এই লেখায় রবিনসন ক্রুসো প্রথমবারের মতো আরেকজন মানুষের সান্নিধ্যে আসবে। ফলে এখানে প্রথমবারের মতো দেখা দিবে সমাজ গঠনের সুযোগ। ক্রুসো সহিংসতার মাধ্যমে কীভাবে সেই সুযোগ গ্রহণ করতে কিংবা নষ্ট করতে পারে তার কয়েকটি দিক আমরা এখানে আলোচনা করবো।
সহিংসতা (অনুবাদ)
মূল – মারি রথবার্ড (অস্ট্রিয়ান স্কুল অব ইকোনমিক্সের অর্থনীতিবিদ)
গ্রন্থ – মানুষ, অর্থনীতি, এবং রাষ্ট্র
বহুদিন একা কাটিয়ে অবশেষে রবিনসন ক্রুসো দেখা পেলো জ্যাকসনের। ক্রুসোর মতোই জ্যাকসন এতোদিন দ্বীপটার অন্য প্রান্তে একা একা টিকে থাকার সংগ্রাম করেছে।
সামনাসামনি হবার পর তাদের দু’জনের মধ্যে এখন যতো ধরনের আদান প্রদান হতে পারে, তার মধ্যে এক রকম হলো সহিংস আদান প্রদান। ক্রুসো ও জ্যাকসনের মধ্যে সহিংস মিথস্ক্রিয়াও আবার হতে পারে অনেক রকমের। যেমন, ক্রুসো জ্যাকসনের প্রতি তীব্র হিংসা পোষণ করে তার নির্মূল কামনা করতে পারে। এখানে ক্রুসোর লক্ষ্য হবে জ্যাকসনের মৃত্যু। আর সহিংসতা হবে সেই লক্ষ্য চরিতার্থ করার অবলম্বন।
কিংবা জ্যাকসনের প্রতি ক্রুসোর হয়তো কোনো হিংসা নেই, কিন্তু জ্যাকসনের থাকার জায়গা আর বানানো চামড়ার কোটগুলোর প্রতি তার রয়েছে নিদারুণ লোভ। সেগুলো সে দখল করতে চায়। সেক্ষেত্রেও ক্রুসো তার সেই লক্ষ্য চরিতার্থ করতে পারে জ্যাকসনকে হত্যা করে।
উভয়ক্ষেত্রে ক্রুসো তার অভীষ্ট লক্ষ্য চরিতার্থ করছে জ্যাকসনের জীবনের বিনিময়ে।
সরাসরি সহিংসতা ব্যবহার না করে সহিংসতার হুমকি ব্যবহার করাটাও সহিংসতার কাছাকাছি ধরনেরই একটা মিথস্ক্রিয়া। যেমন, ক্রুসো জ্যাকসনের গায়ে ছুরি ধরে হুমকির মুখে তার আহরিত সম্পদ লুট করতে পারে। ফলে – বলপ্রয়োগ বা তার হুমকির ব্যবহার – দুটোকেই আমরা নির্ণয় করবো সহিংসতা হিসেবে। উভয় ক্ষেত্রে একজনের অর্জন ঘটছে অন্যজনের শরীর বা সম্পদের বিয়োজনের মাধ্যমে।
কী কী কারণে ক্রুসো এখানে সহিংসতা এড়াতে চাইতে পারে? ক্রুসোর সহিংসতা এড়ানোর জন্য নিচের যেকোনো একটি কারণ কাজ করতে পারে –
১) সে উপলব্ধি করে উঠতে পারে যে সকল প্রকার সহিংসতাই অনৈতিক। সেক্ষেত্রে সহিংসতা থেকে নিবৃত্ত থাকাটা নিজেই একটা চূড়ান্ত লক্ষ্য হয়ে উঠবে। সহিংসতার মাধ্যমে অন্য যা কিছু সে অর্জন করতে পারতো, পুঁজি বা ভোগ্যদ্রব্য, সেই সবকিছুর তুলনায় সহিংসতা এড়ানোটাই তার কাছে তখন অধিক মূল্যবান মনে হবে।
২) বা এমন হতে পারে যে সহিংসতা নিবারণ তার কোনো মৌলিক লক্ষ্য নয়, তবু সে এমন উপলব্ধি করে উঠতে পারে যে সহিংসতার পথ অবলম্বনের ফলস্রুতি তার জন্যে খুব সুখকর নাও হতে পারে। বরং সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফলও তৈরি করতে পারে। যেমন, যার উপর সে সহিংসতাটা ঘটাচ্ছে সেও এর উত্তর দিতে পারে সহিংসভাবে। আর এর ফলাফল হতে পারে ক্রুসো যা আশা করছে ঠিক তার উল্টো। অর্থাৎ আক্রমণকারী ক্রুসো নিজেই এখানে সহিংসতার দুর্বল পক্ষে পরিণত হতে পারে। বিভিন্ন ফলাফলের মধ্যে এটাও যেহেতু সম্ভাব্য, ক্রুসো এই অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফলের ঝুঁকি নেওয়ার বদলে অসহিংস থাকাটাই শ্রেয় হিসেবে বেছে নিতে পারে।
৩) বা এমনও হতে পারে যে ক্রুসো মনে করে সহিংস লড়াইয়ে তার নিজের বিজয় একদম নিশ্চিত, তারপরেও সে উপলব্ধি করতে পারে যে – তাকে তো অন্তত একটা যুদ্ধ বা লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। ক্রুসো ভাবতে পারে যে সেই যুদ্ধের যে খরচ, যেমন অস্ত্র জোগাড়ে তার সময় আর শ্রমের বিনিয়োগ, তার তুলনায় যুদ্ধজয়ের লাভটা যৎসামান্য। এমন উপলব্ধি থেকে সহিংসতা ঘটানো থেকে সে নিবৃত্ত হতে পারে।
৪) আবার এমন হতে পারে যে ক্রুসো নিশ্চিত তার যুূদ্ধের খরচের তুলনায় যুদ্ধজয়ের প্রাপ্তিটাই বেশি, কিন্তু তারপরেও সে এই উপলব্ধিই করে উঠতে পারে যে যুদ্ধজয়ে তার যে প্রাপ্তিটা সেটা সাময়িক। তার এই সাময়িক প্রাপ্তিটা ভবিষ্যতের অন্যান্য সম্ভাব্য দীর্ঘস্থায়ী প্রাপ্তির সুযোগকেই বরং নষ্ট করে দিচ্ছে। সেই ভবিষ্যত প্রাপ্তিটা বরং এই সাময়িক প্রাপ্তির চাইতে তার কাছে অনেক বেশি সুখকর হতে পারে। যেমন, তার এই সাময়িক প্রাপ্তিটা একসময় ফুরিয়ে যাবে, জ্যাকসনের বানানো বাসাটা কিংবা চামড়ার কোটগুলো ব্যবহারে ধীরে ধীরে জীর্ণ হয়ে যাবে, একসময় হয়ে যাবে ব্যবহারের অযোগ্য। ফলে ক্রুসো ভাবতে পারে যে জ্যাকসনকে হত্যার ফলে সে জ্যাকসনের কাছ থেকে অবিরাম সেবা পাওয়ার সুযোগটা বরং হারাচ্ছে। সেটা হতে পারতো জ্যাকসনের সান্নিধ্য, কিংবা জ্যাকসনের তৈরি বা জোগাড় করা অন্যান্য পুঁজি ও ভোগ্যদ্রব্য, যেটা জ্যাকসন বেঁচে থাকলে তাকে সরবরাহ করতে পারতো। জ্যাকসনকে না মেরে তার কাছ থেকে কীভাবে সেইসব সেবা আদায় করা যেতো সেটা আলাদা প্রশ্ন, কিন্তু মেরে ফেললে সেগুলো পাওয়া যে অসম্ভব তা নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই। ফলে ক্রুসো হিসেব করে এই সিদ্ধান্তে আসতে পারে যে যুদ্ধজয়ের সাময়িক প্রাপ্তিটা জ্যাকসনের বেঁচে থাকার দীর্ঘস্থায়ী প্রাপ্তির তুলনায় তুচ্ছ। এই সিদ্ধান্তের কারণে সে সহিংসতা ঘটানো থেকে বিরত থাকতে পারে।
এই সকল ক্ষেত্রেই ক্রুসো তার হিসেব নিকেশে ভুল করতে পারে কিংবা যুদ্ধের খরচ বা ভবিষ্যত প্রাপ্তিটা আমলে নিতেই ভুলে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ক্রুসো যদি তার লাভকে সর্বোচ্চ করার জন্যে সহিংসতা অবলম্বন করে, সেটা তার পক্ষে হবে একটা ভুল সিদ্ধান্ত।
আর এইসব কিছুকে আমলে না নিয়ে ক্রুসো যদি জ্যাকসনকে হত্যা করেই ফেলে, সেক্ষেত্রে সে নিশ্চিতভাবেই নষ্ট করবে তার সমাজ গঠনের একমাত্র সুযোগটাকে।
ধরা যাক ক্রুসো হিসেব করে দেখলো যে জ্যাকসনকে হত্যা না করাটা বরং ভবিষ্যতের বিচারে অধিক লাভজনক। কারণ সেক্ষেত্রে ক্রুসোর সুযোগ থাকে জ্যাকসনের বিভিন্ন সেবা থেকে অবিরত লাভ অর্জনের। কিন্তু কীভাবে সে জ্যাকসনকে জীবিত রেখে তার সেবা থেকে অবিরত লাভ পেতে পারে? এরও নানা রকম সহিংস কিংবা অসহিংস উপায় থাকতে পারে। কিন্তু ক্রুসো হয়তো এক্ষেত্রেও সহিংস উপায়টাই বেছে নিতে পারে। ক্রুসো হয়তো জ্যাকসনকে হত্যা না করে তাকে আমৃত্যু শারীরিক আক্রমণের হুমকির মুখে রেখে শ্রম দিতে বাধ্য করতে পারে। একে আমরা বলবো দাসত্ব, যেখানে দাসের মালিক দাসকে তার নিজের গবাদি পশু হিসেবে গণ্য করে। দাসকে মালিক তার নিজের চাহিদা পূরণের জন্যে উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। এর বিনিময়ে সে দাসের খাদ্য আর বাসস্থানের ব্যবস্থা করে, কিন্তু ঠিক অতোটুকুই করে যতোটুকু করলে দাস তার মালিকের প্রতি সেবা প্রদান অব্যাহত রাখতে পারে।
আমরা মনে করতে পারি দাস হয়তো স্বেচ্ছাতেই এই চুক্তিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু দাস এখানে আসলে মাত্র দুটো সম্ভাবনার মধ্যে একটাকে বেছে নিয়েছে – হয় মালিকের জন্যে কাজ করা নয়তো শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। সহিংসতার হুমকির মুখে শ্রম দেয়া আর সহিংসতার হুমকির অনুপস্থিতিতে স্বেচ্ছায় (এবং সম্ভবত কোনো লাভের বিনিময়ে) শ্রম দেয়া এই দুটো একেবারেই ভিন্ন গুণাবলীসম্পন্ন শ্রম। একটাকে বলা যায় বাধ্যতামূলক শ্রম, আর অন্যটাকে বলা চলে স্বেচ্ছাধীন বা স্বাধীন শ্রম।
জ্যাকসন যদি ক্রুসোর অধীনে এই দাসত্বকে মেনে নেয়, তাতে জ্যাকসনকে তার দাসত্বের একজন উৎসাহী সমর্থক বলার মোটেও সুযোগ নেই। বরং এখানে এটা বলা যায় যে মালিকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে অবস্থার উন্নতি করার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে জ্যাকসন মনে করে। এই বিদ্রোহে তার যে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতিটা সেটা সে বইতে পারবে না।
যারা মনে করে যে কোনো কোনো দাস হয়তো খাদ্য আর বাসস্থানের নিশ্চিত সরবরাহের কারণে দাসপ্রথাটাকে নিজ উৎসাহেই সমর্থন করতে পারে, তারা এখানে এই বিচারটা করে না যে সেক্ষেত্রে এই ব্যবস্থার পেছনে কোনো বলপ্রয়োগ বা হুমকির প্রয়োজন মালিকের পড়তো না। কারণ সেক্ষেত্রে জ্যাকসন তো নিজ ইচ্ছাতেই তার সেবা দান করার জন্যে ক্রুসোর কাছে হাজির হতে পারতো। আসলে সেটাকে আর তখন দাসত্ব বলার সুযোগ থাকতো না। ফলে এটা পরিষ্কার যে বলপ্রয়োগের হুমকির অনুপস্থিতিতে ব্যক্তি যে সম্ভাবনাটাকে বেছে নিতো, দাসত্ব সর্বদাই তার চাইতে অধিক অনাকাঙ্ক্ষিত ও মন্দ। দাসত্বে মালিক সর্বদাই দাসের ক্ষতির বিনিময়ে লাভ করে। এটা উভয়ের জন্যে লাভজনক কোনো মিথস্ক্রিয়া নয় মোটেও।
দাসত্বের অধীনে দুটো ব্যক্তির মধ্যে যে মিথস্ক্রিয়াটা ঘটে, সেটাকে বলা যায় হেজামোনিক (আধিপত্যমূলক) মিথস্ক্রিয়া। এখানে মিথস্ক্রিয়াটা নিয়ন্ত্রণ ও বাধ্যতার। মালিক তার নিজের চাহিদা পূরণের নিমিত্তে দাসকে উৎপাদনের একটা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে দাসত্ব বা হেজামোনি হলো এমন একটা ব্যবস্থা যেখানে অন্যের হুকুম ও বলপ্রয়োগের হুমকির মুখে বাধ্যতামূলক শ্রম প্রদান করতে হয়। হেজামোনিতে দাসের কেবল দুটো বিকল্প –
১) মালিক বা স্বৈরাচারের কাছে নিজেকে সমর্পণ করা; কিংবা
২) এই সহিংস ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিজের সহিংসতা ব্যবহার করার মাধ্যমে কিংবা আজ্ঞা পালনে অবাধ্য হবার মাধ্যমে বিদ্রোহ করা।
সে যদি প্রথম বিকল্পটা বেছে নেয়, তাহলে সে হেজামোনিক শাসকের কাছে নিজেকে সমর্পণ করলো। এরপর তার সকল সিদ্ধান্ত আর কর্মকাণ্ড নির্ধারিত হতে থাকবে ওই শাসক দ্বারা। দাস এখানে মাত্র একটা বিকল্প বাছাইয়ের সুযোগ পায়, এবং এরপর সে বাধ্যতামূলক শ্রমে সমর্পিত হয়। এরপরের সকল স্বাধীন বাছাইয়ের সুযোগ থাকে কেবলমাত্র তার মালিকের। কিন্তু দাস যদি বরং অন্য বিকল্পটি বেছে নেয়, তাহলে লড়াই বা যুদ্ধের সূত্রপাত হবে। আর সেক্ষেত্রে ঘটতে পারে নিচের ঘটনাগুলোর যেকোনো একটি –
১) কোনো পক্ষই জিতলো না, যুদ্ধটা একটা লম্বা সময় ধরে চলতে থাকলো।
২) একজন অপরজনকে হত্যা করলো। এক্ষেত্রে আর কোনো ভবিষ্যত মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ থাকলো না।
৩) একজন অপরজনকে লুট করে নিজের একাকী নিবাসে ফিরে গেলো। এক্ষেত্রে এই লুটের ঘটনা উভয়পক্ষ থেকে থেমে থেমে লম্বা সময় ধরে চলতে পারে।
৪) একজন অপরজনের উপরে বলপ্রয়োগের হুমকির মুখে একটা অবিরাম একচেটিয়া হেজামোনি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলো।
এই চারপ্রকার ফলাফলের মধ্যে কেবল চার নম্বরটাতেই একটা দীর্ঘস্থায়ী মিথস্ক্রিয়াপূর্ণ সম্পর্কের সুযোগ তৈরি হয়। সেই সম্পর্কটা হবে বলপ্রয়োগমূলক। এখানে খাদ্য ও বাসস্থানের বিনিময়ে দাসকে ব্যবহার করা হবে মালিকের উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে। দাস নিজেকে উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হতে দিতে বাধ্য হবে। মালিক তার খাদ্য ও বাসস্থানের সরঞ্জাম করবে। এই বলপ্রয়োগমূলক সম্পর্কে এটাই মূল বিনিময়। যেকোনো মিথস্ক্রিয়াপূর্ণ সম্পর্ক যেখানে দীর্ঘস্থায়ী বিনিময় প্রতিষ্ঠিত হয় তাকে আমরা বলতে পারি সমাজ। এটা পরিষ্কার যে সহিংসতার অধীনে কেবল চার নম্বরটাতেই সমাজ গঠন সম্ভব। জ্যাকসনকে দাস বানানোর মাধ্যমে ক্রুসো যে সমাজ গঠন করবে, সেটা সার্বিকভাবে একটা হেজামোনিক সমাজ।
একাধিক মানুষের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বিনিময়ের যে বিন্যাস বা আচরণ তৈরি হয়, সেটাকে আমরা সমাজ বলি। লক্ষণীয় যে সমাজ একটা বিন্যাসের নাম, সে তার নিজ বলে অস্তিত্বমান কোনো স্বাধীন সত্তা নয়। সমাজ পুরোপুরিই তার একক ব্যক্তিসত্তাদের আচরণের উপর নির্ভর করে। তাদের বাইরে সমাজের অতিরিক্ত কোনো অস্তিত্ব বা বাস্তবতা নেই।
এখানে আমরা ক্রুসো আর জ্যাকসনের দ্বীপে সহিংসতার অধীনে টিকতে পারে এমন সম্ভবত একমাত্র সমাজ সম্পর্কে জানলাম। এখানে একটি হেজামোনিক সমাজ গঠিত হয়েছে। এটাকে শোষণমূলক সমাজও বলা চলে। এই সমাজে মালিক বা স্বৈরাচার নিজের লাভ করে তার অধীনস্থকে শোষণ করার বিনিময়ে।
ইকনোমিক্সের কথায় মানুষ ইউটিলিটি ম্যাক্সিমাইজিং র্যাশনাল এজেন্ট। বাস্তবতা বলে যে এটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সঠিক নয়, মানুষ অধিকাংশ সময়েই র্যাশনাল ব্যবহার করতে পারে না। তবে এই রকম সিম্পল গেম এ, যেখানে দুইজন মাত্র প্লেয়ার এবং তাদের স্ট্র্যাটেজী সেট ও সীমিত, সেখানে কিন্তু ইউটিলিটি ম্যাক্সিমাইজিং র্যাশনাল সিদ্ধান্ত নেয়া প্লেয়ারদের জন্যে খুব কঠিন নয়। এখানে একটা ন্যাশ ইক্যুইলিব্রিয়াম পাওয়ার সম্ভাবনা ভালো।
এটা ইউটিলিটির প্রশ্ন, যদি কো-অপারেশনের মাধ্যমে এমন একটা ইক্যুলিব্রিয়াম পাওয়া যায় যেটা দাসত্ব ইক্যুলিব্রিয়ামকে ডমিনেট করে, অর্থাৎ দুজনেই কিংবা এট লিস্ট একজন দাস ইক্যুলিব্রিয়াম এর চেয়ে ভালো থাকে অন্যজনের ইউটিলিটি একই রকম থাকে, তবে দুজনেই কো-অপারেশন ইক্যুইলিব্রিয়াম বেছে নেবে।
@সফিক,
ঠিক। রথবার্ডের বইটার পরের লেখাটা সেটা নিয়েই।
ঠিক। এমন কি এই ক্রুসো ইকোনমিতেও র্যাশনাল না হতে পারা সম্ভব। লেখায় তাই বলা হচ্ছে
তবে মানুষের এই আপাত ইরর্যাশনাল আচরণকেও কিন্তু সীমিত তথ্য ও বোধনের অধীনে র্যাশনাল আচরণ হিসেবে ভালোভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন, ধরুন ক্রুসো ও জ্যাকসনের উভয়ের জন্যেই হয়তো স্বেচ্ছাধীন বিনিময় ম্যাটারিয়ালিস্টিক অর্থে সবচেয়ে বেশি লাভজনক, কিন্তু ক্রুসো সেই লাভটা এস্টিমেট করতে ব্যর্থ হলো, কিংবা গণিমতের মালকে ওভারএস্টিমেট করলো, কিংবা ভবিষ্যতের লাভকে অতিরিক্ত ডিস্কাউন্ট করলো, বা খুনের পেছনে কোনো সাব্জেক্টিভ ভ্যালু (যেমন, জীঘাংসা চরিতার্থের তৃপ্তি) কে অতিরিক্ত মূল্য দিলো, সেক্ষেত্রে তার সিদ্ধান্তকে তার নিজস্ব সাব্জেক্টিভ ইউটিলিটি ও গিভেন ইনফরমেশনের সাপেক্ষে কিন্তু ঠিকই র্যাশনাল বলা যায়। সেক্ষেত্রে imperfect information এর আওতায় ইকুইলিব্রিয়াম আসতে পারে (যেমন দাসত্ব)। মুক্ত শ্রমিক ক্রুসোর জন্যে বস্তুগতভাবে অধিক লাভজনক হলেও সে তার দম্ভ বা অহংকারের কারণে কম বস্তুগত লাভঅলা দাসপ্রথাকেই বেছে নিতে পারে।
আপনি যদি মানুষের মস্তিষ্ককে রিডাকশনিস্ট অ্যাপ্রোচে (আর কী প্র্যাক্টিকাল অ্যাপ্রোচই বা আমাদের আছে) বুঝতে চান, একে ইরর্যাশনাল বলে কিন্তু তেমন কূল করতে পারবেন না। মানুষের ডিসিশন ম্যাকিংয়ের যেই কম্পিউটেশনাল মডেলই আপনি তৈরি করবেন, সেটাকেই আপনি র্যাশনাল আন্ডার সাব্জেক্টিভ ইউটিলিটি অ্যান্ড ইমপার্ফেক্ট ইনফরমেশন হিসেবে দেখতে পারবেন।
@রূপম (ধ্রুব),খুব ভালো বলেছেন। র্যাশনালিটি’র সংজ্ঞা আগের ক্ল্যাসিকাল অর্থনীতির মতো আর নেই।
ডিসিশন মেকিং মডেলে এখন সাবজেক্টিভ বায়াস, ইমপার্ফেক্ট ইনফরমেশন এমনকি ব্রেনের মেন্টাল মডেলকে গ্রাহ্য করতে হচ্ছে। নিশ্চই জানেন যে ইকনোমিক্সে এখন নিউরোইকনোমিক্স খুবই হট। মানুষকে একেবারে এমআরই মেশিনের মধ্যে ঢুকিয়ে বিভিন্ন রকম ইকনোমিক ডিসিশনমেকিং প্রসেস ম্যাপিং করার চেষ্টা হচ্ছে।
অনেকদিন পর মুক্তমনায় আসায় স্বাগতম। ব্যস্ততা কিছুটা কমেছে মনে হয়?
@সফিক,
একটা ভালো ফ্রাইডে দেখে হয়তো। 🙂
আপনার মন্তব্যে লাভ হলো। কী কী কারণে মানুষের আচরণকে আমরা ইরর্যাশনাল ভাবতে পারি (কিন্তু ভিন্নভাবে দেখলে আসলে র্যাশনাল) সেটার একটা খসড়া করার চিন্তা মাথায় এলো। আপাতত এখানে তুলে রাখি –
১) ক এর আচরণকে খ অযৌক্তিক ভাবতে পারে কারণ ক এর ইউটিলিটি খ এর জানা নেই। খ এর ইউটিলিটির সাপেক্ষে ক এর আচরণ তাই অযৌক্তিক। কিন্তু ক এর ইউটিলিটির সাপেক্ষে তার নিজের আচরণ ঠিকই যৌক্তিক। ক ঠিকই তার নিজস্ব ইউটিলিটি ম্যাক্সিমাইজ করছে।
২) ক এর সাব্জেক্টিভ ইউটিলিটিটাই খ জানে, কিন্তু ক সেই ইউটিলিটি যথেষ্ট ম্যাক্সিমাইজ করতে পারছে না বলে ক এর আচরণ খ এর কাছে অযৌক্তিক লাগছে। কিন্তু ক এর কাছে ঠিক কী কী তথ্য অ্যাভেইলেবল ছিলো সেটা খ এর জানা ছিলো না। ফলে খ ভাবছে, এই ইউটিলিটি তো খুব সহজেই অমুকভাবে ম্যাক্সিমাইজ করা যায়, অথচ ক এর হাতে যে তথ্য ছিলো তার সাপেক্ষে ক এর পক্ষে এর চেয়ে ভালো কিছু করা সম্ভব ছিলো না।
৩) ক এর সাব্জেক্টিভ ইউটিলিটি ও অ্যাভেইলেবল তথ্য সবটাই খ জানে, কিন্তু খ দেখতে পাচ্ছে যে এই একই তথ্যের সাপেক্ষে ক এর ইউটিলিটিটা খ নিজে যেভাবে ম্যাক্সিমাইজ করতো, ক তার চেয়ে বাজেভাবে ম্যাক্সিমাইজ করছে। ফলে ক এর আচরণ খ এর কাছে অযৌক্তিক লাগছে। কিন্তু ইউটিলিটি ম্যাক্সিমাইজ করার জন্যে ক এর কাছে ঠিক কী গণনা সরঞ্জাম (computational resource) অ্যাভেইলেবল আছে সেটা খ এর জানা নেই। হতে পারে ক এর গণনা সরঞ্জাম সীমিত বা ইম্পেয়ার্ড। সেক্ষেত্রে ক তার প্রাপ্ত সরঞ্জামের সাপেক্ষে যা করা যেতো তা-ই করছে।
আরও যোগ হতে পারে।
প্রাসঙ্গিক হিসেবে এটাও তুলে রাখলাম:
http://mises.org/daily/2249
যদিও এই বিষয়টাতে আমার ট্রিটমেন্টটাই বরং বেশি রিগোরাস হয়েছে। 🙂
@রূপম (ধ্রুব),
বরাবরের মতই ভাল লিখেছেন। আমার জানা মতে র্যাশনালিটির এই তত্ত্ব, যাকে থিউরি অফ বাউন্ডেড র্যাশনালিটি নাম দেয়া হয়েছে, উত্থাপন করে হার্বার্ট সাইমন ১৯৭৮ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
@হারুন উজ জামান,
বাহ্। এতো কাছাকাছি চিন্তা দেখে পুলক বোধ করছি। 🙂