চন্দ্রলোক থেকে পৃথিবী ও এককোষী একটি প্রোটোজোয়া
দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়
অনুলিখন : অনন্ত বিজয় দাশ
জনৈক সুপণ্ডিত ব্যক্তির সঙ্গে আমার মোট বার পাঁচেক পরিচয় হয়েছিল। ভদ্রলোক আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক হয়ে এসেছিলেন। অভিজ্ঞ মানুষ। ফরসা, বেঁটেখাটো, গাঁট্টাগোট্টা-অনেকটা সে-আমলে প্রতুলচন্দ্র লাহিড়ীর আঁকা কার্টুনের নায়ক খুঁড়োর মতো চেহারা। মনের ভাব বড় একটা তাঁর মুখের অভিব্যক্তিতে ধরা পড়ত না। ইতিহাসবিদ বলেই বোধহয় তাঁর ছোটখাট মানুষের কথা মনে থাকত না। প্রত্যেক বার নতুন করে পরিচয়ের সময় ভদ্রলোক যেই শুনতেন আমি পদার্থবিদ্যার শিক্ষক, অমনি সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করতেন, ‘আপনি কি অ্যাটম-বোমা বানাতে পারেন?’
তখনও ইসলামি বোমার ধুয়ো ওঠেনি, ইয়োরোপের বাজারে ছোটখাটো পরমাণু বোমা তৈরির উপকরণও পাওয়া যেত না। সুতরাং, সু-বাবুর প্রশ্নটি আমাকে বিব্রত করত। পদার্থবিদ্যার অধ্যাপনা আর পরমাণু বোমা তৈরি, এই দুটো ঘটনাকে প্রায় সমার্থক বলে মনে করা, এটা কীরকম ব্যাপার? বুঝতেই পারছেন, বয়সে আমি সু-বাবুর চেয়ে অনেকটা ছোটই ছিলাম।
দুঃখের বিষয়, সু-বাবু আর বেঁচে নেই। কিন্তু তাঁর প্রশ্নবাণটি এখনও আমার মনে বিঁধে আছে। কী বলতে চাইতেন সু-বাবু তাঁর ঈষৎ ছিটগ্রস্ত প্রশ্নের ভিতর দিয়ে? ‘তোমরা বিজ্ঞানীরা তো আর কিছুই পার না, পার কেবল ধ্বংসের সরঞ্জাম গড়তে’? না কি, ‘পদার্থবিদ্যার আর কিছুই আমার মতো একজন অব্যবসায়ীর মনে দাগ কাটে না, শুধু ওই অ্যাটম বোমার ব্যাপারটা ছাড়া’? উলটে পালটে যেভাবেই দেখি না কেন, অস্বস্তি দূর হয় না।
এরই মধ্যে আমার এক তরুণ বন্ধু সেদিন একটি ছোটখাটো অ-জিলদ বই আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। বইটির নাম ‘দ্য লাইভস অফ আ সেল’, সাবটাইটেল ‘নোটস অফ আ বায়োলজি ওয়াচার’ (লেখকের নাম লিউইস টমাস (Lewis Thomas, ১৯১৩-১৯৯৩)। বইটি হাতে পেয়ে মনে পড়ল, ‘টাইম’ পত্রিকায় বছর সাতেক আগে বইটির প্রশংসা দেখেছি। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে। তবু যে অসংকোচে তার সম্বন্ধে লিখতে বসেছি, তার কারণ সু-বাবুর প্রশ্নের একটা মোটামুটি রকমের সদুত্তর আমি এই বইয়ে পেয়েছি। নিছক পদার্থবিদ হিসেবে নয়, বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবেই)।
পরের মুখে ঝাল খাওয়ার চেয়ে সুখাদ্য সরাসরি আস্বাদন করা সর্বদাই শ্রেয়। সুতরাং আসুন, বইটির অন্তত একটি অনুচ্ছেদ পরখ করে দেখা যাক। এটি টমাসের শেষ প্রবন্ধের প্রথম অনুচ্ছেদ, আবার বইয়ের গোড়াতেই মুখবন্ধ হিসেবেও উদ্ধৃত হয়েছে। অনুবাদের ভুলত্রুটির দায়িত্ব অবশ্য বর্তমান লেখকের।
‘চন্দ্রলোকের দূরত্ব থেকে পৃথিবীর দিকে তাকালে রুদ্ধশ্বাস বিস্ময়ে যে-কথাটা আমাদের মনে আসে তা এই যে, পৃথিবীটা একটা জীবন্ত ব্যাপার। চাঁদের মাটিতে তোলা ছবির সামনের দিকে তাকালে দেখবেন অজস্র উপলখণ্ডের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত সেই উপগ্রহের পিঠ, মরা জন্তুর পুরনো হাড়ের মতোই মৃত আর তার উপরে, সিক্ত উজ্জ্বল ঝিল্লির মতো ঝলমলে নীল আকাশের নীচে, উদিত হচ্ছে ভাসমান মুক্ত পৃথিবী, বিশ্বের এই অঞ্চলের একমাত্র উচ্ছ্বসিত সত্তা। যথেষ্ট সময় হাতে নিয়ে যদি তাকিয়ে থাকেন, দেখবেন সাদা মেঘের বিপুল প্রবাহ ভেসে চলেছে। মেখলার মতো সেই মেঘরাশি অর্ধলীন ভূমিখণ্ডগুলিকে কখনও পুরোপুরি ঢেকে দিচ্ছে, আবার কখনও অনাবৃত করছে। যদি পারতেন যুগ যুগ ধরে চেয়ে থাকতে, দেখতে পেতেন এমনকী মহাদেশগুলিও ভূত্বকের ফলকের ভেলায় চড়ে ভেসে চলছে, সরে যাচ্ছে একে অন্যের কাছ থেকে। ভূপৃষ্ঠের ভিতরকার আগুনই তাদের ভাসিয়ে রেখেছে। এই যে পৃথিবী, এর চেহারাটা যে-কোনও জীবন্ত প্রাণীর মতোই সংগঠিত, স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং তথ্যময়। সূর্যের আলো এবং শক্তিকে কাজে লাগাবার আশ্চর্য নৈপুণ্যকে সে আয়ত্ত করেছে।’
এই যে উচ্চারণ, এর সঙ্গে উপনিষদের সেই নবজাগ্রত মনের সবাক বিস্ময়ের একটা মিল আছে। তফাতের মধ্যে কেবল এই যে, টমাসের অনুচ্ছেদের প্রতিটি উক্তিই বৈজ্ঞানিক গবেষণার দ্বারা বিশদভাবে সমর্থিত আর দৃষ্টিকোণ কী বিপুলভাবে পালটে গেছে। আজ থেকে আড়াই-তিন হাজার বছর আগে যখন আমাদের পূর্বপুরুষেরা তমসার ওপারে স্থিত আদিত্যবর্ণ কোনও মহান্ত পুরুষের কথা বলেছিলেন, তখন তাঁরা ছিলেন এই পৃথিবীরই মাটির একটা ছোট অংশে গভীরভাবে আবদ্ধ। অন্য দিকে টমাসের বর্ণিত মেঘ-মালা পৃথিবীর রূপ ঠিকমতো দেখতে হলে পৃথিবীর বাইরে অন্তত আড়াই লক্ষ মাইল দূরে চাঁদে গিয়ে দাঁড়াতে হয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং দুঃসাহসিক প্রেরণার ভিতর দিয়েই আজকের মানুষ সেই অভিনব দৃষ্টিকোণ খুঁজে পেয়েছে। যাঁরা মনে করেন, বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে শুধু পরমাণু বোমা আর জীবাণুযুদ্ধের হাতিয়ার, লিউইস টমাসের চটি বইটি সেইসব মনঃক্ষুন্ন বৃদ্ধ পিতামহদের পড়ে দেখা দরকার। তার কারণ এই বই হচ্ছে বিজ্ঞানের গবেষণাগারে বসে লেখা জীবনের গীতিকাব্য। পেশা এবং নেশা দু’দিক দিয়েই টমাস একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুটিতিনেক বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগে বড় বড় পদ তিনি অলংকৃত করেছেন। ‘দ্য লাইভস অফ আ সেল’ লেখবার সময় তিনি নিউইয়র্কের বিশ্ববিখ্যাত মেমোরিয়াল স্লোন-কেটারিং ক্যানসার গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ ছিলেন। যতদূর জানি, এখনও তাই আছেন।
টমাসের বইটিও আসলে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন নামের পত্রিকায় প্রকাশিত উনত্রিশটি প্রবন্ধের সংকলন। যে স্বচ্ছন্দ সাহিত্যিক ভঙ্গিতে প্রবন্ধগুলি লেখা হয়েছে, পেশাদারি পত্রিকায় তা বড় একটা দেখা যায় না।
প্রথমেই যেটা নজরে পড়ে, তা হল এই গ্রন্থে সাধারণভাবে প্রাণের এবং বিশেষভাবে মানুষের অস্তিত্বের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে টমাসের আন্তরিক আশা আর আগ্রহ। বলতে গেলে এটাই তাঁর রচনার প্রধান সুর। নানাভাবে এই সুর অবশ্য এ-যুগের বড় বড় বিজ্ঞানী এবং বুদ্ধিজীবীদের অনেকেরই রচনায় বেজেছে। রাসেল কিংবা আইনস্টানের কথা তো সহজেই মনে আসে। রাসেল নিজে জীবনের অনেক সময় যুদ্ধের বিরুদ্ধে, মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। প্রায় নব্বুই বছর বয়সেও পরমাণু বোমার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি জেলে গেছেন। তাঁর রচনার মধ্যে প্রজ্ঞার সঙ্গে খানিকটা আশঙ্কাও মিশে থাকত। হঠকারিতার বশে মানুষ যে নিজেকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে, এই ভয় তাঁর পুরোদস্তুর ছিল। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের মনেও এই ভয় অনুপস্থিত ছিল না। বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে তিনি মানুষের আত্মবিশ্বাসের সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। আবার একই সঙ্গে গভীর নৈতিক দায়িত্বের বশবর্তী হয়ে যথাসাধ্য তার প্রতিকারও করতে চেষ্টা করেছেন।
এই যে দুজনের কথা বললাম, এঁদের সঙ্গে টমাসের চিন্তাভাবনার ভঙ্গির একটু পার্থক্য আছে। সেই পার্থক্যের একটা কারণ প্রজন্মের প্রভেদ। টমাসের জীবনের একটা বড় অংশই কেটেছে পরমাণু বোমার বিষন্ন ছায়ায়। কিন্তু মূল কথাটা বোধহয় এই যে, টমাস নিজে একজন ডাক্তার। পেশাদার চিকিৎসক হিসেবে অনেক মানুষের জীবনের প্রত্যক্ষ দায়িত্ব তাঁকে নিতে হয় এবং হয়েছে। এখন, একটু অদ্ভুত শোনালেও এ-কথা বোধহয় সত্যি যে, ভাল একজন ডাক্তারের জীবনে দার্শনিক বিষন্নতার সুযোগ বড় একটা আসে না। মৃত্যুর সঙ্গে যাঁকে প্রতিদিন পাঞ্জা লড়তে হয়, তাঁর চেয়ে বেশি করে আর মৃত্যুকে কে চিনবে? এই রকম একজন বুদ্ধিমান মানুষ যখন মনুষ্যজাতির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কিংবা পৃথিবীর প্রাণের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কথা বলেন, তখন তার মধ্যে একটা প্রসন্ন দার্ঢ্য থাকে. রসবোধ থাকে. এমন কী শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে খানিকটা আশার ভাবও থাকে। টমাসের রচনার মধ্যে এই লক্ষণগুলি ওতপ্রোত হয়ে আছে। রাসেল কিংবা আইনস্টাইনের রচনায় সঙ্গত কারণেই আমরা এটা আশা করি না। আবার টমাস তো শুধু ডাক্তার নন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের একজন বড় গবেষকও বটে। প্রাণতত্ত্বের নানা এলাকায় তাঁর দখল রীতিমতো দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাই তিনি যখন এই গ্রহে প্রাণের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলেন, তখন শুধুই কতকগুলি সামান্য সিদ্ধান্তে পৌঁছবার চেষ্টা করেন না, নানা ধরনের চিত্তাকর্ষক তথ্যের সাহায্যে নিজের বক্তব্যকে সমৃদ্ধও করে তোলেন। ফলে তাঁর আলোচনা অনেকটা সাকার হয়ে ওঠে। এই গোটা ব্যাপারটাই তিনি করেন রসে-বশে থেকে, জীবন্ত আগ্রহের সঙ্গে। তাঁর কলমটি ঝরঝরে, চমৎকার একটি শিক্ষিত নাগরিক মনের পরিচয় পাই তাঁর লেখার সর্বাঙ্গে।
একটা নমুনা দেওয়া যাক। ‘একটি আন্তরিক প্রস্তাব’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি এই গ্রহের যুযুধান নেতাদের সামনে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। টমাস লক্ষ করেছেন, এবং আমরাও জানি এইসব নেতারা ‘রিয়্যাল পলিটিক’ নামক সুপ্রাচীন শাস্ত্রে বিশ্বাসী (‘রিয়্যাল পলিটিক’ কথাটি অবশ্য তিনি ব্যবহার করেননি, আমি করছি)। সেই শাস্ত্রের মোদ্দা কথা হল, ‘জোর যার মুল্লুক তার’। শাস্ত্রটি যে প্রাচীন তার প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন দেশের মহাকাব্য এবং আমাদের দেশের চাণক্যনীতির মধ্যে। আজকাল এই নীতির সমর্থনে আবার ডারউইনের অভিব্যক্তিবাদ (Theory of Evolution), সামাজিক প্রাণতত্ত্ব এবং মনস্তত্ত্বের শরণ নেওয়া হয়। প্রাণী মাত্রেরই সহজপ্রবৃত্তির কেন্দ্রে আছে আক্রমণের স্পৃহা, সেই স্পৃহাই তাকে চালায় এবং রক্ষা করে, এটাই হল রিয়্যাল পলিটিকের আধুনিক তত্ত্ব। তা টমাস বলেছেন, ঠিক আছে, তোমাদের এই তত্ত্ব এবং তার আচরণগত পরিণামকে আমরা মেনে নেব, কিন্তু তার আগে তথ্যে সাহায্যে তাকে বিশদভাবে যাচাই করে নিতে হবে। যে-সব মারণাস্ত্র তোমরা ব্যবহার করতে চাও, তার অবধারিত ফল তো হবে প্রাণের সামুদায়িক বিলোপ। নেই বিলোপই যদি ঘটাতে হয়, তবে তার আগে দেখে নিতে হবে এই গ্রহের যাবতীয় সপ্রাণ সংস্থা তোমাদের ওই নিয়মগুলিই মেনে চলে কি না। অর্থাৎ সামুদায়িক বিনষ্টর আগে সামুদয়িক তথ্যসংগ্রহের কাজটা সেরে নেওয়া যাক। বলা বাহুল্য, যে-কোনও কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষের পক্ষেই এই যুক্তি অগ্রাহ্য করা শক্ত।
অন্য দিকে এটাও ঠিক যে, পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণী সম্বন্ধে সর্বাঙ্গীণ তথ্য সংগ্রহ করাটা ভীষণ কঠিন ব্যাপার। এত বড় একটা কঠিন প্রস্তাব পৃথিবীর জঙ্গি নেতারা মুখ বুঝে মেনে নেবেন, এমনটা আশা করা যায় না। টমাস নিজেও তা বোঝেন। ভেবেচিন্তে তাই তিনি এর চেয়ে অনেক সহজ একটা প্রস্তাবই নেতাদের সামনে রেখেছেন। প্রস্তাবটা এই। এই গ্রহের যাবতীয় প্রাণী নয়, শুধু একটি মাত্র প্রাণী সম্বন্ধেই যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করা হোক। এটা করা হোক বিভিন্ন দেশের মধ্যে সহযোগিতার ভিত্তিতে, যাতে বছর দশকের মধ্যে কাজটা শেষ হয়ে যায়। তারপর সংগৃহীত সমস্ত তথ্য কম্পিউটারের সাহায্যে ভালভাবে বিশ্লেষণ করে নেওয়া হোক। পরিশেষে বিশ্লেষণের ফলাফল দেখে ঠিক করা হোক আমরা সকলে মিলে বাঁচব না মরব?
লিউইস টমাসের এই আন্তরিক প্রস্তাবের মধ্যে সাহসিকতা তো আছেই, সূক্ষ্ম রসবোধও আছে। সুখের বিষয়, পৃথিবীর জঙ্গি নেতাদের এইরকম একটা বই পড়ে দেখবার সময় হবে না, প্রবৃত্তিও হবে কিনা সন্দেহ। হলে অবশ্য টমাসের বিপদে পড়বার একটা সম্ভাবনা ছিল। কেন-না, প্রথমত জঙ্গি নেতারা রসবোধের জন্যে বিখ্যাত নন এবং দ্বিতীয়ত বড় বেশি ক্ষুদ্র একটি সরল এককোষী প্রাণীকেই তিনি (অর্থাৎ টমাস) আন্তর্জাতিক গবেষণার বিষয় হিসেবে নির্বাচন করেছেন। সেই প্রাণীটির নাম মিক্সোট্রিকা প্যারাডক্সা। পরিভাষায় এই ধরনের আদিপ্রাণীকে বলা হয় প্রোটোজোয়া। টমাসের নির্বাচিত প্রোটোজোয়ারা বাস করে অস্ট্রেলিয়ান উইপোকার পরিপাকযন্ত্রের ভিতর, অর্থাৎ অন্ত্রের মধ্যে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই প্রাণীও যে কী আশ্চর্য জটিল পদ্ধতিতে তার চারপাশের পরিবেশকে রক্ষা করে এবং নিয়ন্ত্রণ করে, খুব সহজ ভাষায় টমাস সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। আর সেই বর্ণনার ভিতর দিয়েই তিনি ইঙ্গিতে ‘জোর যার মুলুক তার’ নীতির সম্বন্ধে একচোট হেসে নিয়েছেন।
তা হলে দেখা যাক, অস্ট্রেলিয়ান উইপোকার সঙ্গে তার অন্ত্রস্থ প্রোটোজোয়ার সম্বন্ধটা কেমন, আর আশেপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর তাদের সম্মিলিত প্রভাবই বা কী ধরনের। প্রোটোজোয়াটি তো এককোষী প্রাণী। তার একটা বৈশিষ্ট্য এই যে, উইপোকার পরিপাকযন্ত্রের মধ্যে সে খুব স্বচ্ছন্দে এবং সবেগে চলে-ফিরে বেড়াতে পারে। কিন্তু আসল কাজ উইপোকার হজমশক্তিকে চালু রাখা। উইপোকার প্রধান খাদ্যটি কিঞ্চিৎ সুপাচ্য―স্রেফ মরা গাছের গুঁড়ি। এই গুঁড়ির কাঠকে সে চিবিয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো করে উদরস্থ করে। সকলেই জানেন, কাঠের মধ্যে থাকে সেলুলোজ। প্রাণধারণের ব্যাপারে সেলুলোজ কোনও কাজে আসে না, যদি-না তাকে এনজাইমের সাহায্যে জীর্ণ করে নিয়ে কার্বোহাইড্রেটে পরিণত করা যায়। এই এনজাইমটি আসে মিক্সোট্রিকা প্যারাডক্সার শরীর থেকে। এনজাইমের সাহায্যে উইপোকা সেলুলোজের অনেকটাই হজম করে নেয়, ফেলে দেয় শুধু লিগনিন নামক আর্বজনা জাতীয় পদার্থ। পরিচ্ছন্ন দলার আকারে বর্জিত এই লিগনিনের মল দিয়েই তৈরি হয় উইপোকার বাসা। এইভাবে মিক্সোট্রিকা প্যারাডক্সা নামক ছোট্ট এককোষী প্রাণীটি তার আশ্রয়দাতা উইপোকাকে বাঁচিয়ে রাখে। আবার রাখে উইপোকা নিজে মরা গাছকে জীর্ণ করে তৈরি করে উর্বর দো-আঁশ মাটি। সেই মাটিতে সে একজাতের ছত্রাকের চাষ করে―এমন ছত্রাক যা ওই বিশেষ ধরনের মাটি ছাড়া অন্য কোথাও জন্মায় না। অরণ্যের মরা গাছ, উইপোকা, দো-আঁশ মাটি আর ছত্রাক, এই সবটা নিয়ে গড়ে ওঠে যে বিশিষ্ট পরিবেশ, তার কেন্দ্রে আছে ওই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এককোষী প্রোটোজোয়া।
মিক্সোট্রিকার কাহিনীর যেটুকু আমরা জানি, তা কিন্তু এখানেই শেষ হয় না। উইপোকার অন্ত্রের ভিতরকার জলীয় পদার্থের মধ্যে সাঁতার দিয়ে চলে-ফিরে বেড়ানোর জন্য অবশ্যই তার শরীরে কিছু সরঞ্জাম থাকা চাই। সচরাচর এককোষী প্রাণীরা এই কাজটা করে থাকে খুব সরু সরু শিকড়ের মতো অজস্র প্রত্যেঙ্গের সাহায্যে। পরিভাষায় একে বলা হয় ফ্ল্যাজেলাম (যার বহুবচন ফ্ল্যাজেলি)। মিক্সোট্রিকার শরীরকে ইলেকট্রন অণুবীক্ষণের সাহায্যে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, তার ফ্ল্যাজেলামগুলি আসলে তার নিজস্ব অঙ্গই নয়। এগুলিও আসলে স্বতন্ত্র এক ধরনের এককোষী প্রাণী। প্রোটোজোয়াটির দেহত্বকের উপরে পরপর সমান দূরত্বে এরা এসে জুটে যায়, গিয়ে তাকে সাহায্য করে সাঁতার দিতে। এই এককোষীগুলিকে বলা হয় স্পাইরোটিক।
এ ছাড়া মিক্সোট্রিকার কোষের অন্তর্গত সাইটোপ্লাজম বা কোষবস্তুর মধ্যে থাকে আর নান ধরনের জীবাণু বা ব্যাকটিরিয়া। তাদের কাজ সম্বন্ধে খুব বিশদভাবে জানা না থাকলেও এটা বোঝা যায় যে, মিক্সোট্রিকা এবং তার আশ্রয়দাতা উইপোকার শরীরের পরিপাক ক্রিয়ায় তাদের একটা ভূমিকা আছে।
এই যে প্রাণের বিচিত্র সমাহার, অনেকের ধারণা ‘জটিলতর প্রাণীর দেহকোষের অভিব্যক্তির ইতিহাস’ এর মধ্যে পাওয়া যাবে। প্রাণীর দেহকোষে কোষকেন্দ্র ছাড়া অন্য যে-সব উপাদান থাকে, তার মধ্যে একটি হল মিটোকনড্রিয়া, একবচনে মিটোকনড্রিয়ন। এই মিটোকনড্রিয়ার কাজ হচ্ছে দেহকোষের মধ্যে অক্সিজেনের সাহাজ্য নিয়ে অ্যাডেনোসিন ট্রাইফসফেট বা এ টি পি নামক যৌগিক পদার্থ তৈরি করা। এই এ টি পি-র মধ্যেই শরীরের প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চিত থাকে। যেহেতু বেঁচে থাকার জন্যে যাবতীয় বিপকীয় ক্রিয়াতে, এমনকী স্নায়ুতন্ত্রের ভিতর দিয়ে সংবাদ আদান-প্রদানের কাজেও, শক্তির প্রয়োজন সেইহেতু মিটোকনড্রিয়া দেহকোষের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। প্রাণীমাত্রেরই কোষে এরা থাকে। অবশ্য এদের সংখ্যা নির্ভর করে অভিব্যক্তির মাপকাঠিতে কোন প্রাণী কতটা অগ্রসর, তার উপর। সে যাই হোক, মিটোকনড্রিয়ার ভিতরকার ঝিল্লির চেহারা কিন্তু কোষের অন্যান্য অংশের ঝিল্লির মতো নয়, বরং জীবাণুর ঝিল্লির সঙ্গেই তার মিল বেশি। শুধু তাই নয়, মিটোকনড্রিয়ার নিজস্ব ডি এন এ-ও থাকে এবং তার গড়ন কোষকেন্দ্রের ডি এন এ-র থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তার মিল দেখা যায় জীবাণুর ডি এন এ-র সঙ্গে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যখন প্রাণীর বংশবৃদ্ধি হতে থাকে, তখন কোষকেন্দ্রের ডি এন এ-র থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে মিটোকনড্রিয়ার ডি এন এ নিজের অবিকল প্রতিরূপ তৈরি করে চলে। বোঝা যায়, কোষের অন্তর্ভুক্ত হলেও মিটোকনড্রিয়া আসলে এক শ্রেণীর স্বতন্ত্র সংস্থা।
শুধু মিটোকনড্রিয়া নয়, কোষকেন্দ্রের কাছাকাছি সেন্ট্রিয়োল (Centriole) বলে দুটি জিনিষও থাকে। কোষ বিভাজনের সময় ক্রোমোজোমগুলি দুই দলে বিভক্ত হয়ে এই দুটি সেন্ট্রিয়োলকে অবলম্বন করে ঝুলে থাকে। অর্থাৎ সেন্ট্রিয়োলগুলি যেন ক্রোমোজোমের আলনার মতো কাজ করে। এই সেন্ট্রিয়োগুলিও কোষের অন্যান্য অংশ থেকে স্বতন্ত্রভাবে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখে। এইরকম আরও কিছু কিছু অঙ্গ আছে যা কোষের অন্তর্গত হয়েও ক্রিয়ার দিক দিয়ে এবং বংশগতির দিক দিয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।
এইরকম নানা সাক্ষ্যপ্রমাণ বিচার করে মারগুলিস সিদ্ধান্ত করেছেন যে, অভিব্যক্তির বিভিন্ন পর্যায়ে এইসব স্বতন্ত্র সংস্থা একে একে মিলিত হয়ে আজকের সুপরিণত কেন্দ্রসংবলিত কোষের জন্ম দিয়েছে। সোজা কথায় বলতে গেলে, নানা ধরনের এককোষী প্রাণীর সমন্বয়েই বহুযুগ ধরে ক্রমশ উন্নত প্রাণীসমূহের উদ্ভব হয়েছে। শুধু প্রাণীদেহ নয়, উদ্ভিদের দেহেও এই ধরনের মিলনের সুস্পষ্ট স্বাক্ষর পাওয়া যায়। উদ্ভিদের কোষে যে ক্লোরোপ্লাস্ট দেখা যায়, তার কাজ হচ্ছে সূর্যের আলো থেকে শক্তি আহরণ করে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং জলের মিলন ঘটিয়ে কার্বোহাইড্রেট তৈরি করা। পরিভাষায় এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় আলোকসংশ্লেষ (Photo-synthesis)। এই ক্লোরোপ্লাস্টের মধ্যেও থাকে তার নিজস্ব স্বতন্ত্র ডি এন এ এবং আর এন এ, অর্থাৎ তার নিজস্ব নিউক্লিক অ্যাসিড। দেখা গেছে, আলোক-সংশ্লেষের ক্ষমতাসম্পন্ন কিছু কিছু জীবাণু নিউক্লিক অ্যাসিডের সঙ্গে ক্লোরোপ্লাস্টের নিজস্ব নিউক্লিক অ্যাসিডের গভীর মিল আছে। তাই মনে হয়, একসময় এই ধরনের কোনও কোনও জীবাণুর সঙ্গে অন্য জীবাণুর মিলনের ফলেই উদ্ভিদ-কোষের অভিব্যক্তি শুরু হয়েছিল।
বিভিন্ন ধরনের এককোষী প্রাণীর এই যে সম্ভাব্য মিলন, অস্ট্রেলিয়ান উইপোকার অন্ত্রের ভিতরকার প্রোটোজোয়ার মধ্যে যেন তারই মডেল দেখতে পাওয়া যায়। যে-আশ্চর্য তাগিদের বশে উন্নত প্রাণীর দেহকোষের জটিল গড়নের সূত্রপাত হয়েছিল, লিউইস টমাস আশা করেন মিক্সোট্রিকার জীবনচক্র সম্বন্ধে গবেষণা তার উপর নতুন আলো ফেলবে। আবার হয়তো এইভাবেই ক্রমশ আমরা একক প্রাণী থেকে প্রাণিগোষ্ঠী এবং প্রাণিগোষ্ঠী থেকে প্রাণের বৃহত্তর সমবায়ের অভ্যুদয়ের ইতিহাস বুঝতে পারব। যে জটিল সুবেদী প্রক্রিয়াগুলির মাধ্যমে প্রাণের এই বিপুল সমবায় নিয়ন্ত্রিত হয়, তাদের ভালভাবে না জানলে বোঝা যাবে না ‘জোর যার মুলুক তার’ এই অনুমানের মধ্যে যথার্থই সর্বজনীন সত্যের কোনও বীজ আছে কি না। যে-সব চিত্তাকর্ষক সাক্ষ্যপ্রমাণ টমাস তাঁর রচনায় উপস্থাপন করেছেন, বলা বাহুল্য তার ওজন ওই অনুমানের বিপক্ষেই যায়।
লিউইস টমাসের কৃতিত্ব এই যে, কোনও সামাজিক কিংবা দার্শনিক নীতির বিশ্লেষণের মাধ্যমে নয়, বিজ্ঞানের তথ্যের সাহায্যেই তিনি নিপুণভাবে প্রাণের সপক্ষে ওকালতি করেছেন।
ড. দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৩-২০০২) অধ্যাপনা করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৮-৬১) এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৬৫-৯৮)। অতিথি বিজ্ঞানী এবং অধ্যাপকরূপে যুক্ত ছিলেন বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। তাঁর গবেষণা মূলত বিজ্ঞান ও তত্ত্বগত পদার্থবিদ্যা। প্রকাশিত গ্রন্থ ‘The Theory of Auger Transitions’, ‘মৌল কণা’, ‘ইলেকট্রন ও তার বর্ণালী’ (দুই খণ্ড), ‘প্রাণ ও অপ্রাণের সীমান্তে’ এবং ‘রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান’।
ভালো লেগেছে তবে আরো লেখা পরতে চাই’ (N)
ভালো লেগেছে।
লেখা দেখি চেইনজ হয়ে গেছে ানেকখানি। মডারেটর একটু খেয়াল করবেন।
“Lewis Thomas, ১৯১৩-১৯৯৩)। বইটি হাতে পেয়ে মনে পড়ল, ‘টাইম’ পত্রিকায় বছর সাতেক আগে বইটির প্রশংসা দেখেছি। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে। তবু যে অসংকোচে তার সম্বন্ধে লিখতে বসেছি, তার কারণ সু-বাবুর প্রশ্নের একটা মোটামুটি রকমের সদুত্তর আমি এই বইয়ে পেয়েছি। নিছক পদার্থবিদ হিসেবে নয়, বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবেই। )”
এটা হবে এখান থেকে :” এরই মধ্যে আমার এক তরুণ বন্ধু সেদিন একটি ছোটখাটো অ-জিলদ বই আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। বইটির নাম ‘দ্য লাইভস অফ আ সেল’, সাবটাইটেল ‘নোটস অফ আ বায়োলজি ওয়াচার’। লেখকের নাম লিউইস টমাস (” ……
উপরের াংশটুকু আসবে Bracket এর ভিতর।
@Ananta Bijoy Dash,
লেখা ঠিক করে দেয়া হল। আপনার জন্য ব্লগ একাউন্ট সংক্তান্ত ইমেইল করা হয়েছে। আপনি লগ এইন করেও আপনার লেখা যে কোন সময় এডিট করতে পারেন – মাডারেটরের সাহায্য ছাড়াই।
আসলে সত্যি বলতে কি বিবর্তন নিয়ে অনেকেরই খুব ভ্রান্ত ধারনা আছে। অনেকেই মনে করেন বিবর্তন বুঝি কেবল ‘জোর যার মুলুক তার’। আসলে বিবর্তনে এত বেশি সহবিবর্তন, মিথোজীবীতার উদাহরণ আছে, যে বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের পেটের ভিতরেই অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া আছে যারা আমাদের পেটে বাস করার কারনে বেঁচে থাকতে পারছে, আবার আমরাও সেই ব্যাকটেরিয়াগুলো দিয়ে নানাভাবে উপকৃত হচ্ছি। এগুলো নিয়ে আরো বিস্তৃত করে লেখা প্রয়োজন। অনন্তকে ধন্যবাদ লেখাটি মুক্তমনায় দেওয়ার জন্য।