১২ ই মে, অনন্ত বিজয়ের ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী!
বেশিদিন আগের কথা নয়। মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞানমনস্কতা, ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কার বিরোধিতার ব্যাপারগুলো কিছু বুদ্ধিজীবীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাদের কেউ কেউ এগুলো নিয়ে জটিল থেকে জটিলতর কিছু কথা লিখতেন, কেউ হয়ত পাঠ করতেন, কেউ সম্মান দেখিয়ে তুলে রাখতেন। কিন্তু একটি শোষণ-নিপীড়ন মুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য মুক্তচিন্তা, ইহজাগতিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা ও কুসংস্কার বিরোধিতা যে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়াটা অতি আবশ্যক তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন গুটিকয়েক মানুষ।
অনন্ত বিজয় দাশ(অক্টোবর ৬, ১৯৮২-মে, ১২, ২০১৫) সেই রকম একজন। জন্ম তাঁর সিলেট শহরে যেখানে এসব ব্যাপারে কথা বলার মত মানুষ সব সময়ই ছিল হাতে গোনা। হয়ত কৈশোরে অবাক হয়ে তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যে এক ভয়াবহ অন্ধকার বলয়ে আটকা পড়েছেন তিনি। বুঝতে পেরেছিলেন এ অন্ধকার থেকে মুক্তির জন্য নামতে হবে সংগ্রামে। জানতেনই যে এইটি একটি বিপদ-সংকুল পথ, বুঝেছিলেন পদে পদে বাধা আসবেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শুরু করার গোড়ার দিকেই তার উপলব্ধি হয় যে একটি সংগঠন প্রয়োজন যার ছায়ায় আসবেন সমমনা মেধাবী তরুণদল যারা তারই মত একই তরণীর যাত্রী। তিনি গঠন করলেন বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল (প্রতিষ্ঠাকাল ২৭ জুলাই, ২০০৫)। সিলেটের শহীদ মিনারে প্রতি সপ্তাহে আড্ডা বসত। বিতর্ক-আলোচনা সমালোচনা হত নানা ব্যাপারে। একবার সিলেটের সারদা হলে একটি বিজ্ঞান সম্মেলনেরও আয়োজন হয় এই সংগঠনটির উদ্যোগে। ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তার সম্পাদনায় বের হল ‘বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল’ এর মুখপত্র ‘যুক্তি’ নামক ছোটকাগজ (লিটলম্যাগ) যা খুব আল্প সময়েই অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়েছিল। ‘যুক্তি’ ম্যাগাজিনে সংগঠনটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে সংক্ষেপে বিবৃত হয়েছিল এভাবেঃ
আমরা চাই চিন্তার চর্চা ও প্রকাশের স্বাধীনতা। ঘটাতে চাই মুক্ত চিন্তার বিপ্লব; সাংস্কৃতিক বিপ্লব। চাই এই বেনিয়াবাজির সমাজ পরিবর্তন। আমাদের দর্শনে বিজ্ঞানমনস্কতা আর যুক্তিবাদ। গাহি মোরা সাম্যের গান।
আমরা মনে করি অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার আর চিরাচরিত প্রথার প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্যই মানুষের এগিয়ে যাবার পথে প্রধান অন্তরায়। আরো মনে করি, এই প্রশ্নহীন, যুক্তিহীন বিশ্বাস আর সংস্কারাবদ্ধ জীবনাচরণ কাটিয়ে ওঠার একমাত্র পথ হচ্ছে বিজ্ঞানমনস্কতা ও যুক্তিবাদের প্রসার।
আমরা মনে করি না অলৌকিক বলে কিছু ছিল বা আছে। জানি এ নিয়ে আছে শুধু অতিকথন, মিথ্যাচার আর কিছু লৌকিক কৌশল। আমাদের কাছে বিজ্ঞান শুধু কোন আন্দোলন নয়, কোন খেলা নয়, এটি হচ্ছে প্রযুক্তির সবচেয়ে বেশি সুবিধা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এই দায়িত্ব সরকার এবং প্রশাসনেরও।
আমাদের কাছে বিজ্ঞান আন্দোলনের অর্থ হচ্ছে-কুসংস্কার, অপবিশ্বাস দূর করে যুক্তিবাদী-বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গড়ার আন্দোলন।
অতএব, আপনি যদি সহমত পোষণ করেন আমাদের ভাবনার সাথে, যুক্ত হতে চান আমাদের কর্মে, হতে চান আলোর দিশারী, তবে নির্দ্ধিধায় যোগাযোগ করুন আমাদের সাথে। যুক্ত হোন আমাদের আন্দোলনে।
সর্বশেষ ২০১৩ সালের জুলাই মাসে ‘যুক্তি’ এর ৪র্থ সংখ্যা বের হয়। এই সংখ্যাটি ছিল ছদ্মবিজ্ঞান নিয়ে। আগের সংখ্যাগুলো একক কোনো বিষয়ের উপর ছিল না। তাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি সহাস্যে উত্তর দিতেন, ‘আমাদের যুক্তির যে কোন সংখ্যাই সর্বশেষ সংখ্যা হয়ে যেতে পারে, তাই সব ধরণের লেখাই দিলাম’।
একজন লেখক হয়ে উঠতে দীর্ঘ দিনের অধ্যবসায় প্রয়োজন। সেই দিক থেকে চিন্তা করলে দেখা যায় এখনই ছিল দীর্ঘ লেখালেখি শেষে অনন্ত বিজয়ের পরিপূর্ণ লেখক হয়ে ওঠার সময়। আর ঠিক এই সময়েই তাকে খুন হতে হল ঘাতকের নির্মম আঘাতে।
অনন্ত বিজয় লেখালেখি শুরু করেছিলেন মূলতঃ মুক্তমনায়। অভিজিৎ রায় তাকে মুক্তমনায় লিখতে উৎসাহিত করেছিলেন। মুক্তমনা তখন ওয়েব সাইট ছিল। সেখানে দেশ-বিদেশের অনেক লেখক নানাবিধ বিষয় নিয়ে লিখতেন। এর মধ্যে লেখালেখি শুরু করেন অনন্ত বিজয়ও। মুক্তমনার চিন্তা-চেতনা সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে তিনি ছিলেন বদ্ধ পরিকর।
সংক্ষিপ্ত জীবনে অনেক গুণীজনের সান্নিধ্যে এসেছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে হোমিওপ্যাথির চিকিৎসক পর্যন্ত অনেকের বিরাগভাজনও হয়েছেন। ‘যুক্তি’ প্রকাশের পর থেকে ফোনে, চিঠিপত্রে হুমকি-ধামকি কম পাননি। হুমকি এসেছিল হোমিওপ্যাথি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও, যারা কিনা মামলার ভয় দেখাতো।
অনন্ত বিজয়ের যে গুণটি অন্যদের থেকে তাঁকে আলাদা করে রেখেছে, তা হলো তার প্রচারবিমুখ মনোভাব ও খ্যাতির প্রতি নির্লিপ্ততা। তিনি বেশ কিছু লেখককে গড়ে তুলেছেন নিজ হাতে। সম্পাদনার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ-বই তার হাত ঘুরে হয়ে উঠে উঁচু মানের। বাংলা অনলাইন জগতের অনেক খ্যাতিমান লেখক, যাদের পাঠক-নন্দিত তাদের বেশ কিছু লেখার পেছনে অনন্ত বিজয়ের উৎসাহ ও প্রণোদনা অনস্বীকার্য।
২৬শে ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ঘরে ফেরার পথে নির্মমভাবে খুন হন অভিজিৎ রায়, সাথী ও স্ত্রী বন্যা আহমেদ গুরুতর আহত হন। অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পরে দেশের মুক্তচিন্তকরা নিজেদের জীবনের উপর বিপদের আঁচটা আবারো টের পান। কিন্তু অনন্ত বিজয় বিপদের আশঙ্কা মাথায় নিয়েও বন্ধুদের শত অনুরোধ উপেক্ষা করেও বাসা ছেড়ে অন্যত্র থাকতে রাজি হননি। বৃদ্ধ অসুস্থ পিতামাতাকে দেখভাল করার মূল দায়িত্ব যে ছিল তার উপরেই। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছে সাহায্যের আবেদন করা শুরু করলেন জনান্তিকে । বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো সন্তোষজনক উত্তর মিলল না। ইতোমধ্যে ওয়াশিকুর রহমান বাবুকেও জবাই করে মেরে ফেলেছে জঙ্গিরা। বিপদগ্রস্থ লেখকদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘আইকরন’ আবেদন গ্রহণ করলেও নির্দিষ্ট কোন সময়সীমা উল্লেখ করতে অস্বীকার করল। এরই মধ্যে ‘আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিবসে’ অংশগ্রহণ ও বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বক্তব্য প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ এলো সুইডিশ পেনের পক্ষ থেকে । তবে সেটাও নিরাশায় পরিণত হল। ১২ই মে’র সেই বিভীষিকাময় সকালে বাড়ীর খুব কাছে তাকে কুপিয়ে হত্যা করলো কিছু নরপশু। অনন্ত কাউকে জীবনে ফুল দিয়েও আঘাত করেননি। নিপাট ভদ্র, মেধাবী, অত্যন্ত অমায়িক, শান্তিপুর্ণ আলোচনায় বিশ্বাসী ও জ্ঞানপিপাসু মানুষটিকে হত্যা কর হল পাশবিক নৃশংসতায়।
অনন্ত বিজয় সকল কুসংস্কার, ছদ্মবিজ্ঞান, মিথ্যা অলৌকিকতাকে যৌক্তিক প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেছেন, এর অন্তঃসারশুন্যতা বলিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে খণ্ডন ও উন্মোচন করেছেন। অনন্তের আগ্রহের বিষয়বস্তু ছিল জীববিজ্ঞান, বিশেষত জীববিবর্তন তত্ত্ব। তার জীবনে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তিটির নাম চার্লস ডারউইন। তাই তার বেশিরভাগ লেখার মূল উপজীব্য জীববিবর্তন তত্ত্ব।
অকালপ্রয়াত এই প্রতিভাধর মানুষটি তার অসংখ্য অতুলনীয় কাজের মাধ্যমে বন্ধু-সহযোদ্ধাদের প্রেরণা যোগাবেন, অসংখ্য পাঠককে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করে যাবেন অনন্তকাল নিঃসন্দেহে। প্রণতি, অনন্ত বিজয় দাস।
এক নজরে লেখক অনন্ত বিজয়ঃ
বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতার ছোটকাগজ ‘যুক্তি’র সম্পাদক। মানবতা এবং যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৬ সালে মুক্তমনা র্যাশনালিস্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। প্রকাশিত প্রবন্ধ গ্রন্থ :
(১) পার্থিব, (সহলেখক সৈকত চৌধুরী), শুদ্ধস্বর, ঢাকা, ২০১১।
(২) ডারউইন : একুশ শতকে প্রাসঙ্গিকতা এবং ভাবনা, (সম্পাদিত), অবসর, ঢাকা, ২০১১।
(৩) সোভিয়েত ইউনিয়নে বিজ্ঞান ও বিপ্লব : লিসেঙ্কো অধ্যায়, শুদ্ধস্বর, ঢাকা, ২০১২।
(৫) জীবববিবর্তন তত্ত্বঃ নানা জিজ্ঞাসা ।
অনন্ত বিজয় দাস’এর লেখা সবগুলো বই ও সম্পাদিত সকল ম্যাগাজিন আমাদের ই-লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত রয়েছে, সেখান থেকে আপনারা তাঁর সব বই বিনামূল্যে ডাউনলোড করে পড়া যাবে।
আজ অনন্ত বিজয় আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তিনি তার কাজের মাধ্যমেই আমাদের দিয়ে গেছেন এগিয়ে যাওয়ার দিক-নির্দেশনা। হয়ত একদিন মানুষ ধর্মান্ধতা-কুসংস্কার মুক্ত ন্যায়ভিত্তিক মানবিক পৃথিবী গড়ে তুলতে সক্ষম হবে আর তখন এই পৃথিবী আবার অনন্ত বিজয়ের অবদানের কথা স্মরণ করবে কৃতজ্ঞচিত্তে।
২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ছয় ব্লগারকে হত্যা করা হয়েছে। নির্মমভাবে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আহত করা হয়েছে আসিফ মহিউদ্দিন এবং অভিজিতের স্ত্রী বন্যা আহমেদকে। সরকারের কাছে নাস্তিক আখ্যায়িত করে ব্লগারদের যে তালিকা দেয়া হয়েছিল, তা ধরেই এই হত্যাকাণ্ড চালানো হচ্ছে। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হত্যাকাণ্ড থামাতে যেমন ব্যর্থ হচ্ছে তেমনি ব্লগারদের নিরাপত্তাও দিতে পারছে না। ফলে ক্রমেই মুক্তমনা লেখকদের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে দেশের পরিবেশ।
হত্যা কখনো সমর্থনের বিষয় নয়। বিচার প্রক্রিয়ার বাইরে সব হত্যাই অন্যায়। ছয়জন ব্লগারকেই হত্যা করা হয়েছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার দায়ে এবং বিচারবহির্ভূত ভাবে!
ধর্মের নামে মানুষকে হত্যা করার অধিকার কারও নেই। একজন মানুষ জন্মগত ভাবেই স্বতন্ত্র মন নিয়ে জন্মায়। তাই সে যা বিশ্বাস করে তা সে অনুসরণ করতেই পারে। বাক স্বাধীনতার অধিকার সবার রয়েছে। স্বাভাবিকতই একজনের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণার সঙ্গে অন্যজনের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণার মিল না-ও হতে পারে। তাই বলে হত্যা করা কোন ভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমি মুক্তমনা ব্লগারদের হত্যার তীব্র প্রতিবাদ করছি। সেই সাথে মুক্তচিন্তার ব্লগারদের হত্যার বিচার দাবি করছি। মুক্তচিন্তার ব্লগারদের পরিবার যাতে ন্যায় বিচার পায়, সেই প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি।
যাদের শরীরিক শক্তিতে ও হত্যা করে ধর্ম টিকিয়ে রাখতে হয় তাদের উচিত সেই পথ ত্যাগ করে শান্তির পথে ফিরে আসা। একজন মানুষ তার ইচ্ছে হলে নাস্তিক হবে, ইচ্ছে হলে আস্তিক হবে। এটা তার চিন্তার ব্যাপার, তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। পরিশেষে বলব, হত্যা করে কখনো ধর্মকে ঠিকিয়ে রাখা যায় না।