অভিজিৎ রায়ের ভেতর যে অসম্ভব সেলফলেস একটা বিষয় ছিলো, সেটা হচ্ছে নতুনদের উৎসাহ দেয়া। নতুন বলতে একেবারে নাম পরিচয়বিহীন নতুন। এই প্রসঙ্গে আমার সাথে হয়তো হিমাংশু কর কিংবা রায়হান আবীর একমত হবেন। অভিজিৎ রায় একেবারে রেন্ডম কিন্তু পটেনশিয়াল অনেক পোলাপানদের রাইটার বানাইসিলেন। আমি আমার গল্পটা বলতে চাই।
২০১০ সালের কথা, ফেসবুকে আমার একেবারে নিজস্ব বন্ধু-বান্ধব আর রাজনৈতিক এফিলিয়েশনের সামান্য কয়েকজন ছাড়া বাইরের কোন মানুষের সাথে তখনও আমি যুক্ত নই। প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে তখন সামুতে একটা ফেইক নামে একাউন্ট খুলে কবিতা লিখতাম আর বুক রিভিউ করতাম। গড়ে পঞ্চাশজনও সেইসব লেখা পড়তো না। সেই সময় ফেসবুক এরকম জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম ছিলো না। সবারই ব্লগে একাউন্ট থাকতো।
২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়ি থার্ড ইয়ারে। ডিসেম্বরের বারো তারিখ কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়। সেইসময় বিরোধীপক্ষ খুব জোর গলায় বলে বেড়াতো কসাই কাদের আর মোল্লা কাদের আলাদা লোক। মিথ্যা পরিচয়ে একজন ভালো মানুষকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে।
আমি ঐ মামলাটা ভালো করে ফলো করতাম। আমি জানতাম ক্যামেরা ট্রায়ালে মোমেনা খাতুন নামের একজন রে’প ভিকটিম সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, যিনি কাদেরকে হ’ত্যা করতে দেখেছেন। সেই এক সাক্ষ্য মামলার মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এরপর তখন ফেসবুকে মোজাম্মেল হক নামের একজন মুক্তিযোদ্ধার সাথে পরিচয় হয়। উনি আবার ছিলেন মোল্লা কাদেরের স্কুল ফ্রেন্ড। যার সাথে ওনার যোগাযোগ মুক্তিযুদ্ধের পরেও অব্যাহত ছিলো। উনি ফাঁ’সির পর স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, “বিদায় এককালের বন্ধু কাদের মোল্লা”। সেদিন আমি ফেসবুকে এই দুটো বিষয় নিয়ে দুই প্যারার একটা স্ট্যাটাস দেই।
সেই স্ট্যাটাস ভাইরালও হয়নি কিংবা লাইকের বন্যায় ভেসে যায়নি। কিন্তু আমাকে অভিজিৎ রায় ফেসবুকে নক দিয়ে বললেন: ‘তোমার এই লেখাটা খুব ভালো হয়েছে। এই লেখাটা একটু বড় করে মুক্তমনায় দেবে?’
খেয়াল করবেন, এর মধ্যে আমি কিন্তু কয়েকবার মুক্তমনায় একাউন্ট খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। কারণ খুব স্বাভাবিকভাবেই মুক্তমনায় লেখালেখি করার জন্য যেই নূন্যতম মেরিট দরকার সেটা আমার ছিলো না। আমার একাউন্ট কখনোই এপ্রুভ হতো না। ফলে মুক্তমনার মূল কারিগর যখন নিজে থেকে নক দিয়ে আমাকে লিখতে বলছেন তখন আমার না বলার কোন কারণই থাকতে পারে না।
সেই লেখাটিতে ক্রমাগত ইনপুট দিতে দিতে একটা বিরাট লেখায় পরিণত করেন অভিজিৎ রায়। লেখাটা রাতারাতি ভাইরাল হয়ে যায়। একদিন পর অভিজিৎ রায় আমাকে বললেন, ‘বিডিনিউজের মতামত পাতার জন্য এই বিষয়ে একটা লেখা দেয়া যায়, কি বল?’
আমার আসলে বলাবলির কিছু ছিলো না। দুইদিন ধরে ব্যাক এন্ড ফোর্থ করে করে আমরা একটা চমৎকার লেখা দাঁড় করাই। সেই লেখাটা বিডিনিউজের মতামত পাতায় প্রকাশিত হয় ‘কাদের মোল্লার আসল নকল: একটি নির্মোহ বিশ্লেষণ’ শিরোনামে। বিডিনিউজের মতামত পাতার সম্পাদক আমাকে জানিয়েছিলেন, পরপর কয়েক মাস এই লেখাটা তাদের পাতার সর্বাধিক পঠিত লেখা ছিলো। এরপর থেকে বিডিনিউজ আমার কাছ থেকে আলাদা ভাবে লেখা নিতো। আমার সেই বয়সে এটা অনেক বড় বিষয় ছিলো।
এরপর অভিজিৎ রায়কে আমিই নক দিয়ে বিভিন্ন লেখায় যুক্ত করাতাম। পরের বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে এরকম আরেকটা ভাইরাল লেখা বিডিনিউজ থেকে প্রকাশিত হয় যার শিরোনাম ছিলো ‘ভাষা সৈনিক গোলাম আজম: একটি গয়েবলসিয় প্রচারণার ব্যবচ্ছেদ’। এই লেখাটাও বিডিনিজের আগে মুক্তমনা ব্লগে প্রকাশিত হয়। এই দুই লেখায় সাড়া পেয়ে আমি ডিপলি লেখালেখিতে ইনভল্ভ হয়ে যায়। ২০১৪ সালে মুক্তমনায় আমি ‘ত্রিশ লক্ষ শহিদ: বাহুল্য নাকি বাস্তবতা’ শিরোনামে আমার সিরিজ ব্লগের কাজ শুরু করি। এই সিরিজের বারোটি লেখা প্রকাশিত হয়।
এক একটা লেখা প্রকাশিত হলে সেটা মুক্তমনার সর্বাধিক পঠিত লেখা হতে সময় লাগতো না। ২০১৫ সালে আমার প্রথম বই প্রকাশিত হলে অভিজিৎ রায় ঐ বইয়ের জন্য চমৎকার একটা ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। সেই লেখাটা উনি ফেসবুকেও প্রকাশ করেন। মৃত্যু’র আগে এটাই ছিল ওনার সর্বশেষ বড় কোন লেখা।
২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নোবডি আমি ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই একজন পরিচিত ব্লগার হিসেবে এই কমিউনিটিতে জায়গা পেয়ে গেলাম। এবারে এই ঘটনাটা কখনোই ঘটতো না যদি না অভিজিৎ রায় আমার স্ট্যাটাসটা দেখে আমাকে নক না দিতেন।
মাঝখানে দশ বছর কেটে গেছে। আমার বয়সও দশ বছর বেড়েছে। এখন আমি অনেক সময় হতাশ থাকি। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি গ্রাস করে ফেলে মাঝেমধ্যেই। কিন্তু পুরো অংকটা যোগ করলে আমি নিজেকে অত্যন্ত সুখী অবস্থায় খুঁজে পাই।
আমার ঘরে খুব বেশি টাকা নাই, এই ল্যাপটপটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, এটা গেলে আরেকটা কিভাবে কিনবো আমার কোন ক্লু নাই। জিনিসপত্রের যেই দাম তাতে মাসে একদিন স্ত্রীকে নিয়ে ভালো রেস্টুরেন্টে খেতে যেতে পারার মুরোদ আমার নাই। অফিস থেকে ফেরার পথে বাস থেকে নেমে বাসা পর্যন্ত দেড়-দুই কিলোমটারের রাস্তাটা যেটা রিকশায় আসতাম সেটা কিছুদিন ধরে হেঁটে আসতে বাধ্য হচ্ছি। এতকিছুর পরেও আমি
নিজেরে আনন্দিত অবস্থায় পাই। লিখতে বসলে নিজেকে সুখী অবস্থায় পাই।
এই যে কোন একটা বিষয়ে প্যাশন খুঁজে পাওয়া, নাওয়া খাওয়া ভুলে দিনের পর দিন একটা বিষয়ের পিছনে লেগে থাকতে পারার যেই আনন্দ সেটা তুলনাবিহিন। এই দুনিয়ায় বহু বহু মানুষের অনেক টাকা কাছে কিন্তু এরকম একটা বিষয় তাদের জীবনে নাই নাই।
আমি এখনো খুব কৃতজ্ঞতার সাথে এই বিষয়টা মাথায় রাখি যে আমাকে একজন মানুষ স্পেস করে দিয়েছিলেন বলেই আমি লিখতে পেরেছিলাম। আমার লেখক হবার স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছিলাম।
অভিজিৎ রায়ের জন্মদিনে অভিজিৎ রায়কে নিয়েই কিছু বললাম না। ওনার বন্ধুরা, কমরেডরা যারা জীবিত আছেন, যাদের এখনো মেরে ফেলা হয় নাই, তারা হয়তো লিখবেন। আমি আমার গল্পই লিখলাম। কারণ আমি খুব ভালো করে জানি আমার এই গল্পের ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন ঐ মানুষটাই। একটা মানুষ যিনি এই দেশে লেখক বানানোর একটা ফ্যাক্টরি দিয়েছিলেন। নিজে যেমন অকাতরে লিখেছেন, তেমনি বিভিন্ন আলাদা আলাদা বিষয়ে এক্সপার্ট লেখক গড়ে তুলেছিলেন। তাদের দায়িত্ব নিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
এন্থ্রপোলজিস্টরা যদি এই অঞ্চলের জনপরিসরে চিন্তার বিবর্তন নিয়ে দুইশ বছরের একটা সার্ভে করেন তাহলে খুব ভালো করে দেখা যাবে রবিন্দ্রনাথের পরে বাংলা ভাষায় সামগ্রিক চিন্তার একুমুলেটেড উলম্ফনের আর সবচেয়ে বড় উদাহরণ অভিজিৎ রায় আর আর মুক্তমনার কর্মকান্ড।
বিষয়টা যেখানে রবিন্দ্রনাথকে উত্তীর্ণ করে গেছে সেটা হচ্ছে একটা চিন্তা কতোটা শক্তভাবে পাবলিক স্ফেয়ারকে নাড়া দিতে পারেল সেই চিন্তার এসোসিয়েটদের এরকম বেরহমভাবে মা’র্ডার করা হতে পারে এই প্রশ্নে।
ষোল শতকে মুঘল সালতানাতে এই অঞ্চলের চিন্তার ইতিহাসে শিখ জাতির ওপর বেরহম নির্মমতার পর (গুরু তেগ বাহাদুর এবং অনান্যদের হত্যা) ইতিহাসে বাংলাদেশে মুক্তমনাদের নির্মূল কর্মকাণ্ডকেই বলতে হয় পাঁচশ বছরের ভেতর এই অঞ্চলে সবচেয়ে নির্মম চিন্তানির্মূল অভিযান।
সেই মুক্তমনার কান্ডারির নাম শহিদ অভিজিৎ রায়!
আজ এই মানুষটার ৫১তম জন্মদিন…
খুব ভালো লিখলেন, কনভিনসিং ছিলো।
অভিজিৎ রায়ের কোন লেখা পড়ি নাই এখনো, যদিও আগ্রহ ছিলো বেশ। আর এই site সম্পর্কে জানলাম আজ’ই প্রথম সম্ভবত।
আপনার লেখাটি পড়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে নিলাম। আমার ব্লগে লেখালেখির পরিমাণ তুচ্ছ, তবে একেবারে শুরুতে জাফর ইকবালের সমালোচনা করে মুক্তমনাতে একটা লেখা প্রকাশের পরে অনেকেই তার সমালোচনায় মুখর হলে অভিজিত দা সেখানে এসে মুক্তচিন্তা ও বাক স্বাধীনতার কথা সবাইকে মনে করিয়ে দেন। খুব অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম এবং সাহস পেয়েছিলাম সেদিন।
বিনম্র শ্রদ্ধা!