তৃণাঙ্কুর আহমেদ
আদর আবেং, একজন আদিবাসী লেখক, জনজাতির কণ্ঠ নামের এক ওয়েবপোর্টালে প্রকাশিত এক নিবন্ধের শিরোনাম দিয়েছিলেন
“আদিবাসী ও উচ্ছেদঃ সমার্থক দুটি শব্দ?”
তার শিরোনামটি নতুন করে ভাবাচ্ছে নতুন একটি প্রেক্ষাপটে। ফেসবুকে ম্রো সম্প্রদায়ের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের ছবি দেখতে পাচ্ছি ইদানিং। জেনেছি বান্দরবনের চিম্বুক পাহাড়ে এক হাজার একর জমি দখল করে “এমিউজমেন্ট পার্ক” নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। চিম্বুক পাহাড়ের সে অংশে বংশপরম্পরায় ম্রো সম্প্রদায় বসবাস করে আসছে। সেই এমিউজমেন্ট পার্ক নির্মিত হলে বাপদাদার আমলের ভিটা ত্যাগ করতে হবে তাদের। এর মধ্যেই উচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে।
বাংলাদেশের আদিবাসী উচ্ছেদের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় ঢাবি অধ্যাপক আবুল বারকাতের গবেষণায়। তার মতে, গত ৬৪ বছরে ২ লাখ ২ হাজার ১৬৪ একর জমি কেড়ে নেয়া হয়েছে আদিবাসীদের কাছ থেকে! বাংলাদেশ সরকার ২২ টি আদিবাসী সম্প্রদায়ের অস্তিত্বই স্বীকার করে না! এদেশে প্রায় ৫০ লাখ আদিবাসী বসবাস করলেও, সরকারী হিসেবে বাস করছে মাত্র ২৫ লাখ!
তথাকথিত সভ্যতা থেকে দূরে পাহাড় জঙ্গলে প্রকৃতির মাঝে প্রকৃতির বাধ্য সন্তানের মতোই বাস করে আসছিল আদিবাসীরা নিজেদের সংস্কৃতি, ভাষা ও ঐতিহ্য নিয়ে। সেই পাহাড়ে প্রথম আঘাত হেনেছিল ইংরেজরা টিস্টেট নির্মাণের মাধ্যমে। পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল পাহাড়ি জীবনযাত্রায়। পাহাড়ি প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে একের পর এক টিস্টেট নির্মাণ করা হয়েছিল। চা বাগানের পর এখন শুরু হয়েছে পর্যটনের আগ্রাসন! পার্বত্য চট্টোগ্রামের বিভিন্ন অংশে নির্মিত হয়েছে কটেজ, হোটেল ও এমিউমেন্ট পার্ক বন উজার করে, পাহাড় কেটে। পাহাড়ি আদিবাসীরা তাদের ভূমি হারিয়েছে, পাহাড়ের নিশ্ছিদ্র নির্জন নিরাপত্তা হারিয়েছে, হারিয়েছে তাদের সংস্কৃতি। পাহাড়ি সেটলারদের দ্বারা আদিবাসী নারী ধর্ষণের খবর খুব স্বাভাবিক এদেশে। যে হারে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে ভিটেমাটি থেকে, চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে সমতলের পুঁজিবাদী সংস্কৃতি, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে আর কোন আদিবাসী গোষ্ঠী থাকবে না। এর মধ্যেই রাজশাহীর কোল ও ভিল সম্প্রদায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ থেকে।
আমেরিকায় বসতি স্থাপন করেই রেড ইন্ডিয়ানদের প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল ইউরোপিয়ানরা। যেদেশে ছিল তাদের পূর্বপুরুষের চারণক্ষেত্র, যে দেশের অধিপতি ছিল তাদেরই প্রপিতামহরা, ইউরোপীয় সভ্যতার(!) বিকাশে সে দেশেই তারা এখন বাস করছে রিজার্ভড ল্যান্ডে! বড়ো সংস্কৃতির আগ্রাসনে ছোট সংস্কৃতিগুলো এভাবেই ধ্বংস হয়ে যায়।
কিছুদিন আগে ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু হয়েছে “সাঁওতালি বিভাগ”, তাদের ভাষা সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা করার জন্য। সংস্কৃতির-শিল্পের বিকাশ তো দূরের কথা, আমাদের দেশে আদিবাসীদের “আদিবাসী” পরিচয় পর্যন্ত নেই। আমাদের সংবিধানে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে “ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী” হিসেবে! যে সাঁওতালেরা সিপাহী বিপ্লবের দুই বছর আগেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, দিয়েছিল ১০ হাজার প্রাণ, তারা এদেশের আদিবাসী নয়; যে কোল ভাষার শব্দ বাংলায় দেশী শব্দ হিসেবে গৃহীত হয়, সে কোলেরা আদিবাসী নয়, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী! স্বাধীনতার পর থেকে এভাবেই বঞ্চিত করে আসছি আমরা আদিবাসীদের। আমরা তাদের ভাষা সংস্কৃতিতে আঘাত করছি, তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পাল্টে দিয়েছি, শেষে দখল করে নিয়েছি তাদের ভূমি, বাসস্থান আর জীবনভূমি। পর্যটন শিল্প বাড়ানোর নাম করে আবার দখল করা হচ্ছে হাজার একর জমি। পথে নেমেছে, প্রতিবাদে মুখরিত হয়েছে তাই ম্রো সম্প্রদায়।
যে বাঙালি শিশিরের স্বচ্ছতা পায়ে মাড়িয়ে যায়, রাস্তার পাশের ভাঁটফুল আর হেলেঞ্চাকে মনে করে আগাছা, ছাতিম কেটে লাগায় ইউক্যালিপটাস; যে বাঙালি হেমন্তের পাকা ধানের হলুদ সবুজ, কাঁচা হলুদ আর লালচে হলুদে সৌন্দর্য খুঁজে পায় না, একবারও তাকায় না তারাভরা আকাশ কিংবা শুক্লপক্ষের দুধেল জোছনার দিকে, তারাও পাহাড়ে যায় সৌন্দর্যের খোঁজে, প্রকৃতির সান্নিধ্যে। যারা কোনদিন শীতের পূর্ণিমায় আমলকীর ডালে লক্ষ্মীপেঁচার চোখে তাকানোর চেষ্টা করেনি, তারা কী বোঝে পাহাড়ের বিশালতার? তাদের জন্যেই তৈরি করা হচ্ছে পাহাড় কেটে শত শত কটেজ, নির্মিত হচ্ছে হাজার একর জুড়ে এমিউজমেন্ট পার্ক! এদের জন্যেই ভিড় জমেছে সাজেকে, পলিথিনে প্ল্যাস্টিকে দূষিত হচ্ছে পাহাড়ের মাটি।
যে কোন দেশের সৌন্দর্য বৈচিত্র্যে। মরুভূমির মনোটোনাস ধূসরতা আমাদের যেমন স্নিগ্ধতা দেয় না, সমতলের একটানা সবুজও আমাদের দেয়না শান্তি। পাহাড়কে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, বাঁচিয়ে রাখবে হবে পাহাড়ের আদিবাসীদের। ম্রো কিংবা অন্য যে কোন আদিবাসী সম্প্রদায়ের উচ্ছেদ চ্যালেঞ্জ করে আমাদের গণতন্ত্রকে, সভ্যতাকে, মানবতাকে। ভূমি অধিগ্রহণের নামে ম্রোদের উচ্ছেদ করা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। দেশের বিভিন্নমহল থেকে এর জন্য প্রতিবাদ করতে হবে। মানবাধিকারের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, সভ্যতার জন্য, সৌন্দর্য ও সংস্কৃতির জন্য।
Leave A Comment