১৪শ থেকে ১৭শ শতকে উইচ বা ডাইনী হান্টিং শুরু হয় । এই সময় ৬০ লক্ষ নারী কে ডাইনি প্রচার করে হত্যা করা হয়েছিল (সূত্রঃ মারিয়া মাইজ-১৯৮৬, ৮০-১১০)। মূলত যাদের ডাইনী বলে হত্যা করা হয়েছে এদের বেশির ভাগই যুক্তি বুদ্ধি সম্পন্ন এবং জ্ঞান বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ ছিল ।সমাজের অনিয়ম অনাচার এর বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল ।
প্রশ্ন হল এই বিপুল পরিমাণে নারী হত্যা কিভাবে সাধারণ মানুষ মেনে নিল ?
কারণ সাধারণ মানুষের মাঝে স্বার্থান্বেষী হত্যাকারীরা ভ্রান্তি ঢুকিয়ে দিয়েছিল যে এই নারীরা মানুষ নয় এরা ডাইনী । এদের সাথে শয়তান আছে এরা সমাজের জন্য ক্ষতিকর।
যেহেতু সাধারণ জনগণ শয়তান , ভুত প্রেত এই সব বিষয় ভয় পেত এবং তারা এই নারীদের সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল, তাই তারা স্বার্থান্বেষী হত্যাকারীদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়েছিল ।
বাংলাদেশে ব্লগার হত্যা এবং নিপীড়ন দেখে সাধারণ জনগণ এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা দেখাচ্ছে । তারা ভাবছে যুদ্ধটা জঙ্গী এবং ব্লগারদের ভেতরে এখানে তাদের কোন কিছু বলার নেই ।
এটা তাদের সম্পূর্ণই ভুল ধারণা ।
যেহেতু ব্লগ সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই তাই তারা কনফিউজ । আর এই সুযোগটাই নিয়েছে ধর্মান্ধ জঙ্গী গোস্টী । জঙ্গীরা বেছে বেছে এমন ব্লগার মারছে যারা ভিন্ন ধারার চিন্তা করে , এবং যাদের লেখায় ধর্ম বিষয়টা প্রাধান্য পেয়েছে । জঙ্গীরা এই কাজটা করছে সাধারণ মানুষ কে কনফিউজ করে দেবার জন্য । ধর্ম কে হাতিয়ার করে তারা আসলে প্রতিবাদী কণ্ঠগুলো চুপ করিয়ে দিতে চাইছে । সেই সাথে তারা সবাইকে হত্যার আতঙ্কে ফেলে মুক্ত চিন্তা , ভিন্ন মতের প্রকাশ কে বন্ধ করে দিতে চাইছে ।
প্রশ্ন হল কেন ব্লগারদেরই তারা টার্গেট করল ?
কারণ ব্লগাররা এই দেশের সব চেয়ে শাক্তিশালী কণ্ঠ । এরা মুক্ত ভাবে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করে । তারা সরাসরি সমাজের অসঙ্গতির দিকে আঙুল তোলে। তারা যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে নানা সমস্যা তুলে ধরে। এটা এই জঙ্গী গোষ্ঠীর জন্য হুমকি সরূপ। কারণ মানুষ কে অজ্ঞ করে রাখতে পারলে তারা এই সমাজ এই দেশ কে তাদের ইচ্ছে মত কন্ট্রোল করতে পারবে ।তাদের মিথ্যাচার ভণ্ডামিগুলো আর প্রকাশ পাবে না ।
আপনি যদি খেয়াল করেন তবে দেখবে ব্লগার হত্যার মিনিট দশেকের মধ্যে সেই ব্লগারের দু চারটা লেখা যেগুলো বিতর্কিত সেগুলো এই জঙ্গী গোষ্ঠী সাধারণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয় ।এতে তারা এক দিকে যেমন হত্যার বৈধতা আদায় করতে চায় ঠিক তেমনি সাধারণ মানুষ কে একটা ভুল মেসেজ দেয় যে এই লেখক আসলে এসব লেখাই লিখত । কিন্তু যদি তার সব ব্লগগুলো দেখা যায় তবে দেখতে পাবেন সে অন্য অনেক বিষয়ে লেখালিখি করেছে । যেগুলো প্রচার হলে সাধারণ মানুষ বুঝে জেত , হত্যাটা চরম অন্যায় হয়েছে এর প্রতিবাদ করা দরকার । হত্যাকারীদের শাস্তি দ্রুত নিশ্চিত করা উচিৎ ।
ব্লগাররা তো এই দেশরই মানুষ । তারা দেশের বাইরের না । কিন্তু তারা দেশের মানুষের প্রতিনিধি হয়ে সমাজ দেশ পালটাবার জন্য লেখালিখি করছে । অনেকেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চায় কিন্তু গুছিয়ে লিখতে পারে না । ব্লগাররা সেটাই করছে । আবার এমন অনেক অন্যায় হচ্ছে যা দেশের মানুষ জানেই না কিন্তু ব্লগাররা জানাচ্ছে । সেই স্বরূপকাঠি সেই মিনার চড়, সেই শৈলকূপা কিংবা খাগড়াছড়ি তে কি অন্যায় হচ্ছে তা মিনিটের মধ্যে ব্লগে ,সোশ্যাল মিডিয়াতে তারা প্রচার করছে । তারা লেখা দিয়ে যুক্তি দিয়ে সমাজ কে সামনের দিকে প্রগতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে । তারা আসলে কাজ করছে দেশের মানুষের জন্য ।
কিন্তু ব্লগারদের হত্যা করে প্রতিবাদের কণ্ঠটাই স্তব্ধ করে দেয়া হচ্ছে । তাই যুদ্ধটা আসলে ব্লগারদের না । যুদ্ধটা জঙ্গী বনাম বাংলাদেশের সকল সুচিন্তক , বিবেকবান মানুষের । যারা দেশটা কে ভালবাসে ।
আপনি যদি পাকিস্তান এর কথাই ধরেন , সেখানে মসজিদে বোমা হামলা হয় যদি ইসলাম রক্ষাই মুখ্য হত তবে কেন মসজিদে হামলা করে সাধারণ মুসল্লি মেরা ফেলা হচ্ছে ? আপনি তালেবান শাসনের আগের আফগানের কথা ভাবেন কিংবা ৫০ এর ইরান তাহলেই দেখবেন সেখানে মুক্ত চিন্তা ছিল । জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা হত । মুসলিম স্কলাররা তাদের নানা ধরনের কাজ দিয়ে সমাজ দেশ কে সমৃদ্ধ করত । সেকুলার এর চর্চা হত। কিন্তু তাদের কে প্রথমে ইসলামের শত্রু বলে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরা হয় পরে একে কে হত্যা কিংবা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় । প্রথম থেকেই যদি সেই সব দেশের প্রশাসন এবং জনগণ, জঙ্গী গোষ্ঠী কে প্রতিহত করত তবে আজকে দেশগুলোর চেহারা অন্য রকম হত ।
কদিন আগেই মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকি কে হত্যা করা হল । তিনি তো ব্লগার ছিলেন না কিন্তু তাকে হত্যা করা হল কেন ? এবং তার হত্যার পরে ফেইসবুকে জঙ্গী সমর্থিত পেইজগুলোতে তাকে মুরতাদ নাস্তিক বলে প্রচার করা হল ।
এই স্বার্থান্বেষী জঙ্গী গোষ্ঠীর কুটচালের সব চেয়ে ভাল উদাহরণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধ । ৫২ তে যখন ভাষা আন্দোলন শুরু হয় তখন পাকিস্তান সরকার প্রচার করেছিল এরা ‘ধুতি’ গোষ্ঠী । ধর্ম কে অস্র বানিয়ে তাদের আন্দোলন রোধ করার চেষ্টা করেছিল তারা ।
এর পরে ৭১ এ তারা একই কাজ করেছিল । স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন কারীদের মালাউন বলে প্রচার করে সাধারণ মানুষ কে বিভ্রান্ত করেছিল । ইসলাম গেল ইসলাম গেল রব তুলে দিয়ে রোধ করতে চেয়েছিল স্বাধীনতার জন্য ন্যায্য লারইটাকে । কিন্তু সাধারণ মানুষ যখন বুঝল এই লড়াই কোন ধর্ম রক্ষার লড়াই না , এই লড়াই অন্যায়ের সাথে ন্যায়ের লড়াই , দেশের জন্য লড়াই , তখন তারা সারসরই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে । এবং দেশের জন্য বিজয় ছিনিয়ে আনে ।
তাই এই মুহূর্তে দেশের মানুষ কে এটা বুঝতে হবে তাদের বোকা বানানো হচ্ছে । নাস্তিক হত্যা কোন ইস্যু না , এটা জঙ্গিদের একটা হাতিয়ার । যেমন একটা মেয়ে ধর্ষিত হবার পরে তার ড্রেস ঠিক ছিল না এমন কথা বলে ধর্ষণটা কে সঠিক হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে ধর্ষক । এটাও ঠিক তেমন ।
রোকেয়া তার অবরোধবাসিনী এর ভূমিকায় লিখেছেন “ আমি কারসিয়াং ও মধুপুর বেড়াইতে গিয়া সুন্দর সুদর্শন পাথর কুড়াইয়াছি , উড়িষ্যা ও মাদ্রাজে সাগর তীরে বেড়াইতে গিয়া বিচিত্র বর্ণের বিবিধ আকারের ঝিনুক কুড়াইয়া আনিয়াছি । আর জীবনের পঁচিশ বছর ধরিয়া সমাজ সেবা করিয়া কাঠমোল্লাদের অভিসম্পাত কুড়াইতেছি ”
এই জঙ্গীরা এই ধর্মান্ধদের দল বেগম রোকেয়াকে দমাতে পারেনি । পারলে আজকের বাঙালী নারীদের অবস্থা কি হত সেটা সহজেই অনুমেয়।
আজকের ব্লগার আগামী দিনের লেখক , বুদ্ধিজীবী । এরা না থাকা মানে সমাজে বুদ্ধির চর্চা জ্ঞানের চর্চা আর হবে না । শুরু হবে ভণ্ডদের রাজত্ব । তখন লোকে কুসস্কার বিশ্বাস করবে । ভণ্ডরা মানুষ কে ভুল বুঝিয়ে নিজেদের ফায়দা লুটবে । কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাবে না । দেশ রক্ষা করতে হলে ব্লগারদের রক্ষা করতে হবে । নইলে সম্প্রতি কেনিয়ার উদাহরণ তো সামনেই আছে ।
তাই সবার আগে মনে হয় সাধারন মানুষের ব্লগ সম্পর্কে ধারণা টা স্পষ্ট হওয়া উচিত। ব্লগার মানেই নাস্তিক নয়।
লাইক ভিখিরি সুশীল বুদ্ধিজীবি সমাজ ফেবুতে যে হারে মুক্তমনাদের তুলোধূনো করছে তাতে ব্লগিং করাকে সাধারণ মানুষের কাছে অপরাধ বা লজ্জার একটা বিষয় হিসেবে প্রায় প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছে
কিন্তু ব্লগারদের হত্যা করে প্রতিবাদের কণ্ঠটাই স্তব্ধ করে দেয়া হচ্ছে । তাই যুদ্ধটা আসলে ব্লগারদের না । যুদ্ধটা জঙ্গী বনাম বাংলাদেশের সকল সুচিন্তক , বিবেকবান মানুষের । যারা দেশটা কে ভালবাসে ।
কিন্তু এ বিষয়টা বিবেকবান মানুষের বিবেকে নাড়া দিচ্ছে কি?
ধর্মান্ধদের অদৃশ্য আল্লাহ্/ভগবান/ঈশ্বরের পরিবর্তে তাদের নিজের ভেতরে একটা স্বতন্ত্র আল্লাহ্/ভগবান/ঈশ্বর সৃষ্টি করার শিক্ষা দিতে হবে। এর জন্য কৌশুলী হতে হবে। এটা করা গেলেই ধর্মান্ধতার উৎপাদন বন্ধ হবে।
কথাগুলো খুব ভাল।
ভালো হয়েছে। ধন্যবাদ।
অলসতা এখনো ত্যাগ করতে পারিনি।
আরো একটু লম্বা হতে পারতো। বিশেষ করে শেষদিকে এসে….
যদিও লেখাটি বেশ ভালো লেগেছে
আরো একটু লম্বা হতে পারতো। বিশেষ করে শেষদিকে এসে….
অবশ্য লেখাটি বেশ ভালো লেগেছে