কিউবার কৃষি অর্থনীতি/ রেবেকা ক্লসন

দিনমজুর

 

জন বেলামী ফস্টার তার “ধ্বংসের বাস্তুবিদ্যা” (The Ecology of Destruction, Monthly Review, February 2007) প্রবন্ধটিতে ব্যাখ্যা করেছেন মার্কস কেমন করে ‘বিপাকীয় ভেদ’ এবং ‘বিপাকীয় পুনর্ভরণ’ এই দুটি ধারণার মাধ্যমে বিংশ শতাব্দীতে প্রকাশিত হয়ে পড়া পুঁজিবাদী সমাজের বাস্তুসংস্থানগত দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর ‘বিপাকীয় ভেদ’ ধারণার মাধ্যমে বোঝা যায় কেমন করে পুঁজির পুঞ্জিভবনের যুক্তিটি প্রাকৃতিক পুনরুৎপাদনের মৌলিক প্রক্রিয়াটিকে ধবংস করার মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্যকেই বিনষ্ট করে। তার উপর ‘সেই বিপাকের চারপাশের পরিপ্রেক্ষিতকে ধবংস করার মাধ্যমে’, মার্কস বলে চলেছেন, ‘এটি ( পুঁজিবাদী উৎপাদন) পদ্ধতিগত পুনর্ভরণকে সামাজিক পুনরুৎপাদনের নিয়ন্ত্রিত নিয়মে পরিণত করে (অর্থাৎ বাঁধাগ্রস্ত করে)’ – যে পুনর্ভরণ আসলে একমাত্র পুঁজিবাদী কাঠামোর বাইরেই সম্ভব।

কিউবার কৃষি-বাস্তুবিদ্যার সাম্প্রতিক অগ্রগতি প্রত্যক্ষ উদাহরণের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে শুধুমাত্র কিছু পদ্ধতি নয় বরং এর সাথে সমন্বিত খাদ্য উৎপাদনের সামাজিক-বিপাকীয় সম্পর্কের ব্যাপক রূপান্তরের মাধ্যমে এ বিপাকীয় চ্যুতির পুনর্ভরণ সম্ভব। ইতোমধ্যেই অনেক পন্ডিত ব্যক্তি কিউবার জৈব-কৃষির সাফল্যের বৈজ্ঞানিক অর্জন নিয়ে আলোচনা করেছেন। যদিও কিউবার জৈব-কৃষির এই সাফল্য এবং ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলে এর সম্ভাবনাকে কেবল জৈব প্রযুক্তি ব্যবহারের আলোকে না দেখে দেখতে হবে কিউবার পুরো সমাজ ব্যাব¯থায় যে পরিবর্তন এসেছে তার আলোকে। রিচার্ড লেভিন যেমন বলেছেন: “কৃষি ক্ষেত্রে কিউবার অগ্রগতিকে বুঝতে হলে পুরো বিষয়টিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে—– ঘাড় ঘুড়িয়ে একটু পেছনের দিকে তাকাতে হবে, আড়চোখে তাকিয়ে পুরো বিষয়টিকে বুঝতে হবে কেমন করে সত্যিকার অর্থেই মহৎ একটি পথ ধরে কিউবার সার্বিক উন্নয়ন এগিয়ে চলেছে….”

জমি হলো গুপ্তধন যার চাবি শ্রম
মার্কসের বিপাকের ধারণার মূল প্রোথিত আছে শ্রম-প্রক্রিয়া সম্পর্কে তার যে ধারণা তার মাঝেই। শ্রম এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানুষ, তার এবং প্রকৃতির মধ্যে বস্তুগত বিনিময় সাধন করে এবং তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ভূমি অর্থাৎ মৃত্তিকা (এবং তার সাথে সম্পর্কিত প্রাকৃতিক চক্র) এবং শ্রম অর্থাৎ মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যকার বিপাকীয় সম্বন্ধ, এই দুইটি হল মানুষের সকল সম্পদের মূল উৎস। একদল কৃষি-গবেষকের সাথে গত বছরের কিউবা সফরের সময় আমি দেখি ঘোড়ার গাড়িতে করে একটি খামারের জৈব উৎপাদন নিকটস্থ কমিউনিটি স্ট্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। একটা হিমাগারের গায়ে দেখি লেখা আছে: “জমি হলো গুপ্তধন যার চাবি শ্রম”। একটি যৌথ খামারে জৈব ফসল উৎপাদন এবং নিকটস্থ কমিউনিটিতে তার সরবরাহের ব্যাপারটি কাছ থেকে দেখে আমার কাছে মনে হলো এটি যেন মার্কসের প্রাকৃতিক বিপাকের ধারণার দৈশ্যিক উপস্থাপনা। জমিকে গুপ্তধনের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে যেন সাময়িক লাভের জন্য তাকে নি:শেষিত করে ফেলা না হয়, বরং কৃষির বাস্তুগত নিয়মনীতির (কৃষি-বাস্তুবিদ্যা বা এগ্রি-ইকোলজি) যৌক্তিক এবং পরিকল্পিত প্রয়োগের মাধ্যমে একে সদা পুনরুজ্জীবিত রাখা হয়। আর গুপ্তধনের চাবির মতোই শ্রম মাটি থেকে তার শ্র্রেষ্ঠ উপাদান বের করে নিয়ে আসার মাধ্যমে উৎপাদন করে স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য যা সমস্ত সম্প্রদায়ের নিকট সমান ভাগে ভাগ করে দেয়া হয়।

মার্কসের কাছে বিপাক শব্দটির মানে দুরকম। একটি হলো মানুষ ও প্রকৃতির মাঝে যে জটিল আদান-প্রদান ঘটে, তাকে নিয়ন্ত্রণকারী একটি প্রক্রিয়া। দ্বিতীয়টি আরো বৃহত্তর অর্থে শ্রমবিভাজন ও সম্পদের বন্টনকে নিয়ন্ত্রণকারী প্রাতিষ্ঠানিক ধারণাকে বোঝায়। বিপাকীয় বিচ্যুতির বিশ্লেষণ এ দুটি দিককে নিয়েই। ইকোলজিক্যাল বা বাস্তুগত অর্থে, মার্কস লক্ষ্য করেন পুঁজিবাদী কৃষি আর “নিজে নিজে টিকে থাকার” অবস্থায় নেই যেহেতু এটি “আর নিজের মাঝে নিজের উৎপাদনের প্রাকৃতিক শর্ত খুঁজে পায় না”। বরং কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি এখন সুদূর বহির্বাণিজ্য ও কৃষির বাইরের পৃথক শিল্পক্ষেত্র থেকে সংগ্রহ করতে হয়। এর ফলে জমির উর্বরতা ও বর্জ্য সঞ্চয়নের মধ্যকার প্রাকৃতিক চক্রে ফাটল ধরে।

বিপাকের বৃহত্তর সামাজিক অর্থের কথা ধরলে দেখা যায়, পুঁজি ও শ্রমের মধ্যকার বিশেষ সম্পর্কের কারণে মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্কের মাঝে ফাটল দেখা দিয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যক্তিগত সম্পদে রূপান্তর, শারীরিক/মানসিক শ্রমের বিভাজন, গ্রাম ও শহরের মধ্যকার ব্যবধান ইত্যাদির মাধ্যমে সামাজিক অর্থে বিপাকীয় চ্যুতি বা ফাটলকে বোঝা যেতে পারে। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে রিয়েল এস্টেট সেক্টরে কর্পোরেট ফাটকাবাজির প্রাধান্য, ‘দক্ষ’ টেকনিশিয়ানের জ্ঞানের কাছে ক্ষুদ্র কৃষকের স্বাধিকারের বিনাশ, গ্রাম্য খামার থেকে শহরের দিকে জনসংখ্যার স্থানান্তর ইত্যাদি বিভিন্ন ভাবেই এই ফাটল বাস্তবায়িত হয়।

‘এটি সুন্দর কাজ’
আমার সৌভাগ্য যে কিউবায় জৈবখামারগুলোতে কাজ করে এমন অনেক কৃষকের সাথে আমি কথা বলতে পেরেছি। আমার কাঁচা স্প্যানিশের কারণে বেশী সূক্ষ আলোচনায় যেতে না পারাটা আমাকে হতাশ করলেও কৃষকদেরকে মৌলিক একটি প্রশ্ন আমি ঠিকই করতে পেরেছি। আমাকে শহুরে কৃষিজমির কাজ দেখাচ্ছিল এরকম একজন কৃষককে প্রশ্ন করেছি :
“তোমার কি এই কৃষিকাজ ভালো লাগে?” কৃষক দ্বিধাহীন ভাবে বলল: “এটি সুন্দর কাজ”
আরো অনুবাদ এবং কিউবার চারটি প্রদেশের কৃষিকাজ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বুঝেছি খাদ্য উৎপাদনের রূপান্তরের বাস্তব ফলাফল কি; বিশ্ব কৃষিবাণিজ্যের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য ছাড়াই এখানে পুষ্টিকর খাদ্যশক্তি পাওয়া যায়।

কিউবার এই কৃষি মডেল প্রাকৃতিক পুষ্টিচক্রকে পুনর্সংযুক্ত করে, গ্রামের মানুষের শ্রমের সাথে শহুরে উৎপাদনশীল শ্রমের বন্ধন তৈরি করে। সামাজিক-বিপাকীয় সম্পর্কের রূপান্তরের ফলে জীববৈচিত্র্যকে ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদন সম্ভব হয়েছে, যেমন : উপকারী কীটপতঙ্গের ব্যবহার। মালিকানা এবং বিতরণের নতুন ধরনের ফলে চাষাবাদ, ফসল তোলা ও ভোগ- সব ক্ষেত্রেই অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়েছে। নতুন ধরনের শ্রম-সম্পর্ক তৈরী করা হয়েছে যার ফলে আদিবাসী কৃষক একজন প্রশিক্ষিত এগ্রোনোমিস্ট এর সাথে মিলেমিশে পরিবেশ, ভূগোল ও আবহাওয়ার সাথে ফসলকে খাপ খাইয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। আর “ফিদেল ক্যাস্ট্রোর কিউবা ছাড়া আর কোথাও এটি সম্ভব নয়”- সন্দেহবাদীদের এই ধারণাকে উড়িয়ে দিয়ে কৃষকরা ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় দেশগুলোতে চাষাবাদের এই পদ্ধতিটিকে ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করছেন।

“জৈবিক চাষাবাদ পদ্ধতির উন্নয়নের” জন্য কিউবাকে বিকল্প নোবেল পুরষ্কার দিয়েছে কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। এই সাফল্যের পেছনে নতুন পদ্ধতির আবিষ্কারের অবদান অবশ্যই আছে, তবে তা আংশিক; বাকিটা হলো নতুন তথ্যকে স্থানীয় পর্যায়ে প্রয়োগের জন্য ছড়িয়ে দেয়ার সাফল্য। Entomophages and Entomopathogens (CREEs) উৎপাদনের জন্য রয়েছে ২৮০টি সফল গবেষণাগার, যেগুলো ক্ষতিকর পতঙ্গকে আক্রমণকারী উপকারী পতঙ্গ উৎপাদনের মাধ্যমে জৈবপ্রক্রিয়ায় পতঙ্গ দমনকে সম্ভব করে তুলেছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় করা গবেষণার মাধ্যমে প্রাকৃতিক প্রতিষেধক ও জৈব সারের উৎপাদন প্রচলিত কৃষির বাইরে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যদিও বিপাকীয় বিচ্যুতির পুনর্ভরণ শুধু এটিকেই কেন্দ্র করে ঘটেছে, বিষয়টি তা নয়। বাস্তুসংস্থানের সাথে সম্পর্কিত করে বিপাকীয় চ্যুতির পুনর্ভরণকে বুঝতে হলে প্রথমে প্রাকৃতিক পুষ্টিচক্রের স্থানিক পুনর্বিন্যাসকে বোঝা দরকার। বিপাকীয় চ্যুতির বাস্তুগত বোঝাপড়ার মূল বিষয়টি হলো পুষ্টিচক্রকে নিয়ন্ত্রণকারী ভৌত প্রক্রিয়াগুলোর স্থানিক সম্পর্ক (spatial relations)। ভূমি থেকে মানুষের পৃথকীকরণ (গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তর) প্রকৃতি ও সমাজের মধ্যকার বিপাকীয় সম্পর্কের মাঝে ফাটল তৈরী করেছে । কেননা উৎপাদনশীল শস্য ও খামার থেকে পণ্যের সাথে সাথে পুষ্টি উপাদনগুলোও দূরে চলে যায় এবং অবশেষে দূরের কোন শহরের আবর্জনায় পরিণত হয়। পুষ্টিশূন্য মাটির জৈবকাঠামো পুনরুদ্ধারের জন্য পুঁজিবাদী কৃষি প্রক্রিয়ায় তখন দূর থেকে আমদানীকৃত শিল্প উৎপাদন (যেমন : ইউরিয়ার মতো নাইট্রোজেন সার) মাটিতে নিয়মিত প্রয়োগ করতে হয়। এর ফলে প্রাকৃতিক পুষ্টিচক্র নষ্ট হয় এবং প্রকৃতিতে নতুন এক বাস্তুগত দ্বন্দ্বের সূচনা করে যার একদিকে শহরের স্যুয়ারেজ সিস্টেমে পুষ্টি উপাদানের সঞ্চয়ন অন্যদিকে শহর থেকে রাসায়নিক সার দূর গ্রামে রপ্তানীর জন্য জ্বালানীর ব্যবহার। একইভাবে কৃষিকাজে ব্যবহ্রত গবাদিপশুকে তার খাদ্য উৎপাদনকারী জমি থেকে সরিয়ে নেয়ার ফলে খাদ্যশস্য/গবাদিপশু এবং গবাদিপশুর গোবর/খাদ্যশস্যের মধ্যকার বস্তুগত বিনিময় বাধাগ্রস্ত হয় এবং বিপাকীয় বিচ্যুতি ঘটে।

১৯৯৫ সাল থেকে কিউবার কৃষিঅর্থনীতিতে পুষ্টিচক্র ও বস্তুগত বিনিময়ের এই ভেঙ্গে পড়া সম্পর্ককে পুনরুদ্ধারের কাজ চলছে। কিউবার কৃষি-বাস্তুবিদ্যার মূলনীতি হলো : “স্থানীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং চারাগাছ-পশুর সমন্বয়ের মাধ্যদিয়ে আন্ত:খামার সিনার্জি”। কিউবা ভ্রমণের সময় আমি দেখেছি কিভাবে এ নীতিতে চাষাবাদের ফলে নিকটবর্তী খামার কিংবা আন্ত:খামার সমন্বয়ের মাধ্যমে পুষ্টিচক্রের পুনরুদ্ধার হচ্ছে।

কেঁচো, গরু এবং আখ
সফল খাদ্য উৎপাদনের জন্য কৃষকের প্রয়োজন পুষ্টিসমৃদ্ধ কৃষিজমি। কিউবা আগে কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আমদানীকৃত কৃত্রিম রাসায়নিক সার ব্যবহার করতো। আর আজ সংগঠিত পদ্ধতিতে মানবিক শ্রম, পশু ও শস্য-উপজাত এবং প্রাকৃতিক পচন প্রক্রিয়াকে একীভূত করে সাসটেইনেবল কৃষির জন্য কৃষিজমিতে প্রয়োজনীয় পুষ্টির যোগান দেয়া হচ্ছে। ফলে দূর থেকে মূল্যবান জ্বালানী পুড়িয়ে সার আমদানীর প্রয়োজন পড়ছে না। পূর্ব হাভানার একটি যৌথ খামার ঘুরে দেখার সময় আমি দেখি এক কৃষক হাঁটু গেড়ে বসে আছে কতগুলো চৌকো এবং দীর্ঘ কংক্রীটের সারির সামনে, যেখানে লাল ক্যালাফর্নিয়া কেঁচোর ঘনবসতি। তিনি সেই কংক্রীটের সারির মাটিতে হাত ঢুকিয়ে আমাদের দেখালেন প্রতিঘনমিটার মাটিতে থাকা ১০,০০০ থেকে ৫০,০০০ কেঁচোর সামন্য একটি অংশ। বড় আকারের চাষাবাদে কেঁচো প্রতি ৯,০০০ কিউবিক মিটার জৈব উপাদান থেকে ২,৫০০ থেকে ৩,৫০০ কিউবিক মিটার হিউমাস তৈরী করে। ভারমিকালচার (
Vermiculture) অর্থাৎ কেঁচো ব্যবহার করে জৈবসার তৈরীর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে কেঁচোর চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং সঠিক সময়ে তৈরীকৃত হিউমাসকে শস্যক্ষেতে প্রয়োগ করা হয়। তিনি ব্যখ্যা করলেন কেমন করে শাকসব্জির অবশেষের চেয়ে প্রাণীজ আবর্জনা ব্যবহার করে বেশী হিউমাস তৈরী করা যায়, যে কারণে তিনি নিয়মিত স্থানীয় একটি খামার থেকে নিয়মিত গোবর সংগ্রহ করেন। যে গোবর আবার
নিজেই প্রাকৃতিক পুষ্টি চক্রেরই একটি অংশ যেহেতু খামারে উৎপাদিত শস্যের অবশেষকে ব্যবহার করেই গোখাদ্য তৈরী করা হয়।

যদিও কিউবার গবেষকরা আগেই জেনেছিলেন যে বিশেষ ঘাস, বিভিন্ন রকম শুঁটি এবং শস্যের অবশেষ ইত্যাদির মাধ্যমে গরুর প্রয়োজনীয় পুষ্টি যোগান দেয়া সম্ভব কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সস্তায় পশুখাদ্য প্রাপ্তির কারণে বিষয়টি তখন প্রয়োগ করা হয়নি। পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে তারা বাধ্য হলেন শস্য অবশেষ ব্যবহার করার সুবিধা নিয়ে গবেষণা করতে। তারা দেখলেন আখের অবশেষ থেকে তৈরী ঝোলাগুড়, bagasse, cachaza, এমনকি আখের আগার ফেলে দেয়া অংশ গবাদিপশুর জন্য পুষ্টিকর খাদ্য হিসাবে ব্যবহ্রত হতে পারে। যেমন দুজন গবেষক বললেন : “গত ১৫ বছর ধরে বিভিন্ন দেশে চালিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে মাংস ও দুধ উৎপাদনে গবাদিপশু পালনের ক্ষেত্রে গো-খাদ্য হিসাবে আখের ব্যবহারের অর্থনৈতিক কিছু সুবিধা বেরিয়ে এসেছে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশগুলোর জন্য এটি বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য, কেননা এসব দেশে শুকনো মৌসুমে গোচারণ ভূমি ও ঘাসের যখন সংকট, তখনই সেখানে আখ চাষের সময়।” আখ থেকে গোখাদ্য, গরু থেকে কেঁচোর জন্য সার, কেঁচো থেকে উৎপাদিত হিউমাসের জমিতে প্রয়োগ- এই পথ ধরে পুষ্টির চক্রাকার পরিভ্রমণ দেখে আমি বুঝলাম কেমন করে এই প্রদেশের গাছ এবং পশুর বিপাকের মাধ্যমে পুষ্টিউপাদানগুলোকে সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে কিউবার সব প্রদেশেই যে ব্যাপারটি এভাবে আখ, গরু, কেঁচো আর শস্যের মাধ্যমেই ঘটছে তা নয়; বিভিন্ন অঞ্চলের স্থানীয় সম্পদের উপর ভিত্তি করে এটি বিভিন্ন ভাবে ঘটছে যেমন : মাতাঞ্জাতে ( যেটি মধ্যকিউবার প্রধান সাইট্রাস জাতীয় ফল উৎপাদনকারী অঞ্চল) গো-খাদ্যের জন্য কমলার খোসা গাঁজিয়ে সাইলেজ (silage) তৈরী করা হয়।

অন্যরকম চারণভূমি
এরপর আমরা যাই “
Indio Hatuey” নামের পরীক্ষাক্ষেত্রে, যেখানে আমি দেখি রাস্তার দুধারে বেড়া দিয়ে ঘেরা বনময় প্রান্তর। আমি প্রথমেই ধরে নিই এটা বোধ হয় কাঠ তন্তুর কোন প্ল্যানটেশান, কেননা আমার সংকীর্ণ শিক্ষা আমাকে শিখিয়েছে এরকম কোন প্রান্তর হয় একটা গোচারণ ভূমি অথবা কোন বন- এর মাঝে শুধু যে কোন একটাই হতে পারে। বিশেষায়িত উৎপাদন ব্যবস্থা যে নির্দিষ্ট ধরনের প্রান্তরের জন্ম দেয় তা হলো ইনটেনসিভ কৃষির একটি মডেল, যে মডেল এমন একটি কৃষি ব্যবস্থার উদাহরণ যা প্রজাতিসমূহের মধ্যকার বিপাকীয় বিনিময়কে সুচিন্তিত ভাবেই বাদ দেয়। এ পরীক্ষাক্ষেত্রের প্রবেশপথে বড় গাছ এবং লম্বা ঘাসের মাঝে চড়ে বেড়ানো গরু ও তার পাশে বিজ্ঞানের প্রতীক হিসাবে বীকারের ছবি সম্বলিত সাইনবোর্ডটি থেকে প্রথম আমি অন্যরকম এই চারণভূমি সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণাটি পাই। প্রজেক্টির পরিচালক Mildrey Soca Perez বললেন :“শ্রমিকদের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত জানাই”। আমাদের সামনে এরপর এই পরীক্ষাক্ষেত্রের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলো উপস্থাপন করা হয়, সেই সাথে শস্য-গবাদিপশুর সমন্বয়ের সুফল সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়। বিশেষ সময়ের আগে কিউবায় একক চাষাবাদের মডেল অনুসরণ করা হতো। বিশেষ পর্যায়ে এসে স্থানীয় সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে বিকল্প মডেলের অনুসন্ধান করা হয়। স্থানীয় ক্ষুদ্র কৃষক, যারা অনেক আগে থেকেই জমির মিশ্র ব্যবহারে অভ্যস্ত, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেয়া হয়। শস্য আবাদ ও গবাদিপশুপালনের সমন্বয়ের ফলে জমির পুষ্টি ব্যবস্থাপনা ও বর্জ্য সমস্যা এ দুই ক্ষেত্রেই পারস্পরিক সুবিধা পাওয়া যায়। কিউবার গবেষকরা অনুধাবন করলেন “শস্য ও গবাদিপশুপালনকে পৃথক করার ফলে শক্তি ও পুষ্টির এক বিরাট অপচয় ঘটছে”। তারা যখন আমার কাছে ব্যাখ্যা করলেন কিভাবে গরু, গাছের পাতা এবং ঘাসের মাঝে শক্তির আদান প্রদান ঘটছে, আমার কাছে মনে হলো বিপাকীয় ফাটলের ক্ষত পূরণের এটি আরেকটি উদাহরণ। এখানে ইপিল ইপিল (Leucaena leucocephala) নামক গাছের মাঝে গরু পালন করা হয়। গরুগুলো এই ছোট ও ঘন কাঁটাঝোপযুক্ত গাছের পাতা খায়। শ্রমিকরা নিয়মিত গাছগুলোকে ছেঁটে দেয় যেন গাছের ডালগুলো গরুর নাগালের মধ্যেই থাকে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে লাগানো লম্বা ঘাসও গরুর খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এই গাছগুলো মাটিকে নাইট্রোজেন সমৃদ্ধ করে। আবার গরুর গোবরও গাছ ও ঘাসের জন্য সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

leucaena গাছ গরুকে ছায়া দেয় এবং তাপের প্রভাব হ্রাস করার মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে লাগানো ঘাস যেন প্রচুর সূর্যালোক পায় সেজন্য গাছের সারি তৈরী করা হয় পূর্ব-পশ্চিম বরাবর। এই গাছের মূল আবার মাটির কাঠামোকে শক্ত করে ধরে রাখে যেন গরুর খুড়ের আঘাতে ভূমিক্ষয় বেশী হতে না পারে। আর গাছ-গরুর অনুপাতের বিষয়টিও লক্ষ্য রাখা হয় যেন কোন একটি অন্যটির তুলনায় বেশী বা কম হয়ে ভারসাম্য নষ্ট করতে না পারে। গবেষকরা দেখেছেন, এভাবে সমন্বিত চাষাবাদের মাধ্যমে বছরে প্রতি হেক্টর জমি থেকে ৩,০০০ থেকে ৫,০০০ লিটার দুধ উৎপাদন করা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে আবাদের ফলে গ্রীষ্ম ও বর্ষাকালের মধ্যকার উৎপাদন হ্রাস-বৃদ্ধিও কমে যায় এবং গরুর প্রজননও বেড়ে যায়।

কিউবায় এভাবে গরু-বাছুর ছাড়াও ছাগল, ভেড়া, শুয়োর ও খরগোশ পালনের ব্যাপারে গবেষণা চলছে । তাছাড়া এই খামারে কমলা বাগানের মাঝে ঘোড়া পালনের বিষয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। ঘোড়া বাগানের আগাছা পরিষ্কার করে আগাছানাশকের প্রয়োজনীয়তা দূর করে এবং জমির উর্বরতার জন্য প্রয়োজনীয় গোবর-সারেরও যোগান দেয়। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে একক চাষাবাদের চেয়ে এই সমন্বিত চাষাবাদের মাধ্যমে বছরে প্রতি হেক্টর জমি থেকে বাড়তি ৩৮৮ পেসো বেশি লাভ হয়। কিউবার কৃষক এবং গবেষক যারা এই স্থানীয় ও অভ্যন্তরীণ পুষ্টিচক্রের প্রক্রিয়াটি আমার কাছে বর্ণনা করেন তাদের মাধ্যমে আমি দেখতে পাই এভাবে কতগুলো মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে। নতুন ধরনের শ্রম সম্পর্ক, সিদ্ধান্ত গঠনের নতুন কাঠামো এবং জমি ও খাদ্যের নতুন ধরনের বিতরণ ব্যবস্থা কেবল বাস্তুসংস্থানগত অর্থে স্থায়ী একটি উপায়ে কিউবার জনগণকে খাদ্য সরবারহ করছে না, পুরো সমাজের বিপাক প্রক্রিয়াকেও এটি পাল্টে দিয়েছে।

গ্রাম-শহরের ভেদ বিমোচন
শহরাঞ্চলে জৈব বাগান করার উপর জোর দিয়ে এবং শহরের পরিত্যক্ত খালি জায়গায় খাদ্য উৎপাদনের কৌশল অবলম্বন করে গ্রাম-শহরের বিভেদ দূর করা হয়। যে স্থানগুলো একসময় গাড়ি পার্কিং, ময়লা জমা করা এবং পরিত্যক্ত ভবনের ধ্বংসাবশেষ রাখার স্থান হিসাবে ব্যবহৃত হতো সেগুলো হয়ে উঠলো প্রতিবেশীদের জন্য জৈবখাদ্য সরবরাহের উৎস। বর্তমানে কিউবার জনগণ যে শাকসবজি খায় তার শতকরা ৬০ ভাগই আসে শহুরে বাগান থেকে।

শহরের অধিবাসীদের মৌলিক খাদ্যের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে গিয়ে অনানুষ্ঠানিক ভাবে শহুরে কৃষির শুরু। শহুরে কৃষির গুরুত্ব উপলব্ধি করে কিউবার সরকার শহুরে কৃষি বিভাগ গঠন করে এবং শহরের খালি জায়গার উপর নাগরিকদের দখল এবং সেখানে উৎপাদিত ফসল বিক্রির অধিকার আইনসিদ্ধ করে। জৈব কৃষির নীতি মেনে চললে একজন নাগরিক এক একরের এক-তৃতীয়াংশ নিজের আয়ত্বে নিয়ে চাষাবাদ করতে পারে। ২০০০ সাল নাগাদ ১,৯০,০০০ এরও বেশী মানুষ এর জন্য আবেদন করে এবং সব মিলিয়ে বর্তমানে প্রায় ৩,২২,০০০ মানুষ শহুরে কৃষির সাথে জড়িত। কিউবার শহুরে কৃষি বিভাগ এদের জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি পরামর্শ, রোগ-বালাই দমন ইত্যাদি ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করে থাকে।

কৃষির কৌশলগত দিকগুলোর ব্যাপারে কৃষিবিদদের কাছ থেকে খাদ্য-উৎপাদকের কাছে জ্ঞানের প্রবাহ কিউবার কৃষির সাফল্যের আরেকটি দিক। কিউবার কৃষি মডেল অনুসারে শারীরিক ও মানসিক শ্রমের কৃত্রিম বিভক্তি বস্তুত কৃষির সাফল্যকে বাঁধাগ্রস্ত করে। কিউবায় সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য নতুন কৃষি মডেলে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের সুযোগ রাখা হয়েছে। যেমন কিউবার ১৫টি প্রদেশে অবস্থিত পিপলস্ কাউন্সিল ছোট ছোট সমবায়গুলোকে সাহায্য করে। পিপলস্ কাউন্সিলগুলো গঠিত হয়েছে স্থানীয় খাদ্য উৎপাদক এবং কৃষিবিদদের নিয়ে যারা কৃষিতে সর্বোত্তম প্রক্রিয়াটি যেন কৃষকরা ব্যবহার করতে পারে তার জন্য একত্রিত হয়ে কাজ করে। সর্বোত্তম প্রক্রিয়াটি বের করার প্রয়োজনে প্রশিক্ষিত কৃষিবিদ কৃষকদের সাথে সরাসরি মাঠে কাজ করে। সেই সাথে কৃষকের জ্ঞানও ব্যবহার করা হয় কৃষি বিষয়ক সম্মেলন এবং গবেষণাপত্রগুলোতে। ২০০৬ সালে কৃষকদের এক সম্মেলনে যে ১০৫টি গবেষণাপত্র পাঠ করা হয় তার মাঝে ৫৩টি তৈরী করেছিল খাদ্য উৎপাদকেরা, ৩৪ টি গবেষক-টেকনিশিয়ান এবং ১২টি ছিল একাডেমিক অধ্যাপকদের তৈরী। ব্যবহারিক জ্ঞানের সাথে তত্ত্বগত জ্ঞানের সম্মিলনের ফলে এমন এক যৌক্তিক বিজ্ঞানের প্রয়োগ সম্ভব হয় যা সকলের পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব হয়।

সামাজিক বিপাকের ফাটলটিকে পূরণ করার জন্য গ্রাম-শহরের ভেদ বিমোচন (কৃষির জমির পরিবর্তন) এবং সেই সাথে কায়িক ও মানসিক শ্রমের পার্থক্য দূর করা( শ্রম বিভাজন পরিবর্তন করা) প্রয়োজন। এই দুটোর জন্য পুরো খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার পরিবর্তন প্রয়োজন। কিন্তু এটা ছাড়াও সামাজিক বিপাকের আরেকটা দিক রয়েছে- উৎপাদিত ফসলের সুষ্ঠু বিনিময়। এর জন্য কিউবায় প্রত্যেক নাগরিকের একটি করে রেশন কার্ড রয়েছে যা সারা বছর তার খাদ্য প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দেয়। বৃদ্ধ, শিশু এবং গর্ভবতী নারীদের খাদ্য বিশেষ ভাবে পর্যবেক্ষণের আওয়তায় রাখা হয়, স্কুল ও হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করা হয়। কিউবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের মার্কো নিতো খাদ্য পরিকল্পনা বিষয়ে বলেন :
“পরিকল্পনা করার সময় বিভিন্ন ভৌগলিক এলাকায় জনসংখ্যার ধরন বিশেষত জনসংখ্যার ঘনত্ব, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ, জমির উর্বরতা শক্তি ইত্যাদি বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়।”

ল্যাটিন আমেরিকায় সার্বভৌম কৃষি?
পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে জমির ব্যক্তিগত মালিকানা, কায়িক ও মানসিক শ্রমের বিভাজন এবং শ্রমের ফসলের বন্টন প্রক্রিয়ায় অবিচার ইত্যাদি খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সামাজিক বিপাকের বিচ্যুতি বা ফাটলকে আরও বড় করে তোলে।
কিউবার কৃষি মডেলটি সমবায়ের মাধ্যমে কৃষককে ভূমির সাথে পুনরায় সংযুক্ত করা, অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়া চালু করা এবং বিতরণ ব্যবস্থা বহুমুখীকরণের মাধ্যমে পদ্ধতিগত ভাবে এই সব বিচ্ছিন্নকারী উপাদানগুলোকে দূর করেছে। এই বাস্তুসংস্থানগত স্থায়িত্ব এবং সামাজিক সমতার নীতিকে কি কিউবার বাইরেও ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব?

কিউবার কৃষকরা এই ধরনের খাদ্য উৎপাদনের পদ্ধতিকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় দেশগুলোতে ভ্রমণ করছেন। বস্তুত বর্তমানে কিউবার সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল রপ্তানীখাত হলো ‘ধারণা’। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কৃষক এবং কৃষিবিদ কিউবার আতিথেয়তা গ্রহণ করছে। বর্তমানে কিউবার কৃষিবিদরা হাইতির কৃষকদের ট্রেনিং দিচ্ছে এবং ভেনিজুয়েলাকে তার ক্রমবর্ধমান শহুরে কৃষি আন্দোলনের ব্যাপারে সাহায্য করছে।

এই আইডিয়া বিতরণের কাজটি যে শুধুমাত্র কিউবার কৃষকরাই করছে, ব্যপারটি এমন নয়। সারা ল্যাটিন আমেরিকা জুড়েই ঐতিহ্যবাহী কৃষিব্যবস্থায় ফিরে যাওয়া এবং ভূমি সংস্কারের দাবীতে আন্দোলন জোরেশোরে শুরু হয়েছে। ২০০৫ সালের আগষ্টে ব্রাজিলের পানামায় ল্যাটিন আমেরিকান স্কুল অব এগ্রি-ইকোলজি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভূমিহীন শ্রমিক আন্দোলন (Movimento dos Trabalhadores sem Terra, MST) এবং ভায়া ক্যাম্পেসিনা (Via Campesina) এই দুটি সংগঠনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এই প্রতিষ্ঠানটি গ্রাম্য সম্প্রদায়ের মাঝে এগ্রি-ইকোলজি বা কৃষিবাস্তুবিদ্যার ধারণাটি ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে। MST এর সমন্বয়ক Robert Baggio এর মতে, এই প্রতিষ্ঠানটি এগ্রিইকোলজির ভিত্তিতে একটি নতুন ম্যাট্রিক্স তৈরী করবে, যেটি স্থানীয় বাজারের উপর নির্ভর করে পরিবেশের ভারসাম্য অক্ষুণ্ণ রেখে একটি সার্বভৌম কৃষিব্যবস্থা গড়ে তুলবে। (http://www.landaction.org)

এই প্রক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ার মধ্যদিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট উৎপাদকদের (Associated Producers) নিয়ে গঠিত মার্কসের কল্পনা করা সেই ভবিষ্যত সমাজের একটা ধারণা পাই। পুঁজির ভলিউম ৩ এ মার্কস লিখেছেন : “এক্ষেত্রে মুক্তি আসবে এভাবে: সামাজিকৃত মানুষ, সংশ্লিষ্ট উৎপাদকশ্রেণী মানবীয় বিপাকের অন্ধশক্তির নিয়ন্ত্রণে না থেকে মানবীয় বিপাককে প্রকৃতির সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে যৌক্তিক উপায়ে পরিচালনা করবে; আর এ প্রক্রিয়াটি সে সম্পন্ন করবে ন্যূনতম শক্তি ব্যয় করে এবং মানব প্রকৃতির সাথে খাপ খায় এমন শর্ত বজায় রেখে।”

যে মানসিক বাধা আমাদের এ ব্যাবস্থা বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখতে প্রতিবন্ধকতা তৈরী করে তা প্রচলিত কৃষিবাণিজ্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা এক হ্রস্ব দৃষ্টির ফলাফল, যে কৃষিবাণিজ্যের জগতে গবাদিপশু বনে চড়ে বেড়ায় না এবং কেঁচোর সহায়তায় ফসল ফলে না; যেখানে কৃষকেরা বিজ্ঞান চর্চা করে না এবং শ্রমিকেরা তাদের উৎপাদনের ভাগ পায়না; এবং যেখানে মুনাফার স্বার্থে পরিবেশ এবং সমাজের বিপাকীয় বিচ্যুতি বাড়তেই থাকে। কিউবার কৃষি আমাদেরকে দেখিয়ে দিচ্ছে যে বিপাকীয় ফাটল পূরণ করার সম্ভাবনাটি বাস্তব এবং এখনই সম্ভব।

মূল:
Healing the Rift: Metabolic Restoration in Cuban Agriculture
by Rebecca Clauson

http://www.monthlyreview.org/0507rc.htm