লিখেছেন: শোভন সাহা
“কৃতজ্ঞতা স্বীকার“- এই সহজ বিষয়টি এখনো আমাদের সংস্কৃতির বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠে নি। অদৃশ্য কোন সৃষ্টিকর্তার কাছে কত উপায়েই না আমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি অথচ দৃশ্যমান মানব সমাজে পারস্পরিক কৃতজ্ঞতার প্রকাশ প্রায়ই অনুপস্থিত। অবহেলাটাই বেশি দৃষ্টিগোচর। আমরা শুধু অর্বাচীনের মত তুলনা আর যাচাই করতে শিখেছি কিন্তু কৃতজ্ঞতাবোধ আমাদের চর্চায় নেই।
রবিঠাকুর বিশ্ববরেণ্য কবি। পুরো পৃথিবীতে তিনি বিখ্যাত। অথচ ঐ সময়ের একজন নবীন লেখক জীবনানন্দ দাশের প্রথম রচনার স্বীকৃতি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবিঠাকুর তার নিজের পত্রিকায় জীবনানন্দের প্রথম লেখাটি ছাপিয়েছিলেন। ইতিহাস যখন জানতো না বাংলার বুকে একজন অসাধারণ সাহিত্যিকের অভ্যুত্থান ঘটেছে তখন সে সাহিত্যিককে প্রথম পর্দার আড়াল থেকে উন্মোচন করলেন রবিঠাকুর। এটা কি কৃতজ্ঞতার চেয়ে কোন অংশে কম ? তার কৃতজ্ঞতার বিস্তৃতি পাওয়া যায় “সৌন্দর্যের সম্বন্ধ” নামক একটি লেখায়। রবিঠাকুর যদি নিঃসংকোচে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে পারেন তাহলে আমরা কী রবিঠাকুরের চেয়েও বড় মাপের মানুষ ?
“লোকটা বিরক্তিকর, সবসময় শুধু জ্ঞান দেয়” – এই উক্তিটার সাথে কম বেশি আমরা সবাই পরিচিত। খেয়াল করে দেখুন, এটাও কৃতজ্ঞতা স্বীকারোক্তির অভাবের একটা ফসল। ভেবে দেখুন, যে লোকটা আপনাকে জ্ঞান দিচ্ছে সে নিঃসন্দেহে আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী কারন এই জ্ঞান দেয়ার জন্য সে আপনার কাছে অতিরিক্ত কোন অর্থ দাবি করে নি। অথচ তার এই বৈশিষ্ট্যকে কতটা নেতিবাচকভাবে গ্রহন করছি আমরা। এবার একটু মুক্ত মনে ভাবুন তো !!
জীবনে চলার পথে সাধারণতঃ আমরা প্রথম যার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি তিনি অনুপস্থিত ও রূপকথার কোন এক সৃষ্টিকর্তা, যার কৃতজ্ঞতা স্বীকারে কোন আলসেমি নেই আমাদের সমাজে। এরপরেই যার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ সেটা হল প্রকৃতি। কিন্তু এই প্রকৃতির কাছে কি আমরা সত্যিই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি ? যদি তাই হত তাহলে শহরাঞ্চলের বেশির ভাগ আবাসিক এলাকার আবাসস্থলের পাশে ময়লা আবর্জনার স্তুপ দেখা যায় কেন ? এই বুঝি প্রকৃতির প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার ? আর যারা আমাদের নোংরামিগুলো প্রতিদিন পরিষ্কার করে প্রকৃতির কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকারের একটা সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে তাদেরকেই আমরা “ময়লাওয়ালা” “মেথর” নামক এক একটা অবহেলিত উপাধি দিয়ে তাদের এই মহান পেশার মহানুভবতা থেকে বঞ্চিত করছি। প্রকৃতির পরেই কৃতজ্ঞতা প্রাপ্তির যোগ্য আমাদের পিতা–মাতা। মজার বিষয় হচ্ছে বাবা ও মা দিবসে যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন আবেগমূলক পোস্টের ভীড়ে হাজার হাজার বৃদ্ধাশ্রমকে হারিয়ে ফেলি আমরা। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় হয়তো এই বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধ বৃদ্ধাদেরকেই কিছুদিন আগে ফেসবুকের কোন একটা পোস্টের উপলক্ষ হতে হয়েছিল। কত অদ্ভুত আমরা ! এরপর হয়ত আমরা যাদের নিকট কৃতজ্ঞ তিনি হচ্ছেন আমাদের শিক্ষক। না এইটা ভাববেন না যে আমি শুধু বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ শিক্ষকদের কথা বলছি এখানে প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদেরকেই আমি বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি কারন আমাদের মনুষ্যত্বের ভিত্তিটা তাদের হাতেই রচিত হয়। কিন্তু সত্যি করে বলুন তো আমরা কয়জন আমাদের সেই প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষককে মনে রেখেছি বরং বড় বড় ডিগ্রী অর্জন করার পর আমরা হীনমন্যতায় ভুগি এত যোগ্যতা থাকার পরও কেন আমাকে সামান্য একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হল, আমার তো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হওয়ার কথা ছিল। একবার ভেবে দেখুন তো, একদিন আপনি আপনার সেই প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে সুন্দর একটা চিঠি পাঠিয়েছেন অথবা সেই শিক্ষক বা শিক্ষিকার বাসায় দেখা করতে গিয়েছেন আর আপনার কৃতজ্ঞতার ভাষা প্রকাশ করে এসেছেন। বিশ্বাস করেন ঐ শিক্ষক শিক্ষিকা সারাজীবন আপনাকে মনে রাখবে, আপনার সুনাম, আপনার গল্প তার প্রতিটা স্টুডেন্টকে শোনাবে। ভেবে দেখুন তো, এই ছোট্ট কাজটা কয়জন করে আমাদের এই সমাজে ? চলুন না, এখনি লিখে ফেলি একটা সুন্দর চিঠি কিংবা এস এম এস আর পাঠিয়ে দেই আমাদের সেই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বা শিক্ষিকাকে যিনি আমার সুন্দর মানসিক বিকাশের জন্য দায়ী।
পেশাগত জীবনেও এই কৃতজ্ঞতা স্বীকারের অভাব পরিলক্ষিত। কর্পোরেট পলিটিক্স হচ্ছে তার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ। পেশাদার মানুষজন এই বিষয়টি সম্পর্কে কম বেশি অবগত। যাদের কাছে প্রশিক্ষিত হয়ে আমি আমার রুটি রুজি রোজগার করেছি আজ প্রমোশন পেয়ে তাদেরকেই অবহেলা করে কৃতিত্বটা নিজের কাধে নিতে চাইছি। ধরুন যদি এমন হতো যার কাছে আপনি প্রশিক্ষিত হয়েছেন তার কাছে গিয়ে বড় করে একটা কুর্নিশ জানিয়ে আপনার নিজের ভাষায় তার নিকট আপনার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলেন ? বিশ্বাস করেন, আপনার জন্য তার অন্তরে যে জায়গা তৈরি হবে সেটাকে অর্থ দিয়ে পরিমাপ করা যাবে না।
আমরা আমাদের জুনিয়র বা ছোটদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে দ্বিধা করি, আমাদের উন্নতির আরেকটি অন্তরায় হয়ত এইটি। অন্যদের কথা ছাড়ুন আমি আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। মাঝে মধ্যেই আমি আমার ঘনিষ্ঠ এক জুনিয়রের সাথে মুঠোফোনে কথা বলি ( নাম/পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক ) যে বয়সে আমার জুনিয়র আর তার সাথে আমার পারিবারিক সম্পর্কও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তার অসাধারন ইংরেজি দক্ষতায় আমি ততবার মুগ্ধ হই যতবার আমি তার সাথে কথা বলি। প্রথম কয়েকদিন খুব হিংসে হয়েছিল আমার ছোট হয়েও কিভাবে গড়গড় করে ঘন্টার পর ঘন্টা native speaker দের মত ইংরেজিতে কথা বলছে আমার সাথে। আমি বেশি কথা বলতাম না শুধু ওর কথা শুনতাম। তারপর ভাবলাম যে আমি যতটুকু ইংরেজি জানি তা দিয়ে নিজেকে যে কোন জায়গায় যথেষ্টভাবে চালিয়ে নেয়া যাবে কিন্তু তারপরও এডভান্সড ইংরেজি শেখার ইচ্ছা হল আমার ঐ জুনিয়রের ইংরেজি দক্ষতা দেখে। কিছুদিন চেষ্টা করে নিজের দক্ষতার উন্নতি করতে পেরেছি আর আশা করি এই চেষ্টা অব্যাহত থাকলে একদিন আমিও ওর মত হতে পারবো কিন্তু কখনো যদি ওকে ছাপিয়ে যাই সেদিন ওর প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের এতটুকু কমতি হবে না। তাছাড়া আমার এটা ভেবেও ভাল লাগছে, আমার পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যত আমার চেয়ে অনেক মজবুত। আমি তাকে আমার কৃতজ্ঞতার ভাষা ফোনেই জানিয়ে দিয়েছিলাম তবুও মনে হল এই পোস্টে তার কথা উল্লেখ না করলে কিছুটা কমতি মনে হবে। আমি জানি না সে আমার এই পোস্ট পড়বে কি না তবে আমি যতদিন বেচে থাকবো তার সাফল্য কামনা করবো।
এখন আমায় বলুন তো, আমি কী কৃতজ্ঞতার অভাবের প্রসঙ্গ তুলে খুব বেশি বোকার মত কাজ করলাম ! কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেও তো ভাল থাকা যায়, হাসি খুশি থাকা যায়। কেন পৃথিবীটাকে আমরা নিষ্ঠুর করে তুলছি কৃতজ্ঞতার অভাবে। খুব কঠিন কোন কাজ তো না, শুধু সামান্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার।
চলুন না এই “কৃতজ্ঞতা স্বীকারের” সুন্দর একটা সুস্থ সমাজ গড়ে তুলি। দেখবেন, প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ, সংঘর্ষ এই বিষয়গুলো অনেকটাই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
চলুন না, একটা সুস্থ সুন্দর সমাজের জন্ম দেই সামান্য এই “কৃতজ্ঞতা স্বীকারের” মাধ্যমে।
Leave A Comment