ভূমিকাঃ আধুনিক বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রধান ও জনপ্রিয় প্রক্রিয়া হচ্ছে নির্বাচন। কিন্তু নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হবে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, অন্তত বাংলাদেশের মত সদা সংঘাতময়, অসহিষ্ঞু, অবিশ্বাসের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বাস্তবতার দেশে। আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংঘাত ও অস্থিরতার একটি প্রধান কারণ হচ্ছে বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থা। এমনটা বলার কারণ হচ্ছে, বিভিন্ন সময় নির্বাচনে, ভারসাম্যহীন ফলাফলের কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস তৈরী হয়। যা পরবর্তিতে সহিংসতায় রুপ নেয় এবং রাজনৈতিক অচলাবস্থার সৃষ্টি করে।

খুব দূরের কথা নয়, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেশে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, সেই সংকট, দূর্ভোগ, যন্ত্রনা জাতির কোনভাবেই প্রাপ্য ছিল না। সেটা ছিল ক্ষমতাসীনদের তৈরী করা এক কৃত্তিম সংকট। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বা গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের যে দাবী সেই আকাঙ্খা পূরণ হলেই কি’ এই সমস্যার সমাধান হবে? আমার যুক্তিবোধ ও বিবেচনা তা বলে না। এই সমস্যার কারণ আরও গভীরে। ‘তার মূলে হাত না দিলে’ এই পরিস্থিতি আবার তৈরী হবে, এটা ইতিহাস প্রমানিত সত্য। বর্তমান অস্থিতিশীলতা ও কবরের নিরবতাও হয়তো, কিছু মূল্য দিয়ে একদিন অতিক্রম করা যাবে, কিন্তু তারপর..? আবারও লাশের যোগান? হ্যাঁ আমাদের রাজনৈতিক ধারা ও বৈশিষ্ট সে কথাই বলে। এই সমস্যার তাৎক্ষনিক ও খন্ডিত সমাধান এই বাস্তবতার দীর্ঘ মেয়াদে কোন সমাধান দেবে না। তাই জোড়াতালি বা বোঝাপড়া আপাত উপসমের একটি পথ হলেও, একই সাথে পরবর্তি সংঘাতের বীজও বপন করা হবে!

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের নির্বাচনকেন্দ্রীক এই সমস্যার সমাধানে নির্বাচন কমিশনে রদবদল নয়, আইনী সংস্কার নয় এমন কি ‘নির্বাচন সহায়ক সরকার’ নয়, প্রয়োজন প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। দরকার সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী (Proportional Representative) ব্যবস্থার। কেন এই ব্যবস্থা অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়ের দাবী, এই লেখা সেই আলোচনারই সূত্রপাত।

বাংলাদেশের বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থার একটি পর্যালোচনা

তত্ত্বগতভাবে আমরা জানি যে নির্বাচন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া-ব্যবস্থা যেখানে নাগরিকরা ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে কোন প্রার্থীকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করে। বর্তমান ব্যবস্থায় আসন/অঞ্চল (কনস্টিটুয়েন্সি) ভিত্তিতে ‘অনেক প্রার্থীর মধ্যে যে সবচেয়ে এগিয়ে থাকবে সে জয়ী হবে’ (First Past The Post-FPTP)। প্রচলিত FPTP ব্যবস্থায় সংসদে প্রাপ্ত আসনের সাথে- মোট প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতের কোনো সামঞ্জস্য থাকে না। ২০০১ সালের নির্বাচনের ফলাফলের দিকে নজর দিলে দেখা যায় যে, ৪০.২১ ভোট পেয়েও আওয়ামী লীগ আসন পেয়েছে মাত্র ৬২টি, অর্থাৎ ২১ শতাংশ আসন। আর বিএনপি-জামায়াত জোট ৪৫.১৫ শতাংশ ভোট পেয়ে আসন পেয়েছে ২০৮টি, অর্থাৎ ৬৯ শতাংশ আসন। এখানে বিএনপি মাত্র ৪.৯৪ শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে আসন পেয়েছে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত আসনের চেয়ে ১৪৬টি বেশি আসন, অর্থাৎ ২৩৫ শতাংশ বেশি আসন। এই হিসেবই বলে দেয় যে FPTP ব্যবস্থায় জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে না। এই ব্যবস্থায় একটি নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকার আসনের ক্ষেত্রেও প্রকৃত জনমতের একই ধরনের অন্যায্য প্রতিফলন ঘটতে পারে। যেমন ধরা যাক যে, একটি আসনে ৫ জন প্রার্থীর মধ্যে যদি তারা যথাক্রমে ২৭%, ২৬%, ২১%, ১৭% ও ৯% করে ভোট পায় তাহলে যিনি ২৭% ভোট পেয়েছেন তিনিই নির্বাচিত হবেন এবং ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধি’ হিসাবে গণ্য হবেন। যদিও তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোট মোটেও পাননি। মানে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের হিসেবে তিনি অন্তত প্রদত্ত ভোটের ৫১ শতাংশ পাননি। এই ব্যবস্থায় একটি দল ৩০০টি আসনে প্রার্থী দিয়ে প্রত্যেকটিতে ২০ শতাংশ করে ভোট পেয়েও (মোট ভোটের ২০ ভাগ) একটি আসনও না পেতে পারেন। অন্যদিকে প্রধান দু’টি দল গড়ে ৪১% ও ৩৯% করে ভোট পেয়ে সবগুলো আসন পেয়ে যেতে পারে। সঙ্গতই এই ব্যবস্থা মোটেও জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন নিশ্চিত করে না।

বর্তমান সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তারমধ্যে একটা বড় ধরণের ভাওতাবাজি আছে, যা আমরা অনেকেই জানি। আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠ তখনই বলা যাবে যখন ১০০ জনের মধ্যে অন্তত ৫১ জন কারো পক্ষে থাকবে বা সমর্থন করবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ শব্দের মানে হচ্ছে অধিকাংশ বা বেশিরভাগ কোন কিছু। অংঙ্ক, বিজ্ঞান, যুক্তি, তত্ত্ব সব জ্ঞানই তাই বলে। প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে কেন আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থায় এইঅদ্ভুদ সংখ্যাগরিষ্টতার সংজ্ঞাবিদ্যমান এবং তা যুগ যুগ ধরে অব্যাহত আছে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর রহস্যময় উদাসীনতা ও নির্বাচনের সংকীর্ণ রাজনৈতিক সমীকরণের কারনেই তা টিকে আছে। কিন্তু এই ভাবে জনগণকেপ্রকৃত গণতান্ত্রের সাধথেকে বঞ্চিত করা এবং তাদের সাথেভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতার নামেপ্রতারণা করা গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। তত্ত্ব ও বাস্তবতার মধ্যে যদি সংযোগ ঘটানো না যায় তাহলে তার পরিণতি কি হয়, বর্তমান পরিস্থিতিই এর একটি বড় প্রমান।

গত ৪টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল তার বিশ্লেষণ

এবার দেখা যাক বিগত ৪ টি জাতীয় সংসদ (৬ষ্ঠ থেকে ৯ম) নির্বাচনের ফলাফল ও তার একটি পর্যালোচনা। এই ৪টি জাতীয় সংসদকে বেছে নেয়া হয়েছে কারন, এই নির্বাচন গুলো কোন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়নি, তা হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। যাকে আমাদের নির্বাচনের মানদন্ডে সবথেকে গ্রহনযোগ্য বলা হয়।

নিচের ফিগারঃ দেখা যাচ্ছে,

১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি পেয়েছিল প্রদত্ত ভোটের ৩০.৮ শতাংশ, আর আসন পেয়েছিল ১৪০টি। এবং আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৩০.১ শতাংশ ভোট, আর আসন পেয়েছিল ৮৮টি।

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৩৭.৪ শতাংশ ভোট, আর আসনের সংখ্যা ছিল ১৪৬টি। এবং বিএনপি পেয়েছিল ৩৩.৬ শতাংশ ভোট আর আসন সংখ্যা ছিল ১১৬টি।

২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি পেয়েছিল ৪০.৪১ শতাংশ ভোট এবং আসন সংখ্যা ছিল ১৯৩টি। আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪০.০২ শতাংশ ভোট এবং আসন সংখ্যা ছিল ৬২টি।

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৪৯.০ শতাংশ ভোট, আর আসন সংখ্যা ছিল ২৩০টি। এবং বিএনপি পেয়েছিল ৩৩.২ শতাংশ ভোট, আর আসন সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০টি।

ফিগারঃ , বিগত ৪ টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র ভোটের শতাংশ ও প্রাপ্ত আসনের তুলনামুলক চিত্র-

উপরের আলোচনায় দেখা গেল, গত ৪টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র ভোটের শতাংশ ও প্রাপ্ত আসনের তুলনামূলক চিত্র। এবার হিসেবটা একটু অন্যভাবে করা যাক, যদি বাংলাদেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা থাকতো, তাহলে এই চিত্রটা কেমন হতো?

লক্ষ্য করুণ ফিগারঃ ,

ভোটের শতাংশের ভিত্তিতে আসন নির্ধারিত হলে কোন দল কতগুলো আসন পেত। প্রদত্ত সকল ভোটকে একটি ইউনিট হিসেবে ধরে, বিষয়টির একটি তুলনামূলক পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষন-চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রদত্ত ভোটকে ১০০ শতাংশ ধরে হিসেবটা করতে হবে। যেহেতু আসন সংখ্যা ৩০০ তার মানে (১০০x৩=৩০০) এক্ষেত্রে প্রাপ্ত ভোটের হারকে তিনগুণ ধরে আসন নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রাপ্ত ভোটের শতাংশের হিসেবে, কোন দল আসলে কতগুলো করে আসন পেত, তার চিত্রটি দেখুন!

১৯৯১ সালের ভোটের হিসেবে বিএনপি প্রাপ্ত ভোট ছিল ৩০.৮ শতাংশ, সেই অনুযায়ী তারা আসন পেত ৯৩টি। এবং আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছিল ৩০.১ শতাংশ, সেই অনুযায়ী তারা আসন পেত ৯০টি।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৩৭.৪ শতাংশ, সেই হিসেবে আওয়ামী লীগ আসন পেত ১১৩টি। আর বিএনপি’র ভোট ছিল ৩৩.৬ শতাংশ সেই হিসেবে তারা আসন পেত ১০১টি।

২০০১ সালে বিএনপি প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪১.৪১ শতাংশ, সেই অনুযায়ী বিএনপি আসন পেত ১২৪টি। আর আওয়ামী লীগের ভোট ছিল ৪০.১ শতাংশ সেই অনুযায়ী তারা আসন পেত ১২০টি।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪৯.০ শতাংশ সেই হিসেব আওয়ামী লীগ আসন পেত ১৪৭টি। এবং বিএনপি পেয়েছিল ৩২.২ শতাংশ ভোট, সেই হিসেবে আসন পেত ৯৯টি।

ফিগার , বিগত ৪ টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ অনুযায়ী সম্ভাব্য প্রাপ্য আসনের তুলনামুলক চিত্র

ভোট ও আসনের হিসেবের এই যে অন্যায্য গড়মিল এটাই এই নির্বাচনী ব্যবস্থার একটি মারাত্মক ত্রুটি। এই প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে কোনভাবেই জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটে না। যার জন্য এই নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার ও পরিবর্তন জরুরী। বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থার পরিবর্তন বা সংস্কার করে যদি ‘সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি’ (Proportional Representation-PR) চালু করা যায় তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি গুনগত পরিবর্তন ঘটবে।

সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন কি?

সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধি নির্বাচন বলতে এমন একটি ধারনা কে বুঝায়, যেখানে কোন দল জাতীয় ভিত্তিক নির্বাচনে, বিশেষ করে সাংবিধানিক গণতানন্ত্রিক ধারায় কত শতাংশ ভোট পেল তার ভিত্তিতে সংসদে তাদের আসন ও অবস্থান নির্ধারিত হবে। যেমন কোন নির্বাচনে কোন দল (গ্রুপ বা ব্যক্তি) প্রদত্ত ভোটের ৩০ শতাংশ পেল তাহলে ধরে নিতে হবে সেই দল সংসদের ৩০ শতাংশ আসন অর্জন করবে। এই ব্যবস্থায় পার্টির কর্মসূচী অধিক গুরুত্বপায় এবং পার্টিই নির্বাচনের প্রান হিসেবে কাজ করে। সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধি নির্বাচন ব্যবস্থা প্রধানত দুই ভাবে হতে পারে একটি হচ্ছে দলভিত্তিক আরেকটি হচ্ছে ব্যক্তিভিত্তিক। দলভিত্তিক নির্বাচনে সেখানে কোন দলীয় প্রার্থী নির্বাচন করবে না, নির্বাচন করবে দল ও তাদের কর্মসূচী। এবং নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের হার অনুযায়ী দল সংসদে তাদের প্রতিনিধি নির্ধারণ করবে। আবার ব্যক্তি ভিত্তিক নির্বাচনে, দল পূর্বেই তাদের মনোনীত প্রতিনিধিদের নাম প্রকাশ করবে তারপর আঞ্চলিক ও জাতীয় ভিত্তিক প্রদত্ত ভোটের হার/শতাংশ অনুযায়ী দল তাদের প্রতিনিধি নিশ্চিত করবে। যেমন নেদারল্যান্ডে দল ভিত্তিক এবং স্পেইনে ব্যক্তি ভিত্তিক সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধি নির্বাচনী ব্যবস্থা বিদ্যমান। বিশ্বের প্রায় ৫০টির অধিক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে এই ব্যবস্থা প্রচলিত। আবার অনেক দেশে দুই ব্যবস্থার (PR-FPTP) সংমিশ্রনও আছে। বাংলাদেশ একটি নীতিমালার ভিত্তিতে দুই পদ্ধতিই অনুসরণ করা যেতে পারে। অনেক দেশে উভয় পদ্ধতিই আধাআধি (PR ৫০%-FPTP ৫০%) অনুসরণ করা হয়। একই সাথে জাতীয় ও দলীয় ভিত্তিক ভোটের হার অনুযায়ী একটি নীতিমালার ভিত্তিতে মহিলাদের আসনও এর সাথে যুক্ত হতে পারে। প্রথমে নীতিগত সিন্ধান্ত নিতে হবে, PR ব্যবস্থা সাধারণভাবে প্রবর্তন করার। প্রায় দুইশো বছর ব্রিটিশের অধীনে থাকার কারণে মানুষের কাছে এই ব্যবস্থা অধিক পরিচিত এবং অনেকের ধারণা এই পদ্ধতিই পশ্চিমা গণতন্ত্রের সব দেশে অনুসরণ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে তা না, ইউরোপের প্রায় সব দেশে, দক্ষিণ আমেরিকার বেশিরভাগ দেশে, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, পার্শ্ববর্তী শ্রীলঙ্কা, নেপালে এই ব্যবস্থা চালু আছে।

কেন বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থার পরিবর্তন সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি দরকার

গত ৪ টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় সরকার ও বিরোধী দলের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাত খুব কাছাকাছি থাকলেও আসন সংখ্যার ব্যবধান অনেক বেশি (ফিগার ১ ও ২)। যে কারণে অগ্রাহ্য হচ্ছে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর প্রকৃত ইচ্ছা ও মতামত। এই ব্যবস্থায় সরকারী দল সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে-কারণে একটি মীমাংসিত বিষয়কে সহজেই বাতিল বা প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। যার ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয়েছে অনেক জটিল ও ভয়াবহ পরিস্থিতির। একই ভাবে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংকট তা যতটা না জনস্বার্থ কেন্দ্রীক, তার চেয়ে অনেক বেশি দল ক্ষমতাকেন্দ্রীক। আর এই বিবেচনায় বর্তমান পরিস্থিতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুর চেয়ে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থার দাবী উত্থাপন করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ জরুরী। কারণ বিগত ৪টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছিল, তাকে কি দেশের রাজনৈতিক সংকট কিছুটা কমেছে? তা ক্ষমতা বদলের আপত প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করেছে মাত্র। দীর্ঘ মেয়াদে একটি ব্যবস্থাকে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে কতিপয় নাগরিক ও আমলার উপর নির্ভর কোনভাবেই রাজনীতিকদের জন্য সন্মান ও নিরাপদ যেমন নয়। তেমনি সহায়ক ও সমর্থন যোগ্যও নয়। সম্পুর্ন স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন ও সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থাই দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানের প্রধান উপায় হতে পারে।

বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক ধারা ও বৈশিষ্ট্য তাতে এই ব্যবস্থা কার্যকরা করা গেলে অনৈক্য ও উত্তেজনাকর পরিস্থিতি অনেকাংশে কমবে। ক্ষমতাসীন দল সব সময় জনগনের ভোটের্ অজুহাতে, (সরকার ও বিরোধী দলের ভোটের শতাংশ যাই হোক) তাদের যে কোন কর্মকান্ড ও সিদ্ধান্ত দেশ ও জনগনের স্বার্থ ও কল্যানের পক্ষে বিবেচনায় নাগরিকদের তা মেনে নিতে বাধ্য করে। আর এই ব্যবস্থা কার্যকর করা গেলে এই ধরনের কর্মকান্ড ও মানসিকতা বাধাগ্রস্থ হবে। কারন তখন সরকার ও ক্ষমতাসীনদের সংসদে অবস্থান নির্ধারিত হবে ভোটের শতাংশের ভিত্তিতে। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৯ শতাশং ভোট পেয়ে সংসদের ৯০ শতাংশের কর্তৃত্ব পেয়েছে! একই ঘটনা ঘটতে পারে বর্তমান বিরোধীদের ক্ষেত্রেও! সেটা কি আরও বড় বিপদ ডেকে আনবে না? তাহলে কেন আমরা সমস্যার মূলে হাত না দিয়ে এই সংকটকে দীর্ঘ করছি? এই মুহুর্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হচ্ছে অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচনী ব্যবস্থা, প্রাতিষ্ঠানিক কর্তৃত্ব ও ধারাবাহিক ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নটি। তাকে পাশ কাটিয়ে কেবল বর্তমান ধারায় ভোট উৎসব ও ক্ষমতায় যাওয়ার নিশ্চয়তা তৈরী করা তাক্ষনিক চিকিৎসার কোরামিন হলেও সমস্যার দীর্ঘ মেয়াদী ও স্থায়ী সমাধান হবেনা।

সংবিধানের ৭০ () ধারা অনুযায়ী নির্দিষ্ট কনস্টিটুয়েন্সির ভোটারদের ভোটে নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও কোনো সংসদ সদস্য দলের সিদ্ধান্ত অনুসারে ভোট না দিলে বা তার বিরুদ্ধে ভোট দিলে সংসদ সদস্য পদ হারাবেন। এর মানে, প্রত্যেক সংসদ সদস্য শেষ বিচারে দলের সিদ্ধান্তের অধীন। কনস্টিটুয়েন্সির ভোটারদের মতামতের প্রতি দায়বদ্ধতার ঊর্ধ্বেদলের সিদ্ধান্তের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা। পাকিস্তানি আমলে ‘ফ্লোর ক্রসিং’-এর মাধ্যমে সরকারকে অস্থিতিশীল করার কারসাজির অভিজ্ঞতা থেকে এরকম অবস্থা পরিহার করার উদ্দেশ্যে এই বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সরকারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য যদি দলীয় আনুগত্যকে প্রাধান্য দিতেই হয়, তাহলে তার সাথে কনস্টিটুয়েন্সি ভিত্তিক FPTP ব্যবস্থা কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সরকারের স্থিতিশীলতার প্রয়োজনে দলের প্রতি আনুগত্যকে যদি সর্বোচ্চ স্থান দিতেই হয় তা হলে PR ব্যবস্থাই তার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

নির্বাচনী ব্যবস্থার পরিবর্তনে কি সুবিধা হবে

১. এতে প্রদত্ত ভোটের হার অনুযায়ী আসন বন্টন হবে এবং ভোটের যথার্থ মূল্যায়ন হবে

২. জনমতের মতামতের প্রকৃত প্রতিফলন ও মূল্যায়ন ঘটবে

৩. নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দলগুলোর জনমত ও জনগণের প্রতি অধিক দ্বায়বদ্ধতা তৈরী হবে

৪. রাজনীতি হবে অধিক জনমূখী ও কর্মসূচী কেন্দ্রীক

৫. ব্যক্তি, নেতা ও পরিবার কেন্দ্রীক রাজনীতির বিপরীতে যৌথ নেতৃত্বের চর্চা ও গুরুত্ব বাড়বে

৬. সংসদে কোন বিল পাশ করতে হলে অন্যান্য দলের অংশগ্রহন ও মতামতের গুরুত্ব পাবে এবং সংসদে পারস্পারিক সমঝোতা ও সহযোগিতার ভাব বৃদ্ধি পাবে

৭. গণতন্ত্র ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী যে কোন কর্মকান্ড বাধার সন্মুখীন হবে

৮. দলীয় সংকীর্ণতার মনোভাব, রাজনৈতিক অচলাবস্থা, সমস্যা-সংকট, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের পরিমান কমে আসবে

৯. কোন রাজনৈতিক দলের স্বৈরাচারী মনোভাবাপন্ন হবার সুযোগ কমবে

১০. জাতীয় স্বার্থে ঐক্যমতের পরিবেশ তৈরী হবে

১১. নির্বাচনে পেশিশক্তি ও টাকার খেলা বন্ধ হবে

১২. এই ব্যবস্থায় বড় দলগুলোর বাইরেও অনেক ছোট ও বিকাশমান দল সুযোগ পাবে সরকারে অংশগ্রহন করার

১৩. এতে গণতন্ত্রের ভিত্তি প্রসারিত ও রাজনীতিতে প্রকৃত বহুদলয়ীয় গণতন্ত্রের চর্চা হবে

১৪. রাজনীতিতে নীতি ও আদর্শ চর্চা বাড়বে প্রভৃতি

১৫. দল তাদের অধিকতর সৎ, শিক্ষিত, দক্ষ, যোগ্য, অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে সংসদে পাঠাবে ফলে সংসদের মান, পরিবেশ ও কার্যক্রম উন্নত হবে।

নির্বাচনকালীন সরকার না সংখানুপাতিক নির্বাচন, কোনটি জরুরী?

আলোচনার শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জন্য নির্বাচনকালীন সরকারের চেয়ে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা কার্যকর করা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। সামগ্রিক বিশ্লেষণে বলা যায় এই ব্যবস্থা কার্যকর করা গেলে বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পরিবেশ তৈরী হবে। রাজনৈতিক বোঝাপড়ায় গ্রহনযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তা আপাত স্বস্তির হলেও- দীর্ঘমেয়াদে কোন সমাধান দেবেনা। বিগত ৪টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যার কোন সমাধান হয়নি।

FPTP পদ্ধতিতে ভোটের অতি সামান্য ভোটের ব্যবধান ফলাফল কেমন ওলটপালট হয়, পাশের দেশ থেকে তার একটি উদাহরণ টানছি। গতমাসে প্রতিবেশী দেশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের নির্বাচনে টানা ২৫ বছর ক্ষমতায় থাকা বামদল ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়। এই নির্বাচনেও ঘটেছে FPTP পদ্ধতির এক ভয়ংকর প্রতারণা। নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে, ৬০ টির মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ৪৩টি আসন, আর দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা বামদল পেয়েছে মাত্র ১৬টি আসন। কিন্তু ভোটের হিসেবে বিজেপি পেয়েছে ৪৩.০ শতাংশ ভোট, আর বামেরা পেয়েছে ৪২.৭ শতাংশ ভোট! প্রতিদ্বন্দ্বি দুই দলের ভোটের ব্যবধান মাত্র ০.৩ শতাংশ! মাত্র এই ০.৩ শতাংশ ভোটের ব্যবধানের কারণে সেখানে আসনের গড়মিল হয়েছে প্রায় ৩ গুন..! কোথায় ৪৩ আর কোথায় ১৬, যেন আকাশ-পাতাল! এই নির্বাচন যদি সংখ্যানুপতিক হতো তাহলে উভয় দলের আসন সংখ্যা হতো ২৬ টি করে! তারমানে সমান সমান! এখন প্রশ্ন, তারপরও টিকে থাকবে, গণতন্ত্রের নামে- প্রচন্ড অগণতান্ত্রিক একটি ব্যবস্থা, কেবল ধারাবাহিকতা, ক্ষমতার জালিয়াতি ও সংকীর্ণতায়?

উপসংহারঃ বাংলাদেশের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট বিশ্লেষণে বলা যায় নির্বাচনের বর্তমান ব্যবস্থা কার্যকর নয়। এই ব্যবস্থায় সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোড়ে ক্ষমতাসীনরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠে। ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের সকল নীতি-আদর্শ-মূল্যবোধকে ধ্বংস করা হয়। ফলে গণতন্ত্রের স্বার্থেই এই ব্যবস্থার বাতিল জরুরী। সেটা করা গেলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার একটি পরিবেশ তৈরী হবে। কারণ সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থায় কোন একক দলের পক্ষে সংসদে সহজেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠ পাওয়া হবে অনেক কঠিন ও দুরূহ কাজ। যার ফলে ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে কোন কিছু করা হবে প্রায় অসম্ভব। এবং যে কোন বিল পাশ করতেও বিরোধী দলের সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। এর কিছু নেতিবাচক দিক আছে যেমন সংসদের অচলাবস্থা এবং ঘন ঘন সরকার পরিবর্তণ ইত্যাদি। সে ক্ষেত্রে PR-FPTP উভয় পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। জাপান, নেপালসহ বিভিন্ন দেশে এই ব্যবস্থা কার্যকার। এই ব্যবস্থায় প্রথমে FPTP পদ্ধতিতে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়, তারপর দলগুলোর প্রাপ্ত ‘সমগ্র ভোটের’ অনুপাতে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধি বন্টন করা হয়। তারজন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক আসন সবসময় সংরক্ষিত থাকবে। এই ব্যবস্থা কার্যকর করা গেলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাস লেখা হবে ভিন্ন ভাবে। ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার যে দীর্ঘ সংগ্রাম, সহিংসতা ও অবিশ্বাস তা হবে অতীত বিষয়।

দেশ-বিদেশের এমন নির্মম অভিঙ্গতার কারণে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের আলোচনা-সংগ্রাম ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বাংলাদেশেও FPTP (First Past the Post) পদ্ধতির বদলে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী (Propotional Election) ব্যবস্থা চালুর আন্দোলন জোড়দার করা জরুরী। সকল রাজনৈতিক দলের উচিত এই দাবী-ব্যবস্থার পক্ষে ব্যাপক জনমত ও আন্দোলন গড়ে তোলা, এবং তা এখনই।

সারনীঃ , এক নজরে বিগত ৪ টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ভোটের পরিমান, হার ও প্রাপ্ত আসন এবং প্রধান দুই দলের শতকরা ভোটের ব্যবধানের হার

————————————————————————–

ডঃ মঞ্জুরে খোদা, লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।