সৌন্দর্য একটি সামাজিক প্যারাসাইট। আমাদের সামনে সমাজ আদর্শ সৌন্দর্যের প্যারামিটার এমনভাবে নির্ধারণ করে রেখেছে, যেটা বেশিরভাগ নারীর পক্ষেই অর্জন করা অসম্ভব। এর কারণ হলো সৌন্দর্যের মিথ নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিবর্তিত ও বিবর্তিত হচ্ছে। অতীতে সমাজ বলেছিল, প্রশস্ত স্তন এবং নিতম্ব (Ample breasts and hips) বিশিষ্ট্য একজন বক্র ফিগারের নারীই সুন্দর। এখন মনে করুন, সমাজের নারীরা এ মানদণ্ড অনুসরণ করে প্রশস্ত স্তন এবং নিতম্ব তৈরি করার জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করে দিল। তাহলে কী ঘটবে?
সত্যিকার্থেই, অতীতের নারীরা প্রশস্ত স্তন ও নিতম্বের জন্য ব্যাপক সংগ্রাম করেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, আদর্শ নারী বলতে বোঝানো হয়, স্লিম এবং অ্যাথলেটিক নারীদের। এখন আর প্রশস্ত স্তন এবং নিতম্বের প্রতি কেউ আকৃষ্ট নয়। ফিটনেস ম্যাগাজিন এবং টিভি শো এখন নারীদের, ওজন কমানোর প্রতি ফোকাস করতে বলছে এবং তাদের দেহকে রূপান্তর করার জন্য অনুপ্রাণিত করছে। এসবের অর্থ কী? এসবের অর্থ এই যে, সৌন্দর্য একটি মিথ, সৌন্দর্য ফিজিক্সের কোনো আইন নয়, এটি সমাজ থেকেই সৃষ্টি হয়, সময়ের সাথে এটি পরিবর্তিত ও বিবর্তিত হয় এবং এ পরিবর্তনশীল সৌন্দর্যের স্ট্যান্ডার্ডের সাথে, নারী কখনোই নিজেকে ফিট করতে পারবে না। এটি প্রকৃতিগতভাবেই অর্জনযোগ্য নয়, এটা এমনভাবে ফিক্স করা হয়েছে, নারী যেন কোনোদিন নিজের নিজস্ব সৌন্দর্যকে গ্রহণ করতে না পারে, তারা নারীদের নিজের সৌন্দর্যের প্রতি সংশয়গ্রস্ত করেছে এবং নারীর সংশয়কে ব্যবহার করে অজস্র ইন্ডাস্ট্রি মাল্টি বিলিয়ন ডলার আয় করছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেন পৃথিবীর সকল নারীকে একটি সুনির্দিষ্ট উপায়ে সুন্দর হতে হবে, মহাবিশ্বে সুন্দর হওয়ার উপায় কী কেবল একটি?
মনে করুন, পৃথিবীর সকল মানুষ আদর্শিক সৌন্দর্যের মানদণ্ড অনুসরণ করে স্লিম হয়ে গেলো। এখন কী ঘটবে? এখন দেখা যাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে, কারণ নিজেকে স্লিম এবং অ্যাথলেটিক করার জন্য, বেশিরভাগ নারীই আর তাদের প্রোডাক্ট ব্যবহার করবে না। এতে ইন্ডাস্ট্রিগুলোর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লস হবে। তারা এখন কী করবে? তাদের এখন নতুন একটি বিজনেস পলিসি বের করতে হবে, একটি জিন এডিটিং কৌশল আবিষ্কার করবে, যেটা অ্যাপ্লাই করলে মানুষের গায়ের কিছু অংশ নীল হয়ে যায়। মনে করুন, বেলা হাদিদের ওপর এই টেকনোলজি প্রয়োগ করার পর, তার মুখের কিছু অংশ অলৌকিকভাবে নীল হয়ে যাবে, সে একটি বিজ্ঞাপন দেবে। পৃথিবীর মিলিয়ন মিলিয়ন নারী নিজের গাল নীল করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়বে। যারা সৌন্দর্যের এ নতুন ফ্রিকোয়েন্সির সাথে সংযুক্ত হতে পারবে না, তারা ব্যাকডেটেড বলে পরিচিত হবে। এভাবে ইন্ডাস্ট্রিগুলো প্রতিনিয়ত সৌন্দর্যের এক একটি স্ট্যান্ডার্ড আবিষ্কার করতে থাকবে, আর আপনি হাজার হাজার বছর মিডিয়ার পেছনে দৌড়াতে থাকবেন কিন্তু আপনি কখনোই আপনার আদর্শিক সৌন্দর্যের মুকুট অর্জন করতে পারবেন না। আমরা বর্তমানে নারীদের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর বডি ট্যাটু তৈরি করার ট্রেন্ড দেখতে পাই। মিলিয়ন মিলিয়ন নারী বডি ট্যাটু তৈরি করার জন্য সাইকো হয়ে গেছে কারণ এখন তারা এটাকেই সৌন্দর্যের প্যারামিটার মনে করছে। ইন্ডাস্ট্রি তাদের মস্তিষ্কে নতুন একটি বিজনেজ প্ল্যান অ্যাপ্লাই করেছে। ইন্ডাস্ট্রিগুলো কখনোই আপনাকে সুন্দর হতে দেবে না, আপনি যদি সুন্দর হয়ে যান, তাদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার লস হবে। এখন প্রশ্ন হলো, তারা কী নিজের ব্যবসার কথা চিন্তা করবে নাকি আপনার সৌন্দর্য ,স্বাস্থ্য এবং কল্যাণের কথা?
সৌন্দর্যের মিথ খুবই ভয়ানক। কারণ এটি নারীর আত্মসম্মানে আঘাত করে। একজন নারী যখন প্রতিনিয়ত তার চারপাশে হালকা, পাতলা, সুন্দর এবং অধিক সফল নারী দেখবে, তাদের পক্ষে নিজের ওপর সন্তুষ্ট হওয়া কঠিন হয়ে যাবে। এতে করে তাদের অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস তৈরি হবে, তারা অতিরিক্ত ব্যায়াম করবে এবং তাদের ইটিং ডিজঅর্ডার দেখা যাবে। আপনাকে এটা মনে রাখতে হবে যে, সৌন্দর্য সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত একটি উপলব্ধি, আদর্শিক সৌন্দর্য বলতে কোনো সৌন্দর্য নেই, যেখানে প্রতিটি নারীকে সমন্বিত হতে হবে।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, একজন নারী ইন্ডাস্ট্রির সৌন্দর্যের স্ক্রিপ্ট পূরণ করতে না পারলে তার কেরিয়ারের ওপর প্রভাব পড়ে। গবেষণা দেখিয়েছে, সোশ্যাল স্ট্যান্ডার্ড থেকে যে সকল নারী দেখতে আকর্ষণীয়, তারা উচ্চমানের চাকরী পায় এবং তাদের উচ্চমাপের বেতন দেয়া হয়। আর ঠিক এজন্য শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশুনা, গবেষণা এবং বুদ্ধিমত্তাকে প্রায়োরিটি না দিয়ে, সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতায় জয়ী হতে চায়। সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতায় জেতার জন্য, একজন নারী তার বুদ্ধিমত্তাকে কম্প্রোমাইজ করে!
সৌন্দর্যের মিথ মানুষের প্রচুর সময় সাক করে। একজন নারী আনরিয়ালিস্টিক সৌন্দর্যের আদর্শের সাথে নিজেকে সমন্বিত করার জন্য, তার অন্যান্য কাজকর্ম জলাঞ্জলি দিয়ে, দেহ ও রূপচর্চার পেছনে পড়ে থাকে। তারা কোনো কিছু শিখতে চায় না, বুঝতে চায় না এবং তারা গভীরভাবে কোনোকিছু উপলব্ধি করারও চেষ্টা করে না। আপনি আজ বাংলাদেশের নারীদের দিকে তাকান, উচ্চমাপের মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও সেলিব্রেটিদের দিকে তাকান, আপনি দেখতে পাবেন, বেশিরভাগ নারী আনরিয়ালিস্টিক সৌন্দর্যের আদর্শ অনুসরণ করতে গিয়ে, এক একজন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও সাইকোসিসে পরিণত হয়েছে। সৌন্দর্যের পেছনে ছুটতে ছুটতে, যখন তারা সম্পূর্ণ বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, ঠিক সে সময় ধর্মীয় অনুশাসন এসে তাদের আবার গ্রাস করেছে। কারণ তারা ধর্ম ও ধর্মীয় কুসংস্কারকে প্রশ্ন করার মতো জ্ঞান ও বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছে! এদেশের বিশাল সব নারী অভিনেত্রী ধার্মিক কিন্তু তাদের এই সাধারণ জ্ঞান নেই যে তারা স্ববিরোধী আচরণ করছে। এ সকল মেয়েরা তাদের নিজের দেহের প্রতি এতটাই ইনসিকিউর যে, এরা মাল্টিবিলিয়ন ডলার খরচ করছে ইন্ডাস্ট্রির পেছনে। এ সকল নারীদের কোনো আত্মসম্মান নেই। যখন তারা অনুভব করে যে তারা আনরিয়ালিস্টিক সৌন্দর্যের আদর্শের সাথে সমন্বিত হতে পারল না, তারা নিজেদের সম্পর্কে খারাপ বোধ করে, সবসময় ডিপ্রেসন, উত্তেজনা এবং ক্রোনিক স্ট্রেসে ভোগে।
নোয়ামি ওলফ তার “দ্য বিউটি মিথ” বইতে সৌন্দর্যের ধারণা এবং পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের সম্পর্ক আবিষ্কার করেছিলেন। নিচে কয়েকটি উদাহরণ প্রদান করা হলো:
- সৌন্দর্য হলো নিপীড়নের হাতিয়ার: অবাস্তব সৌন্দর্যের আদর্শ একটি ধারণাকে চিরস্থায়ী করে আর তা হলো, একজন নারীর প্রাথমিক মূল্য তার চেহারার মধ্যে লুকায়িত। দেহ ও সৌন্দর্যের প্রতি অযথা জোর দিয়ে, একজন নারীর মনোযোগ জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রগুলো থেকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে যেমন তাদের শিক্ষা, কর্মজীবন এবং ব্যক্তিগত বিকাশ। সৌন্দর্যের ধারণা নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশনার মাধ্যমে, তারা নারীর জীবনের ওপর পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করছে।
- লিঙ্গের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা কার্যকর: সৌন্দর্যের আদর্শ মাঝেমাঝে ঐতিহ্যবাহী জেন্ডার রোলসের সাথে সমন্বিত, যেটি নারীত্বের সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ ডেফিনিশন সম্প্রসার করে। নারীদের জীবনের একমাত্র প্রত্যাশাই থাকে এ সুনির্দিষ্ট সৌন্দর্যের আদর্শ মেনে চলা, আর এভাবে নারীর ঐতিহ্যবাহী লিঙ্গের ভূমিকা পুনরায় জাগ্রত হয় এবং এটি নারীর এজেন্সিকে সীমাবদ্ধ করে।
- অবজেক্টিফিকেশন এবং সেক্সচুয়ালাইজেশন: অবাস্তব সৌন্দর্যের আদর্শ, একটি নারী দেহের অবজেক্টিফিকেশন এবং সেক্সচুয়ালাইজেশনে ভূমিকা পালন করে। একজন নারীকে কেবল তার চেহারার সৌন্দর্য দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়। এ অবজেক্টিফিকেশন ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে এবং এটি এমন একটি ধারণার জন্ম দেয় যে, একজন নারী অন্যের সুখ এবং ভোগের জন্য অস্তিত্বশীল। নারীর কোনো স্বেচ্ছাচারিতা নেই, তার আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন ও উচ্চাশা নেই।
- প্রফিট পরিচালিত বিউটি ইন্ডাস্ট্রি: বিউটি ইন্ডাস্ট্রির কাজ হলো সামাজিক সৌন্দর্যের আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নারীর মস্তিষ্কে নিরবচ্ছিন্নভাবে উস্কানী দেয়া, যেন তারা আতঙ্কগ্রস্ত ও অনিশ্চিত হয়ে ওঠে। এ সকল ইন্ডাস্ট্রি নিয়ন্ত্রিত হয় পুরুষ এক্সকিউটিভ এবং মুনাফা দ্বারা। আর এজন্য তারা মূলধন হিসেবে বিনিয়োগ করে নারীর আত্মসংশয়। এভাবে তারা আনরিয়ালিস্টিক সৌন্দর্যের আদর্শকে চিরস্থায়ী করে। নারীদের অনুপ্রাণিত করা হয় বিউটি প্রোডাক্ট, ট্রিটমেন্ট এবং কসমেটিক সার্জারির উদ্দেশ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করার জন্য, আর এভাবে নারীর দেহ ও অর্থনীতির ওপর পুরুষতান্ত্রিক প্রভাব অক্ষুন্ন থাকে।
- ইন্টারনালাইজড মিসজিনি: অবাস্তব সৌন্দর্যের আদর্শ মিসজিনিকে ইন্টারনালাইজড করে, যেখানে একজন নারী অন্যজনকে তার চেহারার উপর ভিত্তি করে বিচার ও তদন্ত করে। নারীদের মধ্যে এই বিভাজন এবং প্রতিযোগিতা পিতৃতান্ত্রিক নিয়মকে আরও শক্তিশালী করে এবং পদ্ধতিগত লিঙ্গ বৈষ্যমকে চ্যালেঞ্জ করার মনোভাব থেকে, তাদের মনোযোগ সরিয়ে রাখে। এটি একটি বিরূপ পরিস্থিতি তৈরি করে। যেখানে একজন নারী নিরবচ্ছিন্নভাবে অনধিগম্য সৌন্দর্যের আদর্শের জন্য প্রতিযোগিতা করে। যেটি আবারও নারীর দেহের ওপর পিতৃতান্ত্রিক শাসন ব্যাবস্থাকে চিরস্থায়ী করে।
একজন নারীকে মনে রাখতে হবে, সোন্দর্য সমাজের সৃষ্টি এবং সমাজ যে সৌন্দর্যের আদর্শ নির্ধারণ করেছে এটি গাণিতিক শূন্য ও অসীমের মতোই অনধিগম্য, আপনি এটাতে কখনোই রিচ করতে পারবেন না। সমাজ সৌন্দর্যের যে অবাস্তব প্রত্যাশা তৈরি করেছে, এটি হিলবার্টের ইনফিনিটি হোটেলের মতোই একটি প্যারাডক্স, এ হোটেলে কখনো শেষ কক্ষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। সৌন্দর্য হলো একটি মিথ, এটি নারীকে তার বর্তমান অবস্থানের সাথে ক্রুশবিদ্ধ করে রাখে। সৌন্দর্য হলো পটাশিয়াম সায়ানাইড অথবা রেডিয়ামের মতোই ধবংসাত্মক, এটি একজন নারীর শারীরীক ও মানসিক ক্ষতি করে। সৌন্দর্য হলো একটি প্যারাসাইট, যেটি নারীর মস্তিষ্কের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্সকে তালাবদ্ধ করে রাখে। সৌন্দর্য হলো একটি হিপোক্রেট, যেটি নারীর সংশয় নিয়ে ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তোলে। সৌন্দর্য হলো একটি অ্যান্টি লাইফ, এটি সময় ও অর্থের অপচয় করে। সৌন্দর্য হলো একটি সর্বজনীন মিথ্যা, যেটি দিয়ে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীর দেহ ও মনকে দখল করে। সৌন্দর্যের মিথ হলো নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার, এটি এমন একটি ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করে যে, তারুণ্যই একমাত্র সুন্দর। সৌন্দর্যের মিথ মানুষকে তার বার্ধ্যকের প্রতি আতঙ্কিত ও ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে। একজন নারী সকল জ্যামিতিক সাইজ, সকল শেপ এবং স্পেক্ট্রামের সকল কালারের মতোই সুন্দর, নারী একটি প্রিজমের কাঁচ! নারীর উচিত নয়, সৌন্দর্যের মিথ মেনে চলা। ফিজিক্স ও বিবর্তন একজন নারীকে যেভাবে মহাবিশ্বের কাছে উপস্থাপন করেছে, নারীর উচিত তার সে সৌন্দর্যকে সেলিব্রেট করা। একজন নারীর উচিত সৌন্দর্যের মিথকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য একে অন্যকে সহযোগিতা ও সমর্থন করা। একজন নারীর পক্ষে সৌন্দর্যের মিথকে চ্যালেঞ্জ করে বিশ্বকে পরিবর্তন করা সম্ভব।
Leave A Comment