদ্দুর মনে পড়ে আমার বিভাগেই একজন অন্ধ ছাত্র পড়াশোনা করতো। সেই ছাত্রটি আমার দুই এক বছরের জুনিয়র হওয়াতে কখনোই জানতে পারিনি যে সে কীভাবে পড়াশোনা করেছে তখন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্ধ ছাত্রদের জন্য বিশেষ কোন ব্যবস্থা যে ছিল না সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
ওই ছাত্রের কথা ভাবতেই খেয়াল হলো যে আমাদের দেশে শারীরিক এবং মানসিক সীমাবদ্ধ শিশুদের শিক্ষাকার্যক্রমের জন্য আসলে কোন সুনির্দিষ্ট আইন কানুন বা পরিকল্পনা বলে কিছুই নেই। আচ্ছা, আমাদের কি পরিমাণ বাচ্চা এই ধরনের শারীরিক এবং মানসিক সীমাবদ্ধতায় ভুগছে তা কি আমরা সঠিকভাবে জানি। আমেরিকার মত উন্নততর দেশেও ৬ থেকে ১৭ বছর বয়েসি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ১১ শতাংশই শারীরিক বা মানসিকভাবে সীমাবদ্ধ। এখানেই যদি ১১ শতাংশ হয় তাহলে বাংলাদেশে কত শতাংশ হবে। তাদের শিক্ষার কি ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার কে জানে? মুক এবং বধিরদের জন্য একটা স্কুল আছে বিজয়নগরে। এটুকু জানি। কিন্তু সেখানেও কতখানি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শিক্ষা দেওয়া হয় বা কি শিক্ষা দেওয়া হয় সে সম্পর্কে আমার তেমন কোন ধারণাই নেই।
আমেরিকাতেও এক সময় এই সমস্ত বাচ্চাদেরকে স্কুলে ভর্তি করা হতো না বা শিক্ষার সমান সুযোগ সুবিধা দেওয়া হতো না। ১৯৭০ সালের আগে অনেক রাজ্যেই এমন আইন ছিল যাতে সরকারী স্কুলগুলো ওই সমস্ত বাচ্চাদেরকে ভর্তি করাতে অস্বীকৃতি জানাতে পারতো। স্কুল কর্তৃপক্ষেরও শারীরিক বা মানসিক সীমাবদ্ধ শিশুদেরকে সুস্থ শিশুদের মত একই শিক্ষা দেওয়ার আইনগত কোন বাধ্যবাধকতা ছিল না। এদেরকে ভর্তি করা হলেও সাধারণত অন্য বাচ্চাদের থেকে আলাদা করে আটকে রাখা হত দূরের কোন ক্লাসরুমে। কিন্তু সেই অবস্থা থেকে আমেরিকান সমাজ সরে এসেছে অনেকদূর। সমতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের ধারনার বিস্তৃতির সাথে সাথে ওই সমস্ত শিশুরাও অন্তরীন অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে অন্যসব বাচ্চাদের সাথে একই ক্লাসরুমে যাচ্ছে, একই সংগে অংশগ্রহণ করছে সকল কর্মকাণ্ডে। কাউকে আলাদা হবার কারণে স্কুলে ভর্তি না করা বা স্কুল থেকে বহিস্কারের সুযোগ আর নেই এখন। আইন এবং আদালতের সিদ্ধান্তসমূহ প্রতিটি শারীরিক এবং মানসিকভাবে সীমাবদ্ধ শিশুকে অন্য বাচ্চাদের মত সমান শিক্ষা পাবার অধিকার নিশ্চিত করেছে।
মূলত ১৯৭৫ সালে কংগ্রেসের পাশ করা LAW 94-142 বা Education for All Handicapped Children এর মাধ্যমেই এই আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল। এর পরে পাঁচবার সেই আইনে পরিবর্তন এসেছিল। ১৯৯০ সালের সংশোধনীতে ওই আইনকে নতুনভাবে নামকরণ করা হয়। এর নাম হয়ে যায় Individuals with Disabilities Education Act. সংক্ষেপে IDEA. এই আইনই সমাজের পূর্ববর্তী সব ধারণাকে পালটে দেয়। শিক্ষা প্রক্রিয়ায় শিক্ষক, ছাত্র, অভিভাবক, স্কুল কর্তৃপক্ষ সকলের ভূমিকা সম্পূর্ণভাবে বদলে যায়। শারীরিক এবং মানসিক সীমাবদ্ধ লোকজনকে অন্যান্য নাগরিকদের মত সমান সুযোগ সুবিধা এবং অধিকার প্রদান করে এই আইন।
আমাদের দেশেও IDEA-র মত আইন পাশ করা জরুরী হয়ে পড়েছে খুব শিঘ্রই।
ক্যাথেরীনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাদের ঘুমিয়ে থাকা বিবেকের দরজায় করাঘাত করার জন্যে।
অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য, বিদ্রুপ আমরা অবলীলায় প্রতিবন্ধীদের করে যাই। যখন একটু বয়স হয়, তখন করি দয়া, কৃপা, অনুকম্পা, দেখাই সহানুভুতি।
কোনটাই কিন্তু নয়, প্রতিবন্ধীদের প্রাপ্য সম্মান। বিত্ত-বৈভব নেই তাই হয়তো প্রতিবন্ধীদের জীবনযাপন সহজ নয় আমাদের দেশে। কিন্তু সুরুচি-সুসংস্কৃতির অভাব কেন হবে? ব্যাক্তির রুচি দিয়েই গড়ে ওঠে সমস্টির সংস্কৃতি। আসুন কেয়ার আহবানে সাড়া দিয়ে আমরা মানসিক, শারিরীক প্রতিবন্ধীদের দিই যোদ্ধার সম্মান, আর গড়ে তুলি সুসংস্কৃতি ।
কেয়াকে ধন্যবাদ তাঁর প্রাঞ্জল রচনার মাধ্যমে আমাদের সমাজের আর সংস্কৃতির এই বিশেষ ধরনের দৈন্যতার উপর আলোকপাত করার জন্য।
ছয় জন মিলে দশ তারা দিয়েছে লেখাটায়, কিন্তু একজনও কোন মন্তব্য করেননি। ব্যাপারটা মোটেই ঠিক হল না। আমিই মন্তব্য করলাম।
শারীরিক ও মানসিক সীমাবদ্ধতার বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের ‘দেশী সমাজে’ আদৌ কোন চিন্তাভাবনা আছে বলে মনে হয় না। মানসিক আর শারিরিক প্রতিবন্ধিদের নিয়ে ঠাট্টা তামাসা করা হয় অহর্নিশি। এমনকি নাটক সিনেমাতেও দেখেছি – রবিউল, টেলি সামাদরা কমেডীয়ান চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে অভিনয় করছে – কিভাবে একজন খোঁড়া মানুষ চলে। আর তা দেখে হল ভর্তি লোক হেসে গড়াগড়ি। আমাদের মূল্যবোধের স্তর কতটা নীচে নেমে গেলে আমাদের কাছে কারো শারীরিক সীমাবদ্ধতার বিষয়টা আমোদ হিসেবে চলে আসে তা অনুমান করা কঠিন নয়। আমরা কানে খাটো কাউকে দেখলে সম্বধোন করি – ‘আ বে কাউলা’ বলে কিংবা অন্ধকে বলি – ‘কালার পো’! শারীরিক প্রতিবন্ধীদের কথা না হয় বাদই দেই, শারীরিক ভাবে সুস্থ মানুষদেরও রেহাই দেই না। বিধর্মীদের ‘মালু’ নামে সম্বোধন করতে আমার কাছের বন্ধুবান্ধবদেরই দেখেছি। ব্যাপারটা যে অশোভন সেই বোধটুকুও কারো ছিলো না, অথচ শিক্ষাদীক্ষায় কমতি ছিলো না কারো। আর মেয়েদের প্রতি এই বিশেষনের আধিক্য এতো বেশি যে এটা নিয়ে কোন কথা না বলাই বধ হয় ভাল হবে।
আমরা আমাদের সংস্কৃতি নিয়ে যার পর নাই গর্ব বোধ করি, কিন্তু যে সংস্কৃতিতে মানুষের প্রতি সম্মানবোধ জাগানোর চেষ্টা করা হয় না, সে সংস্কৃতি কতটা গৌরবের?
ধন্যবাদ জানাচ্ছি কেয়াকে এই স্পর্শকাতর বিষয়টা নিয়ে লিখবার জন্য।