বাজারে চালু থাকা ঢাকা ভার্সিটিকে জমি দেওয়ার গল্প 💁‍♂️

স্যার, বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলমান ছাত্রদের প্রথম ছাত্রাবাসের নাম যে সলিমুল্লাহ হল রাখা হলো এর কারণ কী? এতে নওয়াব পরিবারের কি কোন আর্থিক কনট্রিবিউশন ছিল?প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক: আদৌ কোন কনট্রিবিউশন ছিল না। আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী লেখাপড়ায় ব্রিলিয়ান্ট ছিল। এরা আহসান মঞ্জিলের টাকায় লেখাপড়া শিখেছে। এরা সলিমুল্লাহর মৃত্যুবার্ষিকী পালন করত। ঢাকা ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠার প্রায় দশ বছর পরে তার একটা মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর নামে একটা ছাত্রাবাস করার প্রস্তাব এঁরা করেন। মুসলিম ছেলেদের জন্য হল তখন তৈরি হয়ে গেছে। প্রথমে এ হল ছিল এখনকার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বিন্ডিংয়ে। আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দী বললেন: এই হলকে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল করা হোক। কোন মুসলমান ধনীর কাছ থেকেই ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডেইরেক্টলি কোন ফাইনেন্সিয়াল কনট্রিবিউশন পায় নাই। কথা ছিল গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া ঢাকা ইউনিভার্সিটি করবে। সেই জন্যে ১৯১০ থেকে কিছু টাকা ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট আলাদা করে রাখত। ১৯২০-২১-এ এই টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০ লক্ষ। কিন্তু এই ৬০ লক্ষ টাকা বেঙ্গল গভর্নমেন্ট ডিড নট গিভ টু দি ঢাকা ইউনিভার্সিটি। তারা এই টাকাটা পুরো নিয়ে নিল। সলিমুল্লাহ হল যে তৈরি হলো তা পুরোটাই সরকারের টাকায়। নওয়াব পরিবারের টাকায় নয়; নওয়াব পরিবারের জায়গাতেও নয়। রমনার যে জায়গা ঢাকা ইউনিভার্সিটি-এর পুরাই খাসমহল, সরকারের জমি। সেটলমেন্ট রিপোর্ট-এ তাই আছে। বরঞ্জ লাখেরাজ সম্পত্তি (নিষ্কর ভূমি) বললে রমনা কালীবাড়িকে বলা যায়। ঢাকা শহরে লাখেরাজ সম্পত্তি কি এ নিয়ে আলোচনা চলেছে ১৮১৫ কি ১৮২০ সাল থেকে। ঢাকার নওয়াবদের জমিজমা এসেছে প্রধানত একটি সূত্র থেকে। ঢাকার স্থানীয় মুসলমানরা মৃত্যুর সময়ে কোন কোন সম্পত্তি নওয়াব আবদুল গনি ও আহসানউল্লাহকে ওয়াকফ করে দিয়ে যেত। এটার ভেরিফিকেশন তো সোজা। যে কেউ ইন্টারেস্টেড, সে ঢাকা কালেক্টরেটে যেয়ে দেখে আসতে পারেন। কাজেই নওয়াব পরিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জমি দেবে, এমন জমি কোথায় ছিল? আহসান মঞ্জিলের কোন জমি ছিল না।বই: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ- সরদার ফজলুল করিমপৃ: ১৭

(জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সাথে সরদার ফজলুল করিমের আলাপচারিতার বই ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ।)

এবার আসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের জ্ঞান ও গবেষণার বিষয়ে। আবদুর রাজ্জাক স্যার আহমদ ছফার সাথে কী বলেছিলেন তা ”যদ্যপি আমার গুরু” বইতে উল্লেখ আছে। পৃ: ৩৩-৩৪

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দের মধ্যে কেউ-কেউ ছিলেন, যাঁরা জ্ঞানচর্চার নানা ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁরা ছিলেন ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোডাক্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেসকল ছাত্র পাশ করেছেন, তাঁরা জ্ঞানচর্চার কোন ক্ষেত্রটিতে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন, সেই জিনিসটি নতুন করে যাচিয়ে দেখা প্রয়োজন। উনিশশো একুশ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়েছে। উনিশশো একুশ থেকে সাতচল্লিশ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রও আইসিএস (ব্রিটিশ আমলের বিসিএস আরকি) পাশ করতে পারেনি। একথা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বলার উপায় নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি প্রধান অবদানের একটি হল পাকিস্তান আন্দোলনের মনস্তাত্ত্বিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ভিতটি তৈরি করা। দ্বিতীয় অবদান বাংলা ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বদান এবং তৃতীয় অবদান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সংকল্প এবং কর্মপন্থার দিকনির্দেশনা। এই জনগোষ্ঠীর জীবনে ওই তিনটিই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু জ্ঞানচর্চার যে আরও একটি বৈশ্বিক মানদণ্ড রয়েছে তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান বিশেষ কিছু নেই। বিশেষত পাকিস্তান সৃষ্টির পরে জ্ঞানচর্চার উত্তাপ আরও অবসিত হয়েছিল। পাকিস্তান-সৃষ্টির পরে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ মতো নিবেদিতপ্রাণ মানুষও নতুন কোনো গবেষণাকর্মে আত্মনিয়োগ করেননি। তিনি বিয়ে পড়ানো এবং মিলাদ শরিফ করে সময় কাটাতেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধীতা প্রসঙ্গে:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা প্রসঙ্গে অনেক রঙের গল্প বাজারে চলা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বিরোধী ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। এরা সবাই ভেবেছে এখানে বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি হলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট কমে যাবে, শুধু কলকাতার হিন্দুরাই নয় ধনী মুসলিমরাও একই কারণে ভার্সিটির সমর্থন দেয়নি। এছাড়া উপাচার্য আশুতোষ ভেবেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে তার কর্তৃত্ব কমে যাবে। উপাচার্য আশুতোষ কখনো ঢাকায় আসেননি, যদিও পরবর্তীতে কোন শিক্ষক আনলে ভাল হয় সেই তালিকা তৈরিতে আবার সাহায্য করেছেন তিনি। একটা তথ্য দিয়ে রাখা দরকার- ব্রিটিশ আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট অপেক্ষায় সম্ভবত কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের বাজেট ছিল বেশি। যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেছিল তাদের অনেকে (কলকাতার হিন্দুরা) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে “মক্কা ইউনিভার্সিটি” বলতে শুরু করে। যদিও নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্র ও শিক্ষক বেশির ভাগই ছিলেন অমুসলমান।