এই হতশ্রী সময়ে
ক্যাথেরীনা রোজারিও কেয়া
বেশ ক’বছর আগের ঘটনা। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার তখন বাংলাদেশে ক্ষমতায়। হঠাৎ করেই এক প্রাক্তন সহকর্মীর চিঠি পেলাম সিলেট থেকে। আমি তখন সমাজবিজ্ঞানের আর তিনি সমাজকর্মের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। কাছাকাছি সময়ে চাকরীতে যোগদান করায় সহজ ছিল আমাদের সম্পর্কটা। ভদ্রলোক খুব উৎকন্ঠার সঙ্গে দিন কাটাচ্ছেন। ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিধায় বেশ কোনঠাসা অবস্থায় আছেন এবং তার চিঠিতে ইঙ্গিত করেছেন যে এতোদিনে যাকে/যাদের আর যাই হোক সাম্প্রদায়িক নয় বলেই জেনেছেন। তাদের আচরণ ক্রমে দুর্বোধ্য হয়ে উঠছে তার কাছে।
আমার শৈশবের এক স্বশিক্ষিত বন্ধু কে বললাম আমার উৎকন্ঠার কথা। সে বললো, এ আর নতুন কি কথা? কথাটা খঁচ করে বিধে গেল বুকে। দেশে দেশে কালে কালে সংখ্যালঘুরা অত্যাচারিত হয়েছে, সত্যি এর আর নতুন কি? কিন্তু যে কথাটা আমরা বলছি না, এড়িয়ে যাচ্ছি তা হল শুধু সংখ্যালঘু নয় দেশের অনেকেই উৎকন্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। আওয়ামী লীগ বলুন বিনপি বলুন জামাতের সাথে আতাতের ক্ষেত্রে কেউই কার্পন্য করেনি কখনো । আমরা দেখেছি শর্ষিনার পীরকে শান্তি আর শিক্ষাক্ষেত্রে স্বাধীনতা পদক পেতে, কিন্তু ভুলে গেছি তারই নির্দেশে মাদ্রাসার ছেলেরা পৈশাচিক আনন্দে ধান ক্ষেতে লুকিয়ে থাকা মহিলা এবং শিশুদের বর্বর আক্রমণ করেছিল………। আমরা দেখেছি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে স্বাধীন দেশে সংসদ সদস্য হতে। কিন্তু ভুলে গেছি তার বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর নির্দেশে তার রাইফেল থেকে তিনটি বুলেট সরাসরি ঢুকে গিয়েছিল প্রার্থনারত সাধনা ঔষধালয়ের সত্ত্বাধিকারী বাবু নতুন চন্দ্র সিংহের বুক বরাবর। আমরা দেখেছি ঘাতকেরা সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিয়েছে, দেখেছি মায়ের অসুস্থতার অজুহাতে গোলাম আজমের দেশে প্রবেশের এবং পরবর্তীতে রাজনীতি করার অনুমতি পেতে, কিন্তু এসব ঘটেছে কিছুটা অন্তরালে। বিএনপির ওই আমলে দেখেছি জামাতের প্রকাশ্যে আস্ফালন। এরা সরকারে অন্তর্ভুক্ত ছিল বিধায় মৌলবাদী আক্রমনের বিচার হয় নি। মৌলবাদ নিয়ন্ত্রণ করেছে যারা তারা দেশটাকেও নিয়ন্ত্রণ করেছে। আওয়ামী লীগ আমলে গীর্জায় বোমার আঘাতে মারা গেছে প্রার্থনারত মানুষ। বলা হয়েছে আন্তঃদলীয় কোন্দলের জের। এর আগে মন্দিরে মুর্তি বিনষ্ট হয়েছে, বলা হয়েছে আভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের। যশোরে বোমা হামলায় বেঁচে যাওয়া এক কণ্ঠ শিল্পী তার পরবর্তী অনুষ্ঠানে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন ‘দাদা, ওরা কি আমাদের বাঁচতে দেবে না?’ প্রশ্নটা হাওয়ায় মেলাবার আগেই দুমাসের মাথায় আর একটি বোমা হামলায় তার মৃত্যু হয়েছিল।
মানুষ পালাবে কোথায়? শুনেছি, যে যত বড় মানুষ তার লুকোনোর জায়গা নাকি তত কম। কিন্তু গ্রামের এই নিরীহ মানুষগুলোতো বড় কেউ নন, তবুও তারা বাঁচতে পারছে না। আমরা এ সব বর্বরতায় চোখের জল ঝরাচ্ছি। কিন্তু যে চোখে অশ্রু ঝরে, সে চোখ তো স্বপ্নও দেখতে চায়।
আমি কোন দল করি না। দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতাম, এখানে সরকারী চাকুরী করি। সুতরাং বুঝতেই পারছেন সকল নির্লিপ্ততাকে প্রশ্রয় দেবার প্রশিক্ষণ আমার আছে। তারপরেও শীতল রক্তে অশান্তি টের পাই। আমাদের মধ্যবিত্তের এই সমস্যা – সমাজের ফাঁকফোকড়্গুলো সহজেই চোখে পড়ে – অশান্তি দানা বেঁধে অসন্তোষ হয় কিন্তু পরিবর্তন করতে পারি না কিছুই। ইতিবাচকভাবে বললে, আমরা উৎকন্ঠা ছড়াই না, উত্তাপ ছড়াবার বৃথা চেষ্টা করি।
কিন্তু সত্যিই কি কিছুই পরিবর্তন করতে পারি না আমরা? এটি কোন রাজনৈতিক লেখা নয়। ওই যে বললাম – আমরা দুঃখ সঙ্গে বয়ে নিয়ে বেড়াই। আমি জানি দেশের জন্য প্রচন্ড মমত্ববোধ নিয়ে আমরা অনেকেই দেশে বিদেশে অবস্থান করছি। আমরা অনেকেই ভাবছি – এই যে মৌলবাদের স্বরূপ দিনে দিনে উন্মোচিত হচ্ছে – আমরা মনে প্রাণে তা’ ঘৃণা করছি। আমরা জানি ধর্মপালন আর ধর্মান্ধতা এক নয় – কোন ধর্মই বোমার আঘাতে ঈশ্বরের সৃষ্ট মানুষের জীবননাশ সমর্থন করে না।
আমি বিশ্বাস করি, আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায় নি। যারা আমরা ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা করি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করি, তাদের সংখ্যা এখনো প্রচুর। শুধু প্রয়োজন সচেতন মানুষের একাত্মতা আর সহনশিলতা।
আমি খ্রীষ্টিয় পরিবারে জন্মেছি, প্রতি রোববার গীর্জায় যাই – ভালো কথা, তাই বলে পারিবারিক আলোচনায় ওসামা বিন লাদেনকে সন্ত্রাসী না বলে ‘মুসলমান’ হিসেবে উল্লেখ করা হবে সাংঘাতিক কুপমুণ্ডকতা। সব বিষয়কে বুঝতে হবে বহুমাত্রিকতায়।
এক ঘরোয়া মজলিশে কথা হচ্ছিল, এক বিদ্রোহী পুত্র কথা বলছিলেন উদারতা নিয়ে। বলছিলেন তিনি হিন্দু ধর্মের হলেও সব ধর্মকে সমান ভাবেন। তার বাবা ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন – ওরা আমাদের ঘৃণা করে, ওরা উদার না হলে তুমি হবে কেন?
কি আশ্চর্য্য যুক্তি। মনে পড়ে ‘তুমি অধম হইলে আমি উত্তম না হইব কেন?’ কথাটি। ঘৃণা প্রসঙ্গে বলি – বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সমাজ মনোবিজ্ঞান পড়াই – সেদিন পাঠ্যসূচী ‘মনোভাব পরিমাপ’। বললাম ছাত্রছাত্রীদের – তোমরা নিজের নাম না উল্লেখ করে কাগজে লেখো – যেদিন প্রথম অন্য ধর্মের মানুষ দেখলে কি মনোভাব হলো। পাঠক, বিশ্বাস করুন – এই ১৭/১৮ বছরের ছেলেমেয়েদের মধ্যে কি যে তীব্র ঘৃণা দেখলাম, তা’ শিহরিত হবার মতো। কেউ কেউ উদারতার পরিচয় দিয়েছে বটে, কিন্তু অনেকেই বস্তুনিষ্ঠ কোন কারণ ছাড়াই প্রচন্ড বিরূপ মনোভাব দেখিয়েছে। চেষ্টা করেছি পরবর্তী লেকচারে এ সব ভুল ভাঙাতে – জানি না কোন ছাপ ফেলতে পেরেছিলাম কিনা।
বেশ ক’বছর আগে চানক্য সেনের ‘পুত্র পিতাকে’ পড়েছিলাম। যতদূর মনে পড়ে তাতে পুত্র শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য পেরিয়ে যৌবনে পৌঁছে পিতাকে প্রশ্ন করছে – কেন তার পিতা বাড়িতে তার মুসলমান বন্ধু এলে সাংঘাতিক আতঙ্কে কাটাত, কেন বাচ্চাদের তড়িঘড়ি লুকিয়ে রাখা হতো। মা কেন আগলে রাখতেন সবাইকে যেন সাংঘাতিক কোন বিপদ ঘটতে চলেছে। কেন মগজের কোষে কোষে গেঁথে দেয়া হয়েছিলো – অন্য ধর্মের মানুষ মানেই সন্দেহের চোখে তাকাতে হবে?
সন্দেহের চোখে আমাকেও তো দেখেছে মানুষ। মুদ্রার অন্য পিঠে আমিও আছি। ধর্মীয় সংখ্যালঘু বলে আমাকেও কি অন্য চোখে দেখেনি মানুষ? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভিসি প্রফেসর বোরহান উদ্দীন খান জাহাঙ্গীর বলেছিলেন – আমরা যারা ভিন্ন চিন্তা করি তারা সবাই সংখ্যালঘু, তাই শব্দটা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না – আপনার দলে আমিও আছি। না, তিনি আমার দলে নেই। কারণ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিষয়ে বিরূপ মনোভাব তাকে দেখতে হয়নি, বা হয় না। যা কিনা দেখতে হয়েছে আমাকে বা দেখতে হচ্ছে আমার সহকর্মীকে।
মনে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর সাংস্কৃতিক সপ্তাহ চলছে। আমি দায়িত্বে রয়েছি, মঞ্চে আমার অবাধ গতিবিধি। হঠাৎ করে হামদ প্রতিযোগিতা শুরু হলে আমাকে তড়িঘড়ি করে মঞ্চের পেছনে নিয়ে আসা হলো – কারণ বোধ করি আমার ধর্ম আর ‘মহিলা’ পরিচয়। সংকুচিত হলাম আমি আমার অস্তিত্ব নিয়ে – অনুভূতিটা কেমন বোঝবার চেষ্টা করি। আপনারা নিশ্চয় মতিঝিল অফিস পাড়ায় কোন বহুতল বিশিষ্ট অফিসে গেছেন। লক্ষ্য করবেন, এই সব অফিসে লিফট পরিচালনার জন্য একজন ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়া হয়। যিনি মহা বিরক্তি সহকারে জিজ্ঞেস করেন – ক’তলায় যাবেন এবং ততোধিক নির্লিপ্ততায় কোন রকমে ডান হাতটি তুলে সেই তলার বোতামটি টিপে দেন। এই-ই হচ্ছে তার চাকরী। তার এই বোতাম টেপার ওপর নির্ভর করেই আপনি হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকেন এবং লক্ষ্য করেন তার হাতের গতিবিধি। এমনি সময়ে কোন মহিলা লিফটে উঠলে ব্যক্তিটি অত্যন্ত তৎপর হয়ে ওঠেন। এই অভিজ্ঞতা আমি জানি, অনেক মহিলার এবং অনেক সচেতন পুরুষও ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছেন। লিফটম্যান এতো চিন্তিত হয়ে পড়েন এই মহিলাটিকে কোথায় দাঁড় করাবেন তা নিয়ে। মহিলাটিকে ডান থেকে বাঁয়ে, বাঁ থেকে ডানে, সামনে থেকে পেছনে, পেছন থেকে সামনে নড়িয়ে, সরিয়ে তিনি হাঁপিয়ে যান। আর যাকে নিয়ে এই ঘটনা সে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে মরমে মরে যান। আমিও ঠিক তেমনি আমার অস্তিত্ব নিয়ে সংকোচে থাকি। কিন্তু এতো নতুন কিছু নয়। সঠিক শিক্ষা নেই বলেই অন্য ধর্মের মানুষকে অন্যভাবে দেখার শিক্ষা পেয়েছে সাধারণ জনগণ।
এমনি কত ঘটনা – আদমশুমারী করতে আসা অফিসার আমাদের জাতি না বলে উপজাতি বলেছেন। আমার প্রতিবাদী বাবা তাকে বাইরে বেরিয়ে যাবার দরজা দেখিয়ে চীৎকার করে বলেছে – ‘মটরশুঁটি পরিমাণ বুদ্ধি নিয়ে কাজ করেন কেন?’ ছোটবেলা থেকেই এই প্রশ্ন শুনেছি বহুবার। আমার মা শাড়ী পরেন কিনা? আমরা কাটা চামচে ভাত খাই কিনা? ঘরে ইংরেজীতে কথা বলি কিনা? আমার এক শিক্ষক, যাকে উদার বলেই জানতাম। বলেছিলেন, ‘ভালো – খ্রীষ্টান মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবে – মেইন স্ট্রীমে চলে এলে তুমি’। মেইন স্ট্রীম কথাটা আমাকে প্রচণ্ডভাবে বিদ্ধ করেছিল।
আশ্চর্য হয়ে ভাবি বাংলাদেশে আমি ধর্মীয়ভাবে খানিকটা আলাদা, এদেশে আমার গাত্রবর্ণ আর কথার ধরণের জন্যেও আমি খানিকটা আলাদা, নারী হিসেবে খানিকটাতো আলাদাই বটে। আলাদা হতে হতে আমার আমি যে কি পরিচয়ে বাঁচি – তাই ভাবি।
একবার কথা হচ্ছিল কবি অসীম সাহার সঙ্গে নীলক্ষেতে তার ‘ইত্যাদি’ প্রেসে বসে। বলছিলেন যেদিন বাবরী মসজিদ ভাঙা হয় তার পরদিন তাণ্ডব চলেছে ঢাকায়। সব রাস্তায় উত্তেজনা। কিছুতেই ঘরে ফিরতে পারছিলেন না। সাথে নির্মলেন্দু গুণ রয়েছে। খুব কায়দা করে ঘরে পৌঁছে তিনি দু’ছেলে আর স্ত্রীসহ দুয়ার এটে বসে ছিলেন। ছেলে দু’টো টেবিলের উপর উঠে পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর করে জানালার ঘুলঘুলি দিয়ে বাইরে দেখবার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ শুনলেন কড়া নাড়ার শব্দ। ভাবলেন দরজা খুলবেন না। কচি একটা কণ্ঠ শুনে সিদ্ধান্ত পালটে দরজা খুললেন। দেখলেন ১৩/১৪ বছরের একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। বা পা থেকে রক্ত ঝরছে। ছেলেটি বললো যে তার নাম কুমুদ। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে থাকে। মন্দিরে ঢাক বাজায়। ওই দিন যখন মন্দির আক্রমণ করা হয় সে তখন আশ্রয় চেয়েছিল সামনে দাঁড়ানো পুলিশের কাছে। নির্বোধ বালক জানতো না যে এই উর্দি পরা পুলিশ আর আক্রমণ করতে আসা মানুষে কোন ভেদ নেই। পুলিশের রাইফেলের বাট যখন সজোরে তার হাঁটুর উপর এসে পড়েছিল তখন বুঝেছিল। প্রাণ ভয়ে দৌঁড়েছে তখন। অসীম সাহা বোঝেননি কোন কারণে তার কষ্ট বাড়াতে কুমুদ নামের এই ছেলেটি তার বাড়ীর দরজায় কড়া নেড়েছিল।
অসীম সাহা সেদিন বাঁধ ভাঙ্গা তোড়ে বলে যাচ্ছিলেন। তিনি আরো বললেন – ‘তাঁর বাবা মারা যাবার পর, তখনো মৃত দেহের সৎকার হয়নি – এমনি সময়ে আশেপাশের লোকজন বলা শুরু করেছিলো ‘তাহলে তোমরা তো এবার ওপারে চলে যাচ্ছো তাই না’। অসীম সাহা নীরব চীৎকারে বলেছিলেন – ‘এই শহরে তার বড় হওয়া, প্রথম কবিতা লেখা, প্রথম মঞ্চে দাঁড়ানো, এ মাটি তার। কেন ছেড়ে যাবেন তিনি সব পাট চুকিয়ে’। বললেন – ‘১৯৮৯ এর ঘটনার পর থেকে যে কবিতায় হাত দিয়েছেন, দেখেছেন ‘উদ্বাস্তু’ শব্দটা কেমন করে যেন কলমের ডগায় চলে এসেছে’।
ধর্মকে ইস্যু করে দেশ ছেড়েছেন অনেকেই। সত্যও আছে যেমন তাতে, তেমনি মিথ্যেরও প্রভাব আছে তাতে। আমি প্যারিসে ল্যুভ মিউজিয়ামের সামনে সুশান্ত মজুমদারকে কাঠের খেলনা বিক্রি করতে দেখেছি – আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেছেন – তার আসল নাম সুলতান আহমেদ, ভিন্ন নামে আশ্রয় পেয়েছেন এখানে। আমি নেদারল্যান্ডে মোহাম্মদপুরের মুন্নাকে দেখেছি ‘আবু’ নামের রোহিঙ্গা সেজে আশ্রয় পেতে। আমি বেলজিয়ামে দেখেছি তসলিমা নাসরিনের সাথে ছবি তুলে অ্যাসাইলাম পাওয়া ব্যক্তিকে।
লক্ষ্য করুন এরা কোন একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে ঘটনা সাজাচ্ছেন। ঘটনাগুলো সত্য নাও হতে পারে, কিন্তু ইস্যুগুলো অসত্য বলি কি করে। মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই, সারা বিশ্বে আজ যখন ধর্মীয় বিভাজনের অশুভ সংকেত শোনা যাচ্ছে, তখন কি উচিত নয় সচেতন মানুষের বিষয়টিতে মনোযোগী হওয়া। যত ক্ষুদ্রই এর পরিসর হোক না কেন। খানিকটা পড়াশুনো করা অন্য মত সম্পর্কে, খানিকটা জানা সেই মতকে। আমি প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনোর কথা বলছি না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই যে চূড়ান্ত শিক্ষা আমি তা মনে করি না।
‘তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবার দাও শক্তি’। পতাকা আমাদের হাতে, তাকে বহন করার শক্তি আমাদের মেধায় রয়েছে। কিন্তু বোধ করি বার বার আমরা পিছিয়ে পড়ছি – পতাকা হাতে এগিয়ে যাবার তাগিদ অনুভব করছি না আমরা যেন কিছুতেই।
পৃথিবীকে পরম সত্য আর মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ জেনে সচেতন মানুষদের একাত্ম হবার সময় বোধ করি এখনই।
গবেষণা এবং পরবর্তীতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন ডঃ ক্যাথেরীনা রোজারিও। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি শেষে বর্তমানে ফ্লোরিডা সরকারের শিক্ষা বিভাগে কর্মরত রয়েছেন। আশির দশকের বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম সাহসী সংগঠক ও কর্মী ছিলেন। টিএসসি কেন্দ্রিক আবৃত্তির সংগঠন স্বরশ্রুতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তার একক আবৃত্তির সিডি ‘একজন অনিমেষ আজো জেগে আছে’ প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা থেকে ২০০৭ সালে।
অনেক দেরীতে বলছি। আপনার লেখার প্রতিটি বাক্য মাথার ভেতরে খচ করে গেঁথে গেলো। …
বাঙালি মুসলিম এখন এ দেশে এক আশ্চর্য পিরানহা-জাতিতে পরিনত হয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে, এই সেদিনও ১৯৭১ এ জাতপাত ভুলে এ দেশেরই সন্তান হিন্দু-মুসলিম-খ্রিষ্টান-জাতি-উপজাতি অস্র ধরেছিল নিজেদের একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করবে বলে! শেষে কিনা তাদেরই সুবিধাভোগি বাঙালি এখন সংখ্যাগুরুত্বের জোরে সর্বত্র পাকি-পনা প্রতিষ্ঠা করে চলেছে! এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ধর্ম তো বটেই, এমন কি জিয়া-এরশাদ-হাসিনা-খালেদা-নিজামীর রাজনীতি।
এ থেকে ভাষাগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের যেনো কোনো মুক্তি নেই! 🙁
Onekdin por keya….tomar lekha pore valo laglo.
Moushumi
[email protected]
লেখাটা পড়ে খুব ভালো লাগলো । আমিও আপনার সাথে একমত, এখন সময় এসেছে সকল প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার মানুষের একাট্টা হওয়ার ।
আমি কেয়া ম্যাডামের সাথে একমত। কারন এটা আমার সাথেও হয়েছে। গেলো জুনে দেশে গিয়েছিলাম, মুক্তমনার সাথে ততদিনে পরিচয় থেকে পরিনয় হয়ে গেছে, বাবার সাথে তর্ক হয়েছিল ধর্ম নিয়ে, সে ত্যাজ্যপুত্র করার হুমকি দিলো, আবার কেমনে কেমনে জানি মামা জেনেছিল, আর যায় কোথায়। আত্নীয় স্বজন সবাই মিলে আমায় ধরলো চেপে। বিষয়টা যে এতো খারাপ হবে আঁচ করতে পারিনি। বুঝতে পারলাম গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে। মসজিদের হুজুর আমার বাড়িতে সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে হাজির। অবশেষে বড়চাচার হস্তক্ষেপে সে যাত্রায় রেহাই। পরে শুনেছি গ্রামের লোকজন এখনো আমার উপরে খেপে আছে। এবার বুঝুন পাঠক, শুধু ধর্ম নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন করায় আমার এই অবস্থা। অন্যদের কথা আর কি বলবো!
আমার কেন যেন মনে হয়, ইস্যু একটাই। আর তা হচ্ছে দারিদ্র্য। অর্থের, অন্নের দারিদ্র্য তো বটেই, তবে শিক্ষার, সভ্যতার, সংস্কৃতির, রুচির, এবং মনুষত্ব্যেরও। অর্থনৈতিক দারিদ্র্যের কারণে সুলতান আহমেদ হয়েছেন সুশান্ত মজুমদার, মুন্না হয়েছেন আবু । আর সাংস্কৃতিক দারিদ্র্যের কারণে আপনি ক্যাথেরীনা রোজারিও বাঙ্গালী হলেও খ্রীস্টান, মানুষ হলেও নারী। ধর্ম, সম্প্রদায় আর লিঙ্গ-বিভাজন এখানে ঘটনা সাজানোর উপায় কিন্তু ইস্যু নয়।
কেয়া, এই হতশ্রী সময়ে আপনার সুশ্রী লেখাটা পড়ে ভালো লাগলো, আরো লিখুন।
সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু এই সমস্ত অশ্লীল কদর্য কথামালা থেকে কবে যে মুক্তি পাবো আমরা কে জানে? কত সহজেই না শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের অমিলতার কারণে আমরা আমাদের আপন লোকজনকে ঠেলে দেই অপরিচিতের আঙিনায়। যে মাটিতে আমার নাড়ি পোতা, সেই একই মাটিতেই কি পোতা নেই ক্যাথেরীনারও নাড়ি? ওই জন্মভূমির জন্য আমার যেটুকু দরদ, ক্যাথেরীনার দরদ কি তার চেয়ে কম? ওই মাটির জন্য আমার যতটুকু মমতা, ক্যাথেরীনার মমতা কি তার চেয়ে ভিন্ন কিছু? ওইসব মানুষের জন্য আমার বুকে যে পরিমাণ ভালবাসা, ক্যাথেরীনার ভালবাসা কি তারচেয়ে কিছু কম? তা যদি না হয়, তাহলে কেন তাকে অযথাই শুনতে হবে তুমি সংখ্যালঘু? কেন তাকে কৃতার্থ করতে হবে এই বলে যে তুমি মেইনস্ট্রীমে চলে এলে? কবে যে আমরা মানুষ হবো? কবে যে আমরা আমাদের মানুষের মানুষ পরিচয়টাকেই বড় করে দেখবো, কে জানে?
একদম সত্যি কথা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে এই অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মনিরপেক্ষরা বিচ্ছিন্ন পরস্পরের কাছ থেকে। বড় বেশি নীরব তারা বিপরীত শক্তির বিপরীতে। আমাদের সময় এসে গেছে একত্রিত হবার। সময় এসেছে সমস্বরে সরব হওয়ার। সেই কাজটাই আমরা করে যাচ্ছি মুক্তমনার মাধ্যমে। কতটুকু করতে পেরেছি জানি না। কিন্তু শেষ শক্তিটুকু নিঃশেষ করেও শেষ পর্যন্ত করে যেতে চাই এই প্রত্যয়টুকু আছে আমাদের।
ক্যাথেরীনা, আপনার গদ্যশৈলী খুবই মনোরম এবং ছন্দময়। পড়তে গেলে দারুণ আরামদায়ক অনুভূতি হয়। আপনার চিন্তাভাবনাও দেখলাম খুব প্রগতিশীল, স্বচ্ছ এবং পরিণত। মুক্তমনায় আপনাকে নিয়মিত পেলে আমরা আনন্দিতই হবো।
খুউবই ভালো লেগেছে। আমারতো মনে হয়, ধর্ম জিনিষটিই হচ্ছে সমস্ত ধরনের পস্চাদপদতা আর অনিষ্টের মূল। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক টানাপোরেন তো বুদ্ধি ও যুক্তিগ্রাহ্য। যুক্তি ও বুদ্ধি দিয়ে একে মোকাবেলা করা যায়। কিন্তু যুক্তিহীন ধর্মকে রুখবেন কি করে? সেই জন্যে দরকার মনে হয় বিঙ্গানমনষ্ক উদার শিক্ষা। যা কিনা শিক্ষিতকে সশিক্ষিত ও যুক্তিবাদী করে গড়ে তুলবে।