লন্ডনের ইকোনোমিকস এবং পলিটিকাল সায়েন্স স্কুলের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডেভিড মোটাডেল সম্প্রতি ডয়েচে ভেলে’র সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন হিটলারের এন্টি সেমিটিজম বা ইহুদি বিরোধিতা প্রচারণা কীভাবে মুসলিম নেতাদেরকে ইহুদি নিধনে সামিল করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হাজার হাজার মুসলিম যোদ্ধা নাৎসি বাহিনীর পক্ষে ইহুদি নিধন যজ্ঞে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল। ডেভিড মোটাডেল Islam and the European Empires বইটিতে আধুনিক ইউরোপ এবং ইউরোপের সাথে বাকি পৃথিবীর সম্পর্ক এবং ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন। ইতিহাস সম্পর্কিত গবেষণা এবং পঠন পাঠনে অনন্য অবদানের কারণে মোটাডেল ২০১৭ সালে সম্মানজনক Philip Leverhulme পুরষ্কার লাভ করেন। Islam and Nazi Germany’s War বইটি আগ্রহী পাঠকদেরকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে বিচরণ করতে সাহায্য করবে। ডয়েচে ভেলে’র সাথে তার সাক্ষাৎকারটি নিচে প্রকাশ করা হলো।

ডয়েচে ভেলে: আপনার “Islam and Nazi Germany’s War,” বইতে আপনি মুসলিম রাজনৈতিক নেতাদের সাথে নাৎসি-বাহিনীর সম্পর্ক এবং নীতিমালা লিখেছেন। তবে সেই নীতিমালা কেমন ছিল?

ডেভিড মোটাডেল: ১৯৪১-১৯৪২ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চূড়ান্ত ডামাডোলের মধ্যে যখন জার্মান সৈন্যবাহিনী বলকান, উত্তর আফ্রিকা, ক্রিমিয়া এবং ককেশাস এলাকার মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে প্রবেশ করে, মধ্যপ্রাচ্য বা মধ্য এশিয়ার মুখোমুখি হয় তখন হিটলার বুঝতে পারে ইসলাম যুদ্ধের ময়দানে রাজনৈতিকভাবে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। নাৎসি জার্মানি এবং মুসলিম বিশ্বের যৌথ শত্রু ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা এবং ইহুদিদের বিরুদ্ধে কৌশলগত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে।

যুদ্ধাক্রান্ত অঞ্চলে জার্মানি বেশকিছু ধর্মীয় নীতিমালা গ্রহণ করে এবং নাৎসি শাসন ইসলামের পৃষ্ঠপোষক বলে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। ১৯৪১ সালের শুরুতে নাৎসি সেনাবাহিনী সৈন্যদের মাঝে ‘ইসলাম’ নামের একটা ছোট্ট বই বিলি করত এবং মুসলিমদের সাথে তাদের ব্যবহার কেমন হবে সে সম্পর্কে বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব রণক্ষেত্রে নাৎসি-বাহিনী মুসলিমদের খুশি করতে সোভিয়েত শাসনামলে ভেঙে ফেলা মসজিদ, মাদ্রাসা পুনরায় নির্মাণ করে। কমিউনিস্ট শাসনের সময় বর্জিত মুসলিমদের রীতিনীতি, আচার, সংস্কৃতি, ধর্মীয় উৎসব ফিরিয়ে আনা হয় যাতে সোভিয়েত ক্ষমতা খর্ব করা যায়।

জার্মান সামরিক কর্তারা ইসলামিক পণ্ডিত, চিন্তাবিদদের সাথে মিলেমিশে কাজ করতে মুসলিমদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। জার্মান প্রচারণা দল মুসলিমদের কাছে টানতে পূর্ব ইউরোপের বলকান রাজ্য এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে ইসলামের আলংকারিক ধর্মীয় শব্দ, চিহ্ন, স্থাপত্য চর্চা শুরু করে। তারা কোরানের কিছু আয়াতকে ব্যবহার করে ইহুদী বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিতে। ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টির মাধ্যমে ইহুদিদের হত্যা করার জন্য জিহাদের ধারণাকে উস্কে দেয় এবং রাজনৈতিক সংঘাত সৃষ্টি করে।

১৯৪১ সাল থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের পতনের আগ পর্যন্ত নাৎসি সামরিক বাহিনী এবং সংসদীয় কমিটি হাজার হাজার মুসলিম যুবকদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেয়। এটার পিছনে অবশ্য জার্মান সৈনিকদের রক্ষা করার উদ্দেশ্য ছিল। মুসলিমদেরকেই যুদ্ধের পুরোভাগে পাঠানো হতো সম্মুখ যুদ্ধের জন্য। জার্মানির সেনা কর্মকর্তারা এই বিপুল পরিমাণ মুসলিমদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়াকে ধর্মীয় ভর্তুকি হিসেবে দেখে, এমনকি ধর্মীয় রীতিনীতি এবং ধর্মচর্চার অংশ হিসেবে পশু জবাইয়ের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। যদিও ইহুদিদের ধর্মীয় নীতি অনুসারে পশু কোরবানি করার প্রচলন ছিল। শুধু মুসলিমদের ধর্মীয় আচার বিবেচনা করে হিটলারের ১৯৩৩ সালের প্রাণী রক্ষা আইন সংশোধন করে।

ডয়েচে ভেলে: এটাও তো সর্বজন স্বীকৃত যে মুসলিমরা নাৎসি শাসন সমর্থন করেছিল কারণ মুসলিম এবং নাৎসি-বাহিনীর যৌথ ঘৃণার প্রতিপক্ষ ইহুদি ধর্মের অনুসারী। ঠিক একই কারণে নাৎসি-বাহিনীও মুসলিমদের দলে ভেড়ায়। এই মতাদর্শ সম্পর্কে আপনি কিছু বলবেন?
ডেভিড মোটাডেল: জার্মানির তরফ থেকে বাস্তবিক এবং কৌশলগত কারণেই নাৎসি-বাহিনী মুসলিম সৈন্য নিয়োগ দেয়ার কৌশল অবলম্বন করে। আরবদের ইহুদি বিদ্বেষ উস্কে দিতে নাৎসি-বাহিনী মুসলিম তোষণ নীতি গ্রহণ করে এবং ব্যাপক প্রচারণা ইহুদি নিধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ইহুদি বিরোধী প্রচারণার কারণে মাঝেমধ্যেই ফিলিস্তিনের স্থানীয়রা অভিবাসী ইহুদিদের উপর হামলা করে যেটা আরবের রাজনীতির প্রধান আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। মুসলিমদের পক্ষে থেকে এই হামলাকে কখনো সাধারণভাবে দেখার সুযোগ নেই। নাৎসি-বাহিনীর কিছু গুরুত্বপূর্ণ-মিত্র বিশেষ করে জেরুজালেমের প্রধান মুফতি আমিন আল হুসাইনি ইহুদিদের প্রতি ঘৃণা ছড়াতে এবং ইহুদি নিধনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। বলকান অঞ্চল, উত্তর আফ্রিকা এবং পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর যুদ্ধাক্রান্ত অঞ্চলে ইহুদি বিরোধীতা এবং ঘৃণা চরমে পৌঁছে অথচ এইসব অঞ্চলে ইহুদি এবং মুসলিমরা শত শত বছর ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং সহিষ্ণুতার সাথে পাশাপাশি বসবাস করে আসছিল। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে মুসলিম সম্প্রদায় প্রতিবেশী ইহুদিদেরকে জার্মান নাৎসি-বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা করতে নিজেরা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে লুকিয়ে রেখেছে, তথ্য গোপন করেছে।

জেরুজালেমের প্রধান মুফতি আমিন আল হুসাইনি ১৯৪১ সালে এডলফ হিটলারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। মোটাডেলের বিশ্লেষণ মতে, হিটলারের মুসলিম সহযোগী সম্প্রদায় ইহুদিদের প্রতি নাৎসি-বাহিনীর ঘৃণা ছড়িয়ে দিতে প্রভূত ভূমিকা রাখে।

ডয়েচে ভেলে: নাৎসি-বাহিনী মুসলিমদেরকে যুদ্ধে সংযুক্ত করে কী কী লক্ষ্য পূরণ করতে চেয়েছিল?
ডেভিড মোটাডেল: থার্ড রাইখ ইসলামের সাথে সন্ধি করেছিল শুধু এই কারণেই নয় যে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল জার্মানির রণাঙ্গনে পরিণত হয় বরং ১৯৪১ থেকে ১৯৪২ সালে জার্মানির সামরিক শক্তি সামর্থ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নে এসে জার্মানির অতর্কিত বিমান, কামান, ট্যাংক, পদাতিকের সমন্বিত (Blitzkrieg) আক্রমণ পদ্ধতি মুখ থুবড়ে পড়ে। সেনাবাহিনী চাপের মধ্যে পড়ে গেলে বার্লিন যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করতে স্থানীয় যুদ্ধ বান্ধব খুঁজতে থাকে এবং তখনই তারা ইসলামকে বাস্তবে প্রয়োগ করে। মুসলিমদের সন্ধি করার ফলে জার্মান অধিকৃত অঞ্চলের মুসলিম জনগণকে শান্ত করা সম্ভব হয় এবং মুসলিমদের বিরাট অংশ হিটলারের নাৎসি বাহিনীতে যোগ দেয়।
অনেক মুসলিম যুবক নাৎসি বাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেয়ার পিছনে যথেষ্ট যৌক্তিক কারণ ছিল। ১৯৪১ থেকে ১৯৪২ সালে জার্মানির আগ্রাসী রূপ দেখে তাদের মনে হয়েছিল জার্মানির বিজয় অবধারিত এবং ভবিষ্যৎ পৃথিবী পরিচালিত হবে জার্মান শাসনে, ফলে তারা ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন শোষণ থেকে মুক্তি পাবে।

ইতিহাসবিদ ডেভিড মোটাডেল ইসলাম ধর্মের সাথে ইউরোপ এবং জার্মানির সম্পর্ক নিয়ে দুইটা বই এবং বেশকিছু প্রবন্ধ লিখেছেন।

নাৎসি বাহিনীতে নিয়োগ প্রাপ্ত এইসব মুসলিম সৈনিকদের উদ্দেশ্যের ভিন্নতা ছিল, কিন্তু অতি অবশ্যই তাদের মাঝে ধর্মীয় ঐক্যতার মেলবন্ধন ছিল। তাদের কেউ কেউ নাৎসি-বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল ধর্মীয় ঘৃণা থেকে উৎসারিত বিষবাষ্পে ইহুদি হত্যা করার উগ্র বাসনা নিয়ে, কেউ যোগ দিয়ে বলশেভিক বিরোধিতা থেকে, কেউ আদর্শগত কারণে। যাইহোক সর্বোপরি মুসলিম তরুণ সমাজ ধর্মীয় কারণের বাইরে বরং তারা উন্নত জীবনের আশায় নাৎসি-বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল।

ডয়েচে ভেলে: নাৎসি কি সত্যিই ইসলামের মাঝে ইতিবাচক কিছু দেখেছিল নাকি মুসলিমদেরকে শুধু ইহুদি নিধনের প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যবহার করেছিল?
ডেভিড মোটাডেল: সার্বিক বিবেচনায় আমার কাছে মনে হয় মুসলিমদেরকে শুধুই ইহুদি নিধনে ব্যবহার করা হয়েছে। ইসলামের আদ্যোপান্ত জেনেই নাৎসি-বাহিনী তাদের নীতি নির্ধারণ করেছিল। এডলফ হিটলার, হাইনরিখ হিমলারের মত উচ্চ পর্যায়ের নাৎসি নেতারা বারংবার ইসলামের প্রতি তাদের সম্মান প্রকাশ করেছিল। যখনই হিটলার ক্যাথলিক চার্চের সমালোচনা করত তখনই নিয়মিত ইসলামের তুলনামূলক প্রশংসা করত। হিটলার খ্রিষ্টান ক্যাথলিকদেরকে দুর্বল, অ-পুরুষালি আখ্যা দিয়ে নিন্দায় মুখর ছিল, পক্ষান্তরে ইসলামকে প্রশংসা করত শক্তিশালী, আগ্রাসী এবং সামরিক ধর্ম হিসেবে। যাইহোক, ইসলামের তোষণ ছিল হিটলারের রাজনীতির কূটকৌশল, আদর্শের দিক থেকে হিটলার ইসলামকে পছন্দ করেনি কখনো, ইসলামের পরাশক্তিকে নিজেদের পক্ষে যুদ্ধে কাজে লাগানোর জন্যই নাৎসি জার্মানি এই প্রচারণায় অংশ নেয়।

ডয়েচে ভেলে: নাৎসি বর্ণবাদ কি মুসলিমদের সাথে একাত্ম হওয়ার পথে প্রধান অন্তরায় নয়?
ডেভিড মোটাডেল: হিটলার ইতিমধ্যেই তার বিখ্যাত আত্মজীবনী “Mein Kampf” বইতে অ-ইউরোপীয়দেরকে জাতিগতভাবে নিকৃষ্টতার কাতারে ফেলে রেখেছেন। নাৎসি পার্টি ক্ষমতায় এসেই এতদিনের তাত্ত্বিক ইহুদি বিরোধিতা বাস্তবে প্রয়োগ শুরু করে। ১৯৩০ সাল থেকেই ইহুদি নয় এমন তুর্কি, ইরানীয়, আরবীয়দেরকে প্রকাশ্যেই জাতিগত বৈষম্যের হাত থেকে নিষ্কৃতি দেয়া হয়। কূটনৈতিক তৎপরতায় আংকারা, তেহরান এবং কায়রোর সরকারী সহযোগীতার মাধ্যমে ইহুদিদেরকে আলাদা করে ফেলা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঠিক একই কায়দায় জার্মান নাৎসি পার্টি ইহুদিদেরকে আলাদা করতে এতদিনের ঘৃণা কাজে লাগায়। প্রতিটি জার্মান অফিসারের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যায় যেকোনো স্থানের মুসলিম নাৎসি পার্টির কৌশলগত বন্ধু ও ইহুদি বিরোধী সহযোগী।

ইহুদি বিরোধী অবস্থানে জার্মান নাৎসি পার্টি এবং মুসলিমদের অবস্থান সুস্পষ্ট। নাৎসি পার্টির রাশিয়া আক্রমণের প্রথম মাসে জার্মান বাহিনীর এলিট ফোর্স (Schutzstaffel) সংক্ষেপে এস এস ইহুদি সন্দেহে কয়েক হাজার মুসলিম হত্যা করে, কারণ তাদের খৎনা করা ছিল। অনিচ্ছাকৃত ভুলের পর নাৎসি পার্টির প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা রাইনহার্ড হাইড্রিখ এস এস বাহিনীকে কড়া নির্দেশ দেয় কেউকে হত্যার আগে আরও সতর্ক এবং নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে যে লোকটা আসলেই ইহুদি কী না। সোভিয়েত ইউনিয়নের দক্ষিণাঞ্চলের রণাঙ্গনে জার্মান সৈন্যদেরকে মুসলিমদের থেকে ইহুদি আলাদা করতে বেশ বেগ পেতে হয়। এমনকি উত্তর আফ্রিকা, বলকান অঞ্চল এবং পূর্বপ্রান্তের রণাঙ্গনে জার্মান সৈন্যরা বিভিন্নরকমের মুসলিম যোদ্ধার সম্মুখীন হয় যাদের মধ্যে মুসলিম রোমা এবং ইহুদি থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত জনগোষ্ঠী।

[ লন্ডনের অর্থনীতি এবং রাষ্ট্র বিজ্ঞান স্কুলের আন্তর্জাতিক ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অদ্যাপক ডঃ ডেভিড মোটাডেল। তিনি আধুনিক ইউরোপ এবং ইউরোপের সাথে বাকি পৃথিবীর সম্পর্ক এবং ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছেন। সালে ইতিহাস সম্পর্কিত গবেষণা এবং পঠন পাঠনে অনন্য অবদানের কারণে মোটাডেল ২০১৭ সালে সম্মানজনক Philip Leverhulme পুরষ্কার লাভ করেন। ]

মূল সাক্ষাৎকার: How Nazis courted the Islamic world during WWII