উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রণেশ দাশগুপ্তের ১০৯তম জন্মতিথি উদযাপন উপলক্ষে উদীচী কানাডা সংসদের পক্ষ থেকে ‘শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় রণেশ দাশগুপ্ত’ শিরোনামে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে, সেখানে একটি অংশ রণেশ দাশগুপ্তের জীবনী পাঠ | কিন্তু এখানে এই দূরদেশে তাঁর জীবন নিয়ে একটি রচনা লেখার মাল-মসলা খুঁজে পাইনি | আন্তর্জাল ঘেটে অমিত রঞ্জন দে, মফিদুল হক, মোহাম্মদ আব্দুর রউফ, উত্পল কান্তি ধর, জ. শ. তিমির প্রমুখের কয়েকটি রচনা পেয়েছি | হাতে না পেলেও সন্ধান পেয়েছি, ক’বছর আগে বাংলা একাডেমি থেকে সৌমিত্র শেখরের সম্পাদনায় ‘রণেশ দাশগুপ্ত’ রচনাসমগ্র দুই খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে | সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ ও বিশ্বজিত ঘোষের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে ‘রণেশ দাশগুপ্ত’ স্মারক গ্রন্থ (আগামী প্রকাশনী, ২০০২)| উদীচীর পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত ‘উদীচী বিপ্লবী ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার’ থেকে জেনেছি, উদীচী বার্তার বিভিন্ন সংখ্যায় রণেশ দাশগুপ্তকে নিয়ে লিখেছেন, যতীন সরকার, গোলাম মোহাম্মদ ইদু, ইলা মিত্র, জামশেদ আনোয়ার তপন, সন্তোষ গুপ্ত | রণেশ দাশগুপ্তের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বের হয় জন্মশতবার্ষিকী সংখ্যা, এটিতে লিখেছেন যতীন সরকার, নিরঞ্জন অধিকারী, কাজী মোহাম্মদ শীশ, সৌমিত্র শেখর ও দীপংকর গৌতম | ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় ‘অগ্রন্থিত রণেশ দাশগুপ্ত’ ও ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদের লেখা, ‘রণেশ দাশগুপ্ত’র জীবনী | যে তথ্যটি আমাকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছে, তা হলো, রণেশ দাশগুপ্ত হলেন উদীচীর গঠনতন্ত্রের রচয়িতা |

সচররাচর জীবনী রচনায় সাধাররত: জন্ম, শৈশব, যৌবন, স্কুল-কলেজে পড়ালেখা, কর্মজীবন, রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে আলোচনা করা হয় | আমাদের এই রচনাটিকে একটু ভিন্নভাবে সাজানো হয়েছে | একজন ব্যক্তি কি করে বড় হয়ে ওঠেন, প্রজ্ঞাবান ও নিষ্ঠাবান হয়, তার কোন সোজা-সাপটা ফর্মুলা নাই | কিন্তু কিছু প্রবণতা আছে, যা দিয়ে একজনের বড় হয়ে উঠা ও অন্যকে ছাড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যায় | রণেশ দাশগুপ্তের ক্ষেত্রে শৈশবে তাঁর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তর, বড় পরিবার, সংগঠন, একাধিক ভাষায় প্রবেশাধিকার, সরল জীবন-যাপন তাঁকে আলাদাভাবে গড়ে তুলতে প্রণোদনা জুগিয়েছে | তাই এ লেখাটি জীবনী নয়, কিছু বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জীবন বিচারের প্রয়াস |


রণেশ দাসগুপ্ত [ছবি: ইন্টারনেট থেকে]

রণেশ দাশগুপ্তের জন্ম ১৯১২ সালে, মৃত্যু ১৯৯৭ সালে | জন্ম আসামের ডিব্রুগড়ে  হলেও শৈশবে লেখাপড়া শুরু হয় রাঁচিতে, তারপরে যান পুরুলিয়ায়, আবার ফিরেন রাঁচিতে | স্কুল পেরিয়ে কলেজেও একই অবস্থা; প্রথমে বাঁকুড়া ক্রিস্টান কলেজ, পড়ে কলিকাতা সিটি কলেজ ও সবশেষে বরিশাল বি এম কলেজ | এই যে স্থান থেকে স্থানান্তরে গমন, এটা শুধু জায়গা বদল নয়, এর অভিজ্ঞতা মানুষকে বিশাল করে তোলে | নতুন জায়গা, নতুন স্কুল, নতুন শিক্ষক, নতুন বন্ধু, নতুন সমস্যা ও নতুন সম্ভাবনা এসবকিছুই অভিজ্ঞতার পেয়ালা ভরে দেয় | নতুন অভিজ্ঞতার আলোকে একজন কৌতুহলী কিশোর পূর্ণবয়স্ক লোকের মত চিন্তা করতে সক্ষম হতে পারে | দেখে, ঠেকে, শিখে একজন ব্যক্তি উদ্যমী, সহনশীল, দূরদর্শী ও অতুলনীয় হয়ে উঠে | রণেশ দাশগুপ্তের ক্ষেত্রে তাই ঘটেছিল বলে অনুমান করি |

বড় পরিবারে বেড়ে উঠেছেন রণেশ দাশগুপ্ত | চার ভাই সাত বোন আর বাবা মা | দু’বোন অকালে মারা যান | রবীন্দ্রনাথের জীবনীকার প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন: এক জরিপে দেখা গেছে যে, সাধারণতঃ বড় পরিবারে আর দীর্ঘকায়া লোকেদের মধ্যে মহাপুরুষের আবির্ভাব লক্ষ্য করা যায় না | কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এর ব্যতিক্রম | বড় পরিবার বিবেচনায় রণেশ দাশগুপ্তও ব্যতিক্রম | তিনি ছিপছিপে দীর্ঘকায়া ছিলেন | তবে রাজনীতির প্রেরণা তিনি পান পারিবারিক পরিমন্ডলে, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে | বাবার কাছ থেকে পান ক্রীড়ামোদী হওয়ার প্রেরণা আর মায়ের কাছ থেকে পান সাহিত্য পথের নেশা | বড় পরিবারে টানাপোড়েনের শেকল যেমন আটকে রাখতে পারে, আবার তা ভাঙ্গার প্রনোদনাও জোগাতে পারে |

রণেশ দাশগুপ্ত স্কুলজীবন থেকেই সংগঠনে জড়িয়ে পরেন | ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে উত্তরণের প্রধান উপায় হলো সংগঠন | ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এই মন্ত্রে যারা বিশ্বাসী, তাদের কাছে সংগঠনের কোনো বিকল্প নাই | তা সে রাজনৈতিক সংগঠন কিংবা সাংস্কৃতিক সংগঠন, যাই হোক না কেন | সংগঠনের শক্তি ব্যক্তির কাজের সমষ্টির চেয়ে বেশি | এই প্রক্রিয়াটিকে synergy  বলা হয় | যেমন, synergy অবস্থায় ২ + ২ = ৪ হয় না, ৫, ৬ কিংবা ৭ হতে পারে | এটি একটি concept | স্কুলে থাকা অবস্থায় অনুশীলন সংঘে যোগদানের মাধ্যমে রণেশ দাশগুপ্ত-এর যাত্রা শুরু | কলেজে এসে তৈরী করেন বিপ্লবী গ্রূপ – ‘জাগরণী গোষ্ঠী’ | কারাগারে গিয়ে চালু করেন সাহিত্যের ‘অনুশীলন চক্র’ | যুক্ত হন কমুনিস্ট পার্টির সঙ্গে | ১৯৫৮ সালে পার্টির প্রার্থী হিসেবে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাঁতিবাজার এলাকা থেকে কমিশনার নির্বাচিত হন | বলতে পারেন আজকের মত সেসময়ে ভোট ডাকাতির প্রক্রিয়া শুরু হয়নি | তিনি ‘প্রগতি লেখক সংঘে’র অন্যতম সংগঠক ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন | আবার তিনি শিশু কিশোর আন্দোলন ‘খেলাঘর’-এরও অন্যতম সংগঠক ছিলেন | আমরা যে ‘উদীচী’র পতাকাতলে সমবেত হয়েছি, সত্যেন সেনের সঙ্গে রণেশ দাশগুপ্তও তার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা | শুরুতে উল্লেখ করেছি, তিনি উদীচীর গঠনতন্ত্রের প্রণেতা | সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে থেকে অবিরাম তিনি জীবনধর্মী কাজ করে গেছেন | বিশাল পৃথিবীর বাইরে বার বার যেখানে তিনি গিয়েছেন, তা হলো জেলখানা | জেলখানায় বসেও সংগঠন ও জ্ঞানচর্চা বাদ পরেনি রণেশ দাশগুপ্তের | জেলখানায় বসে তিনি জেলের সহপাঠী রাজবন্দী মুনীর চৌধুরীকে ‘কবর’ নাটক লিখতে ও মঞ্চস্থ করতে উদ্বুদ্ধ করেন | রাজবন্দীদের জড়ো করে বিভিন্ন বিষয়ে ক্লাসও নিয়েছেন তিনি | বিভিন্ন সময়ে কারাগারে তাঁর সাথী হয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদ, তফাজ্জ্বল হোসেন মানিক মিয়া, সত্যেন সেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, সরদার ফজলুল করিম, কামাল লোহানী প্রমুখ | বক্তৃতা, লেখনি ও বেতার কথিকার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছেন | এই হলো রণেশ দাশগুপ্তের সংগঠন বা সংগঠনের রণেশ দাশগুপ্ত |

জানা গেছে যে, রণেশ দাশগুপ্ত বাংলা ভাষা ছাড়াও ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় পারদর্শী ছিলেন | একাধিক ভাষায় পারদর্শী হওয়ার মানে হলো সংস্কৃতি ও জ্ঞান বিজ্ঞানের বহুমুখী দরজায় করাঘাত করার যোগ্যতা অর্জন করা | এক্ষেত্রেও synergy কাজ করে | নিজের সৃজনশীল লেখালেখির মাধ্যমে রণেশ দাশগুপ্ত সেই পরিচয় দিয়েছেন | তিনি স্বজাতির সৃষ্টিসম্ভার ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পৌঁছে গিয়েছিলেন | তাঁর মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, জীবন ধর্মী সাংবাদিতা, শিল্পসাহিত্যের বিশ্লেষণ গুণেমানে অসাধারণ | সময়ের সীমাবদ্ধতার জন্য রণেশ দাশগুপ্তের প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত বই-পত্তর নিয়ে বিস্তারিত বলার সুযোগ নেই | কিন্তু স্বল্প পরিসরে হলেও তাঁর বইপত্রের একটি খসড়া তালিকা এখানে পড়ে শোনাতে চাই | রণেশ দাশগুপ্ত মূলতঃ লিখেছেন সৃজনশীল প্রবন্ধ | তাঁর অনুবাদ গ্রন্থও অনেক | প্রবন্ধ গ্রন্থের মধ্যে আছে ‘উপন্যাসের শিল্পরূপ’, ‘শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে’, ‘ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তিসংগ্রাম’, ‘জিজ্ঞাসা’, ‘আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রাম’,  ‘আলো দিয়ে আলো জ্বালা’, ‘আয়ত দৃষ্টিতে আয়ত রূপ’, অনূদিত গ্রন্থ ‘ফয়েজ আহমদ ফয়েজের কবিতা’, মাও সে তুং-এর ‘শতফুল ফুটতে দাও’, হেনরি এলেগের ‘দ্যা কোয়েশ্চেন’, সম্পাদিত/সংকলিত গ্রন্থ ‘জীবনানন্দ দাসের কাব্যসম্ভার’ ‘গোর্কি-মায়াকভস্কি-নেরুদার কবিতা’, স্বাধীনতা-সাম্য-বিপ্লবের কবিতা’,  অন্যান্য গ্রন্থ ‘সেদিন সকালে ঢাকায়’, ‘রহমানের মা ও অন্যান্য গল্প’, ‘সাজ্জাদ জহির প্রমুখ’, ‘মুক্তিধারা’, ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা: আত্মজিজ্ঞাসা’, ‘কখনো চম্পা কখনো অতশী’ ইত্যাদি | এছাড়াও কিশোরদের জন্য লিখেন নাটক ‘জানালা’ এবং রচনা করেন ‘কার্ল মার্কসের জীবনী’|

একজন রণেশ দাশগুপ্তকে বুঝবার জন্য বাংলা সাহিত্য জগতের আরেক মনীষী শওকত ওসমানের একটি উক্তি, তিনি লিখেছেন,

মানুষ হিসেবে তোমার সীমানায় পৌঁছাব এমন স্পর্ধা কখনো করিনি পোষন,
গৌরী শৃঙ্গের পানে বিস্ময়াহত চেয়ে থাকি |
তোমার স্মৃতি চিরকাল বহন করে সঞ্জীবনী গুণ,
আহা হতে পারতাম যদি তোমার মত মালাউন |

সরল জীবনযাপনের পরিমাপে রণেশ দাশগুপ্তকে বলা হয় ঋষিতুল্য মানুষ | মহাত্মা গান্ধী বলতেন, ‘আমার জীবন আমার দর্শন’ | রণেশ দাশগুপ্তের জীবনযাপন যেন সেই কথার প্রতিধ্বনি | জ্ঞানের উচ্চ শিখরে পৌঁছেও আচার ব্যবহারে তিনি ছিলেন অমায়িক | মানব প্রেমের যে পরাকাষ্ঠা তিনি দেখিয়েছেন, তার তুলনা নেই | অল্পেতে তুষ্ট থেকেছেন তিনি | তাঁর উদারতার ও সরলতার দুটি গল্প বলেই শেষ করব এই রচনা |

রণেশ-দা তখন কাজ করতেন সংবাদ পত্রিকায়; রবিবাসরীয় সাহিত্য সাময়িকীর দায়িত্বপাপ্ত সম্পাদক ছিলেন তিনি | সেসময়ে সাহিত্য পাতার লেখকদের সম্মানী দেয়া হত না | রণেশ-দা, আহমদ ছফার লেখা কয়েক কিস্তিতে ছাপেন ও তাকে সম্মানী দেয়ার ব্যবস্থা করেন | বাস্তবে, রণেশ-দা গোপনে তাঁর নিজের বেতনের পুরোটাই আহমদ ছফাকে দিয়ে দেন | এ তথ্যটি আহমদ ছফা নিজেই প্রকাশ করেছেন |

বিপ্লবের পরে প্রতিপক্ষের গুলিতে আহত হয়ে কমরেড লেনিন কিছুদিন হাসপাতালে ছিলেন | তাঁর স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রুটির সঙ্গে কেকও দিতেন | কেক ফিরিয়ে দিয়েছেন লেনিন, বলেছেন, ‘যতক্ষণ সবাই রুটি পাছে না ততক্ষণ আমি কেক খেতে পারি না’ | কয়েক বছর আগে টরন্টোতে উদীচীর একটি সভায় ড. করুণাময় গোস্বামী বলেন, রণেশ-দাকে তিনি তার বাসায় নিমন্ত্রণ করেছেন | খাবার টেবিলে গিয়ে রণেশ-দা আর খাবার মুখে তুলছেন না | গৃহকর্ত্রী ও গৃহকর্তা দুজনেই অবাক | রণেশ-দা বললেন, আমি চিকন চালের ভাত খাই না | তিনি অনড় | তাঁর জন্য পাশের বাড়ি থেকে মোটা চাল এনে ভাত পাক করার পর শুধু ডাল দিয়ে অল্প খেলেন | গরীব-দু:খী মানুষের সাথে একাত্ম হতে সুস্বাদু খাবার পরিহার করেছিলেন তিনি | ড. গোস্বামী শেষ করলেন এই বলে, “আহা, এই মানুষগুলি আমাদের মধ্যে ছিল !”