কারোর কৃতি বিচার করার আগে দেখার চেষ্টা করি, তিনি আদৌ মানুষ আছেন কিনা। যদি না-হন, যথাসম্ভব দূরে-থাকার চেষ্টা করি। যেমন: আল মাহমুদ বা সৈয়দ আলী আহসানের লেখাপত্র পড়লেও আকর্ষণ বা আগ্রহ বোধ করি না। আলোচনা দূরস্থান। তেমনই, কবীর সুমন নামের ইতরশিরোমণির বিষয়েও। ২০১৫-তে যখন ইস্লামি মৌলবাদী বদমায়েশেরা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে ব্লগারদের কুপিয়ে মেরে উল্লাস করছিল এবং তাতে সাগ্রহে ও আনন্দে সমর্থন জানাচ্ছিলেন অনেক হত্যাপিপাসু ধর্মভীরু জনগণ, তখন বামঘরানার লেখক জাকির তালুকদার ব্যঙ্গ করে সেসব খুনিদের ও তাদের দোসরদের মতই বলছিলেন, এদেশের ব্লগারেরা পাকা পায়খানার লোভে বিদেশ যেতে এসব লেখালেখি করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ধর্মের সমালোচনা নয়, ধর্মকে গালি দিয়ে প্রবাসে সুখময় জীবনলাভ। এই তালিকায়, তিনি হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন যে, একজন মার্কিন নাগরিক আছেন, ডক্টর অভিজিৎ রায়। এবং তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদ, যিনি আরো আগে থেকেই মার্কিন নাগরিক, তিনিও হত্যাপ্রচেষ্টার মুখোমুখি হয়েছিলেন।

এই লেখার সাথে সহমত জানানোর এবং প্রাণভয়ে ভীত ব্লগারদের মুখ ভ্যাংচে কুৎসিত কটুকাটব্য করার হুল্লোড়ে তিনি আত্মপ্রসাদ ছাড়া অন্য কিছু লাভ করেছিলেন, এমন প্রমাণ এখনো মেলেনি।

জাকির তালুকদারের নিজস্ব রাজনৈতিক পন্থা আছে। আছে ক্ষমতাদখলের নিজস্ব স্বপ্ন। সেই আদর্শিক পথে তিনি আওয়ামী লিগ থেকে শুরু করে বাকিদের খারিজ করতেই পারেন। কিন্তু লেখকদের হত্যাকারীদের পাশে আরামসে দাঁড়িয়ে তিনি কোন আদর্শবাদের স্বপ্ন দেখছিলেন, তা আমি জানি না। সারা বাংলাদেশের মাত্র দুজন লেখক তখন ব্লগারহত্যার স্পষ্টতর প্রতিবাদ করেছিলেন। মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও হাসান আজিজুল হক। সেই সময় আমার কাছে শত্রুমিত্রের সীমানা ও ধারণা নিতান্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

আক্রান্তদের, নিরস্ত্রদের, লেখকদের হত্যাকারীদের উল্লাসরত পিশাচদের দলে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্বালানির যোগানদার জাকির তালুকদার বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেতে কাদের লবি যোগাড় করেছিলেন, কিভাবে পেয়েছেন, ফেরত দিয়ে তিনি কত মহান হয়েছেন, এসব হিসেবে আমার আগ্রহ নেই। বমিও আসে তাঁকে মহান হিসেবে প্রতিপন্ন হতে দেখলে।

হয়তো সমস্যা আমারই। আমি ভুলে যাইনি যে শুধু লেখালেখির জন্যে, শুধু মতপ্রকাশের জন্যে, শুধু সত্যবলার অপরাধে আমার তরুণ বন্ধুদের, আমার ভাইদের একের পর এক খুন করা হয়েছে। এবং লোকজন তখন কী করছিল একের পর এক। শোকস্তব্ধ অবস্থায় আমি দেখেছি নীরবেই, কিভাবে একজনের পর একজন মৃতদের চরিত্রহননে বা জীবিতদের সমালোচনায় সোৎসাহে রত হয়েছেন। সেই তালিকায় প্রবীর ঘোষ, তসলিমা নাসরিন থেকে অনেকেই ছিলেন, আছেন।

মুক্তমনা ব্লগারদের রক্তমাখা রাস্তা বেয়ে আমি আর কখনোই একুশের বইমেলায় যাই না, যাবও না আর। জাকির তালুকদারও আমার কাছে একজন আস্তাকুঁড়ের পূতিগন্ধময় আবর্জনা, যেহেতু তিনি মানুষ হতে ব্যর্থ হয়েছেন সাগ্রহে ও সাড়ম্বরে। তাঁর মধ্যেও নিশ্চয়ই পুষ্টিমান কিছু আছে, কিন্তু আমার ঠিক রুচিগ্রাহ্য মনে হয় না সেসব। এরকম নয় যে তাঁর মহান সব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শিল্পকর্ম আমি একবাক্যে খারিজ করে দিচ্ছি, তবে তাঁর কিছু লেখালেখি পড়ে আমার মনে হয়েছে তিনি স্বগুণেই বাংলাসাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র হতে ব্যর্থ হবেন। অবশ্য তিনি উজ্জ্বলতম হলেও আমার বিবেচনা ও বিচার এরকমই থাকত।

মিলান কুন্দেরা বলেছিলেন, ক্ষমতার বিপক্ষে মানুষের লড়াই হল বিস্মৃতির বিপক্ষে মনে-রাখার লড়াই। তাই আমিও লিখে রাখলাম নিজেকে মনে করিয়ে দিতে যে স্রোতের সাথে বা বিপরীতে না-গিয়েও আমার দাঁড়ানোর একটা জায়গা ছিল। এবং সেটা আমার মৃত ও হত ভাইবন্ধুদের রক্তেহাড়ে মাখানো।