ম্যাক্সিমাম সময় মানুষ ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য বিজ্ঞানীদের রেফারেন্স দেন। এমন একটি ভাব যেন কোনো ব্যক্তি ইন্টেলেকচুয়াল হলে সে কুসংস্কারাচ্ছন্ন হতে পারে না। ব্যাপারটা এমন যে একজন ব্যক্তি দেখতে অনেক সুন্দর হলেই তার ক্যান্সার হতে পারে না। আপনার স্বাস্থ্য যতই উন্নত হোক না কেন, আপনার ইমিউন সিস্টেম যদি কোনো ভাইরাসের সাথে পূর্ব -পরিচিত না হয় আপনি ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারেন, তার সাথে আপনার স্বাস্থ্যের সম্পর্ক কী? আর একজন মানুষ পরিপূর্ণ সুস্থ্য হলেই যে তার রোগ হওয়ার আশঙ্কা নেই, এমন কোনো নিশ্চয়তা আছে? এটা নির্ভর করছে তার পরিপার্শ্বিক পরিবেশের উপর।
কোনো বিজ্ঞানী বিজ্ঞানী হওয়ার পর কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়নি। এমন নয় যে সে বুদ্ধিদীপ্তভাবে চিন্তা করতে শেখার পর কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়েছে। প্রতিটি বুদ্ধিমান মানুষ ছোটকালে গড ভাইরাস সংক্রমিত হয়, পিএইচডি করার পর নয়।
কারণ শিশুদের মস্তিষ্ক অপরিণত, তাদের ব্রেন যুক্তিসংগতভাবে চিন্তা করতে পারে না, তাদের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স এত অল্প বয়সে ডেভেলপ হয় না। আমাদের মস্তিষ্কের আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, যুক্তি প্রক্রিয়া ও যৌক্তিক সিদ্ধান্তের সাথে এই কর্টেক্সই জড়িত। ডেভিড ইগলম্যান তার বই ‘দ্য ব্রেন দ্যা স্টোরি অব ইউ’তে (আমি অনুবাদ করেছি) বলেছিলেন, প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্সে কিছু সেল জন্ম হতে ২৫ বছর সময় লেগে যায় অর্থাৎ একজন মানুষ ২৫ বছর পূর্বে নিজের চিন্তা ভাবনাকে পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তার ব্রেন লজিক্যালি সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থও হতে পারে, সে ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়। (১)
এজন্য আমরা দেখতে পাই, কিশোররা অনেক দ্রুত গতিতে বাইক ছোটায়, আক্রমণাত্মক আচরণ করে, ড্র্যাগের প্রতি খুব সহজে আসক্ত হয় এবং এ বয়সেই তারা ইভটিজিং করে, সাইবার বুলিং করে ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশ নেয় কারণ তাদের যৌক্তিক সিদ্ধান্ত, প্রজ্ঞা, নৈতিকতা ও বিবেকের সাথে সম্পৃক্ত কর্টেক্সই উন্নত হয়নি। আর ধর্ম সবসময় এই ঝুঁকিপূর্ণ মস্তিষ্কগুলোকেই টার্গেট করে!
এ সময় তাদের একজন মুক্তচিন্তাসম্পন্ন দার্শনিকের গাইড প্রয়োজন, প্রয়োজন একজন যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের গাইড। আর ঈশ্বরের ধারণা মানুষের মস্তিষ্কে সায়েন্টিস্ট হওয়ার পর প্রবেশ করে না, প্রবেশ করে জন্মের পরপর, যখন তার মস্তিষ্কের সংযোগগুলোও ( নিউরাল কানেকশন ) সঠিকভাবে তৈরি হয়নি, তার ব্রেন মাত্র পরিবেশকে কপি করে করে বিকশিত হচ্ছে, ব্রেন কানেকশন ডেভেলপ হচ্ছে।
প্রশ্ন করতে পারেন, একটি জিরাফ যেখানে জন্মের ৯০ মিনিটের ভেতরেই শারীরীক ও মানসিক ম্যাচিউরিটি অর্জন করে, কেন শিশুদের ব্রেনের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স ২৫ বছর পর্যন্ত আন্ডারডেভেলপ থাকে? কেন ম্যাচিউরিটির প্রসেস এত দীর্ঘ? বিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে এর উত্তর হলো, মায়ের জন্মনালী সরু হওয়ায় মানব শিশু অপরিণত ব্রেন নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। কারণ দু-পায়ে ভর করে হাঁটার কারণে পাইলোসিন যুগের হোমো ইরেক্টাসদের জন্মনালী সরু হয়ে গিয়েছিল এবং মস্তিষ্ক ক্রমশ বড় হয়ে উঠেছিল। এত সরু জন্মনালী দিয়ে এত বড় মস্তিষ্কের শিশু বের হতে পারত না। এটাকে “obstetrical dilemma” বলে। এই সংকট মোকাবিলা করে মা ও শিশুকে রক্ষা করার জন্য প্রকৃতি একটি সল্যুশন বের করেছিল আর তা হলো: অপরিণত ও ফ্ল্যাক্সিবল ব্রেন নিয়ে জন্মাও। ঠিক এজন্যই শিশুদের ম্যাচুউরিটি প্রসেস দীর্ঘ। যেখানে অন্যান্য প্রাণীরা জন্মের পরপরই মানসিক ফিটনেস অর্জন করে শেখানে মানব শিশুকে বছরের পর বছর মানসিক ফিটনেস অর্জনের জন্য পড়াশুনা করতে হয়। ( বিস্তারিত আমার বই “ব্রেনে’ পাবেন”)
বিবর্তনে কেবলমাত্র সে শিশুটির পক্ষেই সার্ভাইভ করা সম্ভব যার ব্রেন কপি ও রেসপন্স করতে পারদর্শি, লজিকে দূর্বল, বিশ্বাস প্রবল।
একটি কম্পিউটারকে ইনপুট দেয়ার পর সে যদি আউটপুট না দিয়ে প্রোগ্রামারকে পালটা যুক্তি দেয় সে কম্পিউটারটি বিশ্বস্ত ও সময় সাশ্রয়ী নয়। আমরা সেই কম্পিউটারকেই বিশ্বস্ত বলতে পারি যেটি অন্ধভাবে কপি করতে পারদর্শী। কম্পিউটার প্রোগ্রামের ভালো বা মন্দ দেখে না সে যেটা দেখে সেটা হলো নির্দেশনা। আর এজন্য কম্পিউটার অনেক সময় ভাইরাস বা খারাপ প্রোগ্রাম দ্বারাও সংক্রমিত হয়।
ঠিক একইভাবে একজন শিশু যদি তার পিতামাতার নির্দেশনা না মেনে কাউন্টার লজিক দেয় তবে শিশুটির ব্রেনও বিশ্বস্ত নয়। মনে করুন আজ থেকে দুই মিলিয়ন বছর পূর্বে পাইলোসিন যুগে, আমাদের পূর্বসূরি হোমো ইরেক্টাস তার চার বছর বয়সী একটি শিশুকে সতর্ক করে বলল, সাবধান! স্মাইলডনের সামনে যেওনা, তার আছে তলোয়ার সদৃশ দন্ত, সে প্রচণ্ড হিংস্র ও আক্রমণাত্মক।আর ঠিক তখনই ইঁচড়েপাকা ইরেক্টাস শিশুটি তার পিতাকে পালটা যুক্তি দিয়ে চ্যালেঞ্জ করল ও স্মাইলডনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এমন অকালপক্ক দুরন্তপনা তার্কিক শিশুর পক্ষে সার্ভাইভ করা সম্ভব ছিল না। আমাদের পূর্বসূরি শিশুরা যদি এরকম যুক্তিবাদী ও মহাপণ্ডিত হতো তবে স্যাপিয়েন্স বিবর্তনের মিলিয়ন বছর আগেই তাদের সকল পূর্বসূরি বিলুপ্ত হয়ে যেত। আজ এ মুহূর্তে আমি এ আর্টিকেলটি লিখতে পারতাম না ! তার মানে দেখা যাচ্ছে, মানব সভ্যতার জিনকে প্রিজার্ভ করার জন্য আমাদের পূর্বসূরি শিশুদের মস্তিষ্কে একটি জেনেটিক্যাল লজিক উন্নত হয়েছিল, যুক্তিকে সাসপেন্ড করো ও অন্ধভাবে অনুকরণ করো।
আপনি আপনার সন্তানকে আগুনে হাত দিতে নিষেধ করার পর যদি সে আগুনে হাত দিয়ে আপনার কথার সত্যতা যাচাই করতে চায় তার হাত পুড়ে যাবে , এজন্য তার জন্য উপযোগী হলো আপনার নির্দেশনাকে বিশ্বাস করে নেয়া। কাউন্টার লজিক দেয়া নয়। আর এ ধরণের অন্ধ বিশ্বাসী শিশুরাই আফ্রিকার জঙ্গলে টিকে থাকতে সক্ষম ছিল।
শিশুদের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স যদি তার জীবনে টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পাঠ শিখে উঠার পূর্বেই বিকশিত হয়ে যেত তবে বেশিরভাগ সময়ই সে শিশু তার পিতামাতার আদেশ অমান্য করত , নিজের মতো যুক্তি প্রদর্শন করত। এ ধরণের বিশুদ্ধ সায়েন্টিস্টদের পক্ষে বিলুপ্তি ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। আমাদের অবিকশিত প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স এই শিশু সায়েন্টিস্টদের রক্ষা করে , এটি অনুন্নত থাকে, চুপচাপ পিতামাতার আদেশ অনুসরণ করে নিজেকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করে তুলতে।
কিন্ত লক্ষ্য করুন, ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বাঘের হাত থেকে শিশুকে বাঁচানোর জন্য মা সবসময় বাঘের ভয় দেখায় না বরং একটি ভূতের গল্প তৈরি করে । কারণ উদ্ভট গল্পের মাধ্যমে মস্তিষ্ককে সহজে ডোমিনেট করা যায়। আর আমাদের ব্রেন গল্প বলার জন্য বিবর্তিত,উদ্ভট গল্পের মাধ্যমে আমাদের ব্রেন খুব দ্রুত রিয়েলিটিকে শিখতে পারে। এজন্য তার মস্তিষ্কের ভেতর এই কুসংস্কারটিও স্থায়ীভাবে লিপিবদ্ধ হয়ে যায় যে ঝোপের ভেতর নিশ্চয় ভূত আছে। আবার অনেক সময় ঝোপের ভেতর কিছু না থাকলেও শিশুটি ঠিকই ঝোপের ভেতর ভূতের অস্তিত্বকে বিশ্বাস করে নেয় কারণ তার ব্রেন যুক্তিকে সাসপেন্ড করার জন্যই বিবর্তিত। এখান থেকেই শিশুদের মধ্যে অন্ধ বিশ্বাস জন্ম হয়, তারা ভাইরাস সংক্রমিত হয়ে ওঠে।
একজন শিশুর মস্তিষ্কে প্রতি সেকেন্ডে দুই মিলিয়ন কানেকশন তৈরি হয়। দুই বছরে একজন শিশুর ব্রেন প্রায় ১০০ ট্রিলিয়ন কানেকশন তৈরি করে। আর এজন্য অ্যাডাল্টদের তুলনায় শিশুরা তার এনভায়রনমেন্টকে অনেক দ্রুত কপি করতে পারে, তারা খুবই দ্রুতগতিতে তাদের চারপাশ সম্পর্কে ধারণা তৈরি করতে পারে। আর এজন্য প্রতিটি শিশুর ব্রেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। শিশুদের মস্তিষ্ক অত্যন্ত সংবেদনশীল স্ক্যানার। আপনি তাকে যা বলবেন সে তাই স্ক্যান করবে। এজন্যই মানুষ তার ছেলেবেলার শিক্ষা থেকে বের হতে পারে না। অনেক বড় বড় বিজ্ঞানীরাও তাদের জন্মগত ঈশ্বর ও ধর্ম বিশ্বাস থেকে বের হতে পারেনি। একজন শিশুর ব্রেন এতটাই সংবেদনশীল যে চাইল্ড ব্রেন তাকে বড় হওয়ার পরও ডোমিনেট করে। অতএব এমন কোনো যুক্তি প্রদর্শন করা ঠিক নয় যে, নিউটন ঈশ্বর বিশ্বাস করলে আমাকেও ঈশ্বর বিশ্বাস করতে হবে, যেমনিভাবে এমন কোনো যুক্তি উপস্থাপন করা উচিত নয় নিউটন ভাইরাস আক্রান্ত হলে আমাকেও ভাইরাস সংক্রমিত হয়ে সুইসাইড করতে হবে!
চমৎকার তথ্য। বইটাও পড়তে শুরু করেছি। অনেক ধন্যবাদ।
আমার যা মনে হয়, এ যুগে বহু মানুষ মনে মনে ঈশ্বর বিশ্বাস করেন না, যথেচ্ছভাবে অন্যায় সব কাজ করেন। বাকি রইল লোকদেখানি ভড়ং, তা ওই সোস্যাল অ্যাকসেপ্টেন্স পাওয়ার জন্য। সবাইকে নিয়ে চলতে হয় — ভাবখানা এমন। বইটিতে পাচ্ছি ইগলম্যান বলছেন, “All the experiences in your life – from single conversations to your broader culture – shape the microscopic details of your brain. Neurally speaking, who you are depends on where you’ve been. Your brain is a relentless shape-shifter, constantly rewriting its own circuitry – and because your experiences are unique, so are the vast, detailed patterns in your neural networks. Because they continue to change your whole life, your identity is a moving target; it never reaches an endpoint.”
তাই আমার মনে হয় ওইসব নীরব মানুষরাও একটি আলোকিত, সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশে তাদের মগজের লেটেন্ট নিরীশ্বর চিন্তা প্রকাশ করতে পারবেন। উপমহাদেশে এটা খুবই ঝুঁকির, কারণ ফ্যাসিস্ট কায়দায় গণতন্ত্রের দখল নিয়েছে কুসংস্কারের দোকানদাররা। এজন্য চেতনায় লেটেন্ট অবিশ্বাস রাখা মানুষজনেরা ভাববেন, ‘দরকার কী ঝামেলায় যাওয়ার? যেমন চলছে, তেমন চলুকই না।’ এখানটাতেই সবার পরাজয়।
এর উল্টোটাও তো হতে পারে? নাকি পারেনা?