আমার প্রবাস জীবনের শুরুর দিকে ব্যাপারটা একধরণের স্বেচ্ছা নির্বাসন ছিল। কন্যা হয়ে জন্মেছিলাম বটে, তারপরও নারী হয়ে উঠবার বদলে অজস্র বাঁধার মুখেও কিভাবে যেন মানুষ হয়ে উঠেছিলাম, দাবী করে ফেলেছিলাম আমার প্রাপ্য মানবাধিকার। আর তাতেই পরিবার বলতে যা বোঝায়, ভালোবাসার মানুষগুলোর কাছে হয়ে গিয়েছিলাম অপাঙতেয়। যা কিছু ছিল আমার জীবনে, তার সবকিছু হারাতে বসেছি জেনেও পরাধীনতা মানতে পারিনি। হৃদয় ভরা অভিমান নিয়ে নিতান্ত ক্ষীনকায় অসুস্থ শরীরে ভালোবাসার মানুষগুলোকে পিছনে ফেলে দেশ ছেড়েছিলাম। আমি নিতান্ত নগণ্য একজন মানুষ, তারপরেও আমি জেনে গিয়েছিলাম, হয় বাংলাদেশের সমাজে মরে মরে বেঁচে থাকার যোগ্যতা আমার নেই, অথবা ওই সমাজটাই আমাকে ধারণ করার যোগ্যতা রাখে না। একফোঁটা চোখের জল ফেলিনি সেদিন, বরং প্রত্যয় ছিল, একাই বাঁচতে শিখবো। এই বিশাল পৃথিবীতে মায়া মমতার সব বাঁধন ছিড়ে বেঁচে থাকবো কি করে তা ভাবার সুযোগ পাইনি, কেবল জানতাম বাঁচতে হবে। এভাবেই আমার প্রথম জীবনের সমাপ্তি ঘটেছিল, আমি পা রেখেছিলাম আমার দ্বিতীয় জীবনে।
আমি ভেবেছিলাম জীবনের সবকিছু বলতে কেবল ভালোবাসার মানুষগুলোকেই বোঝায়। আমি সেদিন কেবল ভালোবাসার মানুষগুলোকেই হারিয়েছিলাম, কিন্তু বাংলাদেশের পাসপোর্টটাতো ছিল সাথে। আমার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে ছিল বাংলাদেশের সংস্কৃতি, সেও আমি বয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম আমারই সাথে। স্বজন ছেড়ে এলেও স্বদেশ ছাড়িনি আমি, আমার দেশটা আমারই ছিল সেইদিন। চারবছর পর টের পেলাম, হারাবার আমার বাকি ছিল আরো অনেকখানি। একুশে বইমেলায় যেদিন অভিজিৎদার মাথায় কোপ দিলো ধর্মান্ধরা, খবরটা পাওয়া মাত্রই ডুকরে কেঁদে ফেলেছিলাম ল্যাবেই। ল্যাবমেটরা ছুটে এসেছিল আমার কাছে, যে দু’তিনটি কথা বলেছিলাম ওদের, তার একটি ছিল, “আজ আমার দেশটাও আমি হারিয়ে ফেললাম।”
প্রবাস জীবনে আমার অর্জন অনেক, নিউরোসায়েন্টিস্ট হবার স্বপ্নকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বেশ কিছুটা পথ পাড়ি দিয়েছি। পরিচিত মানুষদের পৃথিবী থেকে দূরে সরে গিয়ে অপরিচিত পৃথিবীতে চলার পথে “কেমন আছ?” জিজ্ঞেস করবার মত বন্ধু-স্বজন পেয়েছি। শিখেছিও অনেক কিছু। সেই সাথে হৃদয়ের আনন্দ-কষ্ট হৃদয়েই চাপা দিতে শিখেছি, বোবা হতে শিখেছি। শেষবার মনের আনন্দে লিখেছিলাম ২০১২ সালের জুলাই মাসে। তারপরের ঘটনাগুলো এখন ইতিহাস – রাজীব হায়দারের মৃত্যুতে দেখেছি কতগুলো কালো হাত কি করে আমার কন্ঠরুদ্ধ করে দিল। কিছু একটা অসাড় গিয়েছিল ভিতরে, আমার আঙ্গুল আর লিখতে পারেনি। কাদের জন্য লিখব, কেন লিখব এইসব প্রশ্নের উত্তর আর খুঁজে পাইনি।
অভিজিৎদার মৃত্যুর পর ক্রুদ্ধ আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, কিছুতেই থেমে যাবো না। লেখার চেষ্টা করেছি, লিখতে বসে অসহায়ের মত কেঁদেছি, লিখতে পারিনি। বন্যা আপু আর অজয় বায় স্যারকে দেখে নিজেকে বুঝিয়েছি, আমার চেয়ে অনেক সুতীব্র আঘাত নিয়ে প্রাণপণে চিৎকার করে যাচ্ছেন উনারা। কেন আমি পারছিনা! বন্যা আপুর কাছে মুখ দেখাবো কি করে! নিজের কাছে মুখ দেখাবো কি করে! ওয়াশিংটন ডিসিতে “স্টান্ডিং উইথ অভিজিৎ রায়” শিরোনামে যেদিন প্রতিবাদ সভায় দাঁড়ালাম, সবাই মিলে “আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে” গাইছিলাম। গানটার এই তীব্র দহন কোনদিন এভাবে অনুভব করিনি, সানগ্লাসের আড়ালেও কান্নায় বাঁধ দিতে পারিনি। অভিজিৎদার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশটাকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা – ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা নেই আমার।
বন্যা আপু লিখেছে, ধর্মান্ধদের ঘৃণা করতেও ঘৃণা হয়। এই বন্যা আপুকেই আমি চিনি, আপোসহীন। জীবনে দু’জন নারীর মত হতে চেয়েছি আমি, একজন মারি কুরী, আরেকজন বন্যা আপু। বন্যা আপুর শিক্ষা, ব্যক্তিত্ব, সংগ্রাম আমাকে দেখিয়েছে, কোন উচ্চতায় মানুষ যেতে পারে! সেই বন্যা আপুর লেখার নীচে যখন দেখি, একজন দুজন নয়, হাজার হাজার খুনীর দল শকুনের মত ঠোঁট বাড়িয়ে আছে, আমি আবারো অনুভব করি, এই বাংলাদেশ আমি চিনি না। আমার বাংলাদেশে মানুষ বাস করত, শকুন নয়। সেই মানুষগুলো কি সবাই আজ শকুন হয়ে গেছে?
যে দেশের মানুষ, মানুষ থেকে শকুনে রুপান্তরিত হয়, তাদের কাছে মানবতাবোধের বুলি আউড়ানোর সাধ্য আমার নেই। আমি সেই শকুনদের জন্য লিখবো না। হ্যাঁ, আমার স্বেচ্ছা নির্বাসন আজ চাপিয়ে দেয়া নির্বাসনে পরিণত হয়েছে। আজ আমি দেশে ফিরতে চাইলেও আর ফিরতে পারবো না, ফিরে আসার সেই দেশটাই হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশের যেই সংস্কৃতি আমি আমার সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম, সেই সংস্কৃতি আজ কোন জাদুঘরে ঠাঁই পেল, আমার বড় জানতে ইচ্ছা করে। আমার পাসপোর্টে দেশের নামটা আর কতদিন বাংলাদেশ থাকবে, তাও আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে। আমি শকুনদের দেশের জন্য, আমার জন্মভূমির জন্য আর কখনই লিখব না। অভিজিৎদার জন্য লিখবো, যে মানুষটা মানবতা বোধের কথা, যুক্তির মুক্তির কথা বলত, তার জন্য লিখব। নিজের জন্য লিখব, যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সৈনিকের মত আত্মগ্লানিতে ভুগতে ভুগতে মরতে চাই না বলে লিখব। স্বজন হারিয়েছি, দেশ হারিয়েছি, জীবনটা হারাবার ভয়টা আমার কেটে গেছে। সুতীব্র চিৎকার করেই নাহয় মরব তবে। আমার কন্ঠ আর কখনোই থেমে যাবে না, কোপ খেয়ে কন্ঠনালী স্তব্ধ হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত আমি বলে যাবো কথা।
আমরা আসলেই ভয় পেয়ে যাই যখন দেখি অভিজিতের মতো ব্যাক্তিদের রাস্তায় মরতে হয়। তখন আমাদের ও ধর্মের কাপড় পরে অভিনয় করতে হয় সমাজে । কিন্তু তা একেবারে সমাজকে দেখানোর জন্য। মন তো আর ধর্মের মতো কোন কাল্পনিক গল্পকে মানতে চায় না। বিবেক যতদিন আছে ততদিন আমরা এই সব কাল্পনিক কোন গল্পকে মানতে পারব না। তবুও সমাজকে দেখাতে হবে যে আমরা ধার্মিক।টিকে থাকাও না কি চরম সার্থকতা।
বন্ধু, কাজিন অনেকের মধ্যেই হিজাব পরার চল দেখে এমনিতেই দেশের আড্ডাগুলোতে নিজেকে অনেক মিসফিট মনে হতো। অভিজিৎ ভাইয়ের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে কোথায় যেন টানটা কেটে গেছে।
বন্যাপা অসীম সাহসী। বীর পুরুষরা কেউ এগিয়ে আসেনি, যেভাবে তিনি পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন, তার পক্ষেই সম্ভব। শুভকামনা ঘিরে থাকুক এই মানুষটিকে। যা হারিয়েছেন তা আর কখনো ফিরে পাবেন না, তারপরও হায়েনার দলগুলো তার মানসিক শান্তিটুকুও ছিনিয়ে নিতে হিংস্র আগ্রাসী। এদের প্রভু এদের ক্ষমা করুন, পথ দেখান এদের।
একদিন না একদিন বাংলাদেশকে তার নিজের জায়গায়, নিজের শিকড়ের কাছে ফিরে আসতেই হবে। আমরা অনেকে হয়তো তখন থাকব না। কিন্তু বাংলাদেশ হবে উদার মুক্ত আকাশের দেশ।
” অভিজিৎদার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশটাকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা – ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা নেই আমার।”
অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর বাংলাদেশটাকে হারিয়ে ফেললে তো হবে না। দেশটাতে মুক্ত-বুদ্ধির চর্চার প্রসার ঘটানোর দায়িত্ব যে বেড়ে গেল।
আমরা নিরব, কিন্তুু কারো কাছে নত না। আমরা নিরবে একদিন আমাদের স্বদেশকে জয় করবো। তোমাদের হবে হবে হবে একদিন হবে পরাজয়। আমদের হবে বিজয়।
আসুন আমরা সবাই পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠি । আমাদের জ্বালাটা অন্য কোথাও নয় , জ্বালাটা নিজের মধ্যেই বপন করা আছে । প্রকৃতি যখন নির্মমতা দেখাতে শুরু করে , তখন আমাদের চেয়ে দেখা ছাড়া কিছুই করার থাকে না । তেমনি আমাদের মুখামূখি অবস্থানে যখন কেউ কুলিয়ে উঠতে পারে না , ঠিক তখনেই তাঁরা আমাদের ঘায়েল করতে নিকৃষ্ট পন্থা অবলম্বন করে ।
অভিজিত রায় তেমনি একজন , ওয়াশিকুর রহমান বাবু তেমনি একজন ,মালালা তেমনি একজন , জান্নাতী তেমনি একজন ।
আমরা এই পশুগুলোকে বদলানোর জন্য লিখি না। এদের ধ্বংশের জন্যও আমাদের লেখার প্রয়োজন নেই, এরা এমনিতে একদিন মরে শেষ হয়ে যাবে। আমরা লিখি নতুন প্রজন্মের জন্য, অনাগত শিশুদের জন্য, যারা প্রকৃতির বিজ্ঞ নিয়মেই সদা সত্য জানতে চায়।।
শোককে শক্তিতে পরিণত করুন, অভিজিত আমাদের কাঁধে অনেক কাজ দিয়ে গেছে – তা ভুললে চলবে না।
“শোককে শক্তিতে পরিণত করুন, অভিজিত আমাদের কাঁধে অনেক কাজ দিয়ে গেছে – তা ভুললে চলবে না।” – (y)
আমরাও হারিয়ে ফেলছি আমাদের স্বদেশকে। ক্রমেই। চাপাতি কেড়ে নিচ্ছে অভিজিতদেরকে, ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস কেড়ে নিচ্ছে জাতির বিবেককে; আর আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের স্বদেশকে।
হারিয়ে হয়ত ফেলেছি সত্যি, তবে আবার অর্জনও করে নেব। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, এবার ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই আমাদের আর।
আমার মনে হয় দেশেকে আর দেশের মানুষকে ধর্মান্ধতার নাগপাশ থেকে মুক্তির জন্য “মুক্তমনা”দের ভিন্ন কৌশল নিয়ে আগানো উচিৎ। সেই কৌশলটা হবে একদম মূল থেকে পরিবর্তনের চেষ্টা করে যাওয়া। আর ধর্মান্ধদেরকে প্রাথমিক পর্যায়ে সরাসরি তাদের ধর্মে আঘাত না করে ধর্মান্ধতা কি, এটা আমাদের সমাজ, দেশে আর ব্যক্তি জীবনে কি ধরনের ক্ষতির কারন তা বুঝানো। সাথে সাথে তাদেরকে বিজ্ঞানমনষ্ক করেতুলার জন্য পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে সহায়ক বইয়ের সন্ধান দেওয়া (অভিজিৎদার পোষ্টে প্রচুর সূত্র আর লিংক যার প্রমান)।
আপু ধৈর্যহারা হলে চলবে না। আপনারা পিছিয়ে গেলে পথ দেখাবে কে? আপনাদের জ্ঞান,শিক্ষা, ধৈর্য দিয়েই বাংলার আরজ আলী মাতুব্বর সদৃশ কোট কোটি অশিক্ষিত অজ্ঞদের মধ্যে জ্ঞানের আলো জ্বালাতে হবে। কৌশলে তাদের মনের ভেতর থেক প্রশ্ন করতে শিখাতে হবে। না হলে অজ্ঞ, বর্বরের হাতের জ্ঞানের মশাল একটার পর একটা এভাবে নিভে যেতে থাকবে। ওদের কল্পনাতেও নেই ওরা দেশের কত বড় ক্ষতি করছে। ধর্মরক্ষার নামে কতবড় অধার্মিকতায় লিপ্ত হচ্ছে।
দিদি, লেখা বন্ধ করলে এই জানোয়ারগুলাই অস্কারা পাবে। আরও লেখা দিয়ে এদের প্রতিহত কর।
থামিনি সুমন। তোমার দিদি থামবেও না।
এ বানী হউক আজ আমাদের সকলের শপথ এবং প্রতিজ্ঞা।
দেশ আমাদের, ছাগুদের নয়।আমরা কেন পালাবো,পালাবে তো তারা…
পালাচ্ছি না আমরা। কথা বলছি, কথা বলব। অভিজিতদার মৃত্যুর পরে অনেকে থেমে গিয়েছে দেখেছি, কিন্তু কিছু মানুষ কথা বলে যাচ্ছে। হয়ত আরো প্রাণ ঝরে যাবে, কিন্তু কজনের প্রাণ নেবে ওরা?
কলম চলবেই
কলম চলবেই
জগৎ এর সকল চাপাতি একসাথে উঠালেও কলম চলবেই
বন্যা আপুর লেখার নীচে শকুনদের চিৎকারের নমুনা দেখে থমকে গিয়েছিলাম, তবে
এইটাই সারকথা, কন্ঠ থেমে গেলে শকুনের দলই জয়ী হবে, কল্লাও আর থাকবে না। আমাদের লিখে যেতে হবেই, কলমের কালিতে না পারলে রক্ত দিয়ে লিখতে হবে।