তাশখন্দ দু’হাজার বছরের পুরানো শহর। বহু পরিবর্তন, পরিবর্ধন, ধ্বংস ও সূষ্টির মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে আজকের তাশখন্দ। তুর্কী নাম তাশখন্দের বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘পাথুরে নগরী’। প্রশস্ত পথ, পরিকল্পিত বনানী ও ঝকমকে দালানকোঠায় সজ্জিত আজকের তাশখন্দ। ১২১৯ সালে চেঙ্গিশ খানের আক্রমনে তাশখন্দ ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়। আবার ১৯৬৬ সালে প্রবল ভূমিকম্পে তাশখন্দ প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে যায়। সোভিয়েত আমলে এক মহাপরিকল্পনার মাধ্যমে বিধ্বস্ত নগরী তাশখন্দকে ঢেলে সাজানো হয়। আজকের তাশখন্দে মেট্টো, সারিবদ্ধ রাস্তা, পার্ক, ফোয়ারা, বিশ্ববিদ্যালয়, মিউজিয়াম, মেমোরিয়াল, আধুনিক বসতি এসবের প্রায় সবকিছুই সোভিয়েত পরিকল্পনার ফসল। সোভিয়েতের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার তাশখন্দ মেট্টো।
তাশখন্দ মেট্রো
মধ্য এশিয়ায় একমাত্র তাশখন্দেই মেট্টো বা পাতাল রেল আছে। মেট্রোরেলকে বলা হয় তাশখন্দের জুয়েল। দুর্মুখেরা বলেছে, সোভিয়েতরা ওঠা তৈরি করেছে পারমানবিক বোমার আশ্রয়স্থল হিসেবে। কথাটি সত্য নয়। মস্কো মেট্রোর মডেলে তৈরী তাশখন্দ মেট্রো পরিচ্ছন্ন, নিরাপদ ও শিল্পমন্ডিত। উজবেক ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখা হয়েছে প্রতিটি ষ্টেশনের প্লাটফর্ম, খিলান, সিড়ি ও দেয়ালে। বড় বড় ঝালরবাতির উজ্জ্বল আলোয় সজ্জিত কোন কোন স্টেশন আবার কোথায় হয়তোবা নক্ষত্রখচিত আকাশের আবহ। স্থাপত্য শৈলীতে প্রতিটি ষ্টেশন একটি নির্দিষ্ট থিমের উপর প্রতিষ্ঠিত ও অনন্য। উজবেক রুটি ও ফল, কার্পাস তুলার মত পণ্য ছাড়াও বিজ্ঞানী উলুগ বেগ, থিয়েটার ব্যক্তিত্ব আলিশের নাভৈ, মহাকাশচারী ইউরি গ্যাগারিন ও ভ্যালেন্তিনা তেরেশকোভা এসবকিছু যুক্ত হয়েছে প্লাটফর্ম, খিলান বা দেয়ালের স্থাপত্য শৈলীর মার্বেল ও সিরামিকের কারুকাজে। মন মাতানো ঐতিহ্য ও চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বলতার পাশাপাশি কিছু অন্ধকারও আছে। যাত্রী আগমনের ও নির্গমনের আশেপাশে খুব সহজেই চোখে পড়ে ছোট ছোট দলে পুলিশ। তাশখন্দের পুলিশ সবুজ উর্দি পরা। মজার ব্যাপার হচ্ছে পুলিশের কোন অস্ত্র নেই, নেই লাঠি, বন্ধুক, চাকুক কিংবা রিভলবার। ঢাল-তলোয়ার না থাকলেও এই নির্ধিরাম সর্দাররা মেট্রো ষ্টেশনে বিদেশী পর্যটকদের বার বার পাসপোর্ট পরীক্ষা করতে ভুলেন না। সমালোচকের মতে, কারিমভের শাসনে পুলিশ হচ্ছে উজবেকিস্তানের বড় ইন্ডাস্ট্রি।
প্রথম কোরআন
ধূলি ধুসরিত পথ পার হয়ে খাস্ত-ইমমে গিয়েছি। জায়গাটি পুরানো ঘরবাড়ি, অলিগলি সমৃদ্ধ। তাশখন্দের নতুন অংশ থেকে খুব দূরে না হলেও খাস্ত-ইমম লোকালয় খানিকটা অবহেলিত। খাস্ত-ইমম মাদ্রাসায় উজবেকিস্তানের প্রধান মূফতির অফিস। পাশে একটি লাইব্রেরি, তার ভিতরে একটি বড় কামরায় কাঁচের ভল্টে অত্যন্ত সুরক্ষিত অবস্থায় রাখা আছে পৃথিবীর প্রথম কোরআন। সিকিউরিটি ক্যামেরা বসানো আছে সেখানে, সবুজ উর্দি পরা পুলিশও সারাক্ষণ পাহারা দিয়ে যাচ্ছে। বড় করে সতর্কবাণী দেওয়া আছে ‘ফটো তোলা নিষেধ’। সপ্তম শতাব্দীর এই মহাগ্রন্থ এক নজরে দেখার জন্য ধর্মাধর্ম নির্বিশেষে মানুষের আগ্রহের কমতি নেই।
হযরত ওসমান এর কোরআন গ্রন্থনার কাজটি মদিনায় সম্পন্ন হয়। এর আগে ঐশী বাণী মানুষ মুখস্থ করে রাখত অথবা কাঠ বা উটের হাড়ে লিখে রাখত। হযরত মুহাম্মদ এর মৃত্যুর ১৯ বছর পরে ৬৫১ সালে কোরআন গ্রন্থনার কাজ শেষ হয়। কি করে এই পুঁথি তাশখন্দে এসে পৌছাল, এ নিয়ে কিছু মতভেদ আছে। হযরত ওসমান বিদ্রোহী জনতার হাতে খুন হন। মৃত্যুকালে তিনি এই কোরআনখানা হাতে নিয়ে পড়ছিলেন। বিশ্বাস করা হয় যে, কিছু কিছু পৃষ্ঠায় যে কালো দাগ তা ওসমানের রক্তের চিহ্ন বহন করছে। ওসমানের মৃত্যুর পর আলী এই মহাগ্রন্থ ইরানের কুফায় নিয়ে আসেন। সাত’শ বছরে পরে বিজয়ী তৈমুর লং কোরআনখানা হাতের কাছে পান ও তার রাজধানী সমরখন্দে নিয়ে আসেন। তারও চারশ’ বছর পরে রাশিয়ানরা সমখন্দ বিজয় করে এই কোরআন সেন্ট পিটার্সবুর্গে নিয়ে আসে ও ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরিতে রাখা হয়। বলশেভিক বিপ্লবের পর লেলিন মুসলমানদের মন জয় করার জন্য এই কোরআন উফার তাতারদের কাছে পাঠিয়ে দেন। তাশখন্দবাসীর অনুরোধে একটি নতুন ডিক্রি জারির মাধ্যমে ১৯২৪ সালে এই কোরআন তাশখন্দে ফিরে আসে।
১৯৮৯ সালে সোভিয়েত পরবর্তী স্বাধীন উজবেকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট ইসলাম কারিমভের উদ্যোগে পার্লামেন্টে ডিক্রি জারির মাধ্যমে ‘ওসমানের কোরআন’ বোর্ড অব মুসলিম অব উজবেকিস্তানের কাছে হস্তান্তর করা হয়। একটি বড় কাঁচের বাক্সে কোরআনখানা খুলে রেখে ডিসপ্লে করা হচ্ছে। এটি একটি বিশাল পুস্তক। প্রতিটি পৃষ্ঠা আনুমানিক দুই ফুট বাই আড়াই ফুট হরিণের চামড়ার ওপর বড় বড় আর মোটা আরবি হরফে কালো কালিতে লেখা। হরিণের চামড়ার পৃষ্ঠা কিছুটা বাদামি রঙ ধারণ করেছে কিন্তু অক্ষরগুলো কালো কুচকুচে। কালের ঘাত-প্রতিঘাতে রঙের উজ্জ্বলতা এতটুকু মলিন হয়নি। কিন্তু মূল পুস্তকের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ বর্তমান আছে। একজন পুলিশকে একটি ছবি তুলতে পারি কিনা জিজ্ঞেস করি। পুলিশ সিকিউরিটি ক্যামেরার দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষন করে। ছবি তুলবোই ভেবে মূল কামরা থেকে পাশের ছোট একটি কামরায় যাই। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ বন্ধ করে একবার ক্লিক করি। ছবি ভালো হয়নি কিন্তু আবছাভাবে বোঝা যায় ওটা কাঁচের বাক্সে রাখা একটা বিশালাকৃতির পুস্তক।
পৃথিবীর প্রথম লিখিত কোরআন কি করে এখানে এলো, এ নিয়ে একটি ছোট বিবৃতি পাশে প্রদর্শন করা হয়েছে। কিন্তু এতে লেনিনের অবদানের কথা কোথাও বলা হয়নি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে লেনিনের প্রচেষ্টায় এই ঐতিহাসিক মহাগ্রন্থটি সেন্ট পিটার্সবুর্গ থেকে মুসলমানদের কাছে ফেরত দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন সোভিয়েত বলয়ে থাকার জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের মুসলমানরা উজবেকিস্তানের মুসলমানদের ধর্মীয় দিক থেকে হয়তোবা দুর্বল মনে করে। হযরত ওসমানের কোরআনখানা নির্ভরযোগ্য ও সঠিক এই মর্মে ইউনেস্কো সেক্রেটারি জেনারেলের নিকট থেকে প্রাপ্ত একটি সার্টিফিকেট দেওয়ালে প্রদর্শন করা আছে। ৬৫১ সালে ওসমান এর নির্দেশে কোরআন শরীফে মোট পাঁচটি কপি গ্রন্থিত হয়েছিল। তাশখন্দে আছে একটি। অন্য একটির ভগ্নাংশ ইস্তাম্বুলের টপকপি প্রাসাদে রক্ষিত আছে।
তাশখন্দের খানা-খন্দ
দুনিয়ার সব বড় শহরেই কিছু খানা-খন্দ থাকে, তাশখন্দেও আছে। উজবেকিস্তানের হোটেলে গিয়ে নাম লেখাবেন, হোটেল একটি চিরকুট দেবে যা পাসপোর্টের সঙ্গে রাখতে হবে। রাস্তায় পুলিশ ধরলে এই চিরকুট দেখাতে হবে, অন্যথায় জেল জরিমানা হওয়ার আশংকা। স্থানীয় মুদ্রা ‘সোম’ খুবই দুর্বল। ট্যুর এজেন্ট’রা পর্যটকদের ডলার খসিয়ে নেয়ার যতরকম পায়তারা আছে সবই রপ্ত করেছে, সার্ভিস সন্তোষজনক নয়। শহরে পর্যাপ্ত ট্যাক্সি নেই, আইন কানুন নিয়মও তেমন নেই। হাত তুললে রাস্তায় শুধু ট্যাক্সি নয়, প্রায়শ প্রাইভেট কারও থেমে যায়। মূলত সব প্রাইভেট কারই সম্ভাবনাময় ট্যাক্সি। তাশখন্দের যুবকরা হাসিখুশি ও মিশুক। তারা যেচে কথা বলবে ও বন্ধু হবে। পর্যটকের ক্যামেরায় ধরা দেবে। তারা কৌতুহলী, হয়তো আপনার ক্যামেরা বা মুঠোফোন দেখতে চাইবে।
তাশখন্দ কসমোপলিটান নগর। নগরবাসীর সাজসজ্জা খাস ইউরোপিয়ানদের মতো। মহিলাদের হিজাব পরার চল নেই বলেই মনে হলো। রেষ্টুরেন্টের টেবিলে টেবিলে লবনদানির পাশে শরার পানের জন্য ছোট ছোট গ্লাস রাখা থাকে। পারস্য সংস্কৃতির প্রভাবধন্য শীতপ্রধান ও মুসলিমপ্রধান উজবেকিস্তানের নাগরিকরা নিশ্চয় শরাবপ্রিয়।
যাই হোক, স্বশরীরে আর এত কাছ থেকে চামড়ায় লেখা প্রথম কোরআন দেখে সত্যিই শিহরিত হয়েছি।
গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখা। আজকের কোরানের প্রথমদিকের ইতিহাসটা কেমন, কোথা থেকে এলো আজকের কোরান, এখন কতটুকু কোথায় এমন সব তথ্য নিয়ে ছোট্ট এই লেখাটি অসাধারণ করে লিখেছেন স্বপন বিশ্বাস। তথ্য আর ছবিগুলোর জন্য অনেক ধন্যবাদ। আরো লিখুন।