লিখেছেনঃ অরণী সাহা

বাংলাদেশের সমাজের অনেকেই ধারণা করেন যে, নারীবাদী মানেই হচ্ছে অনৈতিক কিছু, নারীবাদ মানেই হচ্ছে নারী-স্বাধীনতার নামে নেতিবাচক কাজে লিপ্ত হয়ে যাওয়া। অসুস্থ বাংলাদেশের সমাজে নারীবাদ নিয়ে কতো ধরণের নেতিবাচক ধারণাই তো রয়েছে যে, নারীবাদী নারীদের মন বিষাক্ত, তারা নাকি পুরুষবিদ্বেষী। জিনিসগুলো ঘুরিয়ে বললে কেমন হয়, যে, পুরুষতন্ত্রবাদ মানেই কি পুরুষদের হাতে নৈতিক অনৈতিক এগুলোর কর্তৃত্ব চলে যায় না? পুরুষতন্ত্রবাদ মানেই কি পুরুষস্বাধীনতার নামে নেতিবাচক কাজে লিপ্ত হওয়া না? পুরুষদের মন বিষাক্ত না? তারা নারীবিদ্বেষী না? সমাজ তো পুরুষদের দ্বারাই তৈরি, সব জায়গায় পুরুষাধিপত্য চলে, নারীদের পোশাকের উপর পুরুষতন্ত্রবাদী নজরদারি, খবরদারি, নিয়ম, নীতি এগুলো কেনো চলে বাংলাদেশের সমাজে? নারীরা তো পুরুষদের পোশাকের উপর কোনো বিধি চাপিয়ে দেয় না। এগুলো কি রকম নৈতিকতা? মানুষ হিসেবে নারীদের মূল্যায়ন, মর্যাদা পুরুষরা যেভাবে তৈরি করবে সেটা নারীরা বিনা প্রশ্নে, বিনা দ্বিধায় মেনে নেবে?

 

পৃথিবীতে মানব সমাজ সভ্যতার ইতিহাস জুড়ে কতো চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, প্রতারণা, ধোঁকাবাজি, খুন খারাবি হয়েছে এগুলোতে কারা অংশ নিয়েছে? নারী না পুরুষ? উত্তরে বলা হবে, নারীও অংশ নিয়েছে, পুরুষও অংশ নিয়েছে, তবে নারীদের তুলনায় এক্ষেত্রে পুরুষদের সংখ্যাই অনেক অনেক বেশি, বলা যেতে পারে এক্ষেত্রে শতকরা হিসেবে ৯০ শতাংশের উপরেই পুরুষ। পুরুষরা মানুষের স্তরে উঠেছে বহু আগেই, আর অপরাধ জগত এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ড সহ বলাৎকার, ধর্ষণ এগুলোও পুরুষরাই করে এসেছে বেশি এবং এখনো এক্ষেত্রে পুরুষদের সংখ্যাটাই বেশি। অনেক পুরুষতন্ত্রবাদী পুরুষই বলাৎকার, ধর্ষণ, বলপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন, নারী হয়রানি এগুলোকে অনৈতিক মনে করেনা, অপরাধ কিংবা নেতিবাচক মনে করেনা। বৈবাহিক ধর্ষণ এটাকেও অনেক পুরুষ-স্বামী ইতিবাচকই মনে করে, মনে করে আমার বউ আমি যখন ইচ্ছা তখন তার শরীর দেখবো, সে দেখাতে বাধ্য হবে, হওয়া উচিৎ কারণ আমি তার স্বামী, পুরুষতন্ত্রবাদ এরকম যথেচ্ছাচারিতা খাটায় নারীর উপর। আমাদের বাংলাদেশের সমাজে আমরা কি দেখতে পাই? খবরের কাগজে যদি চোখ বুলাই বা টেলিভিশনের নিউজ চ্যানেল যদি দেখি কি দেখতে পাই? খুন খারাবি, ধর্ষণ, ধোঁকাবাজির সংবাদের ঢেউ, এক্ষেত্রে এসব কর্মে নারীদের চেয়ে পুরুষদেরই তো সংখ্যাধিক্য দেখতে পাওয়া যায়। দুশ্চরিত্র মানুষ নারীও আছে, তবে নারীদের চেয়ে পুরুষদের সংখ্যাই সবসময় বেশি, আগেও, এখনো। নারীবাদ হচ্ছে পুরুষতন্ত্রের সমস্ত নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে সমালোচনা করা, নারীবাদ হচ্ছে পুরুষতন্ত্রবাদের বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ যেখানে নারী অবহেলিত, নিষ্পেষিত। নারীবাদ নারীদেরকে চুরি করা শেখায় না, নারীবাদ নারীদেরকে খুন করতে শেখায় না, নারীবাদ নারীদেরকে পুরুষদেরকে ধর্ষণ করতে শেখায়না; কোনো নারী যদি নারীবাদের নাম নিয়ে এসব কাজে জড়ায় তবে সে অবশ্যই অপরাধী।

 

নারীর পোশাকে পুরুষতন্ত্রবাদী নৈতিকতার ছড়ি ঘোরে, নারীর আর্থ কর্তৃত্ব বাংলাদেশের সমাজে কটু চোখে দেখা হয় এখনো; এগুলোর বিরুদ্ধে নারীবাদী পড়াশোনা তো জরুরি, কেনো নারীবাদকে ছোটো করে দেখা হবে? বাংলাদেশের সমাজে নারীর মূল্য তার চেহারা, আর শরীরের জন্য, বাংলাদেশের সমাজে নারীর মূল্য তার গৃহিণী হিসেবে দক্ষতার জন্য; নারীরা বাংলাদেশের সমাজে মানুষের স্তরে উঠতে পারেনা, পারছেনা, এক্ষেত্রে নারীবাদী পড়াশোনা, নারীবাদী আন্দোলন খুবই জরুরি। নারীদের সামাজিক ভূমিকা কি আজীবন ঘরোয়া কাজেই শোভা পেতে থাকবে? আর ঘরোয়া কাজ করেও তো নারীরা সেরকম মূল্য পায়না, সবজায়গায় পায়না। একজন নারী সে চাকরিজীবী হতে পারে, একজন নারী লেখিকা হতে পারে, একজন নারী বিয়ে করে সন্তান জন্ম দিয়েও এসব চালিয়ে যেতে পারে, আর কি দরকার সবসময় নারীদের সন্তানের দায়িত্ব নেওয়ার? সন্তানের দায়িত্ব তো পুরুষরাও নিতে পারে, এতে তো কোনো সমস্যা থাকতে পারেনা, থাকার কথা নয়। নারীর আত্ম নির্ভরশীলতা থাকলে সমস্যা কোথায়? এক্ষেত্রে একটা নারীও একটা বেকার পুরুষের দায়িত্ব নিতে পারে যেখানে বাংলাদেশের সমাজে অনেক বেকার তরুণ যুবক রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে, যাদের জীবনে নারীসঙ্গ আসেনা সমাজে চলা পুরুষতন্ত্রবাদী বিধির কারণেই, যার নিয়ম হচ্ছে রোজগার না করলে ছেলেকে বিয়ে দেওয়া হবেনা, পুরুষতন্ত্রবাদ দ্বারা পুরুষরাও যে সব দিক দিয়ে সুফল পায় তা কিন্তু না আবার অনেক নারীও পুরুষতন্ত্রের কারণে উপকৃত হয় যেমন পুরুষসঙ্গ পেতে গেলে রোজগেরে হওয়া লাগেনা। পুরুষত্ন্ত্রবাদে নৈতিকতার মানদণ্ডটা অদ্ভুতভাবে তৈরি করা, বেকার পুরুষের জীবনে নারী আসাটা অস্বাভাবিক, অসম্ভব এবং অনেক ক্ষেত্রে অনৈতিক ও, এর জন্য বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থাই দায়ী যেখানে নারীদেরকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সুযোগ দেওয়া হয়না তেমন।

 

বাংলাদেশের সমাজে ধরা বাঁধা নিয়ম আছে যে এরকম পোশাক নারীরা পরতে পারবে, এরকম পোশাক পরতে পারবেনা; বোরকা, সালোয়ার কামিজ, শাড়ি এগুলোর বাইরে গেলেই নারী খারাপ, নারী অনৈতিকতাবাদী, উদাহরণস্বরূপ, একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী প্যান্ট শার্ট পরে রাস্তায় বের হলো; আর ওমনিই সে সমাজের মানুষের দৃষ্টিতে পড়ে যাবে, এবং সমাজের মানুষ নারীটির বিরুদ্ধে কথা বলবে, তাকে কেউ বলবে অস্বাভাবিক, কেউ বলবে বেয়াদোব এরকম, কারণ সমাজে সে রকম শিক্ষা নেই যে মানুষ নারীর পোশাকের স্বাধীনতা সমর্থন করবে। নারীর পেশা, নারীর সাইকেল চালানো এগুলোও সমাজে নেতিবাচক হিসেবে বিবেচিত; সমাজে পতিতালয় আছে, কিন্তু নারীদের যৌন চাহিদা নিবারণের জন্য কি আছে সমাজে? আছে কিছু সেরকম? সমাজ কি সেরকম ব্যবস্থা রেখেছে? সমাজে নারীবাচক অনেক অপশব্দ আছে, পুরুষবাচকও আছে, তবে নারীবাচকই বেশি। বাংলাদেশের সমাজে মেয়েদের মনস্তত্ত্ব ঋণাত্মক ভাবে তৈরি হয় সমাজের কারণে, নারীরা পুরুষবিদ্বেষী হয়ে যায় সমাজের কারণেই, এবং এখানে মূল দোষ পুরুষদেরই।

 

নৈতিকতার মানদণ্ড একেক দেশে একেক রকম, তবে পৃথিবী জুড়ে সাধারণ কিছু নৈতিকতা আছে, চুরি করা, ধোঁকা দেওয়া, ছিনতাই করা, মিথ্যা বলা, মানুষকে অন্যায় ভাবে মারা এগুলো সব মানব সমাজেই ঋণাত্মক কাজ হিসেবে বিবেচিত; আর নারীদের ব্যাপারে নৈতিক-অনৈতিক এগুলো সমাজ পুরুষতন্ত্রবাদী নাকি অপুরুষতন্ত্রবাদী এটার উপর নির্ভর করে, এটা একেক দেশে একেক রকমই; তবে নারীবাদী পড়াশোনা এখন বিশ্বের প্রায় সব দেশেই আছে, আগে যা শুধু পশ্চিমি দেশগুলোতে ছিলো। বাংলাদেশের মেয়েদের পেছনে পড়ে থাকলে চলবেনা, সামাজিক ভাবে তাদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য নারীবাদী আন্দোলন করা উচিৎ যেখানে বলতে হবে যে মানুষ হিসেবে আমাদের উঁচু স্তরে ওঠার অধিকার আছে, আমরা মানুষ হিসেবে সমস্ত অধিকার চাই।