পূর্ব থেকে পশ্চিম

পরশপাথর

পর্বঃ

 

মার্গারেট এন্ডারসনগালভরা হাসি নিয়ে স্টেইজে উঠেই তার সেই বহুল প্রচারিত গেইমটা শুরু করে দিলেন; যার কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট, প্রোগ্রামের সময়সূচী এমনকি ওরিয়েন্টেশানের লিফলেটসহ সব জায়গায় একেবারে আয়োজন করে লিখে রাখা হয়েছে ওরিয়েন্টেশানের শুরুতে ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়ের সব গুণগান শেষ করে বহুল প্রতীক্ষিতগেইম শোশুরু হলো গেইমের নামস্ট্যান্ডআপ এন্ড সীটডাউন গেইম’, তার ভাষ্য মতে এটিওয়ার্ম আপজাতীয় গেইম গেইমের নিয়মও খুব সোজা, সে একটা একটা করে মহাদেশের নাম বলবে, তারপর সেই মহা দেশ থেকে যারা এসেছে তারা উঠে উঠে দাঁড়াবে এবং তারপর বসে পড়বে প্রথমে সে বলল, ‘এন্টার্কটিকা’; স্বাভাবিকভাবেই কেউ উঠে দাঁড়ায়নি তারপর একে একে সব শেষেএশিয়াবলার সাথে সাথে তুমুল সোরগোলসহ মনে হলো পুরো হলটাই উঠে দাঁড়িয়ে গেলো তা না হয়ে উপায় কি! বিশ্বের একতৃতীয়াংশ মানুহষইতো ইন্ডিয়া আর চীনের আমি মনে মনে বলি, ‘কি এমন তোমার গেইম, পিএইচডি করতে আসা লোকজনকে দিয়ে তুমিস্ট্যান্ডআপ সীটডাউনগেইম খেলাচ্ছো; একবার যদি বাংলাদেশে নিয়ে তোমাকে দিয়েহাডুডুখেলিয়ে নিতে পারতাম, তাহলে বুঝতেওয়ার্ম আপগেইম কাকে বলেকিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে হচ্ছে, এই নিম্নমানের অতি সাধারণ একটি জিনিসকে সে অযথাই গেইম নাম দিয়ে যা করল, তা হেসে লুটোপুটি খাওয়ার জন্য যথেষ্ট

এরপর বিভিন্ন গ্রুপে প্রতি টেবিলে যারা বসে আছে তাদেরকে কিছু কিছু পেপার ধরিয়ে দেয়া হলো; এরা আবার দুই পয়সার কাজ করে তিন পয়সার মন্তব্য পেতে খুব পছন্দ করেআমরা কিভাবে আমাদের মানোন্নয়ণ করতে পারি বলে তুমি মনে করো?’, এই ধরণের ন্যাকামি টাইপ কিছু প্রশ্নের উত্তর পূরণ করা জাতীয় পেপার আমরা আমাদের টেবিলে বসেছিলাম বাংলাদেশ থেকে আসা পাঁচজন, আর তিনজন ইন্ডিয়ান আমরা সবাই বাংলাদেশের এবং ফুলফান্ড নিয়ে পিএইচডি করতে এসেছি শুনে তাদের আকাশ থেকে পড়বার দশা হলো শুধু তারা নয় ,আসলে অনেক দেশের অনেকের সাথেই কথা বলে দেখেছি বেশিরভাগই বাংলদেশ বলে কিছুর নামই শোনেনি, চেনেইনা; যারা চেনে তারাও ভাবতেই পারেনা যে ওই দেশের মানুষ পিএইচডি জাতীয় কিছু করতে পারে কি জানি, তারা হয়তো ভাবে, দেশের মানুষগুলি ধর্মের অজুহাত দিয়ে মহাসমারোহে সারা দেশে একযোগে বোমা ফাটাবে, দুর্নীতি করে বছর বছর রেকর্ড গড়বে আর প্রাকৃতিক দূর্যোগের মুখে পতিত হয়ে হাহাকার করবে; তাদের প্রধানমন্ত্রী অসহায়ভাবে কাঁদো কাঁদো গলায় আন্তর্জাতিক সাহায্য চেয়ে আবেদন করবে হজ্জ্বের নাম করে সৌদি বাদশার পকেটে প্রতিবছর যে টাকা যায়, তা দিয়ে হয়তো একটা ভয়াবহ দূর্যোগ মোকাবেলা করা যায়, অথচ সেই লাভের টাকা থেকে অপদার্থ সৌদি বাদশার জাতেরা কয়েক পয়সার শুকনো খেজুর আর উটের মাংস পাঠিয়ে আমাদের নাম চিরস্থায়ীভাবে পাঠিয়ে দেয় ভিক্ষুকের লিস্টে বিশ্ব দরবারে জাতি ভিক্ষুকের জাতি

কদাচি, ডঃ ইউনুসেরা নোবেল পুরস্কার নিয়ে আসলে তার সবচেয়ে বড় সমালোচক হয়ে উঠে তারই দেশের লোকেরা নোবেল বিজয়ী হিসেবে বিশ্বের দরবারে তাঁর যে সন্মান আছে, তার সিকিভাগও নেই তাঁর নিজের দেশে সেদেশে সন্মান যে শুধু বড়বাপ আর বড়নানার সন্তানদের বরং, সেখানকার মানুষ এখন ডঃ ইউনুসকে পূর্বের চেয়ে অধিক সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখে, নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর তার সন্মানহানি হয়েছে ঢের বেশি কাউকে সন্মান দিতে সেজাতির খুব লজ্জা লাগে তাই বিশ্ববাজারে নিজের দেশেকে যখন পরিচয় করিয়ে দিতে যাই তখন খুঁজে পাইনা কিছুই তবে এত নাথাকার মাঝেও একটা মূল্যবান জিনিস কিন্তু আছেস্বাধীনতা’; আমাদের সন্মানের সর্বশেষ এবং একমাত্র বস্তু কেউ যখন কোন দেশকে চিনতে পারে না, প্রথমেই জিজ্ঞেস করে, ‘এটি কি স্বাধীন দেশ?’ খুব গর্ব করে বলতে পারি, বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ, আমরা নয়মাস যুদ্ধ করে স্বাধীনতা পেয়েছি তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ত্রিশ লক্ষ শুনে চমকে উঠে কেউ কেউ, আরো একবার চমকে উঠি আমিও, আমরাও কি আর আছে আমাদের বলবার মত গরীব একটা দেশ, বেশভূষাহীণ, খাবার নেই, শিক্ষা নেই, চিকিসা নেই, বাসস্থান নেই; আছেতো শুধু হাহাকার আর হাহাকার

হলঘর থেকে বের হয়ে আরো একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো আমাদের এবং বসিয়ে দেয়া হলো বিভিন্ন টেবিলে গ্রুপ করে এবারকার টেবিলে আমি একজনমাত্র বাংলাদেশী বাকী সবাই অন্যদেশের; জার্মানি, চীন, তুরস্ক; সবাই নতুন একটি মাত্র চেয়ার ফাঁকা সবার সাথে সবার কথা বার্তা চলছে, সবাই নিজেদের বিভিন্ন জিনিস নিয়ে বলছে ঠিক তখনি, শীতের শেষের দিকে হঠা যেমন বসন্তের বাতাস প্রথম বারের মত করে এসে অজানা এক অপূর্ব সুখের পরশ বুলিয়ে যায়; কল্পনার রাজ্যে লালনীল ডানা মেলে উড়তে গেলে যখন মনে হয় এই বুঝি ছুঁয়ে গেলো মেঘ, এই বুঝি স্পর্শ করা যাবে আকাশ; আগোছালো আনমনা সময়ে হঠা করে যখন চমক দিয়ে যায় বিজলিবিদ্যুত; সেই সমস্ত অনুভূতিগুলোকে জাগিয়ে দিয়ে হঠা করে পাশের খালি চেয়ারটাতে এসে বসলো পৃথিবীর কোন এক রাঙ্গা রাজকন্যা আমি নিজেকে বুঝাতে চেষ্টা করি হাজার হাজার মাইল দূরে কোথা থেকে আসবে সুরঞ্জনা কিংবা লাবণ্যরা, কে চাইবে পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে তবু, সবকিছু এলোমেলো করে দিতেই বুঝিমহুয়ারা আসে পৃথিবীর পথে পথে, ‘পদ্মাবতীরা চেয়ে থাকে চোখের দিকে, ‘বনলতারা বসে মুখোমুখি আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে পরিচিত হলাম; আর হতবাক হয়ে পড়তে থাকলাম গলায় লাগানো পরিচয়পত্র সেখানে ছোট্ট করে লেখা পৃথিবীর সবচেয়ে মায়াবী, সবচেয়ে প্রেমময় শব্দবাংলাদেশ   

বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ক্যাম্পাস ট্যুরের মাধ্যমে সবকিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো প্রথমে তারপর দুপুরের খাবার শেষে চোখ ধাঁধানোশিকাগোশহর ঘুরিয়ে দেখানো হলো ট্রলিতে করে এবং সেদিনের মতো সবকিছুর সমাপ্তি ঘোষণা হয়ে গেলো পরবর্তী দিন আবার অফিসিয়াল কিছু জিনিস জানবার জন্য আমাদের আসতে বলা হলো অন্য আরেকটা জায়গায় সেদিন বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন কিছুর আয়োজন করে সবাইকে ছোট ছোট উপহার, কলম, টিশার্ট ইত্যাদি দান করে দুহাত ভরিয়ে ফেললো সেদিনকার প্রোগ্রাম মূলত টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টদের(টিএ) জন্য, তাদের কাজ কি হবে সেই সমস্ত বুঝিয়ে দেবার জন্যবারবারানামের ষাটোর্ধ্ব ভদ্রমহিলা হয়তো তার নামকরণের সার্থকতা প্রমাণ করার জন্যই বারবার করে বলতে থাকলো, ‘যার যা প্রশ্ন আছে যেন করে ফেলে এবং সেরা প্রশ্নের জন্য পুরস্কৃত করা হবেঅন্যদিকে, প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবে আগের বছর যারা টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে এসেছে তারা, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে সবাইকে কলম আর কার্ড ধরিয়ে দেয়া হলো প্রশ্ন করবার জন্য যথারীতি মহামূল্যবান প্রথম প্রশ্ন, ‘Can we date with our students?উত্তরটা অবশ্যইNo’, তবে একটু মুচকি হেসে

সবকিছু শেষে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে না আসতেই কোন এক সুন্দরী ভিনদেশি তরুণী লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বলে উঠল, ‘Do you wanna have a kiss?আমি তাড়াতাড়ি আশপাশে আর পিছনে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই তার মানে আমাকেই বলছে ভাবছি, বলে কি? কিন্তু সে যাই বলুক আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো, ‘Sure বলতে না বলতেই সে কলমসহ একটা ফর্ম এগিয়ে দিচ্ছে কি আশ্চর্য! এখানে kiss করবার জন্য আবার ফর্ম ফিলআপ করতে হয় না কি? অবশ্য তাতেই বা কি? বড় কিছু পাবার জন্য ছোট কিছু কাজতো করতেই পারা যায় খুশি মনে kiss ফর্ম ফিলআপ করতে গিয়েই দেখি, হায়! এতোquiz’ সে আমাকে আসলে জিজ্ঞেস করেছে, Do you wanna have a quiz?কোথায়kiss’ আর কোথায়quiz’ ভারাক্রান্ত মনে আস্তে আস্তে চলে গেলাম নিজের ডিপার্টমেন্টে নিজের পরিচয় দিয়ে সব কিছু বলার পর সেখানকার কমবয়সী মেয়েটা বলে উঠলো, ‘Do you wanna have your kiss?আমি আকাশ থেকে পড়ি পড়ি, কি বলে এরা এইসব! আমি কি kiss বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ভর্তি হলাম না কি? কিন্তু ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায় আর বোকামি করছি নাআমি নিশ্চিত হবার জন্য তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘quiz না কি?’ সে আমার ভুল সংশোধন করে দিয়ে বলল,quiz না kiss’. না না করতে করতে করতেও শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললাম, ‘Yes.আমার কাছ থেকে হ্যাঁ শুনবার সাথে সাথেই বালিকা যারপরনাই খুশি হয়ে আস্তে আস্তে কাছে এসে আমার হাত ধরে তুলে দিলো টিএ রুমের চাবি আসলে সে জিজ্ঞেস করেছিলো,‘Do you wanna have your keys?’ (চলবে)

 

পরশপাথর

নভেম্বার ০৯, ২০০৯

[email protected]