বাসুনকে, মা

 

লুনা শীরিন

 

পর্ব  ৩৯

 

 

বাসুন,

 

তোকে একটা কবিতার চারটে  লাইন বলি শোন—

 

        সবচেয়ে দুর্ধর্ষতম বীরত্বেরও ঘাড়ে একদিন মৃত্যুর থাপ্পড় পড়ে

          সবচেয়ে রক্তপায়ী  তলোয়ারও ভাংগে মরচে লেগে

         এই সত্য কথাটুকু কোন মেঘ, কোন নীল নক্ষত্রের আলো

         তোমাকে বলেনি বুঝি? —–

 

বাংলাভাষার শক্তিমান কবি পুর্ণেন্দু পত্রী লিখেছেনশূন্য ঘর বাবু, শুক্রবার রাত, তুই অন্য একটা পরিবারের সাথে একটু বেড়াতে বের হয়েছিস, এইমাত্র তোকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আমি বসলাম নিজের মুখোমুখি, কি লিখবো তোকে বাবু? ঘর আলো করে তুই থাকিস তবুও সময় সময় আমার মনে হয় একটু একা থাকবো, শুধুই আমি, শূন্য ঘরে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আমি গত সাতবছর ধরে বিশ্বাস করেছি, মানুষ মুলত একা খুব সংসারী মানুষকেও (কি ছেলে/ কি মেয়ে) আমি বলতে শুনেছি, ইস তোমার মতো করে যদি বাচঁতে পারতাম? হয়তো একঘেয়েমি জীবন থেকে মুক্তি পেতেই কথাটা বলে আবার এমনও হতে পারে বিশ্বাস থেকেই বলেবাবু পৃথিবীতে মনে হয় মানুষ একমাত্র প্রানী যে বদলায়, সকালে/বিকেলে/রাতে/দিনে প্রতিনিয়ত মানুষ বদলায় আমি সময় সময় অবাক হয়ে তোর ছোট শিশু মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, দীর্ঘক্ষন তাকিয়ে আমি বোঝার চেষ্টা করি আসলে কি আমি একজন মা তাকিয়ে আছি নাকি ভিন্ন মানুষ হয়ে তোর আর আমার জীবনের দর্শক হয়ে বেঁচে আছি?

 

আজ থেকে মাত্র ৪ বছর আগে কানাডায় আসার প্রস্তুতি যখন নিচ্ছিলাম তখন অনেকেই বলেছিলো আমি তোকে তোর বাবার কাছে রেখে আসতে পারি কিনা?কানাডায় একদেড় বছর একটু সেটেল করে তারপর তোকে নিয়ে আসতো পারিআমি সেদিন ভীষন আবাক হয়েছিলাম সবার কথা শুনে, মনে হয়েছিলো এতটাই কি কঠিন দেশ যে আমি আমার ছেলে নিয়ে টিকতেই পারবো না? হ্যাঁ বাবু, যারা কথাগুলো বলেছিলো তাদেরকে আমি কোন দোষ  দিচ্ছি না তারা হয়তো আমার সময়টাকে একটু সহজ করার জন্যই কথাটা বলেছিলো কারন এই দেশে আসার পর প্রতিমুহুর্তে আমার মনে হয়েছে, নতুন অভিবাসীদের  ভিতর যাদের সন্তানদের বয়স ১৩ বছরের  নীচে তাদের জন্য কাজ না করার সবচেয়ে বড় বাধা হলো পরিবার বা সন্তান এখনো জ্বলজ্বল করে মনে পড়ে, তোকে আর তোর সেজখালার বাচ্চাকে দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছিলাম আমি আসার ৭ দিনের মাথায়, একদিন কোথায় যেন দেখা করতে যাবো,কথাটা তোর সেজখালার কাছে বলতেই তোর খালা আমাকে বলল মেঝপা তুই যেখানে ইচ্ছে যা শুধু  বাচ্চাদুটোর (তোকে আর ওর বাচ্চাকে) দায়িত্ব তোকে নিতে হবে, খুব সংগত কারনেই  কথাটা তোর খালা বলতে পারে কারন ও তখন ফুলটাইম জব করতো আর আমিতো মাত্রই তোকে নিয়ে তোর খালার সেই ছোট্ট বাসায় উঠেছিলাম বল, দুটো বাচ্চার ফুলটাইম দেখাশোনা করা, তাদেরকে স্কুলে পাঠানো,সংসারের সব কাজ সামলে এই বিদেশ বিভুঁইএ কি,কোন কাজ করা সম্ভব? সেই কঠিন সময়ও আমি পার করেছি বাবু, তারপর তো তোর খালা আমেরিকা  চলে যাবার পর যেন আমি মহাসমুদ্রে পড়লাম এই তো মাত্র বছর তিনেক আগের কথা, তখন তুই আরো ছোট, আমার কাছে প্রথম দুটো বছর রাত/দিন সমান মনে হয়েছেসেদিনও দিনগুলো এমনই ছিলো বাবু, চোখের পলক ফেলার আগেই চারিদিকে শীত আর অন্ধকারে ভরে উঠতো শহরআজ তোকে নিয়ে এতটা পথ পাড়ি দেবার পরে মনে হচ্ছে, তোকে ছাড়া বাঁচতাম না কিছুতেই, কিছুতেই না স্বার্থটা তোর চাইতেও বেশী আমার, তুই আমার সাথে ছিলি বলেই প্রতিকুলতাকে আমি জয় করবার জন্য মরিয়া ছিলাম, তুই না থাকলে হয়তো ভেসে যেতো জীবনহ্যাঁ বাবু, সত্যি বলছি তোকে, আমার জীবন ভেসেই যেতো,আমি কোন কুল কিনারাই করতে পারতাম না সোনা ব্যক্তি নিজেই সবচেয়ে বেশী নিজেকে জানে, জানিস তো এই সত্যটাকত হাতছানি, কত প্রলোভন, কত কামনা/বাসনার দোলাচলে এই ছোট জীবন, কেউই এর বাইরে নাকিন্তু বাবু, ওই যে সত্য তোকে লেখার প্রথমে বললাম –”সবচেয়ে দুর্ধর্ষতম বীর আর সবচেয়ে রক্তপায়ী তলোয়ার  সবার ঘাড়েই মৃত্যু আছে  তাই তোকে নিয়ে বয়ে যাওয়া এই জীবনে আমার কোন আক্ষেপ নেই হ্যাঁ থাকতো, জীবনের অনেকটা সময় ধরে যদি যথেচ্ছার জীবনযাপনের স্বাদ আমার না থাকতো বাবু, একটা কথা তোকে বলে রাখা দরকার, পাছে তুই ভাবিস যে শুধু তোর জন্যই  আমি সন্নাস জীবন যাপন করছি না সোনা, আমার আজকের এই জীবন আমার স্বাধীন  ইচ্ছে থেকে বেছে নেয়া সিদ্ধান্ত, এখানে কারো কোন দায়ভার নেই, এমনকি তোর ও না

 

তোকে  লিখতে লিখতে কখন চোখ ঝাপসা হয়ে উঠেছে টের পাইনিআজ আর না, অনেক কথা বলে ফেললাম আমার এই শূন্য সময়কে আশ্রয় করে ছোট একটা কাজের কথা বলে শেষ করবো, গত সংখ্যায় দেখেছি মুক্তমনা একটু ভিন্ন আংগিকে লেখাটা পরিবেশন করেছে যেখানে পাঠকের মতামত জানাবার সুযোগ আছেউদ্যোগটা প্রশংসনীয়, আমরা যারাই এই ধরনের লেখালেখির সাথে জড়িয়ে আছি সবাই কাজটা ভালোবেসে করে বলেই  আমার বিশ্বাস — উসাহ বা সঠিক সমালোচনা আমাদের কাজকে ও উদ্যোক্তাদের আয়োজনকে আরো শক্তি দেবেমুক্তমনার পাঠক ও আয়োজকদের নিরন্তর অভিনন্দন

 

তোর মা ,

১৪ই নভেম্বর, ২০০৮