প্রতিদিন সারাদেশে শত শত মানুষ সংঘবদ্ধ কোন গ্রুপ দ্বারা কানে ধরা, জুতার মালা, মাথায় ঘোল, মাথা ন্যাড়া করে দেয়া, নাকে খতসহ বিভিন্ন লাঞ্ছনার শিকার হয়ে থাকেন। প্রতিবাদের নামেতো হয়ই, কাউকে ফাঁসিয়ে তারপর সালিশের নামে এই ঘটনাগুলো সবচে বেশি ঘটে।
এখন মোবাইল ফোনের কল্যাণে কিছু কিছু ঘটনা ফেসবুকে আসছে। সামনে আরো আসবে। যেমন, মাদ্রাসার হুজুরের মাথায় মলমূত্র ঢালার ভিডিওটি। একবার দেখুন। একটা মানুষ কতটা অসহায় হয়ে যায় ওই সময়! চেহারার দিকে ভালো করে চেয়ে দেখুন, এমন অন্ধকার আপনি জীবনেও দেখেননি।
ক’দিন আগে একটা ঘটনা জানতে পারলাম। এক ছেলের নাস্তিকতা তার পরিবার জেনে যায়। ভাইয়ের মাধ্যমে বিষয়টা এলাকায় জানাজানি হয়। তারপর বাড়িতে লোকজন জড়ো হয়। কেউ বলে জুতার মালা পরাও, কেউ বলে পেটাও, কেউ বলে মাথায় বিষ্ঠা লেপে দাও…। যতটা না পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য, তারচে বেশি পাপমুক্ত হওয়ার আশায় ওই ছেলের বাবা মা মসজিদ থেকে হুজুর এনে ছেলেকে তওবা করায়। তওবা করানোর সময় ছেলেটি রাজি হচ্ছিলো না। তখন তার বাপ ভাইসহ উপস্থিত এমন কেউ বাকি ছিলো না, যে পেছন থেকে মাথায়, পিঠে, ঘাড়ে দুই চার ঘা লাগায়নি। এমনকি শিশুদের লেলিয়ে দেয়া হয়েছিলো তাকে চটকোনা দেয়ার জন্য।
সেই রাতে ছেলেটি এলাকা ছেড়ে, পরে দেশ ছেড়ে চলে যায়।
মাদ্রাসার শিক্ষক বৃদ্ধ মানুষ। হয়তো তিনিও এলাকা ছেড়ে চলে যাবেন। হয়তো অন্য কোথাও যাওয়ার সামর্থ্য নেই। কিন্তু এই ঘটনায় মানুষটির মনে ভাঙন ধরেছে। তার ভেতরটা ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাবে। তার পরিবারকে সারাজীবন এই স্মৃতি বয়ে বেড়াতে হবে।
এভাবে দেশের অধিকাংশ মানুষ কোন না কোন অপমান, কোন না কোন ক্ষত বুকে বয়ে বেড়াচ্ছে। অসংখ্য প্রাণোচ্ছ্বাসহীন মনুষ, সেসব মানুষ নিয়ে সমাজ, এই দেশ। ক্ষত ঢাকতে উপরে বার্ণিশ করা, ভেতরটা খালি। সাহস নেই, উৎসাহ নেই, উদ্যম নেই। এগিয়ে যাওয়ার উপায় নেই। সুযোগ পেলেই কোন কোন অপমানের স্মৃতি রাশ টেরে ধরে। তাই মানুষে চাওয়া ছোট হয়ে যাচ্ছে, লক্ষ্য খাটো হচ্ছে, স্বপ্ন মরে যাচ্ছে। কোনভাবে বেঁচে থাকাটাই বাধ্যগত জীবনের লক্ষ্য হয়ে যাচ্ছে।
একটু চেষ্টা করলেই অনুভব করতে পারবেন আপনার চারপাশ কত বিষন্ন, কত অন্ধকার, কতটা স্থবির। মানুষ হাসে না, হাসার চেষ্টা করে। মানুষ আনন্দে নাচে না, শরীরটাকে টেনে উপরে তুলে আবার মাটিতে ফেলে। একটু মনযোগ দিয়ে দেখার চেষ্টা করুন কয়টা হাসি, কয়টা আনন্দ মেকি নয়, বুঝতে পারবেন।
শুরুটা হয় পরিবার থেকে। শহর ও গ্রামভেদে একেক ধরণের অপমান। কানে ধরানো, অতিথির সামনে বকাঝকা, পরিবারের সবাই মিলে অপমান করা, খাবার বন্ধ করে দেয়া, রাতে ঘরে ঢুকতে না দেয়াসহ আরো অনেক কিছু। এরপর স্কুলে। কানে ধরে বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে রাখা, বাদবাকি সব ছাত্রছাত্রীদের সাথে নিয়ে শিক্ষকের নেতৃত্বে নির্দিষ্ট একজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে হাসিতামাশা করা, স্কুলের মাঠে কপালে চক/ইটের টুকরো রেখে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করাসহ আরো অনেক রকমের শাস্তি। এভাবে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে র্যাগিংয়ের নামে অপমান, তথাকথিত ভাইয়া আপুদের দ্বারা মানসিক নির্যাতন। তারপর কর্মস্থলে কলিগদের সংঘবদ্ধ হাসি তামাশার শিকার। আর সমাজের প্রভাবশালী গোষ্ঠী কর্তৃক নানান ধরণের লাঞ্ছনার ঘটনাতো আছেই।
কোথাও দুই জন মিলে কাউকে লাঞ্ছিত করতে থাকলে চারজন, দশজন করে শ’খানেক লোক জমে যাওয়া কয়েক মিনিটের ব্যাপার। মানুষ এটা খুব উপভোগ করে। ন্যায় বিচার, বা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য কেউ কারো সাথে এমনটা করে না। তারা হয়তো জানেও না, এমন আচরণ করে কারণ তারা এটা উপভোগ করে।
এসব থেকে মুক্তির কী উপায় আছে জানি না। তবে প্রতিবাদের নামে যারা অপরাধীকে এভাবে লাঞ্ছিত করে, প্রথমে তাদেরকে প্রতিহত করতে হবে। তাহলে কাউকে ফাঁসিয়ে সালিশের নামে লাঞ্ছিত করাও ঠেকাতে পারবেন।
প্রতিবাদের নামে গণঅপমানের সবচে খারাপ দিক হচ্ছে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম বাধাগ্রস্থ হওয়া। কিছুদিন আগে ফেসবুকে একটা ছবি দেখলাম এক ধর্ষকের গলায় জুতার মালা পরিয়ে গ্রামে ঘুরানো হচ্ছে। যিনি শেয়ার করেছেন তিনি জুতার মালা পরা ধর্ষককে দেখে খুব খুশি হয়েছেন এবং যারা এই কাজ করেছে, তাদেরকে স্যালুট দিয়েছেন। এর পরের ক’দিন মিডিয়ায় চোখ রেখেছি, ওই ধর্ষণের ঘটনায় কোন মামলা হওয়ার খবর চোখে পড়েনি। ধর্ষককে জুতার মালা পরিয়ে গ্রামে হাঁটানোর পর ওই এলাকার বিক্ষুব্ধ জনতার ক্ষোভের কিছুটা প্রশমন হয়। কোন একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ, যারা উদ্যোগী হয়ে গণঅপমানের আয়োজন করে, তাদের বিনোদনের ব্যবস্থা হয়। উৎসাহী জনতা হাসতে হাসতে ঘরে ফিরে যাওয়ার সময় বলেছে “উচিত শিক্ষা হয়েছে!” কেউ আর বিচারের কথা বলেনি, কারণ উৎসাহী বিনোদনলোভী মানুষের তৃপ্তি পাওয়ার মাধ্যমে বিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ধারণা জন্ম নেয় এবং হয়তো ধর্ষিত শিশুটির বাবা মাও প্রতিশোধ নেয়ার স্বাদ পেয়ে যান। ফলে বিচারের দাবিটি আর প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
বিচারের দাবি মাঠে মারা গেছে এটা একটা বিপদ। তারচে বড় বিপদ এলাকার লোকজনের বিনোদিত হওয়া। তো, এর পরের বিনোদন কী হবে? আরেকটা ইভেন্টের অপেক্ষা। আবার সবাই মিলে কাউকে হেনস্থা করা হবে। হতে পারে সে ধর্ষক, হতে পারে কলাচোর, হতে পারে মসজিদের জুতা চোর। আবার হতে পারে নিরপরাধ কোন ব্যক্তি। হয়তো সেদিনের সেই হেনস্থায় এই ধর্ষকও অংশ নিবে, মজা নিবে। এর আগ পর্যন্ত বিনোদনের জন্য ধর্ষিত শিশুটিতো আছেই। এবার তাকে নিয়ে মুখরোচক কথাবার্তা, তার পরিবারের লোকজনের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকানো, নিজেদের আড্ডায় ওই ধর্ষককে ডেকে তার ইন্টারভিউ নেয়া, কিভাবে কী করেছে তার প্রতিটি সেকেন্ডের বর্ণনা শোনাসহ কিছু খুচরা বিনোদনের সুযোগ বহাল আছে।
ক’দিন আগে আরেকটি ছবি দেখেছি মুহম্মদ অবমাননার অভিযোগে একজন হিন্দু ধর্মালম্বী যুবককে জুতার মালা পরিয়ে মারধর করা হচ্ছে। এখানে উৎসুক জনতার আনন্দ ধর্ষকের ছবির উৎসুক জনতার চেয়ে বেশি। এখানে দ্বিগুন আনন্দ। প্রথমত লাঞ্ছিত যুবকটিকে মুহম্মদ অবমাননাকারী বলে ফাঁসানো হয়েছে, দ্বিতীয়ত লোকটি হিন্দু। তার মানে একই সাথে একজন নাস্তিক ও একজন হিন্দু নামধারীকে অপমান করার সুযোগ পাওয়া গেলো! আনন্দের সীমা নাই।
ধর্মান্ধ ওই মানুষগুলো আসলে তাদের নবী অবমাননার বিচার করেনি। এর বিচার তারা চায়ও না। পুলিশ নিজ উদ্যোগে গ্রেফতার করে না আনলে ওই বিক্ষুব্ধ জনতা হয়তো কয়েকদিন ধরে একের পর এক নির্যাতন করে যেত, হয়তো পিটিয়ে মেরেও ফেলতো। অথচ সরকার নবী অবমাননার বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা রেখে আইন করেছে। কিন্তু বিক্ষুব্ধ/উৎসুক জনতা আসলে বিচার চায় না। তারা গণধোলাই, গণঅপমানে অংশ নিয়ে কিছুটা সময় তৃপ্তিসহকারে জমজমাটভাবে বেঁচে থাকতে চায়। কাউকে অপদস্থ করার আনন্দস্মৃতি রোমন্থন করতে চায়, এসব নিয়ে গল্প করে সময় কাটাতে চায়।
ধর্ষকের ছবিতে যে মজায় মজে থাকা পরিতৃপ্ত উৎসুক জনতা দেখেছি, তারা প্রতিবাদের নামে এই কাজ করেছে। হিন্দু যুবকের ছবিতে যাদের দেখেছি, তারা একজন নিরপরাধ মানুষকে নিয়ে খেলে মজা নিচ্ছে। যেভাবেই হোক, উভপক্ষ আনন্দিত।
এটা অসুস্থতা। বদ অভ্যাস। এটা সামাজিক আচার আচারণের অংশ হয়ে যাওয়া একটা ব্যাধি। একটা সমাধান অথবা একটা ইতিটানার চেষ্টা। যারা প্রতিবাদের নামে সত্যিকারের অপরাধীকে নিয়ে এমন মজায় মেতে উঠে, তাদের যুক্তি আছে। বিচারহীনতার যুক্তি। এই যুক্তিতে এমন গণঅপমানের ঘটনা ঘটিয়ে বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে আরো সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করা হচ্ছে। অথচ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা এত সহজ কাজ নয়। টানা কয়েক প্রজন্মকে এর জন্য নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রাম করতে হয়। তারপর হয়তো কিছু একটা সুফল পাওয়া যায়। কিন্তু নিজেকে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে সরিয়ে নিলে সুফল পুরোপুরি অধরা থেকে যাবে।
এ ধরণের অপমান বা অপদস্থ করার পদ্ধতি একেকটি ভয়ানক অস্ত্র। প্রথমত এই অস্ত্র যেমন অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ব্যবহার করা যায়, দ্বিতীয়ত ঠিক তেমনকি ব্যক্তিগত শত্রুতা কোন নিরপরাধ ব্যক্তির বিরুদ্ধেও ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রথম ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়নি, দ্বিতীয়টাতে জেনে শুনে বুঝে মারাত্মক অপরাধ করা হয়েছে। কিন্তু এক জায়গায় দু’টোতেই মিল আছে। দু’টাতেই খুব এনজয় হয়েছে! মজা হয়েছে!! এবং দু’টোতেই একই অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে।
সমাজে যা বদঅভ্যাস, যা অন্যায়ানন্দ, তা নানানভাবে ব্যবহৃত হওয়ার ঝুঁকি আছে। আজ যা প্রতিবাদের নামে করছেন, কাল তা আপনাকে ফাঁসানোর জন্য করা হবে। বিনোদনলোভী মানুষের সামনে অসহায়ভাবে অপমান সহ্য করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।
মাদ্রাসা শিক্ষকের মাথায় যারা মলমূত্র ঢেলছে, তারা প্রভাবশালী। স্কুল শিক্ষককে যারা কানে ধরিয়েছে, তারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের লোকজন। বাউলদের চুল দাড়ি যারা কেটেছে, তারা একই সাথে প্রভাবশালী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ। ওই নাস্তিককে যারা অপমান করেছে, তারা হয়তো রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান নয়, কিন্তু তারচেও বেশি ক্ষমতাবান। কারণ তারা অপরাধ সংঘটিত করার জন্য সংগঠিত সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠী।
এরকম প্রত্যেকটি ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক শক্তি, প্রভাব, গোষ্ঠীবদ্ধ ক্ষমতা ও সংখাগরিষ্ঠতার বল কাজ করে। এই যে প্রভাব ও সংখ্যাগরিষ্ঠতা, এটা একেকসময় একেকরূপ নেয়। আজ আপনি হয়তো মুসলমান পরিচয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রুপে পড়েছেন, কিন্তু কাল উত্তরপাড়ার মুসলমান হিসেবে সংখ্যালঘু হয়ে যাবেন। তখন দক্ষিণপাড়ার সংখ্যাগরিষ্ঠরা আপনাকে নিয়ে অপমানের আনন্দের মেতে উঠবে।
সংখ্যাগরিষ্ঠতার চর্চা ভালো না। ক্ষমতার চর্চা ভালো না। অন্যের লাঞ্ছিত হওয়া উপভোগ করা ভালো না।
অপমানের পাহাড় ঘাড়ে নিয়ে মাথা নিচু করে ভাবলেশহীন তাকিয়ে থাকা অসহায় ব্যক্তিটি পাথরের মূর্তি বা হাতে আঁকা ছবি নয়, যে বছরের পর বছর শুধু ওই একটি লোককেই লাঞ্চিত হতে দেখা যাবে। বরং একেক ঘটনায় একেক লোককে দেখা যাবে। কোথাও নাস্তিক, কোথাও শিক্ষক, কোথাও বাউল, কোথাও হুজুর। কোথাও আপনি, কোথাও আমি।
হাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আছে। গণঅপমানের মত অসভ্য সংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। অন্তত একটা বাক্য হলেও লিখুন, বলুন।
ভিডিওটা দেখার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছে। অসহ্য!
🙁
আমরা চরমভাবে দিশাহীন-জ্ঞানহীন হয়ে ওঠছি। মানুষের মতো দৃশ্যমান প্রাণিগুলো কবে মানুষ হয়ে ওঠবে সেটাই বিরাট প্রশ্ন।
চরম অসহিষ্ণু সময় পার করছি আমরা। চারিদিকে দিশাহীন মানুষের আনাগোনা।
বাংলাদেশ হয়তোবা কখনোই বদলাবেনা।
হয়তোবা…
সম্ভাবনার কিছু দেখছি না।
খুব ভালো লেগেছে
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
পিছিয়ে যাচ্ছি না এগিয়ে যাচ্ছি -কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমার মনে হয়,শিক্ষার গলদটাই মুখ্য এখানে।
লেখাটির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ, পথিক।
সমাজের অবক্ষয় এবং অসহিষ্ণুতা বোধ হয় সমান্তরাল রেখায় চলে। আমাদের সমাজে সর্বক্ষেত্রে এখন সহিষ্ণুতার বড্ড অভাব, এটা কিসের নমুনা হয়তো শুধু ভবিষ্যৎই বলে দিতে পারবে।
ভবিষ্যৎ কত ভয়াবহ হবে, তা এখনই বুঝা যাচ্ছে।