বিবর্তনতত্ত্ব – “আমরা বান্দর থাইকা আইছি” এবং আরো কিছু ভুল ধারণা
ইরতিশাদ আহমদ
এক। “আমরা বান্দর থাইকা আইছি! আপ্নে কইলেই হইলো? আপ্নে আইলেও আইতে পারেন, আমি না।”
খোদ চার্লস ডারউইনকেও এই কথা শুনতে হয়েছিল, তাঁকে নিয়ে বানরের আদলে ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন আঁকা হয়েছিল। আরও শুনতে হয়েছিল বিজ্ঞানী টমাস হাক্সলিকে, অক্সফোর্ডে এক সভায় তাঁকে হেনস্তা করার জন্য এক খ্রিষ্টান বিশপ জানতে চান তার দাদা এবং দাদীর মধ্যে কে বানর ছিলেন। বিশপ প্রবর মোক্ষম জবাব পেয়েছিলেন হাক্সলির বুদ্ধিদীপ্ত তীর্যক উত্তরে। হাক্সলি বলেছিলেন, কোন বানরের উত্তরসুরী হওয়াটাকে তিনি মোটেও লজ্জার কিছু মনে করেন না, তিনি বরং লজ্জা বোধ করবেন সেই ব্যক্তির সাথে সম্পর্কিত হতে যে তার মেধা ও বুদ্ধিমত্তা ব্যাবহার করে সত্যকে ঢেকে রাখার চেষ্টায়।
কিন্তু বিবর্তনতত্ত্ব বলতে এখনো অনেকেই মনে করেন ‘আমরা মানুষেরা বানর থেকে এসেছি’ এটাই এই তত্ত্বের মূল কথা। বানরজাতীয় প্রাণী থেকে আমাদের মানুষ প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছে এটা বোঝাতে চাইলে কথাটা ভুল নয়। কিন্তু কোন ব্যাখ্যা ছাড়া সরাসরি এভাবে বলার ফলে কমপক্ষে দুটি ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়। এক – হঠাৎ করেই কিছু বানর মানুষ হয়ে গেছে। দুই – কিছু কিছু বানর এখনো মানুষ হয়ে যেতে পারে। এই ভুল ধারণারগুলোর ভিত্তিতে অনেকেই সম্পূর্ণ তত্ত্বটাকে না বুঝেই খারিজ করে দেন। ধর্মে বিশ্বাস হারানোর ভয়ে অনেকে আবার বুঝতেই চান না। তবুও ভালো, ধর্মবিশ্বাস আর বিবর্তনতত্ত্বের ধারণা যে ‘মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ’ (পরস্পরবিরোধী) অন্তত এটা তারা ঠিকই বোঝেন।
যথেষ্ট বুদ্ধি থাকা সত্বেও বানরেরা যে মানুষে পরিণত হচ্ছে না – কিংবা আমরা মানুষেরা, আমাদের অনেকের মধ্যে বানরসুলভ অনুকরণপ্রিয়তার বাহুল্য সত্বেও, যে বানরে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছি না, তা তো দেখতেই পাচ্ছি। তাহলে ডারউইন সাহেব আসলে কি আবিষ্কার করেছেন? সাদামাটা কথায়, প্রাণীকূলের সমস্ত প্রজাতি প্রাণের একটা সাধারণ উৎস থেকে বিবর্তিত হয়েছে এই সত্যটাই চার্লস ডারউইন উদঘাটন করেছেন। এবং বিবর্তনের প্রক্রিয়াটা যে মূলতঃ ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের’ মাধ্যমে ঘটেছে, এই তত্ত্বটাকেও তিনি বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে একটা দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
আর বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষ প্রজাতিরও উদ্ভব ঘটেছে বানর জাতীয় কোন প্রজাতি থেকে। শুধু মানুষই নয়, শিম্পাঞ্জী, গরিলা এবং ওরাংওটাং-এর মতো প্রাণীকূলেরও উদ্ভব ঘটেছে সেই একই সাধারণ পূর্বপুরুষ (common ancestor) প্রজাতি থেকে। ব্যাপারটাকে গাছের শাখার সাথে তুলনা করলে বুঝতে সুবিধা হয়। বন্যা আহমেদ খুব চমৎকার ভাবে বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করেছেন, তাই একটু লম্বা হলেও উদ্ধৃতি দিচ্ছি –
প্রাণের বিকাশ এবং বিবর্তনকে একটা বিশাল গাছের সাথে তুলনা করা যায়। একই পূর্বপূরুষ থেকে উদ্ভুত হয়ে বিবর্তনের ওই গাছটির (জাতিজনি বৃক্ষ) বিভিন্ন ডাল পালা তৈরি হয়েছে । এর কোন ডালে হয়তো শিম্পাঞ্জীর অবস্থান, কোন ডালে হয়ত গরিলা আবার কোন ডালে হয়ত মানুষ। অর্থাৎ, একসময় তাদের সবার এক সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিলো, ১.৪ কোটি বছর আগে তাদের থেকে একটি অংশ বিবর্তিত হয়ে ওরাং ওটাং প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। তখন, যে কারণেই হোক, এই পূর্বপুরুষের বাকি জনপুঞ্জ নতুন প্রজাতি ওরাং ওটাং এর থেকে প্রজননগতভাবে আলাদা হয়ে যায় এবং তার ফলে এই দুই প্রজাতির বিবর্তন ঘটতে শুরু করে তাদের নিজস্ব ধারায়। আবার প্রায় ৯০ লক্ষ বছর আগে সেই মুল প্রজাতির জনপুঞ্জ থেকে আরেকটি অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে এবং পরবর্তিতে ভিন্ন ধারায় বিবর্তিত হয়ে গরিলা প্রজাতির উৎপত্তি ঘটায়। একইভাবে দেখা যায় যে, ৬০ লক্ষ বছর আগে এই সাধারণ পুর্বপুরুষের অংশটি থেকে ভাগ হয়ে মানুষ এবং শিম্পাঞ্জির বিবর্তন ঘটে। তারপর এই দুটো প্রজাতি প্রজননগতভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তখন থেকেই একদিকে স্বতন্ত্র গতিতে এবং নিয়মে মানুষের প্রজাতির বিবর্তন ঘটতে শুরু করে, আর ওদিকে আলাদা হয়ে যাওয়া শিম্পাঞ্জীর সেই প্রজাতিটি ভিন্ন গতিতে বিবর্তিত হতে হতে আজকের শিম্পাঞ্জীতে এসে পৌঁছেছে। সুতরাং কোন এক সাধারণ পুর্বপুরুষ থেকে দু’টো প্রজাতির উৎপত্তি ঘটলেই যে তাদের একটিকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে হবে বা এক প্রজাতির সবাইকে অন্য প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়ে যেতে হবে এমন কোন ধরাবাঁধা নিয়ম প্রকৃতিতে নেই।১
তাহলে বোঝা যাচ্ছে, আমরা মানুষেরা রূপান্তরিত বানর নই – সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটা প্রজাতি। প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলে লক্ষকোটি বছর ধরে বিবর্তনের পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়ার ফলে আমরা আজকের অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছি।
এবারে দেখা যাক প্রাকৃতিক নির্বাচন কিভাবে কাজ করে।
দুই। “উঁচা গাছের পাতা খাওয়ার লাইগা জিরাফ যদি হের গলা লম্বা কইরা নিতে পারে, আমরা ক্যান আমাগো ঘাঁড়ে দুইডা পাখা গজায়া নিতে পারি না?”
বিবর্তন সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝির একটা প্রধান কারন হলো অনেকেই ভ্রান্ত ধারনার বশবর্তী হয়ে মনে করেন, বিবর্তন একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের পানে এবং একটা বেঁধে দেওয়া পথে চলে। আর একটা কারণ হলো এই ভুল ধারনা যে, ইচ্ছে করলেই কোন বিশেষ প্রাণীকুল প্রকৃতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারে।
আলফ্রেড ওয়ালেস (১৮২৩-১৯১৩) এবং চার্লস ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২), প্রায়ই একই সময়ে যদিও স্বতন্ত্রভাবে আবিস্কার করেন যে, পরিবেশের সাথে মানানসই বিশেষ প্রকারণ (variation) থাকার কারণে কোন জনপুঞ্জের (population) যে সদস্যরা (individuals) অন্যদের তুলনায় প্রকৃতির সাথে বেশি খাপ খাইয়ে টিকে থাকতে পারে তারাই বেশি বেশি বংশধর রেখে যায়। পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে পূর্ববর্তী প্রজন্মের যে বৈশিষ্ট্যগুলো টিকে থাকতে এবং বংশবিস্তার করতে বেশি কাজে লাগে সেগুলোকেই বেশি বেশি দেখা যেতে থাকে। বংশবিস্তারে এই অতিরিক্ত সক্ষমতাকে differential reproductive success বলা হয়েছে – যাকে বাংলায় ‘ভিন্নতাজনিত প্রজনন সাফল্য’ বলা যেতে পারে। এই সাফল্য ছাড়া বিবর্তন সম্ভব নয়। আর এই প্রক্রিয়ার নামই হলো প্রাকৃতিক নির্বাচন বা natural selection।
আবারো, বন্যা আহমেদের ভাষায়, “যে প্রকারণগুলো তাদের পরিবেশের সাথে অপেক্ষাকৃত বেশি অভিযোজনের (adaptation) ক্ষমতা রাখে, তাদের বাহক জীবরাই বেশীদিন টিকে থাকে এবং বেশী পরিমানে বংশবৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়। এভাবে প্রকৃতি প্রতিটা জীবের মধ্যে পরিবেশগতভাবে অনুকুল বৈশিষ্ট্যের অধিকারীদের নির্বাচন করতে থাকে এবং ডারউইন প্রকৃতির এই বিশেষ নির্বাচন প্রক্রিয়ারই নাম দেন প্রাকৃতিক নির্বাচন (natural selection)” ২
প্রাকৃতিক নির্বাচন কোন জনপুঞ্জের মধ্যে থাকা প্রকারণগুলোর মধ্য থেকে বেছে নেয় সেই বৈশিষ্ট্যগুলোকে যেগুলো পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করে। আর তার ফলেই ঘটে বিবর্তন। দেখা যাচ্ছে প্রকারণ না ঘটলে বেশি খাপ খাইয়ে চলার মতো সুবিধা অর্জন সম্ভব হয় না। এই কারণেই লম্বা গলাওয়ালা জিরাফের সংখ্যা বাড়তে থাকে খাটো গলাওয়ালা জিরাফের সংখ্যার তুলনায়। প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া জিরাফের গলা রাবারের তৈরী খেলনার মতো টেনে লম্বা করে দেয়নি। বরং প্রকারণের কারণে যে জিরাফগুলোর ‘জিন’-এর মধ্যে গলা লম্বা হওয়ার মতো ‘সুবিধাজনক’ বৈশিষ্ট্য ছিল সেগুলোই টিকে থাকতে পেরেছে বেশি এবং খাটো গলার জিরাফের চাইতে বংশবিস্তার করতে পেরেছেও বেশি। কিছু কাল পরে দেখা গেল প্রকৃতির এহেন পক্ষপাতমুলক নির্বাচনের ফলে শুধু লম্বা গলাওয়ালা জিরাফেরাই টিকে থাকলো। সংক্ষেপে এই হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের প্রক্রিয়া।
আরো একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।৩ ধরা যাক, একসময়ে গুবরে পোকারা সব উজ্জ্বল সবুজ রং-এর ছিল। হঠাৎ দেখা গেল, তাদের সন্তানদের মধ্যে খয়েরি রং-এর কিছু পোকার আবির্ভাব শুরু হয়েছে। এই প্রকারণটা (জেনেটিক ভেরিয়েশন) ঘটে থাকতে পারে মিউটেশনের ফলে। (একটি জিন-এর ডিএনএ অনুক্রমে স্থায়ী পরিবর্তনকে বলা হয় মিউটেশন। মিউটেশন হচ্ছে প্রকারণ ঘটার একটা প্রধান উপায় যদিও একমাত্র উপায় নয়।) ক্রমান্বয়ে দেখা গেল খয়েরি রং-এর পোকার সংখ্যা ওই জনপুঞ্জে বাড়ছে আর উজ্জ্বল সবুজ রং-এর পোকার সংখ্যা কমছে। কারণ, পাখীরা উজ্জ্বল সবুজ পোকাগুলো সহজেই চোখে পড়ছে বলে ওগুলোকেই বেশি বেশি খেয়ে নিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সবুজ পোকা আর থাকলোই না, পুরো জনপুঞ্জটাই পরিণত হলো খয়েরি গুবরে পোকার প্রজাতিতে।
মিউটশন ছাড়া অন্য উপায়েও জনপুঞ্জে পরিবর্তন ঘটতে পারে। যেমন, সবুজ পোকাদের মাঝে কিছু খয়েরি পোকা কোন না কোন ভাবে কোন না কোন কারণে অন্য কোন জায়গা থেকে এসে পড়তে পারে। যে কারণেই এসে থাকুক না কেন, খয়েরি পোকাগুলোকে পাখীরা আগের মতোই সবুজ পোকাদের তুলনায় কম খেতে থাকবে। এই ভাবে প্রকারণ ঘটার কারণকে বলা হয়েছে ‘মাইগ্রেশন’ (migration)।
জনপুঞ্জে পরিবর্তন ঘটার আর একটা কারণকে নাম দেয়া হয়েছে ‘জেনেটিক ড্রিফট’ (genetic drift)। ধরা যাক, দৈবক্রমে দূর্ঘটনা বশতঃ, কারো পায়ের নীচে চাপা পড়ে বা আগুন লেগে, একটা ছোট জনপুঞ্জের সব সবুজ পোকাগুলো মরে গেল। কিন্তু সন্তানসন্ততিসহ খয়েরি পোকগুলো বেঁচে গেল, এবং আরো বেশি বংশবিস্তার করতে থাকলো।
উপরের উদাহরণে খেয়াল করা দরকার, ‘জেনেটিক ভেরিয়েশন’ ছাড়া প্রাকৃতিক নির্বাচন বা জেনেটিক ড্রিফট কাজ করতে পারতো না। কিছু সদস্য ভিন্ন রকমের (খয়েরি রং-এর) ছিল বলেই এই দুটি প্রক্রিয়া কাজ করতে পেরেছে। অন্যভাবে বলা যায় প্রথম থেকেই সব পোকাগুলো সবুজ রং-এর হলে এই প্রক্রিয়াগুলো কাজ করতে পারতো না।
মানে দাঁড়ালো এই যে, বিবর্তনের প্রক্রিয়া কার্যকর হতে হলে প্রাকৃতিক নির্বাচন বা জেনেটিক ড্রিফটের মতো কিছু ঘটতে হবে এবং তা ঘটার আগে ডিএনএ-র মধ্যে জেনেটিক ভেরিয়েশনও ঘটতে হবে। তাই কোন প্রজাতি বা কেউ চেষ্টা করলেই বিবর্তিত হ’তে পারে না। এবং তাই প্রাকৃতিক নির্বাচন কোন প্রজাতির বা প্রাণীর যা ‘দরকার’ তাই সরবরাহ করতে পারে না। পারলে এরোপ্লেন না বানিয়ে আমাদের মানবপ্রজাতি নিজেদের ঘাঁড়ে দুটো কেন হয়তো চারটে পাখাই গজিয়ে নেয়ার ব্যাবস্থা করে নিত।
তিন। “বিবর্তন-প্রক্রিয়ার ফলে প্রাণীকুল প্রতিনিয়তই উন্নত হচ্ছে”।
প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলে চমৎকার সব প্রাণীর উদ্ভব ঘটে তাই অনেকেই মনে করেন, এটি একটি প্রচন্ড ক্ষমতাশালী শক্তি যা কিনা প্রতিনিয়তই প্রাণীকুলকে নিখুঁত, ত্রুটিহীন এবং উন্নততর হওয়ার জন্য ঠেলছে। এই ধারণা সঠিক নয়। প্রথমত, প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রচন্ড ক্ষমতাশালী কোন শক্তি নয়, আসলে প্রাকৃতিক নির্বাচন কোন শক্তিই নয়। প্রাকৃতিক নির্বাচনের লক্ষ্যও ত্রুটিহীনতা নয়, আসলে এর কোন লক্ষ্যই নেই। দ্বিতীয়ত, প্রাকৃতিক নির্বাচন একটি প্রক্রিয়া, কোন চালিকাশক্তি নয়। প্রাকৃতিক নির্বাচন অগ্রগতি অর্জন বা প্রকৃতিতে ভারসাম্য রক্ষার কোন প্রচেষ্টা নয়।
যদিও এটা ঠিক যে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফলে কোন জনপুঞ্জের অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য সদস্যরা একটা বিশেষ পরিবেশগত পরিস্থিতির সাথে নিজেদের খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়ে পরিণতিতে অবলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, কোন প্রজাতিকে ক্রমাগত উন্নত থেকে উন্নত স্তরে যেতে হবে। পরিবেশ যদি বৈরী না হয়, বিবর্তনের প্রয়োজন নাও হতে পারে। তাই অনেক প্রজাতি কোটি কোটি বছর ধরে একই রকম রয়ে গেছে। যেমন, কিছু শৈবাল এবং ছত্রাক, এমন কি কিছু হাঙ্গরজাতীয় প্রাণীর মধ্যে কোটি কোটি বছর পার হয়ে গেলেও তেমন কোন পরিবর্তন আসে নি। তাদের অগ্রগতির মই বেয়ে ওপরে ওঠার কোন ‘প্রয়োজন’ হয় নি। কারণ ‘উন্নত’ না হয়েই তারা দিব্যি বেঁচে থাকতে এবং বংশবিস্তার করতে পারছে। বিবর্তনের প্রক্রিয়াকে তাই মই বেয়ে ওপরে ওঠার সাথে নয়, বরং গাছের এক একটা শাখায় বিকশিত হওয়ার সাথেই তুলনা করা অনেক বেশি যুক্তিসঙ্গত।
বিবর্তিত হওয়া মানেই উন্নততর হওয়া নয়। অনেক ‘উন্নীত’ জনপুঞ্জ নতুন পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে অবলুপ্ত হয়ে গেছে। একসময়ের পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ানো ডাইনোসরদের তাই আজ আর মিউজিয়াম ছাড়া কোথাও দেখা যায় না। তাও আবার শুধু তাদের হাঁড়গোড় বা মূর্তি দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় আমাদের। কিন্তু ডাইনোসরেরা যে অবলুপ্ত হয়ে গেছে এই জন্য আমাদের মোটেও অসন্তুষ্ট হওয়া উচিৎ নয় – ডাইনোসরেরা আজো টিকে থাকলে আমাদের মানব প্রজাতির হয়তো উদ্ভবই হতো না!
টিকে থাকার যোগ্যতা পরিবেশের সাথে সম্পর্কিত, সুচিন্তিত কিংবা সুসমন্বিত অগ্রগতির কোন নিদর্শন এতে নেই।
চার। “বিবর্তন কি তাহলে দৈবক্রমে ঘটে?”
উলটে আবার অনেকেই প্রাকৃতিক নির্বাচনকে দৈব-প্রক্রিয়া (random process) মনে করেন। এটিও ভুল। মিউটেশনের মাধ্যমে কোন জনপুঞ্জের মধ্যে যে জেনেটিক প্রকারণ ঘটে তা দৈব-প্রক্রিয়ার ফল হতে পারে, কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচন এই ভেরিয়েশনের উপরে কাজ করে খুবই অদৈব ভাবে। লম্বা গলাওয়ালা জিরাফেরা উঁচু গাছের পাতা খাওয়ার যে সুবিধাটুকু পেয়ে বেশি বেশি বংশবিস্তার করতে পারলো তা কোনক্রমেই দৈব ঘটনা নয়।
জলের মাঝে দ্রুত চলাচলে সক্ষম কিছু জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার এবং বংশবিস্তার করার সম্ভাবনা অপেক্ষাকৃত কম দ্রুত চলাচলে সক্ষম প্রাণীদের চেয়ে বেশি। দ্রুতগতি তাদেরকে শিকার ধরতে এবং বিপদ থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। এই কারণেই টূনামাছ এবং ডলফিনজাতীয় কিছু সামুদ্রিক প্রাণী লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ফলে বিশেষ ধরনের সুবিধাজনক শারিরীক আকৃতি (streamlined body shapes) পেয়েছে যা তাদেরকে দিয়েছে দ্রুতগতিতে সাঁতরানোর সক্ষমতা। যে প্রজাতিগুলো বেশি ভালোভাবে বেঁচে থাকবে আর বেশি সফলতার সাথে বংশবিস্তার করতে পারবে তারা আরো বেশি সুবিধাজনক শারিরীক আকৃতিসম্পন্ন উত্তরসুরী রেখে যেতে পারবে। এই প্রক্রিয়াকে কোন ভাবেই দৈব বলা যায় না।
টিকে থাকার জন্য এবং সফল প্রজননের জন্য যে জেনেটিক ভ্যারিয়েন্টগুলি কাজে লাগে সেগুলিকেই প্রাকৃতিক নির্বাচন বেছে নেয়। তাই প্রাকৃতিক নির্বাচন দৈব-প্রক্রিয়া নয়।
পাঁচ। “তয় বিজ্ঞানীরা যে এইডারে থিওরী কয়? থিওরী অর্থ তো ধারণা, হইতেও পারে আবার নাও হইতে পারে।”
সাধারণ মানুষের মনে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য বিবর্তনতত্ত্ব বিরোধী অনেককে বলতে শোনা যায়, থিওরী শব্দটার মধ্যে অনুমানের বা কল্পনার একটা ব্যাপার আছে। তাই কোন থিওরীই স্বতসিদ্ধ নয়। কিন্তু আমাদের বোঝা দরকার, ইংরেজীতে থিওরী কথাটা দুইভাবে ব্যাবহৃত হয়। এটা ঠিক সাধারণ কথায় এর মানে হলো ধারণা বা অনুমান। যেমন ‘কন্সপিরেসী থিওরী’। কিন্তু বিজ্ঞানের ভাষায় থিওরী শব্দটার অর্থ হলো, প্রাকৃতিক বিশ্বের কোন বৈশিষ্ট্যের (aspects) গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা, যা উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং পর্যবেক্ষনের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। এই পার্থক্যটা না বুঝলে বিভ্রান্তিতে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। বিজ্ঞানীরা কোন ধারণাকে থিওরী বা তত্ত্ব হিসেবে গ্রহন করার আগে নানা ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। যেমন নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব বা আইনস্টাইনের ‘থিওরী অব রিলেটিভিটি’। বিজ্ঞানীদের কাছে থিওরী হচ্ছে একটা ফ্রেমওয়ার্ক বা কার্যকাঠামো, যার মধ্যে তারা নিজেদের কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ করে নেন নতুন নতুন অনুকল্প (hypothesis) পরীক্ষার জন্য বা নতুন কিছু আবিষ্কারের জন্য।
আর একটা কথা না বললেই নয়, বিবর্তন-বিজ্ঞানের বিষয়বস্তু প্রজাতির উদ্ভব, জীবনের উদ্ভব নয়। ডারউইন তাঁর প্রাকৃতিক নির্বাচনের তত্ত্ব (natural selection)বোঝাতে origin of species বা ‘প্রজাতির উদ্ভব’ নামে বিখ্যাত বইটা লিখেছিলেন। বলা দরকার, তিনি জীবনের উদ্ভব বা origin of life নিয়ে লেখেন নি। তাই জীবন কিভাবে পৃথিবীতে শুরু হলো এ প্রশ্নের উত্তর বিবর্তনতত্বে পাওয়া যাবে না। জীবনের উদ্ভব নিয়েও অনেক বৈজ্ঞানিক তত্ব-ব্যাখ্যা আছে এবং এ নিয়ে অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নও বিজ্ঞানী মহলে রয়ে গেছে কিন্তু বিজ্ঞানীরা বিবর্তন তত্ত্বকে একটা পরীক্ষিত এবং প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। দেড়শো বছর ধরে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে নি। অনেক নতুন তথ্য এর মধ্যে জানা গেছে, অনেক অজানা সত্য আবিষ্কৃত হয়েছে এবং ডারউইনের তত্ত্বের সাথে সংযোজিত হয়েছে। কিন্তু প্রতিটি নতুন তথ্যই ডারউইনের মূল আবিষ্কারকে আরো বেশি করে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ডারউইন তাঁর তত্ত্বের যে দিকগুলোকে উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে সঠিকভাবে ব্যখ্যা করতে পারেন নি, পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীরা তা করতে পেরেছেন। উদাহরণ হিসেবে জেনেটিক্স-এর উল্লেখ করা যেতে পারে।
ছয়। “তাইলে মাঝখানের ঘোড়াডারে পাওয়া গেল না ক্যান?”
মধ্যবর্তী প্রজাতি মানে অসম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বিকশিত প্রজাতি নয়। প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়াটাকে সঠিকভাবে বুঝতে পারলে কেউই ‘আংশিকভাবে বিবর্তিত’ কোন প্রজাতি খুঁজে বেড়াবেন না। আসলে আংশিকভাবে বিবর্তিত কথাটার কোন মানেই হয় না। তবে মধ্যবর্তী প্রজাতি আছে, এবং তারা পূর্ণভাবেই বিকশিত। যেমন, বর্তমান পৃথিবীর পাখী আর তাদের ডাইনোসর পূর্বসুরীদের এবং তিমিমাছ ও তাদের স্থলচর স্তন্যপায়ী পূর্বসুরীদের মাঝামাঝি প্রজাতির সন্ধান বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন।
সব মধ্যবর্তী জীবাশ্ম পাওয়া যায় নি বলেই যারা বিবর্তনতত্ত্বকে বাতিল করে দিতে চান তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। প্রথমতঃ প্রকৃতিতে প্রত্যেকটা মধ্যবর্তী জীবাশ্ম সংরক্ষিত থাকবে এই গ্যারান্টি কোথায় পাওয়া যাবে? দ্বিতীয়তঃ বিবর্তনতত্ত্বের সঠিকতা প্রমাণ করতে প্রত্যেকটা মধ্যবর্তী জীবাশ্মের সন্ধান পেতেই হবে এটা আর যাই হোক বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি কি?
তারপরেও বলা যায়, বিবর্তনতত্ত্বকে দৃঢ় বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ভুরি ভুরি মধ্যবর্তী জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। এবং মজার ব্যাপার হলো এমন কোন জীবাশ্ম পাওযা যায় নি যা বিবর্তনতত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করতে পারে। যেমন, বিবর্তনতত্ত্ব ভুল হলে তো ডাইনোসরদের সময়ে মানুষের জীবাশ্ম পাওয়ার কথা। কিন্তু এমন কোন আজগুবি জীবাশ্মের সন্ধান আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি, পাওয়ার কথাও নয়।
আমাদের বুঝতে হবে, বিজ্ঞানের অন্য সব শাখার মতো বিবর্তন বিজ্ঞানও চলমান এবং প্রগতিশীল। নতুন নতুন আবিষ্কারে আর সত্য উদঘাটনে বিজ্ঞানীরা সদাব্যস্ত। প্রয়োজনে পুরোনো ধারণার নতুন ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে হচ্ছে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে, আগের ব্যাখ্যাকে সংশোধন করে, এমন কি বাতিল করে হলেও। এটাই তো বিজ্ঞানের প্রক্রিয়া। গবেষনার ফলে প্রতিনিয়তই আমাদের জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে।
যেমন, ডারউইন জানতেন না যে, প্রাকৃতিক নির্বাচন জেনেটিক মিউটেশন-জনিত প্রকারণের উপর কাজ করে। এ ক্ষেত্রে জেনেটিক্স-এর আবিষ্কারের ফলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণা আরো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো। বিবর্তন প্রক্রিয়ার সবকিছুই আমরা জানিনা (বিজ্ঞানের যে কোন বিষয় সম্পর্কেই এই কথাটা বলা যেতে পারে), সত্যিকারের বিজ্ঞানীরাই সর্বাগ্রে এই কথাটা স্বীকার করবেন। কিন্তু বিবর্তনতত্ত্বের আবিষ্কারের ফলে জীবনের ইতিহাস সম্পর্কে, প্রজাতির উদ্ভবের ধারা সম্পর্কে, এবং যে প্রক্রিয়ায় এই পরিবর্তন ঘটেছে তার সম্পর্কে আজ আমরা অনেক কিছুই জানতে পারছি। সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে জীবনের বৈচিত্রের বিজ্ঞানসম্মত গ্রহনযোগ্য ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত শুধু বিবর্তনতত্ত্বই দিতে পেরেছে।
শুধু তাই নয়, বিবর্তনতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে আধুনিক জীববিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান এবং চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন নতুন শাখা বিকশিত হচ্ছে।
সাত। “বিবর্তন সত্য হইলে আরো নতুন নতুন জীবজন্তু দেখা যাইত, কিন্তু নুহ নবীর পর থাইকা আর কোন নতুন প্রজাতি এই দুনিয়াতে আসে নাই, ঠিক না?”
না, ঠিক না। এই সেদিনের খবর। ফেব্রুয়ারীর ২, ২০০৯ তারিখে ইন্টারনেটে পড়লাম।৪ চমকপ্রদ দেখতে নতুন কয়েকটা প্রজাতির ব্যাঙের খোঁজ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। কলাম্বিয়ায়র এই অঞ্চলকে নোয়া’র (নুহ নবী) জাহাজের সাথে তুলনা করেছেন বিজ্ঞানী হোজে ভিন্সেন্ট রদ্রিগেজ-মাহেচা। বিজ্ঞানীদের কাছে ব্যাঙের এই প্রজাতিগুলো সম্পূর্ণ নতুন। শুধু দশটি নতুন প্রজাতির ব্যাঙই নয়, সর্বসাকুল্যে তারা প্রায় ষাটটি নতুন ধরনের উভচর, বিশটি সরীসৃপ এবং একশত বিশটি পাখী প্রজাতির সন্ধান পেয়েছেন। ডারউইনের দ্বিশততম জন্মবার্ষিকীর উপহার যেন!
অপার সম্ভাবনার দ্বার
নতুন নতুন প্রজাতির সন্ধান যেমন পাওয়া যাচ্ছে, তেমনি অনেক প্রজাতির বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার সংবাদও আমারা অহরহ পাচ্ছি। প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং বিবর্তনের প্রক্রিয়া কাজ করে যাচ্ছে আবহমান কাল ধরে। দেড়শত বছর আগে চার্লস ডারউইন এই বাস্তবতা পৃথিবীর সামনে উদঘাটন করেন তাঁর origin of species প্রকাশ করে। পৃথিবীতে মানবজাতির অবস্থান ও উদ্ভব নিয়ে আমরা কত গল্পই না ফেঁদেছি, কল্পনার জগতে কত ফানুসই না উড়িয়েছি; ধর্মবিশ্বাসের আড়ালে নিজেদের সৃষ্টির সেরা জীব বানিয়েছি নিজেরাই। কিন্তু বিবর্তনতত্ত্ব উম্মোচন করে দিল আসল সত্য। আমরাও বিবর্তিত হয়ে এই পর্যায়ে এসেছি।
কোন পর্যায়ে? এর পরে আমরা কোথায় যাবো? ভবিষ্যতই বলতে পারে।
তবে বিবর্তনের প্রক্রিয়াটা বোঝার ফলে আমরা মানুষেরা ভবিষ্যতের অনেক কিছুই নিজেদের ইচ্ছেমতো ঘটাতে পারছি। অনেক প্রজাতিকে বিলুপ্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পারছি, নতুন প্রজাতির উদ্ভবে কার্যকর ভুমিকা রাখতে পারছি, এবং আরো পারছি চিকিৎসা বিজ্ঞানে এবং কৃষিবিজ্ঞানে বিবর্তনতত্ত্বের প্রয়োগ করে নিজেদের রক্ষার জন্য নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করতে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া আমাদের হাতে এসে আর প্রাকৃতিক রইলোনা, আমরা এখন এই প্রক্রিয়ার অন্তর্নিহিত সূত্রটাকে কাজে লাগাতে পারি নিজেদের পরিকল্পনা মতো, কৃত্রিম উপায়ে। এই তত্ত্ব আমাদের সামনে খুলে দিয়েছে এক অপার সম্ভাবনার দ্বার।
ফেব্রুয়ারী ১২, ২০০৯
মায়ামি, ফ্লোরিডা
শিরোনামে ব্যাবহৃত ছবিটা এই ওয়েবসাইট থেকে নেয়া হয়েছে –
http://listverse.com/science/top-15-misconceptions-about-evolution/
ত্তথ্যসূত্র
১ বন্যা আহমেদ, বিবর্তনের পথ ধরে, অবসর, ঢাকা ২০০৭, পৃষ্টা ২৩৪।
২ বন্যা আহমেদ, ঐ, পৃষ্টা ৩৫।
৩ উদাহরণটা নেয়া হয়েছে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার (বার্কলে) মিউজিয়াম অব প্যালেওন্টোলজি-র এই ওয়েবসাইট থেকে। http://understandingevolution.com/
৪ Alan Boyle, “Exotic frogs found in Colombian Eden,” February 2, 2009.
http://www.msnbc.msn.com/id/28980688/wid/18298287/?gt1=43001
ফেব্রুয়ারী ১২, ২০০৯
মায়ামি, ফ্লোরিডা
ধন্যবাদ়আমার ছোটবেলার ধারণাগুলোকে মজবুত করার জন্য ।
আর দশটা সাধারন মানুষের মত আমারও বিবর্তন সম্মন্ধে ধারণা খুবই কম। আর তাই আপনার এই তথ্যবহুল লেখাটি থেকে অনেক কিছুই নতুন জানতে পারলাম বটে কিন্তু কিছু প্রশ্ন মনে রয়েই গেল। যেমন, ছোট গলার জিরাফ তার পরবর্তী প্রজন্মে বড় গলার জিন সঞ্চারণের মাধ্যমে বড় গলাবিশিষ্ট জিরাফ জন্ম দিয়েছে যারা পরিবেশগত সুবিধা নিয়ে প্রকৃতিতে টিকে গিয়েছে। অন্যদিকে ছোট গলার জিরাফের উপর কি এমন ‘গজব’ নাজিল হয়েছিল যে তারা প্রকৃতি থেকে আজ বিলুপ্ত? ছোট গলাবিশিষ্ট জিরাফের উপর যদি ‘বড় গাছের পাতা খেতে অপারগ হওা’ বিষয়ক গজবই নাজিল হয়ে থাকে তাহলে অন্যান্য তৃণভোজী প্রাণীর ক্ষেত্রে কেন তা হল না?
আবার, ২ ফুট (ধরে নেয়া হয়েছে। প্রকৃত দৈর্ঘ্যটা আমার জানা নেই) দৈর্ঘ্যের গলাবিশিষ্ট জিরাফ হতে হঠাত করে ৮ ফুট দৈর্ঘ্যের গলাবিশিষ্ট জিরাফের উদ্ভব হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। অবশ্য আমার মনে হওা বা না হওায় কিছু যায় আসে না। এ ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক মহল কি বলে তাই আমি জানতে চাই। আবার, ছোট গলা থেকে ধীরে ধীরেই যদি বড় গলার জিরাফের উদ্ভব হয় তাহলে তাদের পর্যায়ক্রমিক বিবর্তিত ফসিল পাওয়া যাওয়ার কথা। কিন্তু আদৌ কি তা পাওয়া গেছে? এছাড়া ছোট গলার জিরাফের পরবর্তী প্রজন্মের মাঝেই যদি বড় গলার জিরাফের উদ্ভব হয়, তাহলে তারা নিশ্চয়ই একই সাথে কিছুকাল হলেও সহাবস্থান করেছে। কেননা আপনিই বলেছেন বড় গলা হওার সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্যযুক্ত জিন নিয়েই ছোট গলার জিরাফ হতে একই সঙ্গে ছোট ও বড় গলার জিরাফ জন্মেছে এবং ছোট গলার জিরাফেরা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এরূপ একই সময়ের মাঝে সহাবস্থানকারী বড় ও ছোট গলার জিরাফের ফসিল কি পাওয়া গেছে?
এবার আমার প্রশ্ন প্রজাতির উদ্ভব সম্মন্ধে। আমি যতটুকু জানি (আসলে আপনাদের লেখা থেকেই আমি বিবর্তন সম্মন্ধে যা একটু জানি। এর বাইরে আমার জ্ঞান নেই বললেই চলে।) নতুন কোন প্রজাতির উদ্ভব হলে পূর্বপ্রজাতি হতে নতুনদের ক্রোমোজোম সংখ্যা বদলে যায়। এই পরিবর্তিত সংখ্যক ক্রোমোজোম নিয়ে উদ্ভূত প্রাণীটি এরপর কীভাবে যৌন পদ্ধতিতে বংশবৃদ্ধি করে তার বংশগতির ধারা বজায় রাখবে, যদি ঠিক ঐ একই সময়ে নতুন প্রজাতিটির বিপরীত লিঙ্গের অন্য একটি প্রাণী না জন্মায়? প্রাণিজগতে এমন কোন প্রাণী (মানুষের উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করলে বোধহয় ভাল হয়) আছে কি যার মধ্যে কোন বৈশিষ্ট্য আছে যার দ্বারা বলা যায় যে এর বিবর্তন হচ্ছে বা বৈশিষ্ট্যটি নতুন কোন প্রজাতি উদ্ভবের ইঙ্গিত বহন করছে।
সবশেষে বলতে চাই, আপনাদের লেখা থেকে বিবর্তন সম্মন্ধে যা জানা যায় তা গ্রহণযোগ্য এবং আমি বিবর্তন বিশ্বাস করি। বিবর্তন হচ্ছে কিনা এ নিয়ে আমার কোন সংশয় নেই। যত গোল বেধেছে সব বিবর্তনের প্রক্রিয়া নিয়ে। এ ব্যাপারে আমি আপনাদের সাহায্য প্রার্থনা করছি।
ধন্যবাদ
ইরতিশাদ ভাইয়ের গণ মনস্তত্ত্ব বা পাবলিক সাইকোলজি সম্পর্কে চমৎকার ধারণা রয়েছে। পাবলিকের মধ্যে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানী সম্পর্কে কৌতূহল জাগ্রত করতে এ ধরনের লেখার জুড়ি নেই।
ইরতিশাদ ভাইকে অনেক ধন্যবাদ আমাদের হাতকে শক্তিশালী করার জন্যে।
আমার মত অলস মানুষও হঠাত করেই সময়ের তীব্র অভাবে ভুগতে শুরু করেছে। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা আমার জন্যে। এ কারণে ডারউইন দিবসের প্রবন্ধগুলোর সামান্য কয়েকটাতে চোখ বুলোতে পেরেছি মাত্র।
ইরতিশাদ ভাইয়ের এই লেখাটির গুণগত মান নিয়ে আমি কিছু বলছি না। উনি অসাধারণ লেখেন সেটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমাকে যে জিনিষটা বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে তা হচ্ছে উনার সহজ সরল ভাষা ব্যবহারের দারুণ দক্ষতা। সহজ ভাষায় লেখার কারণে আমার মত বিজ্ঞান না জানা মানুষেরও বিষয়টি বুঝতে তেমন কোন সমস্যা হয়নি।
ইরতিশাদ ভাই, ফাটাফাটি একটা লেখা, তবে কোন ভাবেই সম্পূর্ন না, পড়লে মনে হয় মোটে লেখাটা শুরু করলেন আর পাঠকদের মহা ফাকি দিয়া হঠাত কইরা শেষ কইরা দিলেন। অর্থাৎ আপনাকে এখন এই লেখাটা শেষ করতে হবে এবং এই বিষয়টা নিয়ে যত কিছু লেখা যায় তা দিয়ে দিব্যি একটা আস্ত বই হয়ে যাবে। এবার বিভিন্ন বাংলা ব্লগে লেখা দেইখা বুঝলাম, বাংলাদেশে আসলে মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা নাই, আর যাওবা আসে সেগুলা উলটা পালটা ভুল ধারণা। এইটা নিয়া একটা বই বাইর করন ফরযকাম হয়ে দাড়াইসে।
আপনি ঘোড়ার মধ্যবর্তী ফসিল পাওয়ার ব্যাপারে যা বলেছেন তা একদমই ঠিক আছে, তবে এখানে মন হয় জেনেটিক্সের ব্যাপারটা আনলে আরও সম্পূর্ন হত উত্তরটা। এখন তো আসলে ফসিল ছাড়াই শুধু জিনোম এবং জেনেটিক কোড দিয়েই বিবর্তনের ধারাবাহিকতা ভের করে ফেলা যায়। তয় লেখাটা এক কথায় দারুন হইসে, হুদাই মাতুব্বরী করার জন্য মাফ কইরা দিয়েনঃ)
@বন্যা,
ফাঁকি আর দিতে পারলাম কই? তোমার হাতে তো ধরা পইরা গেলাম।
মন্তব্যের জন্য অশেষ ধন্যবাদ। আমার লেখাটা ভয়াবহ রকমের অসম্পূর্ণ। এই ধরণের লেখার জন্য যে রকমের সময় দেয়া প্রয়োজন তা আমার হাতে ছিল না। তবুও এটাকে ভাল লেখা বলে তুমি আর অভিজিৎ আমাকে লজ্জায় ফালাইলা। মুক্তমনার বিরাট আয়োজনের সাথে নিজেকে যুক্ত করতে পেরেই আমি যারপরনাই আনন্দিত। ফরিদের সাথে কথায় কথায় বলছিলাম, আমার লেখাটাকে বড়জোর অভিজিতের লেখার (কিশোরের প্রত্যুত্তরে লেখা) ভুমিকা হিসাবে চালায়া দেয়া যেতে পারে।
মিসিং লিঙ্কের আলোচনায় জেনেটিক্সের বিষয়টাকে নিয়ে আসা, অন্তত উল্লেখ করা উচিত ছিল। তবে অভিজিতের লেখায় তা খুবই ভালোভাবে আলোচিত হয়েছে। তাই পাঠকেরা অন্তত বঞ্চিত হবেন না।
তোমার সাথে পুরোপুরি একমত যে আমাদের দেশের তরুণ পাঠকদের জন্য বিবর্তনের ওপর অনেক কাজ করার আছে। তোমাদেরকে অভিবাদন এই কাজটা শুরু করার জন্য।
বিবর্তন নিয়ে অনেক উল্টাপাল্টা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। এগুলি নিয়ে বিস্তারিত লেখা দরকার, বিশেষ করে বাংলায়। তবে আমাকে দিয়ে বই লেখা হবে কিনা এ নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
@ইরতিশাদ আহমদ,
বস, কনকি! বই লেখা হইবনা মানে আলবৎ হবে। এমন একটা কঠিন বিষয়রে যে সহজ কইরা লিখছেন। চালায়া যান বস। তা আপনের শরীলডা অহন কেমন? ভালাতো? ?:-)
@suman,
থ্যাঙ্কু সুমন। প্রশংসার জন্য, উৎসাহের জন্য, আর আমার ‘শরীলডা’র খোঁজ নেয়ার জন্য। বই না লিখলেও লেখাটাকে আরেকটু বিস্তারিত করার ইচ্ছে আছে। মুস্কিল হলো আমার আবার এডিডি (এটেনশন ডেফিসিয়েন্সি ডিসঅর্ডার) রোগ ধরা পড়ছে। আমি বোধহয় এইটা আমার টিনএজ মেয়ের কাছ থেকে পেয়েছি। উলটা জেনেটিক্স আর কি! দেখি বন্যার কাছে এর কোন ব্যাখ্যা আছে কিনা। তা নইলে আমার শরীলডা এখন ভালোই- ডারউইনের দোয়ায়।
ভাল লাগল লেখাটি……বিবর্তনবাদ নিয়ে যে ভ্রান্ত ধারণা তা ধীরে ধীরে ঘুচে যাবে এই আশা করছি…..
Excellent article !!!
সত্যই ভাল হয়েছে লেখাটা। যে প্রশ্নগুলোর উত্তর ডঃ ইরতিশাদ দিয়েছেন, তা অধিকাংশ বিবর্তনবিরধীরই মনের কথা। আমি ধন্যবাদ দিচ্ছি এত সহজে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করার জন্য। আমি কিশোর নামে এক ভদ্রলোকের লেখা পেয়ছি – ডারউইনবাদ একটা তথাকথিত ভ্রান্ত মতবাদ শিরোনামে। আমি লেখাটা ডারউইন ডে পেইজের জন্য রাখব বলে মনস্থ করেছি। লেখাটা পড়লেই যে কেউ দেখবেন কিশোর যে অভিযোগে বিবর্তনকে অভিযুক্ত করেছেন, তার প্রায় সবগুলো প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছেন ইরতিশাদ ভাই।
আমি আরো কিছু বাড়তি ছোট খাট জিনিস ব্যাখ্যা করে উত্তর দিয়েছি এখানে – এক বিবর্তনবিরোধীর প্রত্যুত্তরে।
lekhati valo lagese.
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে এত সুন্দর ভাবে, সহজ ভাষায় বিষয়টা তুলে ধরার জন্য।