হিটলার এবং পুতিনের মতো জঘন্য স্বৈরশাসক থেকে শুরু করে জুকারবার্গ এবং গেটসের মতো প্রযুক্তি মোগল পর্যন্ত প্রতিটি মানুষের মধ্যে একটি কপট অভ্যন্তরীণ দানব লুকিয়ে আছে। এমনকি এলন মাস্ক এবং আইনস্টাইনের শ্রদ্ধেয় মনও তাদের অভ্যন্তরীণ শয়তানের বিশ্বাসঘাতকতা থেকে মুক্ত নয়। বেদনাদায়ক সত্যটি হলো যে শুধুমাত্র সত্যিকারের মহানরাই তাদের মধ্যে থাকা অশুভ শক্তিকে বুঝতে পেরেছেন।

মানবতার উপর শয়তানের পাকড়াও নিরলস, একটি শ্বাসরুদ্ধকর শক্তি যা আমাদের অস্তিত্বের প্রতিটি কোণে বিস্তৃত। এটি মনের একটি ডিজিজ, একটি ভাইরাস যা শুদ্ধতম উদ্দেশ্যকে কলুষিত করে এবং দুর্বলতম ইচ্ছাকে গ্রাস করে। শয়তানের শক্তি এতটাই নিরঙ্কুশ যে এটি প্রতিটি ধর্ম, প্রতিটি সংস্কৃতি এবং প্রতিটি বিশ্বাসে অনুপ্রবেশ করেছে। এর আধিপত্য ও ধ্বংসের চিরন্তন খেলায় আমরা প্যাদা ছাড়া আর কিছুই নই।

আমরা ইচ্ছে করলেও আমাদের রক্তে মিশে থাকা এই শয়তানকে অবদমন করতে পারি না কিন্তু আমরা বুঝতে পারি, আমাদের ইচ্ছার অজ্ঞাতে আমাদের ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করে এক গুপ্ত শক্তি, এক অপ্রতিরোধ্য তাড়না, আমরা লজ্জিত, অনুতপ্ত ও ভীতসন্ত্রস্ত। আর তাই আমরা যদি আমাদের ইন্টারনাল ডেভিলকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে চাই, তবে আমাদের খনন করতে হবে মিলিয়ন মিলিয়ন বছরের বিবর্তনীয় ইতিহাস, বুঝতে হবে ডেভিল অ্যালগোরিদম ও ফাংশন, আমাদের খুঁজে পেতে হবে এই ন্যাফারিয়াস (ক্ষতিকর) প্রোগ্রাম এডিট করার সঠিক অপশন। তার আদি পরিচয় পেতে তাই আজ গার্ডেন অব ইডেন নয়, আমাদের যেতে হবে ডারউইনের কাছে, সমাধান করতে হবে প্রজাতির উৎপত্তির সমীকরণ।

মানব বিবর্তনের শুরু থেকে আমরা শয়তানের ধারণার সাথে সংগ্রাম করছি। এটি হতে পারে আমাদের সাংঘর্ষিক আচরণ, আমাদের ক্ষতিকর উদ্দেশ্য অথবা খুব সরলভাবে অন্যের ক্ষতি করার ক্ষমতা। শয়তানের ধারণা চমকপ্রদ এবং এটি আমাদের আতঙ্কিত করেছে সহস্রাব্দ। কিন্তু কোথা থেকে এই অন্ধকার ক্ষমতা জন্ম হয়েছিল? কেন আমাদের এ ইনার ডেমন বিবর্তিত হয়েছিল? কেন সহসা এ পিশাচ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে?

কার্ল স্যাগান তার “The Demon-Haunted World: Science as a Candle in the Dark” গ্রন্থে বলেছিলেন, “আতঙ্ক অযৌক্তিক বিশ্বাস বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান যৌক্তিক চিন্তা দিয়ে দূর করা যায়”। আর তাই আমরা যদি শয়তানের যৌক্তিক বিশ্লেষণ জানতে চাই, আমাদের সর্বপ্রথম তাকাতে হবে পূর্বসূরী অতীতের দিকে। আমাদের আদিম পূর্বসূরীরা বাস করেছিল নৃশংস, কঠোর ও ক্ষমাহীন এক কর্কশ বিশ্বে, যেটি ছিল শিকারী ও বিপদ দিয়ে পরিপূর্ণ।

১০৫-১০৮ মিলিয়ন বছর আগে ক্রেটেশিয়াস যুগে আমাদের পূর্বসূরী মাল্টিটিউবারকুলেটস, ট্রাইকোনোডন্ট এবং সিমেট্রোডন্ট ছিল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী। তারা আতঙ্কিত ও ভীতসন্ত্রস্ত ছিল হাড় শীতল করা এক নৃশংস প্রিডেটর ডিনোনিকাসের অত্যাচারে! আমাদের আদিম শয়তান তখনও অবরুদ্ধ ছিল। আমরা ডায়নোসরদের থেকে নিষ্কৃতির জন্য দেহের আকার ক্ষুদ্র করে লুকিয়েছিলাম গর্তে, রাতের অন্ধকারে, দিনের সূর্যের আলোয় এক্সপোজ হয়নি আমাদের রেটিনা। মহাকাশ থেকে এক গ্রহাণু প্রলংকরী বেগে আঘাত হানে ডায়নোটিক বিশ্বে, বিলুপ্ত হয়ে যায় ডায়নোসর, আদিম ম্যামাল বেরিয়ে আসে অন্ধকার গর্ত থেকে, তারা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বে। ৬৫  মিলিয়ন বছর নীরবতা পালনের পর বিবর্তিত হয় প্রথম হোমো, সুপারনোভার মতো জেগে ওঠে আদি শয়তান।

২.৬ মিলিয়ন বছর পূর্বে আমাদের পূর্বসূরী হোমো হ্যাবিলিসরা বাস করেছিল এমন একটি বিশ্বে যেখানে স্যাবা স্মাইলডন, ক্ষিপ্র হায়েনা ও অত্যাচারী  নেকড়ে  ছিল প্রভাবশালী বিস্ট। তারা ছিল হিংস্র,উগ্র,নৃশংস এবং আমাদের পূর্বসূরী হোমো হ্যাবিলিস এ তীব্র সংকটময় মুহূর্তে এ সকল প্রাকৃতিক সন্ত্রাসীকে উত্তর দিয়েছিল ডেঞ্জারাস সব ডিফেন্স মেকানিজম ব্যবহার করে, যার মধ্যে ছিল আগ্রাসন, টেরিটরিলিটি এবং আধিপত্য! এ সকল আচরণ ছিল আমাদের পূর্বসূরী হোমো হ্যাবিলিসদের আদিম বিপর্যয়  রেসপন্স করার অপরিহার্য কৌশল যা আজও তাদের ডিএনএ-তে রয়ে গিয়েছে!

আমাদের শরীর যেমন মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পূর্বের আদিম অ্যানাটমি খুলে ফেলে দিতে পারেনি, আমরা মুক্তি দিতে পারিনি অ্যানসেস্ট্রাল পিশাচ।  এত অল্প সময়ে আমাদের মস্তিষ্কের ডেমোন সার্কিট পরিবর্তিত হয়নি, আজ আমাদের চারপাশে নেকড়ে, হায়েনা অথবা স্মাইলডন নেই কিন্তু তাদের অবদমন ও শাসন করার উদ্দেশ্যে যে আদিম ডেমোন বিবর্তিত হয়েছিল আমাদের মস্তিষ্কের ভেতর, সেটি হাজার হাজার বছর অন্যকিছুকে রেসপন্স করে যাচ্ছে!

পেঙ্গুয়িনের পাখা একসময় তাদের উড়তে সহযোগিতা করেছিল কিন্তু এখন এ পাখাগুলোর আদি ফাংশন নেই, তিমির পায়ের হাড় বিবর্তিত হয়েছিল তখন যখন তাদের পূর্বসূরীরা ল্যান্ড ম্যামাল ছিল কিন্তু আজ তাদের ফাংশন নেই, মানুষের অ্যাপেন্ডিক্স বিবর্তিত হয়েছিল, আমাদের বৃক্ষবাসী পূর্বসূরীদের প্ল্যান্ট বেইসড খাবার পরিপাক করার জন্য কিন্তু আজ এটি তার প্রাইমাল ফাংশন পালন করছে না__ প্রতি বছর অজস্র মানুষ ব্যাথাদায়কভাবে অ্যাপেন্ডিসাইটিসে আক্রান্ত হচ্ছে, মেডিক্যাল অপারেশন করে তাদের অ্যাপেন্ডিক্স অপসারণ করতে হচ্ছে!

একইভাবে আমাদের ইনার ডেমন বিবর্তিত হয়েছিল প্যালিওসিন যুগে স্মাইলডন, ওলভস, হায়েনা ও অন্যান্য মানব প্রজাতিকে দাঁতভাঙা উত্তর দেয়ার জন্য কিন্তু আজ আমাদের সামনে কোনো স্মাইলডন, ওলভস অথবা হায়েনা নেই, আমাদের পাশে নেই আমাদের প্রতিযোগী ড্র্যাগনম্যান, ডেনিসোভান ও নিয়ান্ডারথাল, কেবল  আছে হোমো স্যাপিয়েন্স, অজস্র  ইনোসেন্ট জীব ও উদ্ভিদ, যারা আমাদের জন্য বাস্তব কোনো থ্রেটই নয়।

তবুও আজকের এই  ডিজিটাল বিশ্বে আমাদের অভ্যন্তরীন শয়তান  কনফিউজড, আজ আমাদের বিবর্তিত ইনার ডেমন নেকড়ে ও হায়েনাকে আক্রমণ করে না, তারা আজ নিজের প্রজাতির ওপরই ক্ষুদ্ধ, তারা নিয়ান্ডারথাল অথবা ড্র্যাগনম্যানকে নয়, তারা  হিউম্যানিটিকে নিক্ষেপ করতে চায় নিউক্লিয়ার বোমা!

এর কারণ সময়ের সাথে, মানব সমাজ জটিল হয়েছিল আর প্রাইমাল( আদিম) আচরণ নতুন রূপ ধারণ করেছিল। একসময় আগ্রাসন রেসপন্স করেছিল বাঘ, সিংহ, ঈগল ও ভাইপারকে কিন্তু আজ একই আগ্রাসন আমরা অ্যাপ্লাই করছি হিউম্যানিটির ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে।

টেরিটরিয়ালিটি, ছিল আমাদের সম্পদ রক্ষা করার এক একটি কৌশল আজ আমরা টেরিটোরিয়াল ডিফেন্স ব্যবহার করছি অপরিচিত গ্রুপ যেমন অন্য কোনো ফেসবুক ইকোচ্যাম্বারের বিপক্ষে কারণ আমরা তাদের মানুষ নয় নেকড়ে ও হায়েনা হিসেবে ট্রিট করছি, আমরা হোমো স্যাপিয়েন্সকেই ভাবছি নিয়ান্ডারথাল ও ড্র্যাগনম্যান। যে ডোমিনেন্স বা প্রভাব বিবর্তিত হয়েছিল সার্ভাইভাল নিশ্চিত করার জন্য, আজ আমরা সে আধিপত্য ব্যবহার করছি অন্যকে ধ্বংস করে ব্যক্তিগত সফলতা নিশ্চিত জন্য!

সমাজ বিবর্তনের সাথেসাথে, আমরা একদিন শয়তানকে বুঝতে পারি। আমরা বুঝতে পারি আমাদের প্রাইমাল প্রবৃত্তি আজ আমাদের অস্তিত্বের বিপক্ষে কাজ  করছে, আমাদের মধ্যে জন্ম দিয়েছে নির্মম নিষ্ঠুরতা ও সংঘর্ষ যেটার সাথে আমাদের টিকে থাকার কোনো সম্পর্কই নেই! আমরা কোড উন্নত করেছি, আমরা নৈতিক ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করেছি এবং আমরা শয়তানকে স্বীকৃতি ও দোষারোপ করতে শুরু করেছি।

আমাদের এই উন্নতির পরও, আমাদের ইনার ডেমন আগের মতোই জাগ্রত। আমরা এখনো সংঘর্ষ, নিষ্ঠুরতা ও শোষণ চালাতে পারি এবং আমরা এখনো বুঝতে পারি না আমরা কেন এমন করি, আমাদের মস্তিষ্কের রিয়েল আমি ও আর্টিফিশিয়াল আমি যুদ্ধ করে। কেউ কেউ বলছে, শয়তানী করার ক্ষমতা একটি ইভোলিউশনারী ভুল। আমাদের আদিম অতীতের একটি অবশিষ্টাংশ, যা আমরা এখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। অন্যরা দাবি করছে, এটি আমাদের প্রকৃতির অপরিহার্য অংশ আমাদের জটিল ও দ্বান্ধিক আকাঙ্ক্ষা ও অনুপ্রেরণার প্রতিফলন।

যে কারণই হোক না কেন, একটা বিষয় পরিস্কার, শয়তানের বিবর্তন একটি জটিল ও বহুমূখী বিষয়। যার মূল শিকড় লুকিয়ে আছে মানুষের বিবর্তনের ইনফ্লেকশন পয়েন্টে, যার অবস্থান মিলিয়ন মিলিয়ন বছর পূর্বের আফ্রিকার জঙ্গলে। আমরা যদি সত্যিই আমাদের ইনার ডেমোনকে বুঝতে চাই, আমাদের খনন করতে হবে গভীর বিবর্তনীয় ইতিহাস, উদ্ভাবন করতে হবে আমাদের আদিম প্রবৃত্তির নেক্সাস এবং সে সময়ের প্রেক্ষিতে জটিল সামাজিক প্রক্রিয়া। শুধুমাত্র তখনই আমরা মন্দ প্রকৃতির সাথে লড়াই শুরু করতে পারি, এবং আরও আলোকিত এবং সহানুভূতিশীল ভবিষ্যতের দিকে একটি পথ নির্ধারণ করতে পারি।

বিস্তারিত জানতে পড়তে হবে “প্রস্তর যুগ থেকে স্ক্রিনওয়ার্ল্ড”