ভূগোল রাজনীতির জ্ঞান

স্কুলে কোন এক সময় ভূগোল পড়েছি। কোন দেশের অবস্থায় কোথায়, কার পাশে কোন দেশ, তাদের জলবায়ু-প্রকৃতি কেমন-কি, ব্যাস আমার ভূগোল জানা হয়ে গেছে। এর সাথে রাজনীতি জুড়ে দিলেই তো হয়ে গেল। রাজনীতি হচ্ছে কোন দেশের প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী কেমন, কতদিন ধরে ক্ষমতায় আছে, তার ভাল-মন্দই তো রাজনীতি। এই দু’টো জোড়া দিলেই তো ভূ-রাজনীতি হয়ে গেল।

ভূ-রাজনীতির এমন জ্ঞান নিয়ে অনেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছেন। বিশ্বের কোন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীও ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে এমন সরল বিশ্লেষণ হাজির করেননি, যেমনটা এই বন্ধুরা করছেন। ফেসবুকে এমন ভূগোল-রাজনীতি জানাদের মিথ্যা-বিকৃত ব্যাখার ছড়াছড়ি দেখছি। তাই কয়টা কথা এখানে লিখে রাখছি।

ভূরাজনীতি (Geo Politics) কি?

এন.জে. স্পকিসম্যান বলেছেন, “ভৌগোলিক বাস্তবতার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তাজনিত নীতি প্রণয়ন করাকে ভূরাজনীতি বলে।“

এডওয়ার্ড লুত্রাকের জিও_ইকোনমিক্স বা  ভূ-অর্থনীতির তত্ত্বটিতেও  লুত্রাক বলছেন,  ‘আসলে বিশ্ব কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক; সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নিয়ন্ত্রিত। মানবতাবাদ, বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব, আঞ্চলিক সহযোগিতা, বিশ্বায়ন এগুলো অনেকটাই লোক দেখানো বুলি। এডোয়ার্ড লুত্রাক, বিশ্ব অর্থনীতির দুটি পাইভোর্টাল এরিয়া কে নির্দেশ করেছেন।

সুতরাং ভূ রাজনীতি হচ্ছে ভূগোল ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যৌথ শাখা, যা একটি জাতির শক্তির সামর্থ্য নির্ধারণ করে, জাতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে এবং জাতির সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিসহ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোনো দেশের ভূমিকা নির্ধারণ করে।

ভূ-রাজনৈতিক কিছু আঞ্চলিকআন্তর্জাতিক জোটসংস্থার নাম

১। G-8 কি, G-20 কি? কেন, কার বিরুদ্ধে, কার পক্ষে, কি স্বার্থে করা হয়েছে?

২। TPP (প্রশান্ত মহাসাগরীয় অংশীদারত্ব চুক্তি) কার বিরুদ্ধে কাদের বিরুদ্ধে এই জোট?

৩। RCEP (রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ) কি কেন গঠন করা হয়েছিল?

৪। CPTPP  প্রশান্ত মহাসাগরীয় সহযোগিতার নতুন সম্প্রসারিত জোটে, কেন চীন নেই?

৫। QUAD চতুর্ভুজীয় সুরক্ষা সংলাপ কি? এই সামরিক জোটে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত, কেন চীন নেই?

৬। ANZUS অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ড কে নিয়ে গঠিত সামরিক জোট করে; দক্ষিণ চীন সাগরের পূর্বাঞ্চলের সামরিক নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নেয়.

৭। SEATO নামের সামরিক জোট প্রতিষ্ঠা করে দক্ষিণ চীন সাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ কে নেয়?

৮। ASEAN জোট দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে দিয়ে গঠিত হয় কেন?

৯। APEC প্রতিষ্ঠা করে, এই অঞ্চলে বাণিজ্যিক বৈধতা যুক্তরাষ্ট্র নিজের করে নেয়। সেটা কেন?

১০। NAM জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন কি?

১১। NATO কি? কেন করা হয়েছিল? তার দরকার কি? কার ক্ষতি কার লাভ? এর মধ্যে চীন-রাশিয়া নেই কেন?

এখানে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি-অর্থনীতির জোট-সংস্থার  কয়েকটি মাত্র উল্লেখ করলাম। এই যে বিভিন্ন জোট, সংস্থা, সংগঠনের নাম উল্লেখ করলাম, এগুলোর দেশে শান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নয়। এগুলো এ সকল দেশের সবার নানামাত্রিক স্বার্থ-সুবিধা-শক্তি- ক্ষমতার পারস্পারিক বোঝাপড়া। এগুলোর অনেকটার উদ্দ্যেশ্য-লক্ষ্যের সাথে অন্যের স্বার্থ বিপরীতমূখী ও সংঘর্ষিক আছে। কিন্তু একে-অন্যের স্বার্থের ক্ষমতা-কর্তৃত্বের মহড়ার হিসেবে তা করা হয়েছে। দেশগুলো তাদের অস্ত্রভান্ডার ও সামরিক শক্তি গড়ে তোলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে- ‘অর্থ-বাণিজ্য-রাজনীতিতে’ কে কতটা প্রভাব-কর্তৃত্ব-অংশ-অবস্থান বজায় রাখতে পারবে তার উপর।

ভূরাজনীতির কয়েকটি সমীকরণ

১। ম্যাকাইন্ডারের- হার্টলান্ড তত্ত্ব অনুসারে, ইউরোপ-এশিয়ার সংযোগস্থল; ইউরেশিয়ার কৃষ্ণ সাগর  যার দখলে থাকে, বিশ্বের সামরিক নেতৃত্বও তার নিয়ন্ত্রণে থাকে। আমরা দেখলাম, ২০১৪ সালে রাশিয়া গণভোটের মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে, ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার সাথে সংযুক্ত করল। তাই, ২০১৭ সালে, আরব বসন্তকে ব্যর্থ করে, সিরিয়া সংকটের সমাধানও করল রাশিয়া! যুক্তরাষ্ট্র সেখান থেকে সরে যেতে বাধ্য হল।

২। অত্যান্ত শান্তিপূর্ণ উপায়ে এবং কূটনৈতিক পদ্ধতিতে, স্ট্রিং অব পার্লস বা মুক্তার মালা কূটনীতি দিয়ে, চীনের ইউনান থেকে শুরু করে আফ্রিকার জিবুতি পর্যন্ত, প্রায় দশটি সামুদ্রিক ঘাঁটি স্থাপন করে চীন। এর মাধ্যমে চীন ভারত মহাসাগরকে ঘিরে ফেলে।

২০১৬ সালে চীন, যুক্তরাষ্ট্রেকে ছাড়িয়ে বিশ্বের শীর্ষ বাণিজ্যের দেশে পরিণত হয়। শুধু তাই নয়, বরং “বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ” এর মাধ্যমে, এশিয়া ইউরোপ আফ্রিকা তিনটি মহাদেশ এবং ৭২টি দেশের সাথে দানবীয় সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপন করে।

৩। ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে চীন বিরোধী ‘কোয়ার্ড’ জোট গঠন করেছিল। একই সাথে চীনের স্ট্রিং অব পার্লস ব্যবস্থা ঠেকাতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে- ইন্দোপ্যাসিফিক_স্ট্রেটেজি নামে সামরিক জোট গঠন করেছিল।

৪। এরপরও যুক্তরাষ্ট্র ক্ষ্যান্ত না হয়ে অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেনেকে সাথে নিয়ে- অকাস নামে পারমাণবিক সাবমেরিন  সামরিক জোট গঠন করেছে ২০২১ সালে। সুতরাং তাইওয়ানে অকাস এর ঘাঁটি হলে, এরা অতি সহজে চীনের সাংহাই,  ক্যান্টন, ম্যাকাও, বেইজিং, কাউলুন, কুনমিং টাং, উহান শহরগুলোতে পারমাণবিক ক্ষেপেনাস্ত্র হামলা চালাবে এবং ধ্বংস করবে।

৫। নেভাল জিওপলিটিক্স এর জনক ম্যাকাইন্ডারের মতে, এই বিশ্বে সমুদ্র যার নিয়ন্ত্রণে থাকে; বিশ্ব নিয়ন্ত্রণও তার হাতে থাকে। ভূ-রাজনীতির এই সমীকরণ বিশ্বের ক্ষমতাকেন্দ্রের বলয়ে থাকা শাসকরা জানেন। সেখানেই সবাই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার, রক্ষার, অর্জনে সার্বক্ষনিক তৎপর থাকেন।

যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি এক মহাদেশ থেকে উড়ে এসে শান্তি, মানবতা ও নিরাপত্তার মিথ্যা দোহাই দিয়ে- আরেক মহাদেশের পরাশক্তির রাশিয়ার দিকে বন্দুক তাক করবে আর সুবোধ বালকের মত মেনে নেবে সেটা হয় কিভাবে?

বিশ্বব্যাপী মার্কিন সামরিক ঘাঁটি সৈন্যদের অবস্থান

বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের কতগুলো সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, ঘাঁটিগুলো কীভাবে পরিচালিত হয় তা নিয়ে মার্কিন নৃবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভিড ভাইন ‘বেস ন্যাশন’ নামে একটি বই লিখেছেন । সেখানে এ বিষয়ে তিনি বিস্তারিত বলেছেন।

‘কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড সায়েন্স জার্নাল’-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্যে জানা যায়, বিশ্বের ১৫৯টি দেশে প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে। পৃথিবীর অন্তত ৮০টি দেশে প্রায় ৭৫০ সেনাঘাঁটি রয়েছে।

মার্কিন সামরিক ঘাঁটি তাদের সংখ্যা

১। জাপানে সর্বোচ্চসংখ্যক ঘাঁটি মার্কিন ১২০টি। আছে ৫৩ হাজার ৭০০শ সেনা।

২। জার্মানিতে- ১১৯টি মার্কিন ঘাঁটি। ৩৩ হাজার ৯০০শ সেনা

৩। দক্ষিণ কোরিয়ায় ৭৩টি মার্কিন ঘাঁটি – ২৬ হাজার ৪০০ মার্কিন সেনা

৪। ব্রিটেনে ২৫টি – ৯ হাজার ৩০০শ সেনা

৫। ইতালিতে ৪৪টি – রয়েছে ১২ হাজার ৩০০শ সেনা

৬। স্পেনে আছে ৪টি ঘাঁটি

৭। কুয়েত ও সৌদি আরবে- ১০টি করে মার্কিন ঘাঁটি আছে।

৮। ওমানে ৬টি, সিরিয়ায় ৪টি, জর্ডানে ২টি ঘাঁটি আছে।

৯। ইরানের দুই পাশে মার্কিন বাহিনীর অন্তত ১৯টি ঘাঁটি আছে।

১০। মধ্য-এশিয়ার ও ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলোকে অন্তত ২৫টি।

১১। গুয়ানতানামো বে নৌঘাঁটি ওয়াশিংটনের সবচেয়ে পুরনো ঘাঁটি রয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ৭০ বছর পরও ইউরোপ-এশিয়ার বিভিন্ন দেশে কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিগুলো রয়েছে? ইউরোপে অসংখ্য ঘাঁটির সাথে প্রায় আরো ৬০ হাজার মার্কিন সৈন্য আছে। মার্কিন সামরিক ছাতার নীচে থাকা ইউরোপের এই দেশগুলো কি আসলেই স্বাধীন? তাদের কোন একটি দেশ কি মার্কিন নীতির বাইরে গিয়ে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন? পারবেন? যদি না পারেন তাহলে কিভাবে বলি এদের পররাষ্ট্রনীতি স্বাধীন? আর তা না হলে- বলতেই হয় এরা হচ্ছে বিশ্বের একটি সংঘবদ্ধ চক্র, যারা অভিন্ন অশুভ স্বার্থের পক্ষে তৎপর থাকে।

সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ওয়ারপ্যাক্ট বিলুপ্তি হলে ন্যাটোর প্রয়োজন কি? ন্যাটো তো সৃষ্টিই হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক বিশ্বকে প্রতিহত করতে। তার বিলুপ্তি হলে তাকে কেন টিকিয়ে রাখা হয়েছে? শুধু তাই নয়, তাকে আরো বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং ইউক্রেনের মাধ্যমে রাশিয়ার পেটের ভিতর ঢুকে পরতে চাইছে। তখন কি সে চুপ করে থাকবে? সেটা বুঝতেই ভূ-রাজনীতির বিচিত্র স্বার্থ-জটিলতা নিয়ে গড়ে ওঠা কয়েকটি জোট-সংস্থার নাম কথা উল্লেখ করেছি। আগ্রহী বন্ধুরা সে বিষয়গুলো অধিক জানতে অনলাইনের সাহায্য নিতে পারেন।

রাশিয়া যদি অন্যায় করে থাকে সেটা বলার নৈতিক অধিকার কি মার্কিন ও কোন পশ্চিমা দেশের আছে? সেটা বলতে পারে সুইজারল্যান্ড, ফিন্যান্ডের মত দেশগুলো। কারণ তারা কোন যুদ্ধের মধ্যে নেই। যারা ইরান, আফগানিস্তান, ভেনিজুয়েলা, কিউবার বিরুদ্ধে অবরোধ দিয়ে রেখেছে, তারা কোন অধিকারে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলে? মানুষ কি শুধু গুলিতেই মরে, খাদ্যের অভাবে মারা যায় না? যুদ্ধ হয় সৈনিকদের মধ্যে কিন্তু অর্থনৈতিক অবরোধ চলে সকলের বিরুদ্ধে। আর তা এসব দেশের বিরুদ্ধে চলছে দশকের পর দশক ধরে। শান্তি ও মানবতার জন্য কান্নাকারীদের এমন দ্বিচারিতা লোক দেখানো ভন্ডামি-বৈ কিছু নয়।

যারা ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইয়েমেন, আফ্রিকায়, সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় যুদ্ধ করলো, লাগালো তাদের কথায় মানতে রাশিয়া মহাঅন্যায় করছে, তারা মানবতার শত্রু। আর ইউক্রেনে মার্কিন ও ইউক্রেন সরকার সহায়তায় নব্যনাজি নামের আল-কায়দার শক্তিবৃদ্ধি-বিস্তৃতি সমর্থন না করা অন্যায় হবে, সেটা কি করে মানি?

যুদ্ধ অবশ্যই কোন সভ্য মানুষের কাম্য নয়। যে কোন যুদ্ধে শক্তির মহড়ায় যেই জয়ী হোক না কেন, প্রকৃত পক্ষে সেখানে সত্য ও মানবতাই পরাজিত হয়। কিন্তু যখন কোন যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলা হয় এবং যারা এ অপকর্মের অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে, দায় তাদেরই। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমনের সবটা দায় যারা রাশিয়ার মনে করেন, তারা ভূ-রাজনীতি ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা বোঝেন না বা মানেন না। তারা এই যুদ্ধের আসল কারণকে আড়াল করে, পশ্চিমা শক্তির কূটবুদ্ধি, দূরভিসন্ধি ও স্বার্থকেই সমর্থন করছেন। আর ইউক্রেন হলো তাদের সাজানো ছকের অসহায় স্বীকার। যার ঘাড়ে বন্দুক রেখেছে পশ্চিমারা।

[] ড. মঞ্জুরে খোদা (টরিক), লেখক-গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক