গত এক বছরে চিকিৎসা বিজ্ঞানে যুগান্তকারী উদ্ভাবন ঘটে গেছে এবং সাথে ছিল ভয়াবহ রাজনৈতিক ব্যর্থতা। এই বৈজ্ঞানিক সাফল্য এবং রাজনৈতিক ব্যর্থতা থেকে ভবিষ্যতের জন্য কী আমরা শিক্ষা পেলাম?

ইতিহাসের বিশাল পরিপ্রেক্ষিতে কোভিডকে আমরা কীভাবে বিবেচনা করব? অনেকেই মনে করছেন করোনা মহামারীতে আক্রান্ত হয়ে প্রকৃতির আক্রোশের সামনে মানুষ অসহায়ত্ব প্রকট হয়ে পড়েছে। প্রকৃতপক্ষে, ২০২০ সালেই দেখা গেছে মানুষ মোটেও কোন অসহায় প্রাণী নয়। মহামারী এখন আর অনিয়ন্ত্রণযোগ্য কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। বিজ্ঞান মহামারীর মত প্রতিকূলতাকে জয় করতে পেরেছে। তবুও বিশ্বব্যাপী কেন মানুষের এতবড় মৃত্যুর মিছিল আর ভোগান্তি? কারণ আর কিছুই নয়, কারণ হলো রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত। পৃথিবী যখন ১৩৪৬ থেকে ১৩৫৩ সাল পর্যন্ত চলমান ‘ব্ল্যাক ডেথ’ প্লেগের কবলে পড়েছিল তখন মানুষের কাছে প্লেগের কারণ এবং প্রতিকার সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না। যখন ১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা আঘাত হানে তখন সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীরাও মরণঘাতী ভাইরাস চিহ্নিত করতে পারেন নি। ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রতিরোধে যে পদক্ষেপই নেয়া হচ্ছিল না কেন কিছুই কোন কাজে আসছিল না, প্রতিষেধক টিকাও তেমন কার্যকর হচ্ছিল না। কিন্তু কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে হিসেব সম্পূর্ণ আলাদা। ২০১৯ সালের শেষের দিক থেকেই সম্ভাব্য মহামারীর আশঙ্কায় মানুষকে সতর্ক করা হচ্ছিল। ২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি বিজ্ঞানীগণ করোনার জন্য দায়ী ভাইরাসকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হন, ভাইরাসের জিনোম সিক্যুয়েন্স আবিষ্কার করেন এবং অনলাইনে বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশ করতে শুরু করেন। বিজ্ঞানীগণ কয়েক মাসের মধ্যে নিশ্চিত হয়ে যান কীভাবে ভাইরাসের সংক্রমণ থামানো যায় এবং সংক্রমণের দুষ্টচক্র ভেঙে দেয়া যায়। মাত্র এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে কয়েকটি কার্যকরী টিকা আবিষ্কার করে ফেলেছে এমনকি বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হয়ে গেছে। মানুষ আর জীবাণুদের যুদ্ধে মানুষ ইতিপূর্বে কখনো এত শক্তিশালী ছিল না।

বায়োটেকনোলজির অভাবনীয় উন্নতির মাধ্যমে কোভিড আক্রান্ত সময়ে মানুষ অনলাইনের ভার্চুয়াল রিয়েল জগতে প্রবেশ করেছে। এখন বিজ্ঞান তথ্যপ্রযুক্তির চূড়ান্ত শিখরে অবস্থান করছে। আগেকার যুগে মানুষ মহামারী ঠেকাতে কদাচিৎ কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারতো কারণ তখন মানুষ তো বাস্তবিকভাবে ভাইরাস সংক্রমণের দুষ্টচক্র পর্যালোচনা করতে পারতো না। অতীতের রাজনৈতিক কাঠামো অর্থনৈতিক ক্ষতির ভয়ে পুরোপুরি লকডাউন আরোপ করতে পারতো না। ১৯১৮ সালে তখনকার সরকার ব্যবস্থা প্রাণঘাতী ইনফ্লুয়েঞ্জা আক্রান্ত মানুষকে আলাদা করে অন্তরীণ করে রাখতে পারলেও তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না কে ভাইরাস বহন করছে অথবা কার শরীরে জ্বরের লক্ষ্মণ আছে, কেউ হয়ত ভাইরাস বহন করছে কিন্তু লক্ষ্মণ প্রকাশিত নয়, তাদেরকে কিন্তু তখনকার সময়ের প্রযুক্তি দিয়ে আলাদা করা সম্ভব ছিল না। সরকার যদি সাহস করে পুরো দেশের সব নাগরিককে নিজেদের বাড়িতে কয়েক সপ্তাহ অবস্থানের আদেশ দিতো তবে হয়ত ধ্বসে পড়ত অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড, ভেঙে যেত সামাজিক কর্মকাণ্ড, এবং দেখা দিতো মন্বন্তর। কিন্তু ২০২০ সালে আধুনিক নজরদারি ব্যবস্থার মাধ্যমে খুব সহজেই ভাইরাস আক্রান্ত মানুষকে আলাদা করা সম্ভব হয়েছে এবং রোগটির বিস্তার, পরিস্থিতি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব। ফলে আক্রান্ত লোককে অন্তরীণ করা আরো সহজ এবং কার্যকরী হয়েছে। আরো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটে গেছে এই করোনাকালে যেমন মানুষ তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে স্বয়ংক্রিয় হয়েছে আগের তুলনায় বেশি ফলে লকডাউন বর্ধিত হলেও বিশেষত উন্নতদেশে অর্থনীতির চাকা কখনো নিশ্চল ছিল না কখনো। একইসাথে কিছু উন্নয়নশীল দেশে এখনো সেই ‘ব্লাক ডেথ’ প্লেগের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ উন্নতদেশে ডিজিটাল বিপ্লবে খোলনলচে বদলে গেছে সবকিছুর। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, কৃষিক্ষেত্র। হাজার হাজার বছর ধরে খাদ্য উৎপাদন মূলত মানুষের কায়িক পরিশ্রমের উপর নির্ভরশীল ছিল এবং প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ সরাসরি মাঠে কাজ করত। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশে এত বিপুল পরিমাণ মানুষকে আর মাঠে কাজ করতে হয় না। যুক্তরাষ্ট্রে এখন মাত্র ১.৫ শতাংশ মানুষ কৃষিকাজে নিয়োজিত কিন্তু এত অল্প মানুষের শ্রমে যুক্তরাষ্ট্রের এত মানুষের অন্নসংস্থান কীভাবে সম্ভব! তথাপি যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম খাদ্য রপ্তানিকারক দেশ। কৃষির সব কাজই এখন যন্ত্রের সাহায্যে সম্পাদন করা হয়, মানুষকেও রোগজীবাণুর সংস্পর্শে যেতে হয় নি। ফলে লকডাউনে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিক্ষেত্রে খুব প্রভাব ফেলতে পারে নি। পরিসংখ্যানের বিবিধ রেখাচিত্রে ১৪০০ সাল থেকে বিভিন্ন দেশের কৃষিখাতে জড়িত শ্রমের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এই আর্টিকেলে আলোচিত হয়েছে। রেখাচিত্রে দেখা যাচ্ছে ১৯৯১ সালের গমের উৎপাদন ছিল ব্ল্যাক ডেথের সময়ের সমপরিমাণ। যদি ফসলের মৌসুমে কৃষককে বলেন ঘরে থাকতে তবে সংক্রমণে মরার আগে দুর্ভিক্ষে মরার সম্ভাবনা বেশি। মহামারীর সময় পরিস্থিতি আসলেই শাঁখের করাতের মত, যদি কৃষককে বলেন ফসলের মাঠে নিয়মিত কাজ করতে তবে তারা সংক্রামিত হবে এবং অন্যদের মাঝেও সংক্রমণ ছড়াবে। তাহলে এই পরিস্থিতিতে করনীয় কী? এখন একটু চিন্তা করে দেখুন তো ২০২০ সালে সেই একই গমের ক্ষেতের কী অবস্থা? ২০২০ সালে একটা জিপিএস নিয়ন্ত্রিত ফসল কাটার যন্ত্র দিয়ে পুরো মাঠের ফসল অধিক দক্ষতায় কাটা সম্ভব আগের থেকেও কম সময়ে এবং মানুষের সংক্রমণের কোন সম্ভাবনা নেই। যেখানে ১৩৪৯ সালে একজন কৃষক গড়পড়তায় একদিনে ৫ বুশেল গম মাড়াই করতে পারত সেখানে ২০১৪ সালে একজন কৃষক একদিনে ৩০,০০০ বুশেল গম মাড়াই করতে পারে। আলোচনা প্রসঙ্গে বলা যায় কোভিড-১৯ বিশ্বের প্রধান খাদ্যশস্য যেমন গম, ভুট্টা বা চালের উৎপাদনে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। শুধু ফসল উৎপাদন করলেই মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয়া যায় না। উৎপাদিত খাদ্যকে ভোক্তার দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার জন্য অনেক কাজ আছে, পাড়ি দিতে হয় এমনকি হাজার হাজার কিলোমিটার পথ। ইতিহাসে মহামারী ছড়ানোর পিছনে বাণিজ্য অন্যতম খল চরিত্র হিসেবে কাজ করে বলে ধারণা করা হয়। বাণিজ্যিক জাহাজ, দূরপাল্লার যানবাহনে চড়ে প্রাণঘাতী রোগজীবাণু পরিবাহিত হয়ে যায় বিশ্বব্যাপী। যেমন ব্ল্যাকডেথ পূর্ব-এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্যে চলে গেল সিল্করোড ধরে এবং ইটালির জেনোয়ার বাণিজ্যিক জাহাজে করে সেই প্রাণঘাতী ব্ল্যাকডেথ পৌঁছে গেল ইউরোপ। বাণিজ্যের কারণে সংক্রমণ এবং মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়। কারণ প্রতিটি ওয়াগন চালাতে ড্রাইভার, হেল্পার দরকার, একটা ছোট্ট জাহাজের সমুদ্রাভিযানেও অনেক নাবিক লাগে। নাবিকদের ভিড়ে জনাকীর্ণ জাহাজ, হোটেল, সরাইখানা সংক্রমণ ছড়ানোর উপযুক্ত স্থান। কিন্তু সবকিছু যন্ত্র-নির্ভর স্বয়ংক্রিয় এবং ইন্টারনেটের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে দীর্ঘ সময়ব্যাপী লকডাউনে আমাদের খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। ২০২০ সালে বৈশ্বিক বাণিজ্য করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও স্থবির ছিল না কখনো এবং বর্তমানে বাণিজ্য পরিচালনা করতে খুব বেশি মানুষেরও দরকার হয় না। অতীতের সদ্য আধুনিক দেশের সমুদ্রপথে যত বাণিজ্য জাহাজ চলাচল করত তাদের মোট পরিবাহিত পণ্যের থেকেও আজকের দিনের একটা বিশালাকার স্বয়ংক্রিয় আধুনিক জাহাজ অধিক পণ্য পরিবহন করতে সক্ষম। ১৫৮২ সালে ইংল্যান্ডের বাণিজ্যিক জাহাজ বহরের পণ্য পরিবহনের মোট সক্ষমতা ছিল সর্বসাকুল্যে ৬৮,০০০ টন এবং ১৬,০০০ নাবিকের দরকার পড়ত। কিন্তু বর্তমানের OOCL Hong Kong লাইনের একটা জাহাজেই ২০১৭ সালেও ২০০,০০০ টন পণ্য পরিবহন করা সম্ভব ছিল এবং জাহাজের নাবিক লাগবে মাত্র ২২ জন, এখন এই সক্ষমতা আরও বেড়েছে নিশ্চয়। তবে এটাও সত্য যে প্রমোদতরীর মাত্র কয়েকশ পর্যটক এবং এয়ারলাইনের যাত্রীরা কোভিড-১৯ সংক্রমণ ছড়াতে বিশাল ভূমিকা রেখেছে। পর্যটন এবং ভ্রমণ বাণিজ্যের জন্য অত্যাবশ্যকীয় নয়। করোনা মহামারী যুগে মানুষ কিছুদিন ঘরে থাক, ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়ের আলোচনা করে নিতে পারেন জুম মিটিংয়ের মাধ্যমে। অন্যদিকে স্বয়ংক্রিয় জাহাজ এবং প্রায় মনুষ্যবিহীন ট্রেন সচল রাখুক বৈশ্বিক অর্থনীতির চাকা। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী পর্যটন ব্যবসাতে ধ্বস লেগেছে, কিন্তু সমুদ্রপথে ব্যবসা কমেছে মাত্র ৪ শতাংশ। পণ্য পরিবহন ও সেবাখাত স্বয়ংক্রিয় এবং ডিজিটাল হওয়ার কারণে পুরো শিল্পে গভীর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ১৯১৮ সালে লকডাউনের মধ্যে অফিস, স্কুল, আদালত বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কার্যকর রাখার কথা কল্পনাও করা সম্ভব ছিল না। যদি ছাত্র এবং শিক্ষক যোগাযোগহীন পড়ে থাকত ঘরের কোনায় তবে কীভাবে চলত ক্লাস? কিন্তু আজকে আমরা উত্তরটা জানি, কীভাবে সচল আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্বাভাবিক জীবনের চলার পথের সবকিছুই যদি অনলাইনে চলে যায় তবে বিপত্তি অনেক আছে বৈকি, মানসিক পীড়াও অনেক। পুরো অনলাইন জীবনে এমনকিছু সমস্যার জন্ম হয়েছে যার কিছুই আমরা আগে থেকে অনুমান করতে পারিনি যেমন টেক্সাসের এক আদালতে বিচার কাজের অনলাইন শুনানি চলার মাঝপথে মামলা পরিচালনাকারী এক আইনজীবীর স্ক্রিনে দেখা যায় বিড়ালের ছবি। বিড়ালের সেই স্ক্রিন নিয়েই আইনজীবী বলেন, “মাননীয় বিচারক, আমাকে শুনতে পাচ্ছেন? স্ক্রিনের বিড়ালের ছবি বুঝতে পেরে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তিনি বলেন, আমি বিড়াল নই।” বিড়ালের ছবি থাক আর যাইহোক, বিচারকাজ সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হয়েছিল সেদিন। ১৯১৮ সালে মানুষ শুধুই বাস্তবিক জগতে বাস করত এবং যখন প্রাণঘাতী ফ্লু ভাইরাস মরণকামড় বসিয়ে দিলো তখন মানুষের পালানোর কোন জায়গা ছিল না। কিন্তু বর্তমানে আমাদের মধ্যে অনেকেই বাস্তবিক এবং ভার্চুয়াল দ্বৈত জগতে বাস করে। করোনা ভাইরাস বাস্তবিক জগতে ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই তাদের জীবনযাপন ভার্চুয়াল জগতে স্থানান্তর করে ফেলল ফলে তার আর করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ভয় রইল না।

Mounted police in Hanover, Germany, disperse a group playing in a park © Rafael Heygster/Helena Manhartsberger

মানুষ এখনো শারীরিক প্রাণী এবং অবশ্যই সবকিছু ডিজিটালাইজড করা সম্ভব না। কোভিড আক্রান্ত বছরে আমাদের সামনে প্রতীয়মান হয়েছে যে কম বেতনে কাজ করা নার্স, পয়নিস্কাশন কর্মী, ট্রাকের ড্রাইভার, ব্যাংকের ক্যাশিয়ার, ভোক্তার দোরগোড়ায় ডেলিভারি দেয়া পেশাজীবী মানুষগুলোই মানব সভ্যতা টিকিয়ে রাখতে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এটা প্রায়ই বলা হয়ে থাকে যে সভ্যতা হলো বর্বরতা থেকে মাত্র তিনবেলা খাবারের দূরত্ব অবস্থিত। ২০২০ সালে এসে আমরা দেখতে পেলাম প্রান্তিক মানুষগুলোই সভ্যতার সুতোটুকু কোনক্রমে ধরে আছে। বাস্তব জগতে তারাই আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ হিসেবে আবির্ভূত হলেন। ইন্টারনেট গোটা মানবজাতিকে স্বয়ংক্রিয় করছে, মানুষের কার্যক্রম ডিজিটাল করছে এবং অনলাইনে ধাবিত করছে কিন্তু একই সাথে ঠেলে দিচ্ছে নতুন বিপদের দিকে। কোভিডাক্রান্ত সময়ের সবচেয়ে আলোচিত দিক হতে পারে এই মহামারীর মধ্যে কখনো বিচ্ছিন্ন না হওয়া ইন্টারনেট সংযোগ। সাধারণত যদি হঠাৎ করে অনেক গাড়ি একসাথে একটা সেতুর উপর দিয়ে যায় তাহলে ট্রাফিক জ্যাম লাগার সম্ভাবনা দেখা দেয় এমনকি সেতুটা ভেঙেও পড়তে পারে। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী কোভিড আঘাত হানলে রাতারাতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস এমনকি ধর্মালয় অনলাইনে রূপান্তরিত হয় কিন্তু ইন্টারনেট আমাদেরকে বিমুখ করেনি, বিচ্ছিন্ন হয়নি এক মুহূর্ত, সাহায্য করে গেছে অবিরত। আমরা হয়ত খুব কম সময়ই ইন্টারনেটের সেবা নিয়ে চিন্তা করি কিন্তু এখন সময় এসেছে দুদণ্ড কথা বলার। ২০২০ সালের পরেই আমরা জানতে পারলাম পুরোদেশ লকডাউনে অচল হয়ে গেলেও ইন্টারনেটের কল্যাণে আধুনিক মানুষের জীবন থেমে থাকে না। আসুন, এখন একবার চিন্তা করে দেখি কী ঘটতে পারে যদি আমাদের ডিজিটাল অবকাঠামো ভেঙে পড়ে। তথ্য প্রযুক্তি উৎকর্ষতার কারণে আমরা জৈবিক ভাইরাসের কবল থেকে দ্রুত রক্ষা পেলেও ক্ষতিকর সফটওয়্যার এবং সাইবার যুদ্ধ আমাদের জীবনকে আরও বেশি অস্থিতিশীল করে ফেলেছে। মানুষ মাঝেমধ্যেই প্রশ্ন করে কী হতে পারে কোভিডের পরের মহামারী? উত্তর হতে পারে, ডিজিটাল অবকাঠামোর উপর আঘাতই হতে পারে পরবর্তী সম্ভাব্য আক্রমণ। বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে এবং লাখ লাখ মানুষকে ভাইরাস সংক্রমণ করতে কয়েক মাস সময় লেগেছে। কিন্তু ডিজিটাল অবকাঠামো ভেঙে পড়লে পুরো বিশ্ব বালির বাঁধ হয়ে পড়বে মাত্র একদিনেই। করোনা ভাইরাসের আক্রমণে আমাদের স্কুল, অফিস যেমন দ্রুত অনলাইনে রূপান্তরিত হয়েছিল তেমনি ইন্টারনেট ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে কতদিনে আমরা আবার সেই শম্বুক গতির চিঠিপত্র আদানপ্রদান যুগে ফিরে যেতে পারব? বলতে পারেন কতদিন লাগতে পারে? কোভিডাক্রান্ত বছরে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির একটা গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা প্রকাশ হয়ে গেছে আমাদের সামনে। বিজ্ঞান কখনো রাজনীতির স্থান দখল করতে পারে না। যখন আমাদেরকে নীতিমালা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয় তখন অনেক বিষয়ের স্বার্থগত ও মূল্যবোধের ব্যাপারে বিবেচনায় রাখতে হয়। এখন পর্যন্ত স্বার্থগত এবং মূল্যবোধের বিষয়ে কোন কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিৎ এবং কোনটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা নিশ্চিত হওয়ার কোন বৈজ্ঞানিক পন্থা আবিষ্কৃত হয় নি। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, যখন লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তখন প্রশ্ন করা সম্ভব হয়নি যে “কত সংখ্যক মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হবে যদি আমরা লকডাউন আরোপ না করি? লকডাউন আরোপ করলে কত মানুষ বিষণ্ণতায় ভুগবে? কী পরিমাণ মানুষ অপুষ্টির শিকার হবে? কী পরিমাণ শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে ঝরে যাবে? অথবা কী পরিমাণ চাকুরীজীবী তাদের কর্ম হারাবে? কত দম্পতি লাঞ্ছনার শিকার হবে বা তাদের জীবনসঙ্গীর হাতে খুন হবে?” এমনকি এসব প্রশ্নের সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য উত্তর পেয়েও যাই তবুও জিজ্ঞাসা থেকে যাবে, কী আমাদের আমলে নেয়া উচিৎ, কে সিদ্ধান্ত নেবে কোন বিষয়ে চিন্তা করার, কীভাবে আমরা পরস্পর বিরোধী মতামতের মূল্যায়ন করবো? এসব প্রশ্নই রাজনৈতিক, বিজ্ঞানের এখানে কিছু করার নেই। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নেবেন কীভাবে চিকিৎসা, অর্থনীতি এবং বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা মোকাবেলায় কত ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নেয়া যায় এবং অধিকাংশের কাছে গ্রহণযোগ্য ও বোধগম্য নীতিমালা গ্রহণ করা যায়।

Researchers at Munich’s Bundeswehr Institute of Microbiology, a military research facility that diagnosed the first German Covid-19 case © Rafael Heygster/Helena Manhartsberger

অনুরূপভাবে প্রযুক্তি প্রকৌশলীগণ এমন ডিজিটাল ক্ষেত্র তৈরি করেছেন যে লকডাউনের মধ্যেও আমাদের সচল থাকা সম্ভব হয়েছে এবং নতুন নজরদারি ব্যবস্থায় ভাইরাস সংক্রমণের দুষ্ট চক্র ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু সেইসাথে ডিজিটালাইজেশন এবং নজরদারি ব্যবস্থা আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ধ্বংস করে সরকারকে একচ্ছত্র স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে সাহায্য করেছে। ২০২০ সালে কোভিডের কারণে গণমানুষের উপর সার্বক্ষণিক নজরদারি করার বৈধতা পেয়ে গেছে সরকার। মহামারী নিয়ন্ত্রণ করা অবশ্যই জরুরি কিন্তু সেটা কি আমাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা নস্যাৎ করার বিনিময়ে? মহামারী নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় নজরদারি এবং রাতের ঘুম হারাম করে দেয়া ডিস্টোপিয়ান সমাজের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্ব প্রযুক্তি প্রকৌশলীদের নয় বরং এটা রাজনীতিবিদগণের কাজ। এমনকি মহামারির সময়েও ডিজিটাল স্বৈরশাসন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনটে নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। প্রথমত, যখন মানুষ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয় বিশেষত মানুষের শরীরের অভ্যন্তরীণে কী ঘটছে জানার জন্য তখন সেই তথ্য শুধু মহামারী নিরাময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, সেটা হয়ে যায় মানুষকে নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার, রাজনীতির পাশার গুটি, এমনকি মানুষের ক্ষতিও করে ফেলতে পারে। আমার ব্যক্তিগত ডাক্তার আমার সম্পর্কে অনেক মারাত্মক গোপনীয় তথ্য জানে। কিন্তু তাতে আমার কোন সমস্যা নেই, কারণ ডাক্তারের উপর আমার আস্থা আছে যে তিনি আমার শারীরিক তথ্য শুধু আমার শরীরের রোগমুক্তির কাজে ব্যবহার করবেন। আমার ডাক্তার নিশ্চয় আমার শরীরের গোপনীয় তথ্য কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক দলের কাছে বেচে দেবেন না।“মহামারী নজরদারি কর্তৃপক্ষ” হিসেবে আমরা যাকেই প্রতিষ্ঠিত করি না কেন সম্ভবত একই রকম চরিত্র ধারণ করবে।

দ্বিতীয়ত, নজরদারি অবশ্যই দ্বিপাক্ষিক-ভাবে চলতে হবে। যদি নজরদারি শুধু রাষ্ট্রের উপর থেকে নিচের দিকে চলতে থাকে তবে সেটা স্বৈরশাসনের দিকে ধাবিত হবে। সুতরাং যখন সরকার ব্যক্তি নাগরিকের উপর নজরদারি বাড়াবে তখন জনগণকেও যুগপতভাবে সরকার এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উপর নজরদারি বাড়াতে হবে। যেমন, বর্তমান সংকটময় মুহূর্তে সরকার জনগণের মাঝে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিতরণ করছে। অর্থ বরাদ্দের প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিতামূলক হতে হবে। নাগরিক হিসেবে আমি অনায়াসে দেখতে চাই কে কত অর্থ বরাদ্দ পেল, এবং কে সিদ্ধান্ত নিলো কাকে বরাদ্দ দিতে হবে। আমি নিশ্চিত করতে চাই অর্থ যেন প্রকৃত প্রয়োজনেই ব্যয় হয়, যেমন কোন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তার টিকে থাকার জন্য অর্থ বরাদ্দ দরকার, কিন্তু এমন যেন না হয় সরকারি সাহায্য পেয়ে গেল বড় কোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যার মালিক কোন মন্ত্রীর বন্ধু। যদি সরকার বলে থাকে, মহামারির মধ্যে এমন তদারকির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা খুব জটিল প্রক্রিয়া, তাহলে ধরে নিবেন পুরো ভাঁওতাবাজি। সরকারের কথা বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। আপনি কী করছেন তা তদারকি করা যদি সরকারের পক্ষে দুরূহ না হয় তাহলে সরকার কী করছে সেটা তদারকি করাও আপনার জন্য খুব কঠিন কাজ নয়। তৃতীয়ত, মহামারী বা সুন্দর সময় যেকোনো অবস্থাতেই সব তথ্য একসাথে এক ডিভাইসে রাখবেন না। তথ্যের একচ্ছত্র মালিকানা শাসককে স্বৈরশাসনের দিকে ধাবিত করে। সুতরাং মহামারী ঠেকাতে যদি রাষ্ট্রের নাগরিকের বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করতেই হয় তবে সে কাজটা পুলিশকে নয় বরং স্বাধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে দিয়ে করাতে হবে। সংগৃহীত তথ্য ভাণ্ডারের ফলাফলকে সরকার এবং অন্যান্য বড় বড় কোম্পানির নাগালের বাইরে রাখতে হবে। অবশ্য এতে তথ্যের কিছুটা অপ্রতুলতা এবং অদক্ষতা দেখা দেবে। যদিও অদক্ষতা একটা বৈশিষ্ট্য তবে ক্ষতিকর কিছু নয়। আপনি কি সরকারের ডিজিটাল স্বৈরশাসন রুখে দিতে চান? তাহলে অল্প একটু অদক্ষ হয়েই না হয় থাকলেন।

রাজনীতিবিদগণের দায়িত্ব

২০২০ সালের অপ্রতিরোধ্য এবং অভাবনীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন কোভিড-১৯ সংকটের এখনো টেকসই সমাধান করতে পারে নি। বরং প্রযুক্তির সাফল্য করোনা মহামারীকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতায় পরিণত করেছে। যখন ব্লাক ডেথ প্লেগে আক্রান্ত হয়ে লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছিল তখন কেউ রাজাদের কাছ থেকে কোন সাহায্য প্রত্যাশা করেনি। ১৩৪৬ থেকে ১৩৫৩ সাল পর্যন্ত চলমান প্লেগ মহামারীতে ইংল্যান্ডের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মরে যায় কিন্তু তার জন্য ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ডকে তার সিংহাসন হারাতে হয়নি। মহামারী ঠেকানো ছিল রাজার ক্ষমতার বাইরে। প্লেগ ছড়ানো বা মানুষের মৃত্যুর জন্য ইংল্যান্ডের কেউ রাজাকে দোষারোপ করেন নি। কিন্তু আজকের বিশ্বে মহামারী ঠেকানোর জন্য যথেষ্ট কারিগরি দক্ষতা ও প্রস্তুতি মানুষের আছে। ভিয়েতনাম থেকে অস্ট্রেলিয়া এরকম আরও বেশ কয়েকটি দেশ ভ্যাকসিন ছাড়াই শুধু প্রচলিত ওষুধ, যন্ত্রপাতি এবং নীতিমালা দিয়েই তাদের দেশে করোনা নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে। কিন্তু এসব পদক্ষেপের কারণে অর্থনৈতিক এবং সামাজিকভাবে উচ্চমূল্য চুকাতে হয়েছে। আমরা করোনা ভাইরাসকে দমন করতে পারি, কিন্তু করোনা বিজয়ের জন্য যে ক্ষতি হবে তা মানতে রাজি নই। এই কারণেই বিজ্ঞানের আবিষ্কার রাজনীতিবিদগণের কাঁধে বিশাল দায়িত্ব অর্পণ করেছে। প্রযুক্তি প্রকৌশলীদের থেকেও রাজনীতিবিদগণের বড় দায়িত্ব যে প্রয়োজনীয় তদারকি এবং দুঃস্বপ্নের মত নজরদারি এই দুইয়ের মাঝে সমন্বয় সাধন করা। দুর্ভাগ্যবশত বেশিরভাগ রাজনীতিবিদগণ এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট করোনার ভয়াবহতার মাত্রা কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন, বিশেষজ্ঞদের কথা পাত্তা দেন নাই বরং ষড়যন্ত্র-তত্ত্বে জ্বালানি যুগিয়ে গেছেন। তারা কোন সুচিন্তিত রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করেন নি, কোন কার্যকরী কর্মপন্থা প্রণয়ন করেন নি, বরং করোনা নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্র, পৌরসভার গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ব্রাজিলের জাইর বোলসোনারো প্রশাসনের উদাসীনতা এবং দ্বায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে কিন্তু একটু সচেতন হলেই তাদেরকে বাঁচানো যেত। যুক্তরাজ্য সরকারকে মনে হয়েছে তারা কোভিড-১৯ থেকেও ব্রেক্সিট প্ল্যান নিয়ে বেশি চিন্তিত ও ব্যস্ত। যুক্তরাজ্যের জনসন প্রশাসন ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে পদক্ষেপ “বিচ্ছিন্নকরণ” সেটা করতে ব্যর্থ। আমার নিজের দেশ ইজরায়েলও রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনার শিকার। তাইওয়ান, নিউজিল্যান্ড, সাইপ্রাস তাদের সীমানা বন্ধ করে দেশকে বহির্বিশ্ব থেকে দ্বীপের মত বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। কিন্তু ইজরায়েল তখনো চালু রেখেছিল ব্যস্ত বেন গুরিওন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ যখন তুঙ্গে তখনো নেতানিয়াহু সরকার পর্যটকদেরকে ইজরায়েলে ঢুকতে দিয়েছে কোয়ারান্টাইন ছাড়াই এমনকি শরীরের তাপমাত্রা মাপার কোন ব্যবস্থাও ছিল না। লকডাউনের ঘোষণা দিতেও অনেক গড়িমসি করেছিল।

Researchers at the Covid-19 drive-in test station at the Saarbrücken exhibition centre © Rafael Heygster/Helena Manhartsberger

ইজরায়েল এবং যুক্তরাজ্য উভয় দেশই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বাজারে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে যাচ্ছে কিন্তু করোনার শুরুর দিকে তাদের অবহেলার জন্য উচ্চমূল্য চুকাতে হবে। করোনা মহামারীতে ব্রিটেন ইতিমধ্যে হারিয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার নাগরিক। ব্রিটেনে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার বিশ্বের মধ্যে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। অন্যদিকে ইজরায়েলে শনাক্ত করার তালিকায় সপ্তম স্থানে আছে। মহামারি মোকাবেলায় ইজরায়েল প্রতিটি আক্রান্ত মানুষের তথ্যের প্রক্রিয়া শুরু করেছে এবং আমেরিকান ফাইজার ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছে। ইজরায়েলের নাগরিকদের তথ্যের বিনিময়ে ফাইজার ইজরায়েলের সকল নাগরিকদের ভ্যাকসিন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যদিও সকল নাগরিকের গোপনীয় সকল তথ্য একটা কোম্পানির কাছে চলে যাওয়া উদ্বেগের বিষয়। কারণ, নাগরিকদের তথ্য দিয়ে কোম্পানি ও সরকার একচ্ছত্র আধিপত্য বিরাজ করতে পারে। নাগরিকদের তথ্যই এখন সরকারের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ।

করোনা মোকাবেলায় কিছু দেশ ভালোভাবে সামাল দিলেও সামগ্রিক বিচারে মানব সম্প্রদায় করোনা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। দেশগুলো করোনাকে রোধ করতে বিশ্বব্যাপী কোন পরিকল্পনাও গ্রহণ করতে পারেনি। ২০২০ সালের শুরুর দিকে তাকালে মনে হয় আমরা যেন গতি কমিয়ে একটা দুর্ঘটনার পুনর্মঞ্চায়ন দেখছিলাম। কীভাবে উহান থেকে করোনা ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ শুরু এবং সেখান থেকে ইটালি এবং তারপর ধীরে ধীরে পুরো বিশ্বকে মহামারী আচ্ছন্ন করে ফেলল সেটা পর্যায়ক্রমে দেখাতে সক্ষম আধুনিক বিজ্ঞান প্রযুক্তির যোগাযোগ ব্যবস্থা। কিন্তু বিশ্বের কোন নেতা বিশ্বকে গ্রাস করা মহামারী নিয়ন্ত্রণের বাস্তবিক পদক্ষেপ নিলেন না। করোনা নিয়ন্ত্রণের সমস্ত উপকরণ আমাদের ছিল, কিন্তু কোন দেশেরই রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল না। কেউ হয়ত বাড়িয়ে দেবে সাহায্যের হাত, প্রাণে প্রাণে শোনাবে মঙ্গলবারতা।

বৈজ্ঞানিক সফলতা এবং রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণ হলো বিজ্ঞানীগণ বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে থেকেও একে অপরকে সাহায্য করতে পারে কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা এখনো সামন্ত প্রভুর মত আত্মকেন্দ্রিক। অনিশ্চয়তা আর চাপের মধ্যে কাজ করার সময় বিজ্ঞানীগণ বিশ্বব্যাপী দ্বিধাহীনভাবে নিজেদের মাঝে তথ্যের আদানপ্রদান করে এবং একে অপরের প্রাপ্ত ফলাফল ও মতবাদের উপর নির্ভর করে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে। যেমন লকডাউনের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যের একটা, চীনের তিনটা, যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচটা মিলে মোট নয়টা গবেষণা প্রতিষ্ঠান একসাথে কাজ করছিল। পক্ষান্তরে রাজনীতিবিদগণ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে বিশ্বব্যাপী একসাথে কাজ করার জন্য একটা মৈত্রী গড়ে তুলতে পারলেন না। বিশ্বে দুই পরাক্রমশালী নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন একে অপরকে তথ্য গোপন করার জন্য দোষারোপ করছিল, ভুল তথ্য ছড়াচ্ছিল, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব হাজির করছিল এমনকি ইচ্ছাকৃতভাবে ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করছিল। আরও বেশ কয়েকটি দেশ করোনা ভাইরাসের মহামারী সংক্রান্ত মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছিল, কেউ তথ্য গোপন করছিল।

One of about 400 vaccination centres set up in Frankfurt’s Festhalle, which is usually a concert venue © Rafael Heygster

করোনাকালে তথ্য যুদ্ধে বৈশ্বিক সহযোগিতার অভাব ছাড়াও চিকিৎসার সরঞ্জামাদি নিয়েও দেশে দেশে দ্বন্দ্ব এখন চরমে। যদিও ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশের মাঝে পারস্পারিক সহযোগিতা এবং উদারতার যথেষ্ট নজির স্থাপিত হয়েছে কিন্তু সংকট থেকে উত্তরণে যত সম্পদ ও প্রচেষ্টা দরকার ছিল সেগুলো একত্রিত করে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে দেখা যায় নি। বৈশ্বিক উৎপাদন বিপণনের ভয়াবহ ঘাটতি লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষত, “ভ্যাকসিন ন্যাশনালিজম” নামে নতুন একধরণের বৈশ্বিক বৈষম্য দেখা দিয়েছে কারণ, কিছু দেশ তাদের জনগণকে ভ্যাকসিন দিতে পেরেছে, কিছু দেশ পারেনি।

এটা অত্যন্ত বেদনার, যেসব দেশ তাদের সব জনগণকে ভ্যাকসিন দিলো সেদেশগুলো মহামারী সম্পর্কে খুব সামান্য একটা বিষয় বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে যে, যদি ভাইরাস লাগামহীনভাবে সংক্রমণ করতেই থাকে তবে কোন দেশই শতভাগ জনগণকে ভ্যাকসিন দিলেও তারা নিরাপদ নয়। ধরে নিই ইজরায়েল বা যুক্তরাজ্য তার নিজ দেশের সীমানার মধ্যে ভাইরাস নির্মূল করতে সক্ষম হলো কিন্তু ভাইরাসটি ভারত, ব্রাজিল বা দক্ষিণ আফ্রিকায় ক্রমাগত লাখ লাখ মানুষকে সংক্রামিত করছে। ব্রাজিলের প্রত্যন্ত একটা শহরে ভাইরাসের নতুন মিউটেশন সারাবিশ্বের ভ্যকাসিনকে অকার্যকর করে দিতে পারে ফলে বিশ্বব্যাপী পুনরায় দেখা দিতে পারে ভাইরাসের নতুন সংক্রমণের নতুন প্রাদুর্ভাব। বর্তমান জরুরী পরিস্থিতিতে কোন ক্ষুদ্র স্বার্থ যেন জাতীয় কল্যাণকে ছাপিয়ে না যায়। যাইহোক, অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, বর্তমান জরুরী অবস্থায় সামগ্রিকভাবে বৈশ্বিক জনকল্যাণমুখী পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। এখন জাতীয় স্বার্থ রক্ষার সময়।

ভাইরাস মুক্ত পৃথিবীর খোঁজে

২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী যত ভাইরাস বিরোধী বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে তার রেশ রয়ে যাবে আগামীতে অনেক বছর। কিন্তু সব রাজনৈতিক ঘরানার মানুষ কোভিডাক্রান্ত সময়ে তিনটা শিক্ষা পেয়েছেন। প্রথমত, আমাদের ডিজিটাল অবকাঠামোর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ডিজিটাল অবকাঠামো মহামারী সময়ে আমাদের ত্রাণ কর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও একবার যদি বিকল হয়ে যায় তাহলে প্রলয় হতে আর কিছু বাকি থাকবে না। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি দেশকে জনস্বাস্থ্য অবকাঠামো মজবুত করতে আরো বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। এটাই আত্মরক্ষার নয়া কৌশল কিন্তু রাজনীতিবিদ এবং ভোটার অনেক সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা অবহেলা করেও সাময়িক সময়ের জন্য সফল হতে পারে। তৃতীয়ত, পৃথিবীর সব দেশকে মিলিতভাবে মহামারী নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণের জন্য সমন্বিত ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। মানুষ এবং জীবাণুর মধ্যকার এতদিনের বহু পুরনো যুদ্ধে সম্মুখে যারা থাকে তাদের শরীরে জীবাণু প্রবেশ করে এবং তারাই পুরো মানব জাতিকে বাঁচায়। যদি সম্মুখের জীবাণু যোদ্ধারা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে কখনো ভেঙে পড়ে তাহলে আমরা সবাই বিপদে পড়ে যাবো। ঠিক এই কারণেই পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত-দেশের সবচেয়ে ধনী মানুষেরও পৃথিবীর অপর প্রান্তের সবচেয়ে দরিদ্র-দেশের দরিদ্র মানুষটিকে জীবাণুর হাত থেকে রক্ষা করা তার ব্যক্তিগত স্বার্থরক্ষার মধ্যে পড়ে। যদি কোন দরিদ্র-দেশের প্রত্যন্ত জঙ্গলে একটা নতুন ভাইরাস বাঁদুরের শরীর থেকে মানুষের শরীরের সংস্পর্শে চলে আসে কয়েকদিনের মধ্যেই সেই ভাইরাস ওয়াল স্ট্রীটের শেয়ার বাজারে হাঁটা শুরু করবে।

Bioscientia’s laboratories, where coronavirus tests are diagnosed, evaluated and archived © Rafael Heygster

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য কিছু প্রতিষ্ঠানের কাছে মহামারী বা প্লেগ প্রতিরোধের জন্য ইতিমধ্যেই বিশ্বব্যাপী ব্যবস্থা গ্রহণ করা আছে। কিন্তু মহামারী প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্য কোন অর্থ বরাদ্দ নাই, যোগ্যতা সম্পন্ন জনবল নাই এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক ক্ষমতা নাই। প্লেগ নিয়ন্ত্রণের মত সংক্রমণ প্রতিরোধকারী প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে যাতে তারা আত্মসর্বস্বদের মর্জির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল না হয়ে পড়ে। আগেও উল্লেখ করেছি, আমি মনে করি নির্বাচিত এবং দক্ষ মানুষই গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণে নিয়োজিত থাকা উচিত। যদিও এ-ব্যবস্থার মধ্যেও রাজনীতিবিদগণের স্বার্থ সংরক্ষিত থাকে। কিন্তু কিছু স্বাধীন বিশ্ব স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে। তাদের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে হবে নাগরিকের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্য, তারা পর্যবেক্ষণ করবে ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য রোগবালাই, সতর্ক বার্তা পাঠাবে প্রতিটি দপ্তরে, গবেষণা ও উদ্ভাবনে নেতৃত্ব দেবে।

বিশেষজ্ঞগণ আশংকা করছেন কোভিদ-১৯ হয়ত বড় মহামারীর প্রাথমিক আঘাত। কিন্তু কোডিডের শিক্ষা যদি কাজে লাগাই তবে দেখব কোভিড-১৯ শেষ পর্যন্ত অতীতের মহামারীর মত মড়কে পরিণত হচ্ছে না। মানুষ নিত্য নতুন জীবাণুর প্রবেশ থামাতে পারে না। এইটাই হলো প্রাকৃতিক বিবর্তনের খেলা যা চলছে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে এবং ভবিষ্যতেও পরিবর্তন ঘটবে কারণ বিবর্তন একটা চলমান প্রক্রিয়া। কিন্তু বর্তমানে জীবাণুর আক্রমণ এবং মহামারী থেকে রক্ষার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান-বুদ্ধি ও যন্ত্রায়োজন আছে।

যদি কোভিড-১৯ ভাইরাস ২০২১ এসে আর না ছড়াতো এবং লাখো মানুষের মৃত্যু ঘটাতে না পারতো অথবা যদি ২০৩০ সালে আরও ভয়ানক মহামারী আঘাত হানে তবুও সেটা কোন অনিয়ন্ত্রণযোগ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয় এবং সেই দুর্যোগ কোন ঈশ্বর প্রদত্ত শাস্তিও নয়। এটা হবে মানুষের পরাজয়, আরও সংক্ষেপে বুঝিয়ে বললে এটা হবে রাজনৈতিক ব্যর্থতার কারণে পরাজয়।

মূল প্রবন্ধ: Yuval Noah Harari: Lessons from a year of Covid