বিষাদ ছুঁয়েছে আমাকে

 

ফরিদ আহমেদ

 

আমি মানুষটাই মনে হয় একটু বিচিত্র ধরনের। রসকষহীন, রামগড়ুড়ের ছানা টাইপের। নিজেতো হাসিই না, অন্যদের হাসতে দেখলেও রাগে ব্রক্ষ্মতালু জ্বলে যায় আমার। আর মামু বলে কেউ ডাকলেতো কথাই নেই। মামদো ভুতের মত মারাত্মক চেহারা হয়ে যায় আমার।

 

যে কোন আনন্দময় জিনিষের প্রতিই কেন যেন প্রবল বিতৃষ্ণা আমার। নাচ গানতো একেবারেই দুচোখের বিষ। সাঈদী হুজুরের কিছু ওয়াজ শুনেছিলাম ছোটবেলায়। তারই ডারুইনীয়  প্রভাব হয়তো এতদিনে এসে পড়েছে আমার উপর। স্থূল নাচ ও সস্তা ধরনের গানের অত্যাচার আর ভাষার দুর্বোধ্যতার কারণে হিন্দি সিনেমার রস আস্বাদন করা হয়নি কখনো আমার। অনেক বাংলাদেশিরা যেখানে সারাদিন হিন্দি সিনেমা আর সিরিয়াল নিয়ে হাসি আনন্দে মশগুল থাকেন, আমি সেখানে গোমড়ামুখে পৃথিবীর প্রতি চরম বিরক্তি নিয়ে দিন গুজরান করি। নাচা, গানার প্রতি অনীহার কারণে নাচে গানে ভরপুর রঙ্গীন বাংলা সিনেমাগুলো দেখাতেও ভাটা পড়ে গেছে অনেকদিন ধরে। দামড়া দামড়া ব্যটাছেলেগুলো ধুমসো ধুমসো সব মেয়েদের কোমর জড়িয়ে ধরে  মাজা দুলিয়ে নাচছে সেটা দেখতে আর কাহাতকই বা ভাল লাগে।  

 

নাচ্‌ গানার প্রতি বীতশ্রদ্ধ এই আমিও কী এক বিচিত্র কারণে যেন হলিউডের মিউজিক্যালগুলোর দারুণ ভক্ত। মাই ফেয়ার লেডি, এ্যানি গেট ইয়োর গান, সাউন্ড অব মিউজিক বা ওয়েষ্ট সাইড স্টোরী ছবিগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো অসংখ্যবার দেখি আমি। অসংখ্যবার দেখেও কেন যেন মন ভরে না আমার, তৃষ্ণা মেটে না কিছুতেই। এর মধ্যে ওয়েস্ট সাইড স্টোরী দেখা হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক কারণে। সেই কারণটা পরে বলছি আপনাদের।   

 

শেক্সপিয়ারের রোমিও জুলিয়েটের আদলে গড়ে তোলা হয়েছে এই ছবিটি। তবে পটভূমি হচ্ছে পঞ্চাশের দশকের নিউইয়র্ক। আমেরিকান তরুণদের গ্যাং জেট আর পুয়ের্টো রিকান তরুণদের গ্যাং শার্ক এর সশস্ত্র লড়াইয়ের মাঝে মিষ্টি কিন্তু বিয়োগান্তক পরিণতির প্রেম নিয়ে ছবিটি গড়ে উঠেছে। অনিন্দ্য সুন্দর সব নাচের কোরিওগ্রাফি আর শ্রুতিমধুর সব গান দিয়ে সাজানো কাব্যগাঁথার মত নিটোল এই ছবি। সিনেমার প্রতিটা দৃশ্যই পরিশিলীত নাচের মত দৃষ্টিনন্দন, মোহনীয় কবিতার মতই শুচিস্নিগ্ধ। এমনকি গ্যাং দুটোর সদস্যদের রক্তঝরা মারামারির দৃশ্যগুলোও সাজানো হয়েছে নৃত্যের ছন্দময় সুরে।  

 

এই ছবিটা যতবারই দেখি ততবারই অবাক হয়ে ভাবি যে, শিল্পের প্রতি কতখানি দায়বদ্ধতা থাকলে, কতখানি গভীর ভালবাসা থাকলে একটা চলচ্চিত্র বানাতে মানুষ এতখানি পরিশ্রম করতে পারে। ১৯৬১ সালে মুক্তি পাবার পরে দশটি শাখায় একাডেমি এওয়ার্ড জিতে নিয়েছিল ছবিটি। আপনাদের জন্য ইউটিউব থেকে একটা নাচের দৃশ্য আর একটা গান তুলে দিলাম এখানে।

 

httpv://www.youtube.com/watch?v=II2uaRmlQNg

 

httpv://www.youtube.com/watch?v=L7BQRGXFLJs    

এই চলচ্চিত্রটির রিভিঊ করতে বসিনি আমি। কাজেই এর বেশি আর এগুচ্ছি না। আগেই বলেছিলাম যে, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক কারণে এই ছবিটি আমার দেখা হয় বার বার। সেই কারণটা বরং বলি। খুব খুব যখন মন খারাপ হয় আমার, বিষাদে ছেয়ে যায় যখন সব কিছু, আমি আদিগন্ত নীল জলে পা ডুবিয়ে রাখি তখন। নতুবা মেঝেতে শুয়ে কাঁচের ভিতর দিয়ে অবারিত নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। নরম পেজা তুলোর মত সাদা মেঘের উড়োউড়ি দেখি। এর কোনটাই যখন করা যায় না, তখন বিষাদের সঙ্গে লড়াইয়ে পরম বন্ধু হয়ে আমার সঙ্গী হয় ওয়েষ্ট সাইড স্টোরী।

 

আজ কেন যেন আবার দেখা হলো ছবিটা। বহু দিনের বিশ্বস্ত বন্ধু আজও নিরাশ করেনি আমাকে। গভীর মমতা দিয়ে আমার বিষাদটুকু ঠিকই ঢেকে দিয়েছে সে।