স্কুল জীবনে ছাত্র হিসেবে ডারউইন ছিলেন একেবারেই ‘ফালতু’ ধরনের। তাঁর কোন এক শিক্ষকের মন্তব্য যদি ধরা যায়, তাহলে তিনি ছিলেন ‘ছাত্র নামের কলংক।‘ স্কুলের রিপোর্ট কাডে ডারউইন সম্পর্কে মন্তব্য করা হয়েছে, “পড়াশুনার ধারেকাছে ও সে নাই। তার সব উৎসাহ কেবল ঘোড়ায় চড়তে, শিকার করতে এবং পোকামাকড় সংগ্রহে“*

বিগল জাহাজের ক্যাপ্টেন ফিজরয় ছিলেন পিজিয়োগনমি (physiognomy) বিদ্যায় বিশ্বাসী। এঁরা বিশ্বাস করেন যে, কারো চেহারা দেখে তাঁর চরিত্র বলে দেয়া সম্ভব। তো সে অনুযায়ী রগচটা ফিজরয় ডারউইনের মুখাবয়ব বিশেষভাবে তাঁর মোটা এবং চ্যাপ্টা নাক দেখে বিগড়ে যান। ফিজরয় রায় দিলেন, এ রকম বেঢপ নাক বিশিষ্ট ছেলে বহু বছরব্যাপী ওরকম একটা ঝঞ্জাটপূর্ণ সমুদ্রযাত্রার দখল পোহাতে পারবে না! 

ডারউইন ১৮৩০ সালের দিকে তাঁর বিখ্যাত “দ্য অরিজিন অব স্পিসিজ” লেখায় হাত দিলে ও ১৮৫৯ পর্যন্ত তা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন। সে সময় তিনি যখন জানতে পারেন যে, আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস নামের অপেক্ষাকৃত তরুণতম একজন বিজ্ঞানী এ বিষয়ে তাঁর অনুরূপ একটি তত্ত্বের সন্ধান পেয়েছেন, ডারউইন তখন নিজের বইটি প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন। পৃথিবীব্যাপী মানুষকে নিজের ওরকম অসাধারণ এবং চমৎকার একটি তত্ত্বের কথা এ রকম অস্বাভাবিক দেরীতে জানানোর একটি মুখ্য কারণ ছিল এই যে, ডারউইনের ভীত ছেলেন যে বিবর্তন বিষয়ে তাঁর চিন্তাভাবনাকে লোকজন মানুষ খুন করে স্বীকারোক্তি করার মত সমান একটি ব্যাপার ভাববে। কোন এক বন্ধুর কাছে পত্রে ডারউইন সে কথাই লিখেছিলেন।   

ডারউইন তাঁর বিখ্যাত ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিবর্তন’ তত্ত্বের উদ্ভাবন কালে দু’জন মনীষীর মতবাদ দ্বারা বিরাটভাবে প্রভাবিত হন। এঁদের একজন হলেন  অর্থনৈতিক তত্ত্ব বিশারদ থমাস ম্যালথাস; আরেকজন ভূতত্ত্ববিদ চার্লস লাইয়েল। শিকারী প্রাণি, রোগ-বালাই এবং সীমিত খাদ্য সরবরাহ-এ বিষয়গুলি জনসংখ্যার অসীম হারে বৃদ্ধি সীমিত করে দিয়েছে। থমাস ম্যালথাসের এ তত্ত্ব ডারউইনকে চিন্তার যথেষ্ট খোরাক যুগিয়েছে। আর চার্লস লাইয়েলের ‘ভূতত্ত্বের নীতিমালা’ বা ‘প্রিন্সিপলস অব জিওলজী’-র প্রভাব এবং অবদানের কথা স্মরণ করতে গিয়ে ডারউইন বলেছেনঃ “আমি কখন ও এটা বিস্মৃত হই না যে, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বলতে গেলে যা কিছু আমি করেছি, তা সম্ভব হয়েছে তাঁর মহান কর্মাবলি অধ্যয়নের ফলে।“ 

লেখক জন ডার্নটন “দ্য ডারউইন কন্সপিরেসি” উপন্যাসে কৌতুকচ্ছলে ইতিহাসের বিন্যাসকে পালটে দেন ডারউইনকে একজন কূটচালের ব্যাক্তি হিসেবে উপস্থাপন করে যে কি-না তার প্রতিদ্বন্ধীকে আগ্নেয়গিরিতে ফেলে দেয় এবং তার তত্ত্বসমূহ চুরি করে নিজে বিখ্যাত হয়।  

এইচএমএস বিগেল জাহাজে অবৈতনিক প্রকৃতিবিদ হিসেবে ডারউইনের দু’বছর ব্যাপী সমুদ্র যাত্রার ঘোর বিরোধী ছিলেন তাঁর পিতা প্রথমেদিকে। তাঁর ভাষায়, ওটা ছিল সময়ের অপচয়। ডারউইনের পিতাকে শেষে রাজী করান ডারউইনের মামা (পরবর্তীতে শ্বশুর)। দু’বছরের যাত্রা শেষপর্যন্ত পাঁচ বছরে গিয়ে ঠেকে।

প্রথমে ঠিক হয়েছিল যে, বিগেলে ক্যাপ্টেন ফিজরয়ের সংগে প্রকৃতিবিদ হিসেবে যাবেন হেন্সলো নামধারী জনৈক পাদ্রী। তিনি শেষপর্যন্ত নাম প্রত্যাহার করে নিলে ডারউইনের সেখানে সুযোগ মিলে।

বিগেল যাত্রা কালীন ম্যাডাগাস্কার দ্বীপে ডারউইন কৌতূহল বেড়ে গেল বিশাল আকারের মোমসমেত সাদা অর্কিড ফুলের মধুগ্রন্থি (nectur spur) অবলোকন করে। দৈর্ঘ্যে ছিল তা এক ফুট। ডারউইন কোন ধারণা ছিল না এই অস্বাভাবিক ফুলের পরাগায়ণ কি ভাবে ঘটে, তথাপি তিনি মত ব্যক্ত করলেন যে, এই উদ্ভিদের পরাগায়ণ এক ফুট শুঁড় বিশিষ্ট অস্বাভাবিক কোন পতংগের দ্বারাই ঘটে থাকবে। যেহেতু এ রকম অদ্ভূত পতংগের কথা কারো জানা ছিল না, ডারউইনের মতকে সবাই হেসে উড়িয়ে দিলেন। এই ঘটনার বিশ বছর পরে উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা সত্যি সত্যি সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি বিস্তৃত ডানাওয়ালা এবং এক ফুট লম্বা শুঁড় বিশিষ্ট এক ধরনের নিশাচরী পতংগের সন্ধান পান!

দূরদর্শনের গসপেল প্রচারক জিমি সোয়াগার্ট ১৯৮৫ সালে তাঁর বিমোহিত শ্রোতাদের জানান যে, মৃত্যুশয্যায় ডারউইন নাকি পুরোপুরি বদলে গিয়েছিলেন। বিবর্তন বিষয়ে নিজের তত্ত্বকে তিনি পরিত্যাগ করেছিলেন; এমনকি মারা যাবার পূর্বে একখন্ড বাইবেল চেয়েছিলেন যাতে যীশুর প্রেমে আবার মজতে পারেন। আসলে এটি ছিল ডাহা মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি রটনামাত্র। সর্বপ্রথম এই অপপ্রচারের শুরু ১৮৮২ সালে যখন স্যার জেমস হোপ (এডমিরাল অব দ্য ফ্লিট)এর স্ত্রী (অপ)প্রচার করেন যে, তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িত ডারউইনকে নাকি আফসোস করে বলতে শুনেছেনঃ “আমার বিবর্তনের তত্ত্ব লোকজনকে ওভাবে না জানালেই পারতাম!” এ অপপ্রচারে ক্ষুদ্ধ হন ডারউইনের মেয়ে। তিনি স্পষ্ট করে জানান যে, লেডি হোপ ডারউইনের মৃত্যুশয্যা তো দূরের কথা, কোন অসুস্থতার সময়ই উপস্থিত ছিলেন না। ডারউইনের সাথে তাঁর সাক্ষাত ঘটার সম্ভাবনা ও খুব ক্ষীণ। আর দৈবাতক্রমে তা ঘটে থাকলে ও ডারউইনের ওপর লেডী হোপের কোনই প্রভাব ছিল না। ডারউইনের মেয়ে সকল সংশয় ও বিভ্রান্তি নিরসনে এটা ও বললেন যে, মৃত্যুর পূর্বক্ষণে কিংবা তার ও আগে, ডারউইন কখনোই নিজের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং মতামতসমূহ পরিত্যাগ করেন নি। মারা যাবার পূর্বে ছেলের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলেন ডারউইন। তাঁর সর্বশেষ উক্তি ছিল “আমি মৃত্যু নিয়ে এতটুকু ও ভীত নই।“  

জীববিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞানীরা কিন্তু “ডারউইনবাদ” টার্মটি ব্যবহার ব্যবহার করেন না। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হার্ভাডের জীববিজ্ঞানী ই ও উইলসন বলেন, “ডারউইনবাদ কথাটি বিভ্রান্তি ছড়ায় লোকজনের মনে। তাঁরা এটাকে তখন এক ধরনের ধর্ম রা রাজনৈতিক বিশ্বাসের মত ব্যাপার ভেবে ভুল করেন। যেমনঃ মাওবাদ। সে জন্য “ডারউইনবাদ” কথাটি মূলত বিবর্তন বিরোধীদের মুখেই ঘন ঘন শোনা যায়।“

বিখ্যাত এইচ এম এস বিগেল জাহাজে ১৮৩১ সালে সমুদ্র যাত্রার পূর্বে ডারউইনের জীবনের লক্ষ্য ছিল যে তিনি একজন পাদ্রী হবেন।অন্যান্য জিনিসপাতির সাথে একখানা বাইবেল ডারউইন সাথে করে নিয়ে যান। বাইশ বছর ছিল তাঁর বয়স সে সময়। 

১৮৩৮ সালে মামাতো বোন এমাকে বিয়ের প্রাক্বালে পিতা ডারউইনকে উপদেশ দেন, যেন তিনি ধর্মে সংশয়ের ব্যাপারটি চেপে যান।

গভীরভাবে ঈশ্বর ও ধর্মে বিশ্বাসী ডারউইনের স্ত্রী এমার ধারণা ছিল যে, ডারউইন শেষ ঠাঁই হচ্ছে সোজাসোজি নরক।

‘ডারউইনিয়ান কবিতা প্রকল্পে’র নাম শুনেছেন কখনো? ২০০৩ সালে ডেভিড রিয়া নামের আমেরিকান এক কবি এবং কম্পিউটার প্রকৌশলী একটি সৃজনশীল কম্পিউটার প্রোগ্রাম তৈরী করেন যার সাহায্যে কবির্তার বিবর্তন ঘটানো সম্ভব। সেটি কিভাবে?ইংরেজী ভাষার ধ্রুপদী সাহিত্যসমূহ যেমন হ্যামলেট, বেওয়ুফ, ইলিয়ড (অনুবাদ) থেকে এলোমেলোভাবে নেয়া ১,২০০ শব্দের ভান্ডার থেকে এলোপাতাড়িভাবে শব্দ বাছাই করে পদ্যাকারের একটি সংক্ষিপ্ত পংক্তি তৈরী করতে প্রোগ্রামকে নির্দেশ দেয়া হয়। ডেভিড তাঁর ওয়েবসাইটের ভিজিটরদের এ জাতীয় দুটি পংক্তি পড়তে দিয়ে অনুরোধ করেন যেন তাঁরা একটিকে বেছে নেন। জনপ্রিয় নয়- এরকম কবিতাসমূহ মুছে ফেলা হয়; তারপর জনপ্রিয় কবিতাগুলির একটার সাথে আরেকটার ‘প্রজনন’ ঘটানো হয় যেখানে শব্দসমূহের বিনিময় ঘটে প্রজননকালে জীবের ডিএনএ বা জীণ-এর বিনিময়ের মত। প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে বিবর্তন ঘটাকালে যে রকম মিউটেশন প্রক্রিয়ায় নতূন জীণের সৃষ্টি হয়, ডেভিড তাঁর প্রোগ্রামে ও ব্যবস্থা রাখেন যাতে প্রতিটি নতুন কবিতার ক্ষেত্রে প্রতি-হাজারে-এক সম্ভাবনা থাকে নতুন একটি শব্দ যুক্ত, বিযুক্ত অথবা এলোপাতাড়ি ভাবে অবস্থান পরিবর্তন করার। উপরে উল্লেখিত প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট ডেভিডের ‘বিবর্তিত’ একটি কবিতার নমুনা নীচে দেয়া হলঃ     

“before
poets spoon over pure poise through thee poppy
to remember war and that seduce
to light above one is
water”

‘সর্বাধিক যোগ্যতমদের টিকে থাকা’ বা ইংরেজীতে “Survival of the fittest” বাক্যটির প্রচলন কিন্তু ডারউইন নিজে করেননি, যদি ও ডারউইন এটি তাঁর রচনাতে উল্লেখ করেছেন। হার্বাট স্পেন্সার সর্বপ্রথম ১৮৬৪ সালে প্রিন্সিপল অব বায়োলজি (জীববিজ্ঞানের নীতিমালা) গ্রন্থে এই বাক্যটির উল্লেখ করেন। ডারউইনের ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিবর্তন’ তত্ত্বের সাথে নিজের অর্থনীতি বিষয়ক তত্ত্ব বা ধারণাসমূহের সামঞ্জস্য টানতে গিয়ে স্পেন্সার এ বাক্যটি উদ্ভাবন করেন। পরবর্তীতে ডারউইন “Survival of the fittest” কথাটি তাঁর রচনাতে রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করলে ও সেটি তিনি ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া’-র সমার্থক হিসেবে কেবল একটি রূপক বা মেটাফোর হিসেবে ব্যবহার করেছেন; বৈজ্ঞানিক অর্থে প্রয়োগ করেননি।  

ব্রিটিশ ১০-পাউন্ডের নোটে এককালের চার্লস ডিকেন্সের স্থলে ডারউইনের ছবি স্থান পায়। 

১৯৯৬ সালে ভ্যাটিকানের প্রধান দ্বিতীয় পল ঘোষণা দেন যে, ডারউইনের তত্ত্বের সাথে ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসের কোন ‘দ্বন্ধ’ নেই।

ডারউইন যদি ও সারা জীবন ধরে ঈশর বিশ্বাসের প্রশ্নে লড়ে গেছেন, শেষ অবধি তিনি নিজেকে একজন ‘সংশয়বাদী’ হিসেবেই বর্ণনা করেছেন।

শতকরা অর্ধেকের ও কম আমেরিকান ডারউইনের তত্ত্ব বিশ্বাস করে।

অতি সম্প্রতি ডারউইনের ২০০তম জন্মবার্ষিকী এবং বিখ্যাত ‘অরজিন অব স্পিসিজ’ প্রকাশনার ১৫০তম বার্ষিকীকে সামনে রেখে এককালে ডারউইনের কট্টরর বিরুদ্ধাচারনকারী ‘দ্য চার্চ অব ইংল্যান্ড’ অতীত ভূমিকার জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করে।   
—–

ডারউইন দিবস ২০০৯ উপলক্ষে প্রকাশিত।

তথ্যসূত্রঃ   
                             
Weekly Newsweek (Nov. 28, 2005 issue)
The Autobiography of Charles Darwin
http://www.guardian.co.uk
http://www.amnh.org/exhibitions/darwin/
www.anecdotage.com
* অনুবাদ আমার নিজের – লেখক