এটা আমার লেখা নয়। বাংলাদেশ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ের আমার প্রাক্তন সহকর্মী অধ্যাপক সিরাজ আহমেদ আমাকে ইনবক্স করেছেন এটি। মুক্তিযুদ্ধে নিহত হাবিবের মায়ের মত শত মায়ের ক্রন্দন আছে এই লেখায়। হাবিবের মা এসেছিলেন বাংলাদেশ কৃষিবিশ্ববিদ্যালয়ে হাবিবের গায়ের গন্ধ, শ্বাস-প্রশ্বাস খুঁজতে। যে কক্ষে হাবিব থাকত সেই কক্ষের প্রতিটি জিনিষ স্পর্শ করতে। হাবিবকে তিনি পেয়েছেন। আর পেয়েছেন সিরাজের মাঝে হাবিবকে।
মা ছেলেকে খুজতে এসেছিলেন ১৯৯৯ সালের ২৬ শে মার্চ। পড়ুন লেখাটি।
শিরোনাম: পথ হারা পাখী- – –
১৯৯৯ সনে ২৬শে মার্চের বিকাল বেলা ময়মনসিংহস্হ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে রেলওয়ে ষ্টেশনের পূর্ব পাশে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে প্রতিষ্ঠিত প্রাইমারী স্কুলের সামনের মাঠে স্বাধীনতা দিবসের এক অনুষ্ঠানে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারকে আমন্ত্রন জানানো হয়েছিল। ঐ অনুষ্ঠানে উপাচার্য প্রফেসর ড: মুহাম্মদ হুসেন স্যার, রেজিষ্ট্রার জনাব নজিবুর রহমান ভাই, ময়মনসিংহের ডিসি সাহেব ও ছাত্র শিক্ষকসহ আরো অনেকে উপস্হিত ছিলেন। মূলত নজিবুর ভাইয়ের একান্ত প্রচষ্টা ও উদ্যোগেই এরকম একটা ব্যতিক্রমধর্মী অনুষ্টানের আয়োজন করা হয়েছিল। আমিও একজন শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ওখানে উপস্হিত ছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে সবাই একে একে প্রস্থান করছিলো, আমিও চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই রেজিষ্ট্রার নজিবুর ভাই একজন ভদ্র মহিলা ও সাথে তাঁর এক ছেলেকে নিয়ে আমার সামনে এসে ভদ্র মহিলাকে বললেন- তার নাম সিরাজ, আপনার ছেলে তার সাথে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতো, আপনি এখন তার সাথে আলাপ করেন।
ভদ্র মহিলা হঠাৎ আমাকে দেখে কি করবে বুঝতে পারছিলেন না, আমার বয়স তখন প্রায় ৫০ এর কাছাকাছি, মনে হলো আমাকে দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে তাঁর বুকের কাছে টেনে নিয়ে এতদিনের জমিয়ে রাখা সবটুকু স্নেহ ও ভালবাসা উজাড় করে দিয়ে আমাকে যেন আদর করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারলেন না, একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষকে এভাবে কাছে টেনে নেওয়া তো আমাদের সমাজে আর সম্ভব নয়, বিদেশে হলে না হয় সম্ভব হতো। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে অঝর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন- বাবা, তোমার কি হাবিবের কথা কিছু মনে আছে, সে তো এখানেই পড়াশুনা করতো, সংগ্রামের সময় যুদ্ধ করতে গিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে নিহত হয়েছে, বেঁচে থাকলে আজ হয় তো তাকে তোমাদের মতই দেখাতো। তোমাদের মতই ভাল চাকুরী করতো, তাকে নিয়ে আমার কত আশা ছিল, কত স্বপ্ন ছিল, কতই না গর্ব ছিল, কোথা থেকে আচমকা এক ঝড় এসে সবকিছু উলট পাল্ট করে আমাদের সংসারটাকে যেন লন্ড ভন্ড করে দিয়ে গেল, তিরিশটি বছর আমি ছেলে হারানোর এক অসহ্য দারুন ব্যথা এবং গভীর ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছি, তার স্মৃতি এখনো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। যেখানে আমার ছেলেটা পড়াশুনা করতো ওটা দেখার খুব ইচ্ছা ছিল, যাদের সাথে পড়তো তাদের কাউকে দেখার দারুন সাধ ছিল মনে, তাই আমন্ত্রন পেয়ে মনকে আর সামলাতে পারলাম না, বৃদ্ধ বয়সে অনেক আশা নিয়ে অনেক ভরসা নিয়ে অনেক দূর থেকে আজ এখানে এসেছি, সারাটা বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরলাম, সে কোথায় ক্লাস করতো, কোন হলে থাকতো, কোন রাস্তা দিয়ে হেঁটে ক্লাশে আসতো তা সারাদিন ঘুরে ঘুরে দেখলাম, এখন বাবা, তোমাকে দেখে আমার বুকের জ্বালা আরো অনেকটা লাঘব হলো।
এতক্ষনে আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না কে সেই হাবিব, নজিবুর ভাই আমাকে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে এবং এইচ. এস.সি প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসাবে ভাল করে জানতেন, তাই এই ভদ্র মহিলাকে কোন না কোন ভাবে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার চেষ্টায় ছিলেন এবং সহজেই পেয়ে গেলেন। ১৯৭০ এর আগষ্ট থেকে ৭১ এর মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত হাবিব আর আমি বাকৃবিতে কৃষি অনুষদে প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলাম, হাবিবের বাড়ী ছিল সম্ভবত বগুড়া জেলায় নজিবুর ভাইয়ের এলাকাতেই। ভর্তি হওয়ার আগে মেডিক্যাল টেষ্টের দিন সে আমার সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষন হাসাহাসি করছিল, স্বাধীনতার পর আমরা সবাই ক্লাসে ফিরলাম, কিন্তু এই ভদ্র মহিলার ছেলে হাবিব আর কোন দিন ক্লাসে ফিরে এলো না, আমাদের ক্লাসে শুধু সে-ই শহীদ হয়েছিল, বাকৃবির লাইব্রেরীর ভিতরে দরজার সন্নিকটে এক স্মৃতিফলকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শহীদদের নামের তালিকায় “মো: হাবিবুর রহমান” নামটা লিখা রয়েছে। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, যতদিন এই বাকৃবি থাকবে, ততদিন তার নাম এই স্মৃতিফলকে চির অম্লান হয়ে থাকবে। ভদ্র মহিলার কান্না দেখে আমি আর অশ্রু সম্বরণ করতে পারলাম না, ঝর ঝর করে আমার দু’চোখ থেকে পানি গড়িয়ে গালে আসতেই দু’হাত দিয়ে পানি মুছে দিয়ে বললেন- তুমি তো আমার ছেলের মতই, আমি তোমার চোখের পানিটুকু মুছে দিয়ে আমার হৃদয়ে এতদিনের পুজ্ঞীভূত সকল ব্যথা বেদনার অবসান ঘটিয়ে এক অনাবিল শান্তির পরশ নিয়ে ঘরে ফিরে যাবো, আর মনে মনে ভাববো-আমার আজকের এখানে আসাটা খুবই যথার্থ হয়েছে, পুরোটাই সার্থক হয়েছে।
আমার বাসায় আমন্ত্রন জানালে তিনি বললেন-বাবা, ছোট ছেলেকে সাথে নিয়ে এসেছি, রাতের ট্রেনে বাড়ী ফিরে যাবো, যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন তোমার চেহারাটা আমার স্মৃতিপটে আঁখড়ে ধরে রেখে হাবিবের অভাবটা পূরণ করে যাবো। বিদায় নিয়ে বাসার দিকে আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলাম, হাবিবের মুখমন্ডলটা যতই আমার মানসপটে ধীরে ধীরে আরো ভেসে উঠতে লাগলো, ততই ছেলে হারা মায়ের আকুতি, করুন কান্না, মর্মান্তিক ও হৃদয় বিদারক দৃশ্যটা আমার হৃদয়কে ক্রমশ আরো ব্যথাতুর ও ভারাক্রান্ত করে তুললো। মনে হলো, নজরুলের গানের -“পথ হারা পাখী কেঁদে ফিরে একা” এই কলির সাথে ভদ্র মহিলার জীবনের কোথাও যেন একটু মিল খুঁজে পাই।
স্বাধীনতার সুবর্ন জয়ন্তীতে আসুন আমরা সবাই সকল শোকসন্তপ্ত শহীদ পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করি এবং পরম করুনাময়ের কাছে সকল শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি-আমিন।
অনেক ধন্যবাদ এরকম লেখা শেয়ার করার জন্য