৩১ আগস্ট ২০১২। নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যার পাচ নম্বর ঘাট। সন্ধ্যায় জলের প্রতিফলনে চাদের আলো কেমন যেন প্রাচীন আবেশ ছড়াচ্ছে, ভাবতে ইচ্ছে করে ঈজিয়ান সাগরের উপকূল। হাজার হাজার মানুষের উৎসব মূখর আনাগোনা। সেদিন ছিল ব্লু মুন : নীল জোছনায় অবগাহন, এক মহাজাগতিক উৎসব। ডিসকাশন প্রজেক্ট এর নদীর বাকে বাকে অনুষ্ঠানের একটি পর্ব। উৎসর্গ করা হয়েছিল সদ্য প্রয়াত চন্দ্রপদার্পনকারী নীল আর্মস্ট্রংকে যিনি চাদে পদার্পনের সময় বলেছিলেন পদক্ষেপটা একজন মানুষের জন্য ছোট, কিন্তু মানবজাতির জন্য বিশাল। আর আমি দেখেছিলাম প্রাচিন কেনিয়ার ওমা নদী থেকে যাত্রা করা সেই পাচ বছরের শিশুটি ২০ লাখ বছরের অভিযাত্রায় এখন কিশোর, শিশুটির প্রতিনিধিত্বকারী এই মানবজাতি এক প্রাযুক্তিক বয়সন্ধিকালে উপনীত।
শীতলক্ষ্যার নদীর ঘাটে একদিকে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে চাদে পদার্পনের ডকুমেন্টারি দেখানো হচ্ছে, পাশেই গাণবাজনা, কবিতা আবৃত্তি আর একদিকে চলছে বিজ্ঞান আলোচনা অনুষ্ঠান। আয়োজকরা শিশু-কিশোর নারী-পুরুষকে চাদ দেখানোর কথা বললেও টেলিস্কাপে আকাশটাই দেখানোর চেষ্টা করছে; আকাশের পর মহাকাশ তার মহাজাগতিক ব্যাপ্তি| কখনো কখনো আগত দর্শক, বিশেষত কিছু শিশু, এমন দৃষ্টি মেলে তাকাচ্ছে যেন নিজের ভিতরটা কেপে ওঠে। এই চন্দ্রালোকিত রাতেও অদ্ভুত সব ভাবনা ঘিরে ধরে। জানতে ইচ্ছে করে শিশুরা আসলে কী দেখছে? ওকে আসলে কী দেখাতে চাচ্ছে, অথবা ওর শৈশবের মানসেই-বা কীভাবে তা প্রতিভাত হচ্ছে?
জানতে ইচ্ছে করে শিশুটি আসলে কী বলতে চাইছে? বর্তমানের শিশুতো ভবিষ্যতের মানুষ, সেখানে তার কর্মকাণ্ডের ভূমিকা কিভাবে রাখবে? এটাই চিন্তা করছে? কোন সূদুরে তার দৃষ্টি? কিছু কি দেখতে চাইছে বা ভাবছে? অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে চিন্তিত হয়ে পড়ছে? না, অনাবিল ভবিষ্যতের সন্ধান করছে? রাজা, মহারাজা, নেতানেতৃত্ব, উচ্চপদস্থ হওয়া, ক্ষমতালোভ এইসব কাঠামো থেকে কি বের হয়ে আসবে পৃথিবী? সবাইকে হারিয়ে সামনের দিকে যাবে? না, সবার একজন হয়ে প্রসারমান বিশ্বকে উম্মাচন করবে, বিন্দু আর প্রান্তের একীভূত এক জীবযাপনের দিকে অগ্রসর হতে পারবে?
শিশুটি কী জানতো আগত ভয়াবহ মহামারীর পথে এই পৃথিবী। এখন সে কিশোর। তার মুখোমুখি হওয়ার কথা ছিল একটি বয়সন্ধিকালের, কৈশরের বয়সন্ধকাল বা বলা যায় বায়োলজিক্যাল অ্যাডলোসেন্স: কৈশরে শিশুরা শারীরিকভাবে নতুন এমন কিছু অনুভব করে, অঙ্গপ্রতঙ্গ বিকশিত হয়; তখন সেই কিশোরটি সঠিক নির্দেশনা বা পরিপকক্কতা ছাড়া মারাত্মক ভুল করে ফেলার বা বিপর্যয় ঘটিয়ে ফেলার সম্ভাবনা থাকে, অবশ্য নতুন যেকোন কিছুর ক্ষেত্রে কিছুটা এই সম্ভাবনা থাকে।
শিশুটির চোখগুলোর দিকে তাকান, কী উৎকন্ঠা? আমি একটা প্রতিবেদন পড়েছিলাম, যার মূল কথা ছিল শিশুর কান্নায় বিপর্যয় বা যুদ্ধের আশংকার আভাস। শতাব্দী আরম্ভ হওয়ার আগেই মার্টিন রিজ তার ‘আওয়ার ফাইনাল সেঞ্চুরি’ গ্রন্থে , ডেভিদ কোয়েম্যান তার স্পিলওভার (অ্যানিমেল ইনফেকশন এন্ড নেক্সট পেনডামিক ২০১৫) গ্রন্থে আগত এই মহামারির সম্ভাবনার কথা বলেছেন, হিসেব করেই বলেছেন; আরো নিশ্চয় অনেকে বলেছেন। তাতে মানব সভ্যতা কোন প্রস্তুতিই নেয়নি; উন্নয়নের কোনো কাঠামোই তা বলে না: সে উন্নত বা, অন-উন্নত যে বিশ্বই হোক।
সতিই ভয়াবহ মহামারীর পথে আজ এই পৃথিবী। এ্ই শিশুটি যে বর্তমানে কিশোর। দুটো বিপদের মুখোমুখি। একটা আরেকটিকে যেন ত্বরন্বায়িত করছে। অথচ তার মুখোমুখি হওয়ার কথা ছিল একটির, কৈশরের বয়সন্ধিকাল বা বলা যায় বায়োলজিক্যাল অ্যাডলোসেন্স।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে : প্রাযুক্তিক বয়সন্ধকাল বা টেকনোলজিক্যাল অ্যাডলোসেন্স। একটা সমাজ, রাস্ট্র, সভ্যতা সংস্কৃতি প্রস্তুত হওয়ার অনেক আগেই স্মার্ট ডিভাইস বা অতি প্রাযুক্তিক সুবিধাগুলো মানুষের হাতে চলে যাওয়া, তার উপর সেটা যদি কিশোরদের শিক্ষার ক্ষেত্রে বৈধতা পায় তা আমাদের কল্পনার চেয়েও মারাত্মক বিপদ নিয়ে হাজির হতে পারে; যার ভয়ে গত শতাব্দী জুড়ে বহু চিন্তাবিদ আহাজারি করে বেড়িয়েছে: জগদীশচন্দ্র বসু ও রবীণ্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকৃতঘনিষ্ট হওয়ার কথা বলেছিলেন বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে, কিন্তু মানুষতো নিজেই প্রকৃতি, তাহলে প্রকৃতিঘনিষ্টের মানে কি?
আমার মনে হয় তারা ইকোলিজিক্যাল ভারসাম্যের কথা বলেছিলেন; অবশ্য এখানে প্রাচীন একটি প্রশ্নের অবতারণা করা যেতে পারে: গ্রিক সফিস্ট প্রটোগোরাস বলেছিলেন, প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে বিপরীতধর্মী ভাব বিদ্যমান থাকে তাহলে বিশ্ব প্রকৃতিতে মানুষের অবস্থান কোথায়?
আইনস্টাইন বিশ্বমেলা-১৯৩৯ দেখে তার আইডিয়াস এন্ড ওপিনিয়ন গ্রন্থের “টাইম ক্যাপসুলে’ বার্তা” প্রবন্ধে একটা সতর্কবার্তা যুক্ত করলেন প্রাযুক্তিক উন্নতির ব্যাপারে; উপন্যাসিক ও বিজ্ঞানী সিপি স্নো’র ‘দ্য টু কালচার’ বক্তৃতায় (১৯৫৯) এ বিষয়ে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি বলতে চাইছিলেন বিজ্ঞান এবং মানবতা যে-মানুষের বৌদ্ধিক জীবন” উপস্থাপন করে তা “দুটি সংস্কৃতিতে” বিভক্ত হয়ে পড়েছে, যা সমাজের ইনটিগ্রেটি বা অখন্ডতাকে নষ্ট করে চলেছে, এক ভারসাম্যহীন সভ্যতার সূচনা ঘটাচ্ছে।আমার কাছে মনে হচ্ছে, শিকারী সময়ের যে একাকিত্ব মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতো তাকে আমরা আবার ডেকে আনছি। অথচ আমরা বলে বেড়াচ্ছি, এতসব আয়োজন, প্রাযুক্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থা একাকীত্ব ঘোচানোর জন্য।
স্যামুইলোভিচ স্কলোভস্কি, নিকোলাই কার্দেশেভ হয়ে কার্ল সাগান সমস্যাটিকে সেল্ফ ডেস্ট্রাকটিভ কন্ডিশন বা আত্মধ্বংস হিসেবে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করলেন: আর তাহলো প্রাযুক্তিক বয়সন্ধিকাল; ফ্রাংক ড্রেক থেকে ফ্রিম্যান ডাইসন সবাই বললেন ওই একই কথা। শুধুই ব্যবসার জন্য, শুধুই কে-কার থেকে লাভে এগিয়ে থাকার জন্য এই ভারসাম্যহীন প্রাযুক্তিক সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছে – প্রাযুক্তিক আত্মধ্বংস। আর যারা এর উদগাতা তারা নিজেদের সম্পদের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলেছে, ভয়ানকভাবে পুজিকেন্দ্রিভূত করছে; আবার তারা জ্ঞানভিত্তিক সমাজের কথা বলে চলেছে।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, ডিজিটাল টেকনোলজি প্রকৃতিগতভাবে কালেক্টিভ পার্টিসিপেশন ও কালেক্টিভ নলেজের কথা বলে, অথচ ঘটে চলেছে চরম কেন্দ্রীভবন, কী বৈপরীত্য! সহনশীলতা, নমনীয়তা উধাও হয়ে যাচ্ছে। এগুলো মারাত্মকভাবে সাংস্কৃতিক সংকটের দিকে নিয়ে গেছে, আমরা সাংস্কৃতিক সংঘাতের দিকে অগ্রসর হচ্ছি।
একটা সভ্যতার সবচেয়ে বিপদজনক সময় বা বাচা-মরার সন্ধিক্ষণ হচ্ছে এই প্রাযুক্তিক বয়সন্ধিকাল। কার্ল সাগান সেই আশির দশকে এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাক্টিকা, হু স্পিক ফর আর্থ প্রবন্ধে সমস্যাটিকে আরো নির্দিষ্ট করলেন। ফ্রাংক ড্রেক উদ্ভাবিত ড্রেক সমীকরণ ব্যবহার করে একটি হিসেব কষলেন বিজ্ঞানীরা, তাতে বললেন প্রতি শতাব্দীতে ষাট শতাংশ সভ্যতা শুধু এ কারণেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। মানে দাড়াচ্ছে ১০০ টি পৃথিবীর মতো সভ্যতার মধ্যে ৬০ টি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এটাই মারাত্মক আশংকার কথা বা সংখ্যা।
তাহলে সিলেবাস শেষ করানোর জন্য প্রাযুক্তিক বয়ঃসন্ধিকালের দিকে ঠেলে দিয়ে কি লাভ? শিক্ষার মূল কথা মানুষ না ব্যবসার হাতিয়ার তৈরি? এই শিশুরাই কি হবে অসহনশীল, নির্বিকার, লাভক্ষতি হিসাব সর্বস্ব ভবিষ্যতের মানুষ, ব্যবসার গুটি। অবয়বগতভাবে মানুষ হলেও মানবিকতার কোন চিহ্ন থাকবে না? গ্রাস করবে অসহনশীলতা, অনমনীয়তা।
তাহলে ৩০ লাখ বছরের মানুষের তিল তিল করে উঠে আসা আর মহাবিশ্বে নিজেকে অনুধাবন করার কী হবে?
রচনাকাল: ৮ জুন ২০২১ – ১৭ জুন ২০২১
Leave A Comment