নাৎসি মতবাদ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

নাৎসিদের সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘটার একটি বড় কারণে নাৎসিদের উগ্রজাতিয়তাবাদী মতাদর্শ। হিটলার ছিলেন এ দর্শনের প্রবক্তা। তিনি মনে করতেন, জার্মান জাতি বিশ্বের উৎকৃষ্ঠ এবং অন্যরা হচ্ছে নিকৃষ্ট। তাই নিকৃষ্ট জাতিগুলো শ্রেষ্ট জাতির দ্বারা শাসিত হবে। তাদের অধীন থাকবে। সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে পুরো ইউরোপকে জার্মানীদের শাসন-কর্তৃত্বে নিয়ে আসতে তান্ডব ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেন। যার পরিণতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

আমরা যখন যে কোন একটি দেশের মানবিক বিপর্যয় ও ধ্বংসযজ্ঞ দেখি তখন তা মেনে নিতে পারিনা, প্রতিবাদী হয়ে উঠি। ইরাক, ইউক্রেন সে কোন যুদ্ধের কথাই বলি না কেন, সবই সমান বেদনা ও কষ্টের। আর সে যুদ্ধ যখন বিশ্বব্যাপী হয় তা কতটা ভয়ংকর সহজেই বোধগোম্য। সে যুদ্ধে প্রায় ৭কোটি মানুষ প্রান হারান। তারমধ্যে ইহুদীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৬০ লাখ। ইহুদীদের এই হত্যাকান্ডকে বলে হলোকাষ্ট।

সে যুদ্ধের মূলে ছিল উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদ। হিংস্রতা, ঘৃণা ও সর্বাত্মকবাদের অপরাজনীতি। যে কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই মতবাদ ও তার চর্চাকে নিষিদ্ধ করা হয়। পরবর্তিতে কোন দেশই এই ধারাকে প্রশ্রয় দেয়নি, গ্রহন করেনি। কিন্তু ইউক্রেনই বিশ্বের একমাত্র দেশ যারা রাষ্ট্রীয়ভাবে এই ঘৃণীত নাৎসি মতাদর্শকে শুধু স্বীকৃতিই দেয়নি, তাদের সামরিক বাহিনীতে আত্মীকরণ করেছে। ২৪ ফেব্রুয়ারী রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রোমনের একটি প্রধান কারণ এই নব্যনাৎসির তৎপরতা বন্ধ করা।  

ইউক্রেনে নব্য নাৎসি’র উত্থান যেভাবে

ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নের একমাত্র অঞ্চল, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসিবাহিনী আশ্রয় ও সহযোগিতা পেয়েছিল। একদিকে সোভিয়েত সৈন্য ও জনগণ জার্মানের ফ্যাসিস্ট হিটলারের বিরুদ্ধে মরণপন যুদ্ধ করছে অন্যদিকে ইউক্রেনের জনগণের একাংশ মাতৃভূমির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ইহুদী হত্যায় মেতে উঠেছে।

সেই নাৎসি ও উগ্রশ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ থেকে ইউক্রেনে ‘আজভ ব্যাটেলিয়ন’ গড়ে তোলা হয়। জাতিবিদ্বেষী সংগঠন প্যাট্রিয়ট অফ ইউক্রেন এবং সোশ্যাল ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির মধ্য থেকে একে গড়ে তোলা হয়।

হিটলারের সঙ্গী হলোকাস্টের সেই স্তেপান বান্দেরার উত্তরসূরীরা ইউক্রেনে নব্য নাৎসি সংগঠনের  জন্ম দেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গনের পর এদের সমর্থকরা সংগঠিত হতে শুরু করে। ২০০৫ সালে পেট্রিয়ট নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। ২০০৮ সালে এরা ইউক্রেনে প্রকাশ্য তৎপরতা শুরু করে। নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি ও সামরিক প্রশিক্ষন বাড়াতে থাকে।

২০১৪তে মার্কিন মদদে ইউক্রেনের রাজনৈতিক পরিবর্তন ও রুশপন্থী সরকার অপসারণে এরা ভূমিকা রাখে। সে বছর ইউক্রেনের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তামন্ত্রী তাদের কাজের প্রশংসা ও সমর্থন করেন। এবং তাদেরকে প্যারা মেলেটারিতে অন্তর্ভূক্ত করেন। পরবর্তিতে রুশপন্থী গেরিলাদের বিরুদ্ধে পূর্ব ইউক্রেনে সরকারী বাহিনীর সাথে একযোগে যুদ্ধ করে। নাৎসি বাহিনীর ব্যাস-সিম্বল নিয়ে তারা তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ম্যাগাজিন, দ্য নেশনের সংবাদদাতা ২০১৯ এ তথ্য প্রকাশ করেন।

তারা নাৎসি জেনেও ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি পেট্রো পোরোশেঙ্কো বলেছিলেন, এরাই আমাদের সেরা যোদ্ধা, সেরা স্বেচ্ছাসেবক। এদের মূলনেতা আন্দ্রেই বিলেতস্কি। অ্যাজভ বাহিনীকে স্বেচ্ছাসেবক বলে পশ্চিম ইউরোপের সংবাদ মাধ্যমে প্রচার করা হলেও তারা আসলে ইউক্রেনের সরকারি সেনাবাহিনীর অংশ।

জেলেনেস্ক্রি ইহুদী বলে দায় মুক্ত নয়   

ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি জেলেনস্ক্রি ইহুদী হওয়ায় অনেকে বলেন যে, তিনি কিভাবে নাৎসিবাদকে সমর্থন ও  প্রতিষ্ঠা করেন? যে নাৎসিরা লক্ষ লক্ষ ইহুদীকে হত্যা করেছে! জেলেনস্ক্রির রাজনীতিতে আসেন হটাত করে এবং তিনি ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি হন ২০১৯ সালে। আর নব্যনাৎসিদের তৎপরতা শুরু হয় তার অনেক আগে। রাশিয়া তার ক্ষমতায় আসার অনেক আগে থেকেই এই অভিযোগ করছিল। এই অভিযোগ শুধু রাশিয়ার নয়। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমও তাদের কর্মকান্ডের অনেক সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ফেসবুকও তাদের ঘৃণ্য ও হিংসাত্মক কর্মকান্ডের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। স্বজাতী, স্বধর্মের দ্বারা ক্ষতি-ধ্বংসের ইতিহাস দুনিয়াতে কম নেই। এ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে লক্ষলক্ষ মানুষ মুসলমানের হাতেই। জগতে ক্ষতি মানুষের দ্বারাই মানুষের হয়েছে। বনের হিংস্র জানোয়ারদের দিয়ে হয়নি।

স্তেপান বান্দেরা ইউক্রেনের জাতীয় বীর!

অর্গানাইজেশন অফ ইউক্রেনিয়ান ন্যাশনালিস্ট (OUN) এর জঙ্গি, সন্ত্রাসী শাখার নেতা হিসাবে বান্দেরা নাৎসি সহযোগী হয়ে ওঠেন। যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর জার্মান সুরক্ষায় তার প্রতিনিধিদের সাথে কাজ করতেন। নাৎসিদের সহযোগীতার মাধ্যমে বান্দেরা ইউক্রেনকে সোভিয়েত শাসন থেকে মুক্ত করে সেখানে তার নিজস্ব সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। বান্দেরার সমর্থকরা দাবি করেন যে, তারা সোভিয়েত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নাৎসিদের পক্ষে ছিলেন এই বিশ্বাসে যে হিটলার ইউক্রেনকে স্বাধীনতা দেবে। সে কারণে তারা হিটলারের সহযোগী হিসেবে লক্ষ লক্ষ ইহুদী হত্যায় সহায়তা করে। এমন কি হিটলারকে খুশী করতে ইহুদীদের মাথা কেটে তার পায়ে রাখারও ঘোষণা দেয়।

ইতিহাসবিদ ক্যারেল বার্খফের  মতে, বান্দেরা তার সহযোগী ও নাৎসিদের পরিকল্পনা ছিল ইহুদীদের ধ্বংস করা। কারণ ইউক্রেনের ইহুদিরা কমিউনিজম এবং স্ট্যালিনের পক্ষে ছিল। ইহুদিদের হত্যাকারীসহ নাৎসি সহযোগীদের শ্রদ্ধা পূর্ব ইউরোপে একটি ক্রমবর্ধমান ঘটনা। যেখানে এমন ব্যক্তিদের নায়ক হিসাবে বিবেচনা করা হয়, কারণ তারা সোভিয়েত কমিউনিজমের বিরুদ্ধে ছিল। ২০১০ এর ২২ জানুয়ারী ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভিক্টর ইউশচেঙ্কো স্টেপান বান্দেরাকে ইউক্রেনের হিরো” বলে মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদান করেন। স্তেপান বান্দেরার জন্মদিন কিয়েভে টর্চলাইট মিছিল করে

নব্য নাৎসি আজভ’কে মার্কিন ও পাশ্চাত্যের সাহায্য-প্রশিক্ষন   

মার্কিন অনলাইন পত্রিকা দ্য গ্রেজন এর এক প্রতিবেদন বলছে, কানাডা, আমেরিকা, ব্রিটেন রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের প্রশিক্ষণ ও সমরসজ্জিত করার এক বিশাল দায়িত্ব পালন করেছে। সেই প্রশিক্ষণে আজভ ব্যাটালিয়নের শীর্ষ কমান্ডাররা আছেন।

কানাডার জাতীয় প্রতিরক্ষা বিভাগ ২৬শে জানুয়ারি উল্লেখ করে যে, তারা ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর ৩৩ হাজার  সদস্যকে বিভিন্ন কৌশলগত ও উন্নত সামরিক দক্ষতার প্রশিক্ষণ দিয়েছে। ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল জেনস স্টলটেনবার্গ ৯ মার্চ অটোয়ার নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক সম্মেলনে কানাডা এই ভূমিকার প্রশংসা করেন। ব্রিটেন মার্চের শুরুতে ২২ হাজার ইউক্রেনীয় যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠিয়েছে। আমেরিকাও নব্য-নাৎসি আজভ ব্যাটালিয়নের সদস্যসহ ইউক্রেনের বাহিনীকে প্রকাশ্যে প্রশিক্ষণ দিয়েছে।

২০১৭ সালে আজভ ব্যাটালিয়নের ওয়েবসাইটে পোস্ট করা একটি ফটোতে দেখা যাচ্ছে যে একজন মার্কিন সামরিক অফিসার নব্য-নাৎসি ব্যাটালিয়নের একজন অফিসারের সাথে বৈঠক করছেন। ২০১৬ সালে ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীতে রকেট চালিত গ্রেনেড লঞ্চার স্থানান্তরে কিয়েভে মার্কিন দূতাবাস সাহায্য করেছিল।

গ্রে জোনের ম্যাক্স ব্লুমেন্থাল ২০১৮ সালে লিখেছিলেন, আমেরিকার এক সামরিক পরিদর্শন দল ইউক্রেন গৃহযুদ্ধের প্রথম সারিতে থাকা আজভ ব্যাটালিয়নের কর্মকান্ড পরিদর্শন করেন এবং তাদের সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করেন।

জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোপীয়, রাশিয়ান এবং ইউরেশিয়ান স্টাডিজ ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত এক সমীক্ষা বলছে, সেন্টুরিয়া নামের ইউক্রেনের সামরিক অফিসারদের একটি স্বল্প পরিচিত নব্য-নাৎসি বড়াই করে বলেছে যে, তাদের সদস্যরা “ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং পোল্যান্ডের সাথে সামরিক মহড়ায় অংশগ্রহণ করেছে। সিআইকে অভিযুক্ত করে ইউক্রেনের উগ্রজাতীয়তাবাদীদের সাহায্য ও প্রশিক্ষনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

নব্য-নাৎসির উত্থান ও বিশ্ব রাজনীতির হুমকি

নব্য নাজিদের তৎপরতা কতটা বিপদজনক তা এই মন্তব্য থেকেই বোঝা যাবে। ২০১০ সালে এই সংগঠনের নেতা এ্যান্ড্রি বিলেটস্কি ইউক্রেনিয়ানদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘ইউক্রেন জাতির উচিত বিশ্বের নিকৃষ্ট জাতিগুলোর বিরুদ্ধে চুড়ান্ত ধর্মযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া এবং শ্বেতাঙ্গ জাতিগুলোর নেতৃত্ব দেওয়া।‘

এই নাৎসিদের দুটি ধারা ইউক্রেনে সক্রিয় আছে। তাদেরকে রীতিমত গ্লোরিফাই করছে জেলেনোস্কি সরকার। আর এসব দেখেও ইউরোপিয় মিডিয়াগুলো না দেখার ভান করছে। অথচ ধর্ম-বর্ণ ও জাতি বিদ্বেষকে সেখানে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।

মুখে নাৎসি স্লোগান আর হাতে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্বেতাঙ্গ ছাত্রদের মিছিল ঘিরে তুলকালাম কাণ্ড হয়েছিল। শ্বেতাঙ্গ ছাত্র বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল, আমেরিকার অভিবাসন নীতি আমূল বদলাতে হবে। অভিবাসীদের অবিলম্বে আমেরিকা ছেড়ে চলে যেতে বলতে হবে। বিক্ষোভকারীদের মুখে ছিল ‘ব্লাড অ্যান্ড সয়েল’ স্লোগান। দেশপ্রেমের গভীরতা বোঝাতে নাৎসিরা এ স্লোগান দিত।

১৯৯২ সালে ব্রিটেনে কমব্যাট ১৮ গোষ্ঠী গড়ে ওঠে৷ ১ আর ৮ সংখ্যা দিয়ে ইংরেজি বর্ণমালার এক ও আট নম্বর অক্ষরকে বোঝানো হয়েছে৷ এই দুটি অক্ষর হচ্ছে ‘এ’ এবং ‘এইচ’- যা এডলফ হিটলারের নামের আদ্যক্ষর৷ অভিবাসীদের সমর্থনে কথা বলায় জার্মান রাজনীতিক ভাল্টার ল্যুবেককে হত্যা করা হয়। সন্দেহভাজন হত্যাকারীর সঙ্গে ‘কমব্যাট ১৮’ গোষ্ঠীর যোগাযোগ ছিল বলে ধারণা করা হয়।

খারকিভের প্রাক্তন গভর্নর এবং এখন দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা মন্ত্রী আর্সেন আবাকভের সঙ্গে অ্যাজভের সম্পর্ক প্রথম থেকেই ঘনিষ্ঠ। পূর্ব ইউক্রেনের দুই অঞ্চল ডোনেৎস্ক ও লুহানস্কতে গত ছয় বছর ধরে আক্রমণ চালাতে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সাথে বড় ভূমিকা রাখছে আজভ। গত কয়েক বছরে ১৪ হাজার মানুষ মারা গিয়েছে সেখানে। ইউক্রেন সরকারের মদতে গোটা ইউরোপে নয়া নাৎসিদের সামরিক পরিকাঠামো হয়ে উঠেছে।

সিআইএ ২০১৫ সাল থেকে ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থার জন্য এক বিশেষ গোপন প্রশিক্ষণ কর্মসূচির তত্ত্বাবধান করছে৷ প্রতিবেদনে একজন প্রাক্তন সিআইএ কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে বলা হয় যে, সিআইএ ‘একটি বিদ্রোহকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে’ এবং একটি গোপন মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে এই প্রশিক্ষণ পরিচালনা করছে। ইউক্রেনীয় বিদ্রোহীদের এই প্রশিক্ষণটি ওবামা, ট্রাম্প এবং এখন বাইডেন প্রশাসন দ্বারা সমর্থিত, এবং তাদের কার্যক্রম আরো সম্প্রসারিত হচ্ছে।

এ বছরের জানুয়ারিতে, জ্যাকবিন ইউক্রেনে সিআইএ-এর তৎপরতা সম্পর্কিত এক নিবন্ধ প্রকাশ করেন। সেখানে উল্লেখ করেন যে, “সিআইএ এর প্রশিক্ষিত নব্যনাৎসি গ্রুপগুলোর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্বজুড়ে অতিডানপন্থী দলগুলো তাদের দলে সন্ত্রাসীদের অন্তর্ভুক্ত করছে।” সেখানে ২০২০ এর ওয়েস্ট পয়েন্ট এর এক প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, “যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের উগ্র ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলির বেশ কিছু আলোচিত ব্যক্তির সাথে ইউক্রেনের অতি-ডানপন্থী নেতৃত্বের সংযোগ আছে। বিশেষ করে আজভ রেজিমেন্টের সাথে।”

একজন সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা বলেন সিআইএ এমন এক গোষ্ঠী তৈরী করছেন, যারা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়বে। এবং এ সত্য প্রায় আসন্ন। এই প্রশিক্ষিত সশস্ত্র বাহিনীগুলোর একটি ইউক্রেনের আজভ ব্যাটালিয়ন। সিআইএ “গ্লোবাল শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের” নেটওয়ার্কের বীজ রোপন করেছে পরবর্তিতে পৃথিবীতে বড় হুমকি হয়ে দেখা দেবে।  

পশ্চিমাদের জঙ্গীবাদ ও উগ্রজাতীয়তার ধারণা স্ববিরোধী

যে কোন দেশ তার আভ্যন্তরীণ বিষয়ে নেয়ার অধিকার রাখে। বাইরের হস্তক্ষেপ গ্রহনযোগ্য নয়। তা মেনে নিলে আফগানিস্তান কোন ভুল করেনি। তাহলে তাদের উপর কেন অবরোধ জারি আছে? তাদের অপরাধ যদি মৌলবাদী শাসন হয় তাহলে সে দোষে দুষ্ট ইউক্রেনও। তারাও আজভ নামের এক নব্য আলকায়দা সামরিক সংগঠন গড়ে তুলেছে। দোনেস্ক্র গণহত্যায় অংশ নিয়েছে, সংখ্যালঘু রোমা, রুশ ভাষীদের উপর আক্রমন করেছে। শ্বেতাঙ্গবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদের পার্থক্য কোথায়? একজন বলছে ধর্মের নামে, অন্যরা বলছে জাতীয়তার নামে!

কানাডায় ট্রাকারদের ফ্রিডম কনভয় নামের অটোয়া অবরোধও ছিল উগ্র শ্বেতাঙ্গবাদীদের দ্বারা সংগঠিত একটি আন্দোলন। দেশব্যাপী জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে হয়েছিল। মার্কিন থেকে অর্থ-সমর্থন এসেছে। কানাডাই আবার ইউক্রেনের আজভ ব্যটেলিনকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, সাহায্য করছেন! একই কাজের ভিন্ন মোড়কে পশ্চিমাদের কাছে আলকায়দা, তালেবান, আইসিস কখনো শত্রু, আবার ঠিক একই কারণে নব্যনাৎসিরা তাদের বন্ধু হয়ে যায়। বড়ই অদ্ভুদ তাদের এই স্ববিরোধীতা।

উগ্রজঙ্গী ও শ্বেতাঙ্গবাদ উত্থানে ও পাশ্চাত্যের দায়

হিটলার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে ভাইমার প্রজাতন্ত্রে নাৎসি পার্টির নেতৃত্ব লাভ করেন। অভ্যুত্থান করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন যে কারণে তাকে জেলে যেতে হয়েছিল। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মোহনীয় বক্তৃতার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদ, ইহুদি বিদ্বেষ ও সমাজতন্ত্র বিরোধিতা করেন। এভাবেই এক সময় তিনি জনপ্রিয় নেতায় পরিণত হন। তার দল প্রথম নির্বাচনে ক্ষমতায় না আসতে পারলেও, অধিক ভোট পাওয়ায় ক্ষমতাসীন দল তাকে চ্যান্সেলর নিযুক্ত করেন। পরবর্তিতে তিনি কৌশলে নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে রাষ্ট্রের নিরঙ্কুস ক্ষমতা অর্জন করেন। ক্ষমতা নিয়েই বিরোধী নেতাদের হত্যা করেন। দল, মত, পত্রিকা নিষিদ্ধ করে উগ্রশ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী ধারা চালু করেন। সামরিক বাহিনীকে নতুন নতুন সব অস্ত্রে সজ্জিত করে ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

নব্যনাৎসিদের যে তৎপরতা ইউক্রেনসহ ইউরোপ জুড়ে শুরু হয়েছে তা হিটলারের উত্থানের ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়। পশ্চিমারা যেভাবে এই নব্যনাৎসিদের মদদ দিচ্ছে, তারা যেভাবে সামরিক শক্তি অর্জন করছে, তাতে বিশ্বে ধর্মীয় মৌলবাদের সাথেই উগ্রজাতীয়তার ভয়ঙ্কর বিপদ তৈরী হচ্ছে। আর এই অশুভ শক্তি ও বিপদ তৈরীর মূল দায় মার্কিন ও পাশ্চাত্য শক্তির।

————————————————————–

ড. মঞ্জুরে খোদা, লেখক-গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক