গ্রিক মিথোলজি মতে বীর একিলিসের জন্মের পর পরই ভবিষ্যদ্বাণী হয় একিলিস অল্পবয়সেই মৃত্যুবরণ করবেন।একিলিস মাতা অমরত্বের নদীতে গিয়ে একিলিসকে তার পবিত্র জলে চুবিয়ে আনেন এতে একিলিসের জীবন সুরক্ষিত হয়ে যায় বটে কিন্তু মাতা অজান্তে একটি ভুল করে বসেন।তিনি একিলিসের গোড়ালীর যে অংশ ধরে তাকে পানিতে স্নান করান সেই অংশটিতে পানি স্পর্শ করেনি ফলে তার সেই অংশটি থেকে যায় অরক্ষিত।পরবর্তিতে অনেক যুদ্ধে অপরাজেয় থাকার পর প্রতিপক্ষ তার অরক্ষিত গোড়ালীর তথ্য পেয়ে যায় এবং সেই অরক্ষিত অংশে আঘাত করেই একিলিসকে হত্যা করা হয়।এই মিথ থেকেই ইংরেজীতে নাজুক বা অরক্ষিত কিছুকে বুঝাতে একিলিস হিল’ প্রেইজটি ব্যবহার করা হয়।বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের কিছু কর্মকান্ড দেখে একিলিসের এই গল্পটি মনে পড়ে গেল।এতকাল জানতাম ‘বাকশাল’ হলো আওয়ামীলীগের একিলিস হিল।বাকশালের নাম শুনলেই নেতাদের মুখ চুপসে যেতো এবং এখনো যায়। বাকশালের স্বপক্ষে যুক্তি খাঁড়া করার বদলে শব্দটির গন্ধ শরীর থেকে ঝেড়ে মুঁছে ফেলতেই তাদেরকে বেশি তৎপর হতে দেখা যায়।কেউ কেউতো বাকশাল গঠনের সকল দায়ভার তৎকালীন লীগঘেঁষা বাম দলগুলির ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অপাপবিদ্ধের মহিমা দিতে চান। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর পর হাজীলীগ গাজীলীগ ইত্যাদি বহুমুখীলীগ গজিয়ে ওঠার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল শরীর থেকে বাকশালী গন্ধ ঝেড়ে ফেলা।সম্ভবত বয়োজ্যেষ্ট নেতা আব্দুর রাজ্জাকই একমাত্র নেতা যিনি বাকশালে অনড় অটল হয়ে থেকেছিলেন।আওয়ামীলীগ স্বনামে ফিরে না আসা পর্যন্ত তিনি বাকশালকে বিসর্জন দেননি।এহেন দৃঢ়চেতা নেতার শেষকালটা আওয়ামীলীগের সাথে খুব ভালভাবে যায়নি।আওয়ামীলীগের এই একিলিস হিলের সাথে এখন যুক্ত হয়েছে আরেক নতুন একিলিস হিল আর সেটা হলো ধর্মনিরপেক্ষতা।এক সময় বাকশাল নাম শুনলে আওয়ামীলীগাররা যেমন বিব্রতবোধ করতো এখন ধর্মনিরপেক্ষতার কথা শুনলেও তারা তেমনি শরমিন্দা হয়ে যা্ন।এই শব্দের প্রতি আওয়ামীলীগের বিরাগের শুরু কিন্তু সাম্প্রতিক কালের নয়।স্বৈর শাসনের পতনের পর প্রথম নির্বাচনে অনেকটা নিশ্চিত বিজয় হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পরই তাদের অনুভূতি পাল্টাতে শুরু করে।সেসময় বিরোধী দলে থাকাকালীনই তাদের মাথায় টুপি আর থুতনিতে দাড়ি গজাবার একটা দৃশ্যমান প্রবনতা শুরু হয়ে যায়।জিয়াউর রহমানের ‘বেছমিল্লা হিররাহমানের’ অনুকরণে শেখ হাসিনা সহ দলের নেতা কর্মীগণ যখন জিয়া স্টাইলের বাংলা ভার্সন ‘পরম করুণাময় আল্লাহর’ নাম নিয়ে যাবতীয় কর্মকান্ডের উদ্বোধন করা শুরু করলেন তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল আওয়ামীলীগে সেক্যুলারিজম কুপোকাত হয়ে ঐ আসে ভৈরব হরষে রূপে ইসলাম আসতে শুরু করেছে।বলা বাহুল্য আওয়ামীলীগের এই বোল আর ভেক পাল্টানো ব্যাপারটি ক্ষমতাসীন বিএনপি ভালভাবে নেয়নি।না নেয়াটাই যুক্তিযুক্ত।যে সিসিম ফাঁক মন্ত্র নিয়ে তারা ক্ষমতার রত্নগুহায় প্রবেশ করেছে সেই মন্ত্রটি যদি প্রতিপক্ষ ধরে ফেলে তাহলেতো ক্ষমতার নিরংকুশ ভোগ অসম্ভব হয়ে যায়।এক খাপে দুই তলোয়ার থাকে কীভাবে? তাই আওয়ামীলীগের গায়ে হুল ফুটাতে তৎকালীন ঠোঁটকাটা মন্ত্রী ব্যরিস্টার নাজমুল হুদা আওয়ামী নেতৃত্বের এই প্রবনতাকে ইঙ্গিত করে বলে বসেছিলেন-আওয়ামীলীগ হলো নও মুসলিম।বাস, শুরু হলো তীব্র প্রতিক্রিয়া। আওয়ামীলীগের সাংসদরা ইতোপূর্বেই তাদের পদত্যাগপত্র রেডি করে রাখলেও তা জমা দেননি কিন্তু ব্যরিস্টার হুদার এই মন্তব্যের পর তারা হুড়মোড় করে একযোগে সংসদ থেকে পদত্যাগের মাধ্যমে শেষপর্যন্ত সরকারেরই পতন ঘটিয়েছিলেন আর সেই সাথে এটাও প্রমাণ করেছিলেন আসলেই তারা নও মুসলিম।আমাদের ইতিহাস স্বাক্ষী, একজন বনেদি মুসলমান যতটা না অন্য ধর্মের উপর খড়গহস্ত হয় তারচেয়ে একশগুণ বেশি চন্ডরূপ ধারণ করেছে নও মুসলিমরা।তবুও বিষ্ময়করভাবে এই ‘নওমুসলিম’ স্পিরিটটি আওয়ামীলীগের প্রথম টার্মে খুব একটা দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি।দুহাজার এক এর নির্বাচনোত্তর উত্তর ডিপ্রেসন কালের পর যখন আওয়ামীলীগ আবার ক্ষমতায় আসল তখনও তারা মোটামুটি একটা সংযত অবস্থানে ছিল।এর প্রমাণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মতো কঠিন বিষয়ে হাত দেয়া, গণজাগরণ মঞ্চের সমর্থনে সংসদে প্রধানমন্ত্রীর উচ্ছ্বসিত ভাষণ,ধর্মোন্মাদ কুপমন্ডুকদের হাতে ব্লগার রাজীব হায়দার খুন হওয়ার পর তাকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ আখ্যা দিয়ে তার বাসায় ছুটে যাওয়া ইত্যাদি।এ পর্যন্ত আওয়ামীলীগে ধর্মনিরপেক্ষতার চিহ্নটি ক্ষীয়মান চাঁদের মতো হলেও নিভু নিভু করে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল কিন্তু অতি স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আমলা সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানের নিকৃষ্টতম এবং অনৈতিক হলুদ সাংবাদিকতায় এবং শাপলা চত্তরে গজিয়ে ওঠা হেফাজতি তান্ডবে দপ করেই তা নিভে যায়।নিজেদের গদি রক্ষার তাগিদেই সরকার সেদিন হেফাজতের বিরুদ্ধে যে হার্ডলাইন ফর্মূলা নিয়েছিল শেষ পর্যন্ত যদি সেই স্ট্যান্ডটি ধরে রাখতে পারত অর্থাৎ মৌলানা শফিকে যদি তখন হেলিকপ্টারে করে চট্টগ্রামে না পাঠিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে কেন্দ্রীয় কারাগারে ভরে দিত আর বাদবাকি পালের গোদাদের মাস খানেক দৌড়ের উপর রাখত তাহলে কিছুতেই দেশে বর্তমানের এই জেহাদি আবহ সৃষ্টি হতোনা।বিপ্লবের আগুন একেবারে গোড়াতেই ফ্লপ মেরে যেতো।কথায় আছেনা মোল্লারা মাইরেও পাস্ট,দৌড়েও পাস্ট।কিন্তু সরকার সে পথে যায়নি।বরং হেফাজত তাদের দ্বিতীয়বারের মতো উপলব্ধি করতে শেখায় এই মূর্খের দেশে ক্ষমতা ধরে রাখতে মূর্খতাকেই ধারণ করতে হবে।শুধু ধারণ নয় এর ব্যাপক চাষাবাদও করতে হবে।তারই প্রমাণ উপজেলায় উপজেলায় সরকারী মসজিদের পত্তন,পাঠ্যবই থেকে জ্ঞান বিজ্ঞান নীতি নৈতিকতা ও মানবিকতার পাঠকে নির্বাসিত করে অলীক মিথ্যাচার আর ব্যক্তিপূজার প্রবর্তন করা,মাদ্রাসার ঝাড়ফোঁক বিদ্যাকে রাষ্ট্রীয় বা একাডেমিক মর্যাদা দান করা ইত্যাদি ইত্যাদি আরও অনেক অনেক কর্মকান্ড।নেতা কর্মীগণ তাদের মুসলমানিত্ব প্রমাণের জন্য তাদের দলনেত্রীর স্তবপাঠ করতে করতে তাকে ইসলামের এক মহান সাধ্বী হিসেবে প্রতিষ্টিত করেছেন।তিনি ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদ সহ ক রাকাত নফল নামাজ পড়েন,ক পাড়া কোরান তেলাওয়াত করেন,কত সময় জায়নামাযে তসবি টিপে কাটান,তাঁর আমলগুণে সামুদ্রিক ঝড় আইলা দুর্বল হয়ে যায়,তাঁর দোয়াতে ক্রিকেটে বাংলাদেশ দল চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায় ইত্যাদি বিবরণ রেডিওর ধারাভাষ্যের মত প্রচার হতে শুনি।শুধু তাই নয় মহান সংসদে দাঁড়িয়ে তাঁর উপস্থিতিতে তাঁকে হযরত, রাঃ ইত্যাদি বলে প্রশংসা করা হয় আর তিনি নিজে বসে বসে এসব স্তোত্রপাঠ উপভোগ করেন।কিন্তু আওয়ামীলীগ এখানেই থেমে থাকেনি তারা উপলব্ধি করেছে শুধু বর্তমান নিয়ে পড়ে থাকলে চলবেনা তাদের অতীত কর্মকান্ডকেও ইসলামী পাতে মুড়িয়ে ফেলতে হবে এজন্য হাত দিতে হবে গোড়াতে আর গোড়া মানেইতো বঙ্গবন্ধু।অতঃপর শুরু হলো বঙ্গবন্ধুকেও খাঁটি মুসলমান বানানোর প্রক্রিয়া।কিছুদিনের মাঝেই গায়ে সফেদ পাঞ্জাবি আর মাথায় টুপি পড়া বঙ্গবন্ধু ফেসবুক সহ সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেলেন।কেউ কেউ তাঁকে বানালেন মুজাদ্দিদ কেউ খলিফা।কিন্তু অডিও রেকর্ডগুলির কী হবে? ধর্মনিরপেক্ষতা সমাজতন্ত্র নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন সময়ে দেয়া বক্তব্যগুলি যে মুজাদ্দিদ বা খলিফা চরিত্রের সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে যায় তার কী হবে? নো চিন্তা, এগুলিকে সম্পাদনা করতে হবে।চলচ্চিত্রের সেন্সর নিয়মে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা সমাজতন্ত্র বিষয়ক বক্তব্যগুলিকে কাট করে দিতে হবে।তাই হলো।গত ১৫ নভেম্বর ২০২০ জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর তৎকালীন সংসদে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ভাষণটির যে অডিও শুনানো হয় তা ছিল এডিট করা। আর সেই এডিট করা অডিও থেকে সুকৌশলে সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ক অংশটি বাদ দিয়েই প্রচার করা হয়েছে। সমালোচনার মুখে স্পীকার যে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন তা রিতিমত হাস্যকর।তারা নাকি বাংলাদেশ বেতার থেকে ভাষণটি সংগ্রহ করে বাজিয়েছেন।বেতার কী করেছে তা নাকি তাদের জানার কথা নয়।তারা সেটাতে কোনো হাত লাগাননি।বাহ কি চমৎকার যুক্তি! জাতীর পিতার একটি ভাষণের রেকর্ড কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষা ছাড়াই সংসদে বাজিয়ে ফেললেন? সংসদ কি চায়ের স্টল আর বঙ্গবন্ধু স্রেফ একজন ক্যানভাসার? আসলে এই প্রক্রিয়াগুলি বিচ্ছিন্ন কোনো প্রচেষ্টা নয় বরং বৃহৎ পরিকল্পনারই অংশমাত্র। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে আদর্শিক এবং মানবিক অংশগুলি বাদ দিয়ে খন্ডিতভাবে প্রচারের উদ্দেশ্যই হল তাঁকে একজন খাঁটি ইসলামী নেতা হিসেবে প্রতিষ্টিত করে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সমাহিত করা।সবকিছু অতি নিপুণভাবে সম্পন্ন হয়ে গেলেও আওয়ামীলীগের ইসলামিকরণে এখন একমাত্র অশোভন জিনিষটি হচ্ছে তাদের পোষাক।মুজিব কোটে রঙ্গের স্বাধীনতা এসেছে এবার ডিজাইনেও কিঞ্চিত পরিবর্তন প্রয়োজন।তা অবশ্য খুব কঠিন নয় দুটি হাত সংযোজন এবং দৈর্ঘ্যে একটু বাড়িয়ে দিলেই তা এক ধরণের জোব্বায় রূপান্তরিত হয়ে যাবে।দেখতেও তখন খাঁটি ইসলামীই লাগবে।
দেশটা কি এইভাবেই শেষ হয়ে যাবে? মাঝেমধ্যে মনে হয় আমরা স্বাধীন হই-ই নাই। স্রেফ অন্য নামে পাকিস্তান হয়েছি।
ভালো বিশ্লেষণ