গতবার আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন এক প্রবাসী বাংলাদেশী আড্ডায় ছিলাম। প্রায় বিশ পঁচিশজন বাংলাদেশী উপস্থিত ছিলেন সে আড্ডায়। আমরা দু’একজন বাদে প্রায় সবাই একবাক্যে বলেছিলেন, ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন বিরাট ব্যবধানে জিতে যাবেন।
রিপাবলিক্যান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্র্যাম্পের না জেতার কারণগুলো জানতে চাইলে সব্বাই একবাক্যে যা বলেছিলেন, তার সারসংক্ষেপ এ রকম; ডোনাল্ড ট্র্যাম্প অভিবাসনের বিপক্ষে; ডোনাল্ড ট্র্যাম্প আমেরিকান বৈদেশিক বানিজ্য সংকোচনের পক্ষে; ডোনাল্ড ট্র্যাম্প বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আমেরিকার সাহায্য বন্ধের পক্ষে; ডোনাল্ড ট্র্যাম্প আমেরিকায় চাইনিজ আগ্রাসী অর্থনীতির বিপক্ষে; ডোনাল্ড ট্র্যাম্প আমেরিকায় শ্বেতাংগ নাগরিকদের পক্ষে সহ নানাবিধ কারণ।
সেদিন আমি বলেছিলাম, “আপনারা ডোনাল্ড ট্র্যাম্পের বিরুদ্ধে যে কারণগুলোর কথা বলছেন, একজন আমেরিকান শ্বেতাংগ এ কারণগুলোর জন্যেই ডোনাল্ড ট্র্যাম্পকে ভোট দেবে”।
গতবারের আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সেটাই হয়েছিলো। আমেরিকার মধ্য ও দক্ষিণের বিভিন্ন রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শ্বেতাংগ আমেরিকানরা দলে দলে ডোনাল্ড ট্র্যাম্পকে ভোট দিয়েছিল, যাদের অনেকেই বছরের পর বছর ভোট-ই দেয় নি।এক কথায়, ডোনাল্ড ট্র্যাম্প সংখ্যাগুরু শ্বেতাংগদের মধ্যে “আমেরিকান জাতীয়তাবাদ (?)” উস্কে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। এবার কি গতবারের সেই ভোটারেরা অন্যদিকে ভোট দেবে? দিলেও, কেনো দেবে?
ডোনাল্ড ট্র্যাম্পের এ নীতি নিয়ে আমরা তর্ক করতে পারি। বিশ্বায়ণ এবং আন্তর্জাতিকতার মাপকাঠিতে এই তথাকথিত “আমেরিকান জাতীয়তাবাদ (?)” কতটুকু সঠিক বা বেঠিক, কতটুকু উদার বা সঙ্কীর্ণ তা নিয়ে আলোচনা করতে পারি। কিন্তু একজন আমেরিকানের অধিকার আছে আরও বেশী আমেরিকান হ’বার। আমরা যদি খাঁটি বাজ্ঞালি বা বাংলাদেশী হ’তে পারি, তবে একজন আমেরিকানের খাঁটি আমেরিকান হ’তে অসুবিধে কোথায়?
এই সহজ সমীকরণকে কাজে লাগিয়েই গত নির্বাচনে রিপাবলিক্যান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্র্যাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বৈতরণী পাড় হয়েছিলেন। এবারের নির্বাচনেও জিতে যাবেন ব’লেই সবাই ধারণা করছেন।
এবারের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট ট্র্যাম্পকে সুবিধে করে দিয়েছে ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বাছাই এবং অধিকতর সুবিধে ক’রে দিলো সম্প্রতি ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বাছাই। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রশাসনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আমেরিকায় “লেইজি বয়” বা “অলস বালক” হিসেবে পরিচিত। সেই “অলস বালক” জো বাইডেনের সাথে এবার যুক্ত হ’লেন ভারতীয়-কৃষ্ণাংগ কমলা দেবী হ্যারিস।
কমলা হ্যারিসের মা তামিল গোড়া হিন্দু পরিবারের মেয়ে। বাবা জামাইক্যান কৃষ্ণাংগ। একেবারে ছোট সময়েই বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। তারপর মা এবং মায়ের বাবা-মার তামিল পরিবারেই মানুষ কমলা। ভারতীয় সাংস্কৃতিক আবহে কমলা বেড়ে উঠলেও ভারতীয় পরিচয়ের চেয়ে অধিকতর কৃষ্ণাংগ পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। ডেমোক্রেটরা কমলা হ্যারিসের এই কৃষ্ণাংগ পরিচয়ের জন্যেই তাঁকে লুফে নিয়েছেন। সুক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে, প্রার্থী বাছাইয়ে এই সংকীর্ণতা তথাকথিত উদার রাজনীতির নীতি-নৈতিকতার বিপক্ষেই যায় না কি? তবুও “ডেমোক্রেট” বা “লিবারেল” ব’লে কথা!
এবার দেখা যাক , ডেমোক্রেটদের এই ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বাছাই আদৌ কোনো সুবিধে হবে কি? ভোটের হিসেবে এর কোনো প্রভাব পড়বে বলে আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি না। কারণ, প্রথমত, কমলা হ্যারিসের বাছাই যে রাজ্যগুলোতে ভোট বাড়বে ব’লে মনে করা হয়, সে রাজ্যগুলো যেমন, ক্যালিফোর্নিয়া, নিউইয়র্ক এমনিতেই ডেমোক্রটদের অধিকারে। দ্বিতীয়ত, রিপাবলিক্যান তথা ডোনাল্ড ট্র্যাম্পের যে টার্গেটেড শ্বেতাংগ ভোটার, সে সমস্ত রাজ্যে কমলা হ্যারিসের অনুপ্রবেশ আরও কঠিন হবে। তৃতীয়ত, এশিয়ান তথা ভারতীয় ভোটারা কি ভারতীয় সংস্কৃতি তথা পরিচয়ে অস্বীকৃত কমলা দেবী হ্যারিসকে নিজেদের ভারতীয় প্রার্থী মনে করে ভোট দেবেন? কমলা তো নিজেই তাঁর ভারতীয় বংশ পরিচয়কে সামনে নিয়ে আসতে আগ্রহী নন।
সর্বোপরি, বিরাট সংখ্যক মুসলিম ভোটার এবারের নির্বাচনে বিপাকে পড়েছেন । এমনিতেই ডোনাল্ড ট্র্যাম্পকে মুসলিমরা সাধারণত ভোট দেয় না। এবারে কমলা হ্যারিসকে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বাছাই করায় সংশয় বাড়লো ডেমোক্রেটদের প্রতিও। কমলা যতোই নিজেকে কৃষ্ণাংগ দাবী করুক না কেনো, মুসলমানদের একাংশ এখনো তাকে ভারতীয় শুধু নয়, তামিল- হিন্দু- ভারতীয় মনে করে। অনেকে দাবী করে, কমলা হ্যারিসের স্বামী ডগলাস এমহোফ ইহুদী বংশোদ্ভুত। ভারতীয়- তামিল- হিন্দু এবং ইহুদী পরিচয় অনেক মুসলমানকেই ডেমোক্রেটদের ভোট দানে বিরত রাখবে।
সারা বিশ্বেই বিপদজ্জনকভাবে উদার নীতি-নৈতিকতা পিছিয়ে পড়ছে এবং জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। সমাজ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের এর কারণ বিশ্লেষণ ও অনুসন্ধান করা উচিত। অন্বেষণ করা উচিত, কীভাবে “আল্ট্রা লিবারেলিজম” দেশে দেশে উগ্রবাদীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে! ধর্মীয় উগ্রবাদীরা কীভাবে “আল্ট্রা লিবারেলিজম”-এর ক্যামোফ্লেজ গায়ে দিয়ে মৌলবাদ ছড়াচ্ছে।
সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদ ধর্মীয় মৌলবাদের মতোই ভয়ঙ্কর। অথচ রক্ষণশীল বা রিপাব্লিক্যানরা যেমন সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদ ছড়াচ্ছে , তেমনি ডেমোক্রেট বা লিবারেলরা আশ্রয় -প্রশ্রয় দিচ্ছে ধর্মীয় মৌলবাদকে। বিশ্ব মানবতার জন্য দু’টোই হুমকিস্বরূপ। তাই আমেরিকার আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যেই জিতুক না কেনো, কোথাও কোনো শুভ লক্ষণ নেই।
লেখাটি যুক্তিসংগত মনে হয়েছে। তা না হলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মত লোককে তারা ভোট দিতে যাবে কেন?
Rome হবে। typo.
উদারপন্থী নীতি কেন জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে সেটা সমাজবিজ্ঞানীরা খোঁজার চেষ্টা করুক। সহমত।
পুরোন প্রবাদ,
“when you are in Rom behave like a Roman”
রবিঠাকুরের ভাবনায়,
“এস আর্য এস অনার্য ——— এক দেহে হল লীন। ”
প্রাচীনকালে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল ছিল না বলে যারাই যেকোন নতুন দেশে বসবাস করতে যেত তারা তাদের পূর্ব পুরুষদের দেশের ভাষা, ধর্ম ও সাংস্কৃতির সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলত। ফলে নতুন দেশে গিয়ে সহজেই লীন হয়ে যেতে পারতো। তাদের সংখ্যাও অনেক কম ছিল। তাই নতুন দেশের মধ্যে লীন হতে কোন অসুবিধা হয় নি। এভাবেই মুঘলরা ও ইংরেজরাও এদেশের মানুষ, এদেশের ভাষা এমনকি ধর্মীয় রীতি গ্রহন করেছিল। ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও এদেশের মুসলমানরা অনেকেই মুর্তি পূজাকে মর্যাদা দিয়ে থাকে। শ্রী কৃষ্ণ অনেক মুসলমানের মনের গভীরে স্থান পেয়েছে। তাই জন্মাষ্টমীর দিন মুসলমান মা তার বাচ্চাকে বালক কৃষ্ণ সাজিয়ে তৃপ্তি লাভ করে। কলকাতার ফিরিঙ্গি কালী বাড়ী এ দেশে খৃষ্টানদের হিন্দু ধর্মের সাথে একাত্ম হওয়ার সাক্ষ দেয়। যদিও যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হবার ফলে অন্য দেশের থেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হচ্ছে, ফলে এই লীন হবার প্রক্রিয়া স্থিমিত হয়েছে বা বন্ধ হয়েছে। এমনকি উল্টো দিকেও বইছে।
ঠিক এভাবেই যখন একজন ভারতীয় বাঙালি হিন্দু ইউরোপীয় দেশে বসবাস করার সময় নিজের দেশের ভাষা, ধর্ম সাথে নিয়ে যায় এবং চর্চা করতে থাকে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে ভারতের সাথে যোগাযোগ সহজ হয় বলেই নতুন দেশে লীন হয়ে যেতে বাধাগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে কোন মন্দির নির্মাণ করতে পারলে হিন্দুরা খুশি হয়। কিন্তু এটা যে ঐ ব্যক্তির ঐ দেশে লীন হয়ে যেতে অসুবিধা সেটা অনুভব করে না।
প্রত্যেক আধুনিক দেশ নাগরিকদের অবাধ ধর্মাচরণের অধিকার দিয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ ধর্ম শুধু মাত্র নিজের ধর্ম পালন করেই খুশি হয় না। সে চায় অন্যদেরও তার ধর্মে অন্তর্ভুক্ত করতে। আর এর জন্য তারা নৈতিক অনৈতিক সব ধরনের চালাকির আশ্রয় নেয়। তখনই সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। আজ ইউরোপে মনে হয় সেটাই হয়েছে।
সব ধর্ম সমন্বয় করতে গিয়ে না পেরেছে আগের মত লীন হয়ে যেতে। না পেরেছে সবার ধর্ম পালনের স্বাধীনতা পেয়ে শুধু মাত্র নিজের ধর্ম পালন করে খুশি হতে।
ভাল লিখেছেন। গতবার হিলারী মুসলিমদের ব্যাপারে পলিটিক্যালি কারেক্টনেস দেখিয়েও যথেষ্ট পিছিয়েছিল আর অন্যদিকে এই ট্রাম্প সরাসরিই মুসলিম বিরোধী ছিল। অন্যান্য বিষয়গুলো তো ছিলই।
ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি সংস্কার এখন শুধু সময়ের দাবি 🙂