কুয়ার ব্যাঙ
অনন্ত বিজয় দাশ
আজ আমি আপনাদের একটি গল্প বলবো, এক কুয়ার ব্যাঙের গল্প। ভাবছেন নিশ্চয়ই, আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করে ঠাকুমারঝুলির রূপকথার গল্প শুনাতে বসেছি, আসলে মোটেই তা নয়। আবার ‘রূপকধর্মী’ বাস্তব কিছু নয়। এটি শুধু গল্প, নিছক গল্পই; এর বেশি বা কম কিছু না। তবে বলে রাখি, আমি ভাই সুন্দর করে লিখতে পারি না। জানি আমার গল্প বলার ঢঙ বা স্টাইল আকর্ষণীয় নয়। আপনাদের ভালো না লাগতে পারে। ফলে আগেভাগে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। অনুমতি দিলে শুরু করি এবার। কিন্তু গল্প শুরু করার আগে তো ব্যাঙটির নাম-বয়স ইত্যাদি বলতে হবে। জানি না, ব্যাঙেরা মানুষের মতো নাম রাখে কি-না? না রাখলে না-রাখুক। আপনারাই যে কোনো একটি ঠিক করে নিন, রাম-শ্যাম-যদু-মধু যা ইচ্ছে; আর বয়স? ব্যাঙেরা কতদিন বাঁচে, সেটাও তো জানি না। তবে আপাতত ধরে নিন ব্যাঙটি ব্যাঙজাতির হিসেবে প্রাপ্তবয়স্কই। থাকে সে এক মরা কুয়াতে। মরা কুয়া বললাম এই কারণে, সাধারণ কুয়াতে যে পরিমাণ জল থাকার কথা, সেই কুয়াতে এরকম জল নেই। খুবই অল্প পরিমাণ জল, ব্যাঙটির হাটু-কোমর ডুবে যায় কোনোরকমে। গলা পানিতে ভয় পেলেও কোমর পানিতে নেমে সে মাঝেমাঝে কোনোরকমে ডুব দেয়; পানির নীচে চোখ খুলে কালচে-সবুজ রঙের দুনিয়াকে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। কত কিছু ভাবে আকাশ-পাতাল। কূল খুঁজে পায় না। পানিতে বাস করা পোকা-মাকড় আর কীট নিয়ে নিজে নিজে কাহিনী তৈরি করে, গল্প বানায়। বলতে ভুলে গেছি, আমাদের এই ব্যাঙ আবার সাতার জানে না। হাসছেন নিশ্চয়ই! কি সব আলতু-ফালতু কথা বলছি! ব্যাঙ সাতার জানে না, এটা কি করে হয়? হয়, হয়। ভাইরে এই দুনিয়াতে অনেক কিছুই হয়। যদিও কুয়ার মধ্যে এই ব্যাঙের সাথে আরো অনেক ছোট-বড় ব্যাঙ থাকে, তবে তারা প্রত্যেকেই মোটামুটি সাতার জানে। খুব ভালো জানে এরকম কিছু না। সাতার জানা ব্যাঙগুলির মধ্যে কেউ কেউ তাকে পছন্দ করে, কেউবা খুব। আর কেউবা পছন্দ করা তো দূরের কথা, সহ্যই করতে পারে না। এ্যানিওয়ে, যেসব ব্যাঙ তাকে পছন্দ করে, তাদের সাথে তার খুব ভাব। সকাল-সন্ধ্যা শুধু আড্ডা আর গল্প, গল্প আর আড্ডা। বন্ধুদেরকে সে পোকামাকড়ের গল্প শোনায়; বন্ধুরাও তাকে কুয়ার ভেতরের দুনিয়াদারি নিয়ে অনেক কিছু বলে। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন। আচমকা একদিন কুয়াতে হাজির হয় এক বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যাঙ। সাক্ষাৎও হয়ে যায় তাদের দুজনের মধ্যে। আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব। বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যাঙটি বয়স-জ্ঞান-অভিজ্ঞতায় সবকিছুতেই পরিণত। খাল-বিল-নালা-ডোবা-নদী পাড়ি দিয়ে সমুদ্র পর্যন্ত পৌঁছেছে। অনেকের সাথে মিশেছে, অনেক কিছু দেখেছে, অনেক কিছুই বোঝে। কিন্তু ছোটটির তো সেই তুলনায় কোনো বোধ-বুদ্ধি নেই। বয়োজ্যেষ্ঠর কাছে সাত সমুদ্র তের নদীর গল্প সে মুগ্ধ হয়ে শোনে। শুনতে শুনতে সে ভেবে পায় না তাদের এই কুয়ার থেকেও বড় কুয়া আছে! এটা কিভাবে সম্ভব? খাল-বিল-নদী-সমুদ্র এগুলো আবার কি? কুয়ার যে হাটু জলে সে প্রায়ই ডুব দেয়, এরকমই কিছু একটা হবে হয়তো। তবে পুরোপুরি আন্দাজ করতে পারে না। স্বপ্ন দেখতে শুরু করে সেও একদিন পাড়ি দিবে কুয়া, নালা-ডোবা-নদী পার হয়ে পৌঁছুবে তার রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া ‘সমুদ্রে’। অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে।
বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যাঙটি তাকে বলে, বন্ধু তুমি এই কুয়া থেকে বের হতে চাও, ভালো কথা। কিন্তু তোমাকে তো আগে সাতার শিখতে হবে। সাতার না জানলে তো তুমি নালাই পার হতে পারবে না, সমুদ্র তো অনেক দূর।
ছোটটি হাসে। হবে, হবে। সব হবে।
বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যাঙটি একবার ছোট ব্যাঙটিকে হাত ধরে কাছেরই নালা-ডোবাতে বেড়াতে নিয়ে যায়, সেখানে বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। বন্ধুরা অনেকে সমুদ্র বেড়িয়ে এসেছে, কেউবা সমুদ্র না গেলেও নদী পর্যন্ত গিয়েছে। রাতভর খাওয়া-দাওয়া আড্ডা-ফুর্তির পাশাপাশি একেকজন তার সমুদ্র ভ্রমণের কথা বললো, কেউবা নদী ভ্রমণের কথা। ছোট ব্যাঙটি তন্ময় হয়ে যায়। ইস! একবার যদি সমুদ্রে যাওয়া যেত, তবে কি মজাই না হতো!
বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যাঙটি বারেবারে বলে, বন্ধু তুমি সাতার শিখো। নইলে কোথাও একা একা যেতে পারবে না। কুয়াতেই পড়ে থাকতে হবে।
ছোট ব্যাঙ হাসে। হবে, হবে। সব হবে।
নালা-ডোবা বেড়িয়ে যখন ছোট ব্যাঙটি নিজের মরা কুয়োতে ফিরছিল, তখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে। বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যাঙ তাকে কাধে তুলে নেয়। বন্ধুকে বাড়ি পৌঁছে দেয়।
মরা কুয়াতে ফিরে এসে ব্যাঙটি তার আগের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে, অনেক গল্প হয় ডোবা-নালার, সমুদ্র ভ্রমণের পরিকল্পনার কথা জানায়। বন্ধুরা জিজ্ঞেস করে, তুমি তো মিয়া সাতারই জান না। এই কুয়া বর্ষার সময় ভরে গেলে পার হবে কি করে? ডুবে মারা যাবে, নয়তো লতা-পাতা ধরে ঝুলে থাকতে হবে। গতবার তো তাই করলা, এবারও কি তাই করবা?
ব্যাঙটি হাসে। হবে, হবে। সব হবে। স্বপ্ন দেখতে থাকে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যাঙ তাকে পার করে দিবে মাথায় করে। তারপর সমুদ্রে গিয়ে রাত-দিন ঘুরাবে। চক্কর খাবে ঢেউয়ের কোলে। ইস! কত আনন্দ! কত সুখের দিন সামনে অপেক্ষা করছে!
কিন্তু হঠাৎ করেই বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যাঙটির সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। খুব চিন্তায় পরে যায় ছোট ব্যাঙ। বর্ষা চলে আসছে। যে করেই হোক বর্ষার আগে বেরোতে হবে। নয়তো নির্ঘাৎ মৃত্যু। গতবার কোনোরকমে বেঁচে গিয়েছিল, এবার সে চান্স নাও পেতে পারে। সে বার্তা পাঠায় নানাজনের মাধ্যমে। বড় ব্যাঙটি কেন আসে না, কেন কোনো বার্তার উত্তর দেয় না। অবশেষে একদিন উত্তর এল, বন্ধু আমি অসুস্থ। নানা দিকে ব্যস্ত। তারওপর বর্ষা চলে আসছে। আমি তোমার ওখানে আসতে পারবো না। তুমি ভালো থাকো। পরে কথা হবে।
বর্ষার প্রথম বৃষ্টির ফোটা পরতে লাগলো কুয়াতে। পানি ছিটকে পড়ছে ব্যাঙের গায়ে। কুয়ার মধ্যে জন্মানো লতা-পাতা গাছের কোণে ব্যাঙটি চুপটি মেরে আছে। এবার সে স্থির করেছে সাতার শিখতেই হবে। কিন্তু পানি যে পরিমাণে বাড়ছে তাতে সাহস হচ্ছে না এই পানিতে নামার।
——————————————————-
বিশেষ দ্রষ্টব্য : গত কোনো এক রাতের কোনো এক ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এই (অ)গল্পটির যাত্রা। আজ হতে কিছুদিন পর যদি কোনো কারণে এটি নজরে আসে, তবে কেন, কখন, কি অবস্থায় এটি লেখা হয়েছিল তা যেন মনে করতে না পারি, তাই কোনো তারিখ উল্লেখ করলাম না। ধন্যবাদ সবাইকে।
মামুন ভাই, ব্যাঙে সোনার হরিণ দিয়া কি করবো?!!!
স্হির যেহেতু হইছে সাতার কাটার তাইলে দেখবা ছোট ব্যাঙটি একদিন সাতার কাটতে কাটতে ভাইসা ভাইসা সমুদ্রে পৌঁইছা গেছে।আর যদি পৌঁছে যায়-এ তখন ব্যাঙ-এর বুঝ অইবো এটার যে কোনো কুল-কিনারা নাই,নাই কোনো স্বপ্ন-রাংগা সুখ বা সোনার হরিনও।
সোনার হরিন চাই আমার সোনার হরিন চাই, তোরা যে যা বলিস ভাই…………………
ছোট ব্যাঙ সাতার কাটতে সফল হইবে এ আশা রইলো।
ফরিদ ভাই, প্রথমে রসিকতাই করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু মন ঘুরে গেলো সিরিয়াসনেসে। রসিকতা করি কি করে, আপনাদের কল্যানেইতো আজ সত্যটাকে জানার সাহস পাচ্ছি, সাহস করছি। আপনারা ক’জন নিবেদিতপ্রান যেভাবে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে উদাহরন রেখেছেন সেটার কথা না বললে আপনাদের সাথে অবিচার করা হবে। পাঠককুল ভাববেন না আমি স্তুতি করছি, আমি যেটা অনুভব করেছি সেটাই লিখলাম। সব্বাই ভালো থাকুন, ধন্যবাদ।
খুব লজ্জা পেলাম সুমন। সেই সাথে বেশ বিব্রতও। রসিকতার বিপরীতে রসালো কোন মন্তব্য আশা করেছিলাম আমি আপনার কাছ থেকে। এতো সিরিয়াস কিছু শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।
নারে ভাই, আমরা কেউই সাঁতার জানা লোক না। না আমি, না অভি, না জাহেদ। অনিচ্ছায় জলে পড়ে ডুবে যাবার ভয়ে নিঃসঙ্গ কিছু মানুষ আমরা হাত পা ছুড়ছি এই যা। শ্যাওলার মতো স্রোতের অনুকুলে ভেসে যাওয়ার পক্ষপাতী নই বলেই হয়তো আমাদের এই অনিচ্ছুক দাপাদাপি।
আপনারা কেন কুয়ার ব্যাঙ হতে যাবেন? আমাদের সবটুকু শক্তি যে আপনাদের কাছ থেকেই ধার করা। আপনারা হয়তো নিজেরাও জানেন না যে, আপনাদের মত অসংখ্য অদেখা, অচেনা এবং অজানা কিন্তু বড্ড আপন লোকজনেরাই আমাদের কণ্টকময় বন্ধুর চলার পথে বন্ধু হয়ে রসদ জুগিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর। আমাদের যাত্রাকে মসৃন করার জন্য গভীর মমতায় নিরলসভাবে সাফ সুতরো করে দিচ্ছেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পথের কাঁটাগুলোকে।
আমাদের প্রতি আপনাদের এই অসামান্য অবদান, এই অসীম ভালবাসা আমরা ভুলি কি করে?
আবার কে? সিনিয়র মুক্তমনারা। এই যেমন আপনি, অভিজিতদা, জাহেদ ভাই… সাঁতার জানা লোক। যারা কিনা সাগর, ডোবা, নালা ইত্যাদি ঘুরেছেন আর তার গল্প আমাদের শুনিয়েছেন, আপনাদের কথা ভাবলে নিজেরে সত্যি কুয়ার ব্যাঙ মনে হয়। এবার ক্লিয়ার?
ফরিদ ভাই এ্যান্ড কোংটা যেন কে সুমন? মহামতি কিং কোং এর ভাই টাই নাকি? ঠিকমতো চিনতে পারতেছি না যে।
হ, ফরিদ ভাই, আমিওতো কিছুই বুঝলাম না। অনন্ত বিজয়, বড় চিন্তায় ফালাইলেন ভাই। তয় মনে লয়, কুয়ার ব্যাঙ; আংগুলটা নিজের দিকেই বেশি উঠছে আর বুড়ো ব্যাঙ; ফরিদ ভাই এ্যান্ড কোং। কি, ঠিক ধরছিনা?
অনন্ত,
গল্পতো মজাদারই হইছে। খালি বুইড়া ব্যাঙ আর কুয়ার ব্যাঙটারে ঠিকঠাক মতো চিনতে পারলাম না এই যা একটু অসুবিধা। কিছুদিন পরে ভুলে যাওয়ার আগেই একটু বলে টলে দিলে ভাল হতো না ব্যাপারটা। তাইলে আর মনের মধ্যে খচখচানিটা থাকতো না রে ভাই।